আবুল হাসানের সেরা ৭ কবিতা সংগ্রহ



 বনভূমিকে বলো

বনভূমিকে বলো, বনভূমি, অইখানে একটি মানুষ  

 লম্বালম্বি শুয়ে আছে, অসুস্থ মানুষ  

 হেমন্তে হলুদ পাতা যেরকম ঝরে যায়,  

 ও এখন সে রকম ঝরে যাবে, ওর চুল, ওর চোখ  

 ওর নখ, অমল আঙুল সব ঝরে যাবে,  

 বনভূমিকে বলো, বনভূমি অইখানে একটি মানুষ  

 লম্বালম্বি শুয়ে আছে, অসুস্থ মানুষ  

 ও এখন নদীর জলের স্রোতে ভেসে যেতে চায়  

 ও এখন মাটি হতে চায়, শুধু মাটি  

 চকের গুঁড়োর মতো ঘরে ফিরে যেতে চায়,  

 বনভূমিকে বলো, বনভূমি ওকে আর শুইয়ে রেখো না!  

 ওকে ঘরে ফিরে যেতে দাও। যে যাবার  

 সে চলে যাক, তাকে আর বসিয়ে রেখো না।

  


বনভূমির ছায়া

কথা ছিল তিনদিন বাদেই আমরা পিকনিকে যাবো,  

 বনভূমির ভিতরে আরো গভীর নির্জন বনে আগুন ধরাবো,  

 আমাদের সব শীত ঢেকে দেবে সূর্যাস্তেরবড় শাল গজারী পাতায়।  

 আমাদের দলের ভিতরে যে দুইজন কবি  

 তারা ফিরে এসে অরণ্য স্তুতি লিখবে পত্রিকায়  

 কথা ছিল গল্পলেখক অরণ্য যুবতী নিয়ে গল্প লিখবে নতুন আঙ্গিকে!  

 আর যিনি সিনেমা বানাবেন, কথা ছিল  

 তার প্রথম থীমটি হবে আমাদের পিকনিকপ্রসূত।  

 তাই সবাই আগে থেকেই ঠিকঠাক, সবাই প্রস্তুত,  

 যাবার দিনে কারো ঘাড়ে ঝুললো ফ্লাস্কের বোতল  

 ডেটল ও শাদা তুলো, কারো ঘাড়ে টারপুলিনের টেণ্ট, খাদ্যদ্রব্য,  

 একজনের শখ জাগলো পাখির সঙ্গীত তিনি টেপরেকর্ডারে তুলে আনবেন  

 বনে বনে ঘুরে ঠিক সন্ধ্যেবেলাটিতে  

 তিনি তুলবেন পাতার মর্মর জোড়া পাখির সঙ্গীত!  

 তাই টেপরেকর্ডার নিলেন তিনি।  

 একজন মহিলাও চললেন আমাদের সঙ্গে  

 তিনি নিলেন তাঁর সাথে টাটকা চিবুক, তার চোখের সুষমা আর  

 উষ্ণ শরীর!  

 আমাদের বাস চলতে লাগলো ক্রমাগত  

 হঠাৎ এক জায়গায় এসে কী ভেবে যেনো  

 আমি ড্রাইভারকে বোললুম : রোক্কো-  

 শহরের কাছের শহর  

 নতুন নির্মিত একটি সাঁকোর সামনে দেখলুম তীরতীর কোরছে জল,  

 আমাদের সবার মুখ সেখানে প্রতিফলিত হলো;  

 হঠাৎ জলের নীচে পরস্পর আমরা দেখলুম  

 আমাদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের অপরিসীম ঘৃণা ও বিদ্বেষ!  

 আমরা হঠাৎ কী রকম অসহায় আর একা হয়ে গেলাম!  

 আমাদের আর পিকনিকে যাওয়া হলো না,  

 লোকালয়ের কয়েকটি মানুষ আমরা  

 কেউই আর আমাদের এই ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা একাকীত্ব, অসহায়বোধ  

 আর মৃত্যুবোধ নিয়ে বনভূমির কাছে যেতে সাহস পেলাম না!

  


মাতৃভাষা 

আমি জানিনা দুঃখের কী মাতৃভাষা  

 ভালোবাসার কী মাতৃভাষা  

 বেদনার কী মাতৃভাষা  

 যুদ্ধের কী মাতৃভাষা।  

 আমি জানিনা নদীর কী মাতৃভাষা  

 নগ্নতার কী মাতৃভাষা  

 একটা নিবিড় বৃক্ষ কোন ভাষায় কথা বলেএখনো জানিনা।  

 শুধু আমি কোথাও ঘরের দরোজায় দাঁড়ালেই আজো  

 সভ্যতার শেষ মানুষের পদশব্দ শুনি আর  

 কোথাও করুণ জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে,  

 আর সেই জলপতনের শব্দে সিক্ত হতে থাকে  

 সর্বাঙ্গে সবুজ হতে থাকে আমার শরীর।  

 সর্বাঙ্গে সবুজ আমি কোথাও ঘরের দরোজায় দাঁড়ালেই আজো  

 পোষা পাখিদের কিচিরমিচির শুনি  

 শিশুদের কলরব শুনি  

 সুবর্ণ কঙ্কন পরা কামনার হাস্যধ্বনি শুনি!  

 ঐযে নষ্ট গলি, নিশ্চুপ দরোজা  

 ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা, গণিকারা-  

 মধ্যরাতে উলঙ্গ শয্যায় ওরা কীসের ভাষায় কথা বলে?  

 ঐযে কমলা রং কিশোরীরা যাচ্ছে ইশকুলে  

 আজো ঐ কিশোরীর প্রথম কম্পনে দুটি হাত রাখলে  

 রক্তে স্রোত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে, শব্দ হয়, শুনি  

 কিন্তু আমি রক্তের কী মাতৃভাষা এখনও জানিনা!  

 বেদনার কী মাতৃভাষা এখনো জানিনা!  

 শুধু আমি জানি আমি একটি মানুষ,  

 আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা!



সে এক পাথর আছে

সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,  

 মায়াবী করুণ  

 এটা সেই পাথরের নাম নাকি? এটা তাই?  

 এটা কি পাথর নাকি কোনো নদী? উপগ্রহ? কোনো রাজা?  

 পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্না ভেজা চোখ?  

 মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারা? তীব্র তীক্ষ্ণ তমোহর  

 কী অর্থ বহন করে এই সব মিলিত অক্ষর?  

 আমি বহুদিন একা একা প্রশ্ন করে দেখেছিনিজেকে,  

 যারা খুব হৃদয়ের কাছাকাছি থাকে, যারাএঘরে ওঘরে যায়  

 সময়ের সাহসী সন্তান যারা সভ্যতার সুন্দর প্রহরী  

 তারা কেউ কেউ বলেছে আমাকে-  

 এটা তোর জন্মদাতা জনকের জীবনের রুগ্নরূপান্তর,  

 একটি নামের মধ্যে নিজেরি বিস্তার ধরেরাখা,  

 তুই যার অনিচ্ছুক দাস!  

 হয়তো যুদ্ধের নাম, জ্যোৎস্নায় দুরন্ত চাঁদে ছুঁয়ে যাওয়া,  

 নীল দীর্ঘশ্বাস কোনো মানুষের!  

 সত্যিই কি মানুষের?  

 তবে কি সে মানুষের সাথে সম্পর্কিত ছিল, কোনোদিন  

 ভালোবেসেছিল সেও যুবতীর বামহাতে পাঁচটি আঙ্গুল?  

 ভালোবেসেছিল ফুল, মোমবাতি, শিরস্ত্রাণ, আলোর ইশকুল?

  


সেই মুখ

সেই সুখ মাছের ভিতরে ছিল,  

 সেই সুখ মাংসের ভিতরে ছিল,  

 রাতের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যেতো ছেলেবেলা  

 সেই সুখ চাঁদের ভিতরে ছিল,  

 সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল!  

 নারী কোন রমণীকে বলে?  

 যার চোখ মুখ স্তন ফুটেছে সেই রমণী কি নারী?  

 সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল,  

 যখন আমরা খুব গলাগলি শুয়ে  

 অনু অপলাদের স্তন শরীর মুখ উরু থেকে  

 অকস্মাৎ ঝিনুকের মতো যোনি,  

 অর্থাৎ নারীকে আমরা যখোন খুঁজেছি  

 হরিণের মতো হুররে দাঁত দিয়ে ছিঁড়েছি তাদের নখ, অন্ধকারে  

 সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল।  

 যখন আমরা শীতে গলাবন্ধে পশমী চাদর জড়িয়েছি  

 কিশোরীর কামরাঙা কেড়ে নিয়ে দাঁত বসিয়েছি  

 সেই সুখ পশমী চাদরে ছিল, কামরাঙা কিশোরীতে ছিল!  

 রঙীন বুদ্বুদ মাছ, তাজা মাংস, সুপেয় মশলার ঘ্রাণ;  

 চিংড়ি মাছের ঝোল যখোন খেতাম শীতল পাটিতে বসে  

 সেই সুখ শীতল পাটিতে ছিল।  

 প্রথম যে কার ঠোঁটে চুমু খাই মনে নেই  

 প্রথম কোনদিন আমি স্নান করি মনে নেই  

 কবে কাঁচা আম নুন লঙ্কা দিয়ে খেতে খেতে  

 দাঁত টক হয়েছিল মনে নেই  

 মনে নেই কবে যৌবনের প্রথম মিথুন আমি ঘটিয়েছিলাম  

 মনে নেই…  

 যা কিছু আমার মনে নেই তাই হলো সুখ!  

 আহ! সে সুখ…

  



স্মৃতিকথা 

(হেলাল, কাঞ্চন, ওয়ালী, বাচ্চু ও রাব্বীকে)  

 যে বন্ধুরা কৈশোরে নারকেল বনের পাশে বসে  

 আত্মহত্যার মতো বিষণ্ন উপায়ে উষ্ণ মেয়েদের গল্প কোরতো  

 শীতকালে চাঁদের মতোন গোল বোতামের কোটপড়ে  

 ঘুরতো পাড়ায়,  

 যে বন্ধুরা থিয়েটারে পার্ট কোরতো,  

 কেউ সাজতো মীরজাফর, কেউবা সিরাজ  

 তারা আজ, এখন কোথায়?  

 রোমেনা যে পড়াতো ইশকুলে ছোট মনিদের বিদ্যালয়ে  

 রোমেনা যে বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস পড়ে তার  

 নায়িকার মতো জ্বরে ভুগতো,  

 আর মিহি শরীরের সাথে মিল রেখে  

 কপালে পরতো টিপ,  

 শাদা কোমরের কাছে দীর্ঘচুল ঝুলিয়ে রাখতো  

 ব্লু কালারের ব্যাগ,  

 দু’বৎসর আগে শুনেছি বিবাহ হ’য়ে গেছে তার,  

 এখন কোথায়?  

 রুনী তার মাতাল স্বামীর কাছে না গিয়েনিজেই একরাতে  

 একে একে শূন্যতায় সলজ্জ কাপড়গুলি খুলে ফেলে কুয়াশায়  

 উন্মাদিনী কোথায় পালালো!  

 নিজস্ব ভ্রুণের হত্যা গেঁথে দিয়েছিলতাকে মানসিক হাসপাতালের এক কোণে!  

 কোথায় সে? এখন কোথায় ?  

 অনেকেই চলে গেছে, অনেক নারকেল গাছ হয়ে গেছে বুড়ো  

 অনেক প্রাঙ্গণ থেকে উঠে গেছে  

 গোলাপ চারার মতো সুন্দর বয়সমাখা প্রসিদ্ধা তরুণী,  

 মধ্যরাতে নারকেল বনের কাছে ভেঙে যায় আমারও গল্পগুলি  

 স্মৃতিকথা সেখানে নিশ্চুপ!

  



স্রোতে রাজহাঁস আসছে 

পুনর্বার স্রোতে ভাসছে হাঁস, ভাসতে দাও  

 কোমল জলের ঘ্রাণ মাখুক হাঁসেরা;  

 বহুদিন পর ওরা জলে নামছে, বহুদিন পর ওরা কাটছে সাঁতার  

 স্রোতে রাজহাঁস আসছে, আসতে দাও,  

 বহুদিন পর যেনো রোদ আসছে, আসতে দাও  

 নত হতে দাও আকাশকে,  

 আর একটু নত হোক আলো  

 আর একটু নির্জন হোক অন্ধকার!  

 আর তুমি পরে নাও তোমার গহনা, দুল  

 তোমার আঙ্গুল হোক হেমন্তের ফুল,  

 আমি শুঁকি, শুঁকতে দাও!  

 বহুদিন পর যেনো শুঁকছি বকুল!  

 বহুদিন তোমার ভিতরে যাইনা, বহুদিন বকুল ফুলের ঘ্রাণ  

 পাইনা এ মনে!  

 মনে করতে দাও তবু কোনখানে বকুলবাগান ছিল  

 গেরস্থের হাজার দুয়ারী ঘরবাড়ি  

 উঁচু আসন, সিংহাসন  

 মনে করো, মনে কোরে নাও  

 আমাদেরও সিংহাসন আছে আজও  

 আমাদের হাজার দুয়ারী বাড়ি আছে  

 মাটির ময়ূর, ঠোঁটে ঠোঁট, ফুলে ফুল  

 লুকোনো ডাকবাকস আছে সবুজের কাছে  

 মনে করো আমাদেরও ভালোবাসা আছে  

 খাগের কলমে লেখা তাদের অক্ষরগুলি  

 ধানের শীষের মতো টলমলায় সেখানে শরীরে  

 তুমি মনে করো, মনে করে নাও  

 তোমার শরীরে শাড়ি,  

 গেরস্থের হাজার দুয়ারী ঘরবাড়ি  

 আলো আর অন্ধকার মনে করো, মনে করে নাও  

 আমরা নৌকার জলে ভাসতে ভাসতে যেনো প্রতীকের হাঁস  

 ঐ রাজহাঁস  

 জল থেকে আরো জলে,  

 ঢেউ থেকে আরো ঢেউয়ে ছড়াতে ছড়াতে  

 পৌঁছে যাবো আগে।

  




  



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন