আসাদ চৌধুরীর কবিতা সংগ্রহ

 


প্রথম কবি তুমি, প্রথম বিদ্রোহ 

মাত্র পা রেখেছ কলেজে সেই বার,  

 শব্দ দিয়ে গাঁথো পূর্ব সীমান্তে  

 সাহসী ‘সীমান্ত’।  

 দ্বিজাতিতত্ত্বের লোমশ কালো থাবা  

 শ্যামল সুন্দর সোনার বাংলাকে  

 করেছে তছনছ, গ্রাম ও জনপদে  

 ভীতির সংসার, কেবল হাহাকার।  

  

 টেবিলে মোমবাতি কোমল কাঁপা আলো  

 বাহিরে বৃষ্টির সুরেলা রিমঝিম_  

 স্মৃতির জানালায় তোমার মৃদু টোকা।  

 রূপার সংসারে অতিথি সজ্জন  

 শিল্পী কতজন হিসেব রাখিনি তো!  

 স্মরণে ওস্তাদ_ গানের মমতাজ।  

 দারুণ উচ্ছ্বাস, সামনে চা’র কাপ  

 প্রধান অতিথি তো আপনি, বলবেন_  

 কিন্তু তার আগে এ ঘোর বরষায়  

 সমানে বলছেন নিজের সব কথা।  

 ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটে  

 ভাষণ, প্রতিবাদ_ যাত্রা, থিয়েটার  

 রমেশ শীল আর আবুল ফজলের,  

 কলিম শরাফীর সাহসী আচরণ  

 কী হলো? কী হয়েছে? আজ তো আপনার  

 মুখে যে খৈ ফোটে! স্বপ্ন-স্মৃতি দোলে।  

  

 দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর খুঁড়ছো  

 সঙ্গী বেড়ে চলে, সঙ্গে সঙ্গীত  

 নাটক, সাহিত্য, সাম্প্রদায়িকতা  

 ঘেঁষতে পারছে না, আপনি লিখবেন  

 অমর কবিতাটি জ্বরের ঘোরে, একা  

 প্রেসের ছোট ঘরে_ আঙুল কাঁপছিল?  

 কর্ণফুলী সেও জোয়ারে ফুঁসছিল_  

 নদীরা চঞ্চল সাগরে মিশবে যে।  

  

 ঢাকা ও কলকাতা, সুচক্রদণ্ডী  

 কুনতি, কুমিল্লা কোথায় নেই কবি?  

 সেই তো শুভ শুরু, শহীদ মিনারের  

 আকুল হাতছানি, মিশেছে সাভারে  

 অটল স্থাপনায়।  

 এই কি শেষ তবে?  

 প্রতিটি অর্জন ধুলায় মিশে যায়,  

 নতুন উৎপাত মৌলবাদ আর  

 জঙ্গীবাদ আসে, পশ্চিমের থেকে,  

 মানবাধিকারের লালিত বাণী যেনই  

 স্বেচ্ছাচারিতার প্রতাপ চৌদিকে_  

 দৃপ্ত পায়ে কবি কাতারে মিছিলের  

 কারফু কার ফুঁতে ওমন ক’রে ভাগে?  

  

 কবি কি দেখছেন প্রমিত বাংলার  

 করুণ হালচাল? ভাষণে, সংলাপে  

 সিনেমা, থিয়েটারে ছোট্ট পর্দার  

 যাদুর বাক্সতে এ কোন বাংলার  

 মাতম ছড়াছড়ি? হায় রে মূলধারা!  

  

 প্রথম কবি তুমি, প্রথম বিদ্রোহী  

 এমন দুর্দিনে তাই তো মনে পড়ে  

 তোমার হাসি মুখ, তোমার বরাভয়  

 ভীরুতা চারদিকে, তুমিও নেই পাশে। 





  তখন সত্যি মানুষ ছিলাম

নদীর জলে আগুন ছিল  

 আগুন ছিল বৃষ্টিতে  

 আগুন ছিল বীরাঙ্গনার  

 উদাস করা দৃষ্টিতে।  

 আগুন ছিল গানের সুরে  

 আগুন ছিল কাব্যে,  

 মরার চোখে আগুন ছিল  

 এ কথা কে ভাববে?  

 কুকুর-বেড়াল থাবা হাঁকায়  

 ফোঁসে সাপের ফণা  

 শিং কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায়  

 জ্বলে বালির কণা।  

 আগুন ছিল মুক্তিসেনার  

 স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়-  

 প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে  

 কাঁপছিল সব অন্যায়।  

 এখন এসব স্বপ্নকথা  

 দূরের শোনা গল্প,  

 তখন সত্যি মানুষ ছিলাম  

 এখন আছি অল্প। 

  


রিপোর্ট ১৯৭১

প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল  

 বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম  

 আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।  

 এ-সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে  

 বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়-  

 বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে  

 তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে  

 শুধু মুখ টিপে হাসে।  

 প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে  

 কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা-  

 সূর্য্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী।  

  

 অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার  

 সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা  

 সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে-  

 আমি তার সুরকার- তার রক্তে স্বরলিপি লিখি।  

  

 মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী  

 গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়  

 মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে-ঝিয়ে  

 খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো,  

 অস্ফুট গোলাপ-কলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে  

 কার কী বা আসে যায়।  

 বিপন্ন বিস্ময়ে কোরানের বাঁকা-বাঁকা পবিত্র হরফ  

 বোবা হ’য়ে চেয়ে দ্যাখে লম্পটের ক্ষুধা,  

 মায়ের স্নেহার্ত দেহ ঢেকে রাখে পশুদের পাপ।  

 পোষা বেড়ালের বাচ্চা চেয়ে-চেয়ে নিবিড় আদর  

 সারারাত কেঁদেছিলো তাহাদের লাশের ওপর।  

  

 এদেশে যে ঈশ্বর আছেন তিনি নাকি  

 অন্ধ আর বোবা  

 এই ব’লে তিন কোটি মহিলারা বেচারাকে গালাগালি করে।  

  

 জনাব ফ্রয়েড,  

 এমন কি খোয়াবেও প্রেমিকারা আসে না সহজ পায়ে চপল চরণে।  

 জনাব ফ্রয়েড, মহিলারা  

 কামুকের, প্রেমিকের, শৃঙ্গারের সংজ্ঞা ভুলে গ্যাছে।  

 রকেটের প্রেমে পড়ে ঝ’রে গ্যাছে  

 ভিক্টোরিয়া পার্কের গীর্জার ঘড়ি,  

 মুসল্লীর সেজদায় আনত মাথা  

 নিরপেক্ষ বুলেটের অন্তিম আজানে স্থবির হয়েছে।  

 বুদ্ধের ক্ষমার মূর্তি ভাঁড়ের মতন  

 ভ্যাবাচেকা খেয়ে প’ড়ে আছে, তাঁর  

 মাথার ওপরে  

 এক ডজন শকুন মৈত্রী মৈত্রী ক’রে  

 হয়তো বা উঠেছিলো কেঁদে। 

  


বারবার বিডলার কে

বারবারা  

 ভিয়েতনামের উপর তোমার অনুভূতির তরজমা আমি পড়েছি-  

 তোমার হৃদয়ের সুবাতাস  

 আমার গিলে-করা পাঞ্জাবিকে মিছিলে নামিয়েছিল  

 প্রাচ্যের নির্যাতিত মানুষগুলোরজন্যে অসীম দরদ ছিল সে লেখায়  

 আমি তোমার ওই একটি লেখাই পড়েছি  

 আশীর্বাদ করেছিলাম, তোমার সোনার দোয়াত কলম হোক।  

 আমার বড়ো জানতে ইচ্ছে করে বারবারা, তুমি এখন কেমন আছ ?  

 নিশ্চয়ই তুমি ডেট করতে শিখে গেছ।  

 গাউনের রঙ আর হ্যাট নিয়ে কি চায়ের টেবিলে মার সঙ্গে ঝগড়া হয়?  

 অনভ্যস্ত ব্রেসিয়ারের নিচে তোমার হৃদয়কে কি চিরদিন ঢেকে দিলে।  

 আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা।  

 তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়-  

 বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো  

 ওটা একটা জল্লাদের ছবি  

 পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠাণ্ডা মাথায় সে হ্ত্যা করেছে  

 মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সেগলা টিপে হত্যা করেছে  

 অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ  

 বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়।  

 দেশলাইয়ের বাক্সর মতো সহজে ভাঙে  

 গ্রন্থাগার, উপাসনালয়, ছাত্রাবাস,  

 মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি  

 সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ফুলকে সে বুট জুতোয়  

 থেতলে দেয়।  

 ২  

 টু উইমেন ছবিটা দেখেছ বারবারা ?  

 গির্জার ধর্ষিতা সোফিয়া লোরেনকেদেখে নিশ্চয়ই কেঁদেছিলে  

 আমি কাঁদিনি, বুকটা শুধু খাঁ খাঁ করেছিল-  

 সোফিয়া লোরেনকে পাঠিয়ে দিয়ো বাংলাদেশে  

 তিরিশ হাজার রমণীর নির্মম অভিজ্ঞতা শুনে  

 তিনি শিউরে উঠবেন।  

 অভিধান থেকে নয়  

 আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কী ?  

 জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিওলা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না স্বাধীনতার  

 আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাছে এসো-  

 সাধু অ্যাবের মর্মর মূর্তিকে গণতন্ত্র আর মানবতার জন্য  

 মালির ঘামে ভেজা ফুলের তোড়া দিয়োনা-  

 নিহত লোকটি লজ্জায় ঘৃণায় আবার আত্মহত্যা করবে।  

 বারবারা এসো,  

 রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই  

 বিবেকের জংধরা দরোজায় প্রবল করাঘাত করি  

 অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই  

 জল্লাদের শাণিত অস্ত্র  

 সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে,  

 দর্শন ও সাহিত্যকে হত্যা করার পূর্বে  

 এসো বারবারা বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে। 

  



শহীদদের প্রতি

তোমাদের যা বলার ছিল  

 বলছে কি তা বাংলাদেশ?  

 শেষ কথাটি সুখের ছিল?  

 ঘৃণার ছিল?  

 নাকি ক্রোধের,  

 প্রতিশোধের,  

 কোনটা ছিল?  

 নাকি কোনো সুখের  

 নাকি মনে তৃপ্তি ছিল  

 এই যাওয়াটাই সুখের।  

 তোমরা গেলে, বাতাস যেমন যায়  

 গভীর নদী যেমন বাঁকা  

 স্রোতটিকে লুকায়  

 যেমন পাখির ডানার ঝলক  

 গগনে মিলায়।  

 সাঁঝে যখন কোকিল ডাকে  

 কারনিসে কি ধুসর শাখে  

 বারুদেরই গন্ধস্মৃতি  

 ভুবন ফেলে ছেয়ে  

 ফুলের গন্ধ পরাজিত  

 স্লোগান আসে ধেয়ে।  

 তোমার যা বলার ছিল  

 বলছে কি তা বাংলাদেশ? 

  


সত্য ফেরারী

কোথায় পালালো সত্য?  

 দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেইতো  

 রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে,  

 গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,  

 টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে,  

 নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।  

 গুড়ের কলসি, বিষের কৌটো,  

 চিনির বয়াম, বাজারের ব্যাগ,  

 সিগারেট কেস, পানের ডিব্বা,  

 জর্দার শিশি, লক্ষ্মীর সরা,  

 নকশী পাতিল, চৌকির তলা,  

 সবি খুঁজলাম, খুঁজে দেখলাম নেই তো!  

 সাংবাদিকের কাঠের ডেস্কে,  

 কাগজে, কেতাবে, পুঁথিতে, কলমে,  

 ইনজেকশনে, দাঁদের মলমে,  

 ভ্যানিটি ব্যাগে বা পকেটে, আঁচলে  

 ড্রয়ারে, ব্যাংকে, আয়রণ সেফে  

 সত্য নামক মহান বস্তু নেই তো!  

 কবিতায় নেই, সঙ্গীতে নেই  

 রমণীর চারু ভঙ্গিতে নেই  

 পাগলের গাঢ় প্রলাপেও নেই  

 নাটকের কোন সংলাপে নেই  

 শাসনেও নেই, ভাষণে নেই  

 আঁধারেও নেই, আলোতেও নেই  

 রেখাতেও নেই, লেখাতেও নেই,  

 উত্তরে নেই, প্রশ্নেও নেই  

 লেবাসে নেই, সিলেবাসে নেই  

 পারমিটে নেই, বোনাসেও নেই  

 হতাশায় নেই, আশাতেও নেই  

 প্রেম-প্রীতি ভালবাসাতেও নেই  

 এমন কি কালোবাজারেও নেই  

 কোথায় গেলেন সত্য? 

  













একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন