নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী'র ১০ টি কবিতা



 উলঙ্গ রাজা

সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও 

সবাই হাততালি দিচ্ছে। 

সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ! 

কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়; 

কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে; 

কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ 

কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক; 

কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম , চোখে 

পড়ছে না যদিও, তবু আছে, 

অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।  


গল্পটা সবাই জানে। 

কিন্তু সেই গল্পের ভিতরে 

শুধুই প্রশস্তিবাক্য-উচ্চারক কিছু 

আপাদমস্তক ভিতু, ফন্দিবাজ অথবা নির্বোধ 

স্তাবক ছিল না। 

একটি শিশুও ছিল। 

সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু।  


নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়। 

আবার হাততালি উঠছে মুহুর্মুহু; 

জমে উঠছে 

স্তাবকবৃন্দের ভিড়। 

কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি 

ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না।  


শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো 

পাহাড়ের গোপন গুহায় 

লুকিয়ে রেখেছে? 

নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে 

ঘুমিয়ে পড়েছে 

কোনো দূর 

নির্জন নদীর ধারে, কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের ছায়ায়? 

যাও, তাকে যেমন করেই হোক 

খুঁজে আনো। 

সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে 

নির্ভয়ে দাঁড়াক। 

সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে 

জিজ্ঞাসা করুক: 

রাজা, তোর কাপড় কোথায়? 



আবহমান 

যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া, 

লাউমাচাটার পাশে। 

ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল 

সন্ধ্যার বাতাসে।  


কে এইখানে এসেছিল অনেক বছর আগে, 

কেউ এইখানে ঘর বেঁধেছে নিবিড় অনুরাগে। 

কে এইখানে হারিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে, 

এই মাটিকে এই হাওয়াকে আবার ভালবাসে। 

ফুরয় না্‌ তার কিছুই ফুরয় না, 

নটেগাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়য় না!  


যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া, 

লাউমাচাটার পাশে। 

ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল, 

সন্ধ্যার বাতাসে।  


ফুরয় না তার যাওয়া এবং ফুরয় না তার আসা, 

ফুরয় না সেই একগুঁয়েটার দুরন্ত পিপাসা। 

সারাটা দিন আপনে মনে ঘাসের গন্ধ মাখে, 

সারাটা রাত তারায়-তারায় স্বপ্ন এঁকে রাখে। 

ফুরয় না, তার কিছুই ফুরয় না, 

নাটেগাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়য় না।  


যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া, 

লাউমাচাটার পাশে। 

ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল, 

সন্ধ্যার বাতাসে।  


নেভে না তার যন্ত্রণা যে, দুঃখ হয় না বাসী, 

হারায় না তার বাগান থেকে কুন্দফুলের হাসি 

তেমনি করেই সূর্য ওঠে, তেমনি করেই ছায়া 

নামলে আবার ছুটে আসে সান্ধ্য নদীর হাওয়া 

ফুরয় না, তার কিছুই ফুরয় না, 

নাটেগাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়য় না।  


যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া, 

লাউমাচাটার পাশে। 

ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল, 

সন্ধ্যার বাতাসে। 





আংটিটা

আংটিটা ফিরিয়ে দিও ভানুমতী, সমস্ত সকাল 

দুপুর বিকেল তুমি হাতে পেয়েছিলে। 

যদি মনে হয়ে থাকে, আকাশের বৃষ্টিধোয়া নীলে 

দুঃখের শুশ্রূষা নেই, যদি 

উন্মত্ত হাওয়ার মাঠে কিংশুকের লাল 

পাপড়িও না পেরে থাকে রুগ্‌ণ বুকে সাহস জাগাতে, 

অথবা সান্ত্বনা দিতে বৈকালের নদী,– 

আংটিটা ফিরিয়ে দিও সন্ধ্যার সহিষ্ণু শান্ত হাতে।  


আংটিটা ফিরিয়ে দিও, এ-আংটি যেহেতু তারই হাতে 

মানায়, যে পায় খুঁজে পত্রালির ভিড়ে 

ফুলের সুন্দর মুঘ, ঘনকৃষ্ণ মেঘের শরীরে 

রৌদ্রের আলপনা। কোনো ক্ষতি 

ফেরাতে পারে না তাকে তীব্রতম দুঃখের আঘাতে।  


আংটিটা ফিরিয়ে দিও, তাতে দুঃখ নেই, ভানুমতী। 




আকাঙ্ক্ষা তাকে

আকাঙ্ক্ষা তাকে শান্তি দেয়নি, 

শান্তির আশা দিয়ে বার বার 

লুব্ধ করেছে। লোভ তাকে দূর 

দুঃস্থ পাপের পথে টেনে নিয়ে 

তবুও সুখের ক্ষুধা মেটায়নি 

দিনে দিনে আরও নতুন ক্ষুধার 

সৃষ্টি করেছে; সুখলোভাতুর 

আশায় দিয়েছে আগুন জ্বালিয়ে।  


এই যে আকাশ, আকাশের নীল, 

এই যে সুস্থসবল হাওয়ার 

আসা-যাওয়া, রূপরঙের মিছিল, 

কোনোখানে নেই সান্ত্বনা তার।  


বন্ধুরা তাকে যেটুকু দিয়েছে, 

শত্রুরা তার সব কেড়ে নিয়ে 

কোনো দূরদেশে ছেড়ে দিয়েছিল 

কোনো দুর্গম পথে। তারপর 

যখন সে প্রায় ফুরিয়ে গিয়েছে, 

শোকের আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে 

প্রেম তাকে দিল সান্ত্বনা, দিল 

স্বয়ংশান্তি তৃপ্তির ঘর। 




আশ্বিন দিবসে

আশ্বিন বলতেই চোখে ভেসে ওঠে রোদ্দুরের ছবি, 

চক্রাকারে চিল 

মাথার উপর দিয়ে ডানা মেলে 

উড়ে যায় 

মেঘের জানলার দিকে। আশ্বিন বলতেই 

আলোর-তরঙ্গে-ধোয়া দৃশ্যাবলি চোখের সমুখে 

দেখতে পাই। 

দেখি নদী, দেখি নৌকা, গেরুয়া বাদাম 

স্রোতের দুরন্ত টানে ঘুরে যায়।  


এমন আশ্বিন ছিল একদা, এখন 

বাহির-পৃথিবী থেকে তাড়া খেয়ে ভিতরে ঢুকেছে। 

বাহিরে আঁধার। 

লোভী, জেদি, কবন্ধ রজনী তার 

সীমানা বাড়িয়ে চলে আশ্বিন-দিনেও। 

আমি নিরুপায় তার মধ্যে বসে থাকি, আমি ঠিকই 

টের পাই 

বুকের ভিতর দৃশ্যাবলি পুড়ে যায়। 






আগুনের দিকে

রাস্তাগুলি ক্রমে আরও তপ্ত হয়। 

স্বজন, সঙ্গীর সংখ্যা 

ক্রমে আরও কমে আসে। 

হাতের মুদ্রায় তবু জাইয়ে রেখেছ বরাভয় 

হাওয়ার ভিতরে তবু ভাসে 

তোমার সৌরভ। 

আর তাই 

চতুর্দিকে ছত্রাকার ধড়মুণ্ড-আলাদা-করা শব 

দেখেও আমাকে 

এগিয়ে যেতেই হয়, আগুনের দিকে 

এগিয়ে যেতেই হয়। 




আমি ও তিনি

আমি বললুম, “এটা কিছু নয়।” 

তিনি বললেন, “এটাই 

মন্দাকিনীর ধারা নিশ্চয়, 

এতেই তৃষ্ণা মেটাই।”  


আমি বললুম, “মন্দাকিনী কি 

এত কাছে? এটা ছল।” 

তিনি বললেন, “না, না, এটা ঠিকই 

স্বর্গঙ্গার জল।”  


আমি বললুম, “পিছনের টানে 

ঠিক নয় বসে যাওয়া।” 

তিনি বললেন ,”বইছে এখানে 

অতি পবিত্র হাওয়া।”  


আমি বললুম, “বসুন তা হলে, 

স্নান করে হাওয়া খান,– 

পাথরে পা রেখে আমি যাই চলে।” 

তিনি বললেন, “যান।” 



আমার ভিতরে কোন দল নেই

আমার পিছনে কোনো দল নেই, আমার ভিতরে 

দলবদ্ধ হবার আকাঙ্ক্ষা নেই, আমি 

সাদা কালো লাল নীল গাং-গেরুউয়া জাফরান বাদামি 

হরের রঙের খেলা দেখে যাই। 

একলা-পথে হাঁটতে-হাঁটতে একলা আমি ঘরে 

ফিরে যাব। যেতে-যেতে ধুলোবালি জঞ্জালে ও ঘাসে 

খানিকটা প্রশংসা আমি রেখে যাই। 

দেখি শুকনো পাতা উড়ছে হিলিবিলি সন্ধ্যার বাতাসে।  


আমার পিছনে কেউ নেই এখানে। কস্মিনকালেও 

কাউকে আমি ডাক দিয়ে বলিনি, 

চলো যাই, রোদ্দুরে গলিয়ে নেব গিনি, 

হাত বাড়িয়ে টেনে আনব অহঙ্কারী বটগাছের মাথা। 

আমি বলি, দশজনে পঁচিশটা পথে যেয়ো, 

প্রত্যেকে আড়াইটে করে পেয়ে যাবে শুকনো শালপাতা।  


তার মানে কি এই যে, আমি রাখিনি বিশ্বাস 

সঙ্ঘবদ্ধ কাজে? 

দেখিনি কীভাবে কলে-কারখানায় বাঁধে ও ব্যারাজে 

কিংবা পূর্তবিভাগীয় নির্মিতিমালায় 

সভ্যতা নিষ্পন্ন হয়? বালিহাঁস 

সরে গিয়ে জায়গা দেয় পৌরহিতসাধিনী সভাকে; 

জলা ও জঙ্গল হটে যায়। 

চৌষট্টি ফ্লাটের হর্ম্য মেঘের বালিশে মাথা রাখে।  


সমস্ত দেখেছি আমি, বুঝেছি যে, মানুষের মিলিত উদ্যম 

ব্যতিরেকে 

এমন সহস্রফণা 

উপরন্তু একই সঙ্গে এমন বিষাক্ত-মনোরম 

উল্লাসের আবির্ভাব সম্ভব হত না।  


কিন্তু এই সম্ভবপরতা তাকে কী দেয়, কতটা 

দেয়, যে সভ্যতা অর্থে অন্য-কিছু বোঝে? 

সভ্যতার ভিতরে যে খোঁজে 

অন্য চরিতার্থতা, সে অন্য পথে যায়। 

দলবদ্ধতার ঘটাপটা 

দুই পায়ে মাড়িয়ে তাকে একবার নিজের মধ্যে উঁকি 

দিয়ে কথা বলতে হয় নিজস্ব ভাষায়, 

একবার দাঁড়াতে হয় নিজস্ব ইচ্ছার মুখোমুখি।  


আমার ভিতরে কোনো দল নেই, দলবদ্ধতার 

আনন্দ অথবা গ্লানি, কোনোটাই নেই। 

আকাশে অজস্রবর্ণ খেলাধুলো সমাপ্ত হলেই 

ফিরতি-পথে জঞ্জালে ও ঘাসে 

খানিকটা প্রশংসা রেখে আমি দেখি, এন্তার…এন্তার 

হিলিবিলি পাতা উড়ছে সন্ধ্যার বাতাসে। 



ঈশ্বর! ঈশ্বর!

ঈশ্বরের সঙ্গে আমি বিবাদ করিনি। 

তবুও ঈশ্বর 

হঠাৎ আমাকে ছেড়ে কোথায় গেলেন? 

অন্ধকার ঘর। 

আমি সেই ঘরের জানলায় 

মুখ রেখে 

দেখতে পাই, সমস্তা আকাশে লাল আভা, 

নিঃসঙ্গ পথিক দূর দিগন্তের দিকে চলেছেন। 

অস্ফুট গলায় বলে উঠি: 

ঈশ্বর! ঈশ্বর! 




উপাসনার সায়াহ্নে

ভীষণ প্রাসাদ জ্বলে, যেন চিরকাল জ্বলে সায়াহ্নবেলায়। 

অলিন্দ, ঝরোকা, শ্বেতমর্মরের সমস্ত নির্মাণ 

জ্বলে ওঠে। আগুনের সুন্দর খেলায় 

দাউদাউ জ্বলে হর্ম্য, প্রমোদ-নিকুঞ্জ। কিংবা সাধের তরণী 

অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেন অন্যপথে ধীরে আগুয়ান 

হতে গিয়ে অগ্নিবয়লয়ের দিকে ঘুরে যায়। 

মুহূর্তে মাস্তুলে, পালে, পাটাতনে প্রচণ্ড হলুদ 

জ্বলে ওঠে। 

সাধের তরণী জ্বলে, যেন চিরকাল জ্বলে সায়াহ্নবেলায়।  


জানি না কখনও কেউ এমন জ্বলেছে কি না সায়াহ্নবেলায়। 

যেমন প্রাসাদ জ্বলে, অলিন্দ, ঝরোকা কিংবা শ্বেতমর্মরের 

বিবিধ নির্মাণ। যথা সহসা দাউদাউ 

প্রমোদ-নিকুঞ্জ, ঝাউ-বীথিকা, হ্রদের জল, জলের উপরে 

সাধের তরণীখানি জ্বলে ওঠে। 

যেমন কুটির কিংবা অট্টালিকা কিছুকাল চিত্রের মতন স্থির থেকে তারপর 

অগ্নিবলয়ের দিকে চলে যায়। 

যেমন পর্বত পশু সহসা সুন্দর হয় বাহিরে ও ঘরে। 

যেমন সমস্ত-কিছু জ্বলে, চিরকাল জ্বলে সায়াহ্নবেলায়। 




















একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন