বিখ্যাতদের প্রেমের কবিতা সংগ্রহ

 

আবার যখনই দেখা হবে – নির্মলেন্দু গুণ

আবার যখনই দেখা হবে, আমি প্রথম সুযোগেই

বলে দেব স্ট্রেটকাটঃ ‘ভালোবাসি’।

এরকম সত্য-ভাষণে যদি কেঁপে ওঠে,

অথবা ঠোঁটের কাছে উচ্চারিত শব্দ থেমে যায়,

আমি নখাগ্রে দেখাবো প্রেম, ভালোবাসা, বক্ষ চিরে

তোমার প্রতিমা। দেয়ালে টাঙ্গানো কোন প্রথাসিদ্ধ

দেবীচিত্র নয়, রক্তের ফ্রেমে বাঁধা হৃদয়ের কাচে

দেখবে নিজের মুখে ভালোবাসা ছায়া ফেলিয়াছে।


এরকম উন্মোচনে যদি তুমি আনুরাগে মুর্ছা যেতে চাও

মূর্ছা যাবে,জাগাবো না,নিজের শরীর দিয়ে কফিন বানাবো।


‘ভালোবাসি’ বলে দেব স্ট্রেটকাট, আবার যখনই দেখা হবে।



আমার কিছু স্বপ্ন ছিল – নির্মলেন্দু গুণ


আমার কিছু স্বপ্ন ছিল, আমার কিছু প্রাপ্য ছিল,

একখানা ঘর সবার মতো আপন করে পাবার,

একখানা ঘর বিবাহিত, স্বপ্ন ছিল রোজ সকালে

একমুঠো ভাত লঙ্কা মেখে খাবার।


সামনে বাগান, উঠোন চাইনি, চেয়েছিলাম

একজোড়া হাঁস, একজোড়া চোখ অপেক্ষমাণ

এই তো আমি চেয়েছিলাম।


স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার, আর কিছু নয়,

তোমায় শুধু অনঙ্গ বউ ডাকার।

চেয়েছিলাম একখানি মুখ আলিঙ্গনে রাখার।


অনঙ্গ বউ, অনঙ্গ বউ, এক জোড়া হাঁস,

এক জোড়া চোখ, কোথায়? তুমি কোথায়?



আপন মানুষদের কাছে ফিরে যাবো — মহাদেব সাহা


এখানে মানুষ থাকে, এই নির্দয় নিষ্প্রাণ দেশে,

এই লৌহপুরীতে?

এই শহরের ভিড়ে পাখিদের ওড়াউড়ি নেই,

গাভীর হাম্বা রব কখনো শুনি না;

শুধু অচেনা মানুষের কোলাহল, গাড়ির কর্কশ শব্দ

বাড়ির উঠানে এখানে ওঠে না চাঁদ, নদীময় তারাভরা

দেখি না আকাশ

জুড়ায় না ক্লান্ত দেহ দখিনা বাতাস

এখানে মানুষেরা এক সাথে হেঁটে যায় কেউ কাউকে চেনে না, মানুষ

এখানে থাকে?

ঢের হয়েছে বিদ্যা, ঢের হয়েছে প্রাপ্তি, তবু যেটুকু জীবন

আছে, বুকে নিয়ে

এবার আপন মানুষদের কাছে ফিরে যাবো, গলা

ছেড়ে ডাকবো বাহার কাকা,

কানু ভাই তোমরা কোথায়?

ছি, এখানে মানুষ থাকে, এই সোনার খাঁচায়, ইটের জঙ্গলে,

বন্দিশালায়

হোটেলের বদ্ধ ঘরে, ফ্ল্যাট বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে

বৈদ্যুতিক আলোর এই অন্ধকারে,

এই স্নেহহীন, মায়াহীন, জলবায়ু শুন্য জতুগৃহে?

কতোদিন শুনি না ঘুঘুর ডাক, রাখালের বাঁশি,

টানা বাতাসের শব্দ

দেখিনা সবুজ মাঠ, উধাও দিগন্ত

ঘরের পিছনের ছোট্ট জংলায় দোয়েলের উড়াউড়ি,

কোথাও দেখিনা একটি ধানের শীষে গঙ্গাফড়িং,

লাউ জাংলার পাশে স্থলপদ্ম,

এখানে কী পেয়েছি প্রচুর সুখ, পেয়েছি প্রচুর শান্তি,

এবার অর্ধেক মানুষ আমি খুইয়ে এখানে

সব অনুভুতি, শুদ্ধতা, আনন্দ

সেই আপন মানুষদের কাছে ফিরে যাবো।

সেই বন্ধুগাছ, বন্ধুপাখি, ডোবার কচুরি ফুল,

সেই কাদামাটি জলে ভেজা বাড়ি

কাজলাদিদির কথা লেখা সেই পাঠ্যবই, তোমাদের কারো

কিছুই জানি না;

পাখিরা যেমন আপন পাখিদের সাথে মিশে যায়

আমিও তেমনি আপন মানুষদের মাঝে মিশে যাবো

প্রিয় বৃক্ষ, প্রিয় নদী, আপন মানুষ।



সঙ্গতি-শহীদ কাদরী


বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা

মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,

কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা

ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ

প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই

কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…

একাকী পথিক ফিরে যাবে তার ঘরে

শূন্য হাঁড়ির গহ্বরে অবিরত

শাদা ভাত ঠিক উঠবেই ফুটে তারাপুঞ্জের মতো,

পুরোনো গানের বিস্মৃত-কথা ফিরবে তোমার স্বরে

প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই

কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…

ব্যারাকে-ব্যারাকে থামবে কুচকাওয়াজ

ক্ষুধার্ত বাঘ পেয়ে যাবে নীলগাই,

গ্রামান্তরের বাতাস আনবে স্বাদু আওয়াজ

মেয়েলি গানের- তোমরা দু’জন একঘরে পাবে ঠাঁই

প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই

কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…



অবনী বাড়ি আছো – শক্তি চট্টোপাধ্যায়

অবনী বাড়ি আছো

দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া

কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া

‘অবনী বাড়ি আছো?’


বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস

এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে

পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস

দুয়ার চেপে ধরে–

‘অবনী বাড়ি আছো?’


আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী

ব্যথার মাঝে ঘুমিয় পড়ি আমি

সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া

‘অবনী বাড়ি আছ’



দোতলার ল্যন্ডিং মুখোমুখি ফ্ল্যাট। একজন সিঁড়িতে, একজন দরোজায় –আহসান হাবীব

: আপনারা যাচ্ছেন বুঝি?

: চ’লে যাচ্ছি, মালপত্র উঠে গেছে সব।

: বছর দু’য়েক হ’লো, তাই নয়?

: তারো বেশি। আপনার ডাকনাম শানু, ভালো নাম?

: শাহানা, আপনার?

: মাবু।

: জানি।

: মাহবুব হোসেন। আপনি খুব ভালো সেলাই জানেন।

: কে বলেছে। আপনার তো অনার্স ফাইনাল, তাই নয়?

: এবার ফাইনাল

: ফিজিক্স-এ অনার্স।

: কি আশ্বর্য। আপনি কেন ছাড়লেন হঠাৎ?

: মা চান না। মানে ছেলেদের সঙ্গে ব’সে…

: সে যাক গে, পা সেরেছে?

: কি ক’রে জানলেন?

: এই আর কি। সেরে গেছে?

: ও কিছু না, প্যাসেজটা পিছল ছিলো মানে…

: সত্যি নয়। উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে…

: ধ্যাৎ। খাবার টেবিলে রোজ মাকে অতো জ্বালানো কি ভালো?

: মা বলেছে?

: শুনতে পাই? বছর দুয়েক হ’লো, তাই নয়?

: তারো বেশি। আপনার টবের গাছে ফুল এসেছে?

: নেবেন? না থাক। রিকসা এলো, মা এলেন, যাই।

: যাই। আপনি সন্ধেবেলা ওভাবে পড়বেন না,

চোখ যাবে, যাই।

: হলুদ শার্টের মাঝখানে বোতাম নেই, লাগিয়ে নেবেন, যাই।

: যান, আপনার মা আসছেন। মা ডাকছেন, যাই।



শেষের কবিতা –রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?

তারি রথ নিত্য উধাও।

জাগিছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন

চক্রে পিষ্ট আধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।

ওগো বন্ধু,

সেই ধাবমান কাল

জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল

তুলে নিল দ্রুতরথে

দু’সাহসী ভ্রমনের পথে

তোমা হতে বহু দূরে।

মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে

পার হয়ে আসিলাম

আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়;

রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়

আমার পুরানো নাম।

ফিরিবার পথ নাহি;

দূর হতে যদি দেখ চাহি

পারিবে না চিনিতে আমায়।

হে বন্ধু বিদায়।

কোনদিন কর্মহীন পূর্ণো অবকাশে

বসন্তবাতাসে

অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,

ঝরা বকুলের কান্না ব্যাথিবে আকাশ,

সেইক্ষণে খুজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে

তোমার প্রাণের প্রানে, বিস্মৃতি প্রাদোষে

হয়তো দিবে সে জ্যোতি,

হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নে মুরতি।

তবু সে তো স্বপ্ন নয়,

সব চেয়ে সত্য মোর সেই মৃত্যুঞ্জয় –

সে আমার প্রেম।

তারে আমি রাখিয়া এলাম

অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।

পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে

কালের যাত্রায়।

হে বন্ধু বিদায়।

তোমায় হয় নি কোন ক্ষতি।

মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি

যদি সৃষ্টি করে থাক তাহারি আরতি

হোক তবে সন্ধ্যা বেলা-

পূজার সে খেলা

ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;

তৃষার্ত আবেগবেগে

ভ্রষ্ট্র নাহি হবে তার কোন ফুল নৈবদ্যের থালে।

তোমার মানস ভোজে সযত্নে সাজালে

যে ভাবরসের পাত্র বাণীর ত’ষায়

তার সাথে দিব না মিশায়ে

যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।

আজও তুমি নিজে

হয়তো বা করিবে বচন

মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নবিষ্ট তোমার বচন

ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়।

হে বন্ধু বিদায়।

মোর লাগি করিয় না শোক-

আমার রয়েছে কর্ম রয়েছে বিশ্বলোক।

মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,

শুন্যেরে করিব পূর্ণো, এই ব্রত বহিব সদাই।

উ’কন্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে

সে ধন্য করিবে আমাকে।

শুক্লপখক হতে আনি

রজনী গন্ধার বৃন্তখানি

যে পারে সাজাতে

অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে

সে আমারে দেখিবারে পায়

অসীম ক্ষমায়

ভালমন্দ মিলায়ে সকলি,

এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।

তোমারে যা দিয়েছিনু তার

পেয়েছ নিশেষ অধিকার।

হেথা মোর তিলে তিলে দান,

করূন মুহূর্তগুলি গন্ডুষ ভরিয়া করে পান

হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম,

ওগো নিরূপম,

হে ঐশ্বর্যবান

তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান,

গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।

হে বন্ধু বিদায়।




কথোপকথন –৪ –পুর্ণেন্দু পত্রী


যে কোন একটা ফুলের নাম বল

– দুঃখ ।

– যে কোন একটা নদীর নাম বল

– বেদনা ।

– যে কোন একটা গাছের নাম বল

– দীর্ঘশ্বাস ।

– যে কোন একটা নক্ষত্রের নাম বল

– অশ্রু ।

– এবার আমি তোমার ভবিষ্যত বলে দিতে পারি ।

– বলো ।

– খুব সুখী হবে জীবনে ।

শ্বেত পাথরে পা ।

সোনার পালঙ্কে গা ।

এগুতে সাতমহল

পিছোতে সাতমহল ।

ঝর্ণার জলে স্নান

ফোয়ারার জলে কুলকুচি ।

তুমি বলবে, সাজবো ।

বাগানে মালিণীরা গাঁথবে মালা

ঘরে দাসিরা বাটবে চন্দন ।

তুমি বলবে, ঘুমবো ।

অমনি গাছে গাছে পাখোয়াজ তানপুরা,

অমনি জোৎস্নার ভিতরে এক লক্ষ নর্তকী ।

সুখের নাগর দোলায় এইভাবে অনেকদিন ।

তারপর

বুকের ডান পাঁজরে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে

রক্তের রাঙ্গা মাটির পথে সুড়ঙ্গ কেটে কেটে

একটা সাপ

পায়ে বালুচরীর নকশা

নদীর বুকে ঝুঁকে-পড়া লাল গোধূলি তার চোখ

বিয়েবাড়ির ব্যাকুল নহবত তার হাসি,

দাঁতে মুক্তোর দানার মত বিষ,

পাকে পাকে জড়িয়ে ধরবে তোমাকে

যেন বটের শিকড়

মাটিকে ভেদ করে যার আলিঙ্গন ।

ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত হাসির রং হলুদ

ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত গয়নায় শ্যাওলা

ধীরে ধীরে তোমার মখমল বিছানা

ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে সাদা ।

– সেই সাপটা বুঝি তুমি ?

– না ।

– তবে ?

– স্মৃতি ।

বাসর ঘরে ঢুকার সময় যাকে ফেলে এসেছিলে

পোড়া ধুপের পাশে ।



চিঠি দিও –মহাদেব সাহা


করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও

আঙ্গুলের মিহিন সেলাই


ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,

এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো

অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।


চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও …

বর্ণণা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও!


আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি,

আসবেন অচেনা রাজার লোক

তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে ….

এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল! …


করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি

দিও খামে

কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস

একটি ফুলের ছোট নাম,


টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু, হয়তো পাওনি খুঁজে

সেইসব চুপচাপ কোন দুপুরবেলার গল্প

খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে, তাই লিখো


করুণা করে হলেও চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালবাসি !



প্রস্থান –হেলাল হাফিজ


এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পএ দিও


এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালীর তাল পাখাটা

খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পএ দিও।

ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত

ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পএ দিও।

কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে

কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে

পএ দিও, পএ দিও।


আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেও, আপত্তি নেই।

গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?

আমি না হয় ভালবাসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,

নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে

পাঁচ দুপুরে নির্জনতা খুন করেছি, কি আসে যায়?

এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,

এক মানবী কতোটা বা কষ্ট দেবে!



একবার তুমি –শক্তি চট্টোপাধ্যায়


একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো–

দেখবে, নদির ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে পড়ছে

পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল

নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল

একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো ।


বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই যখন পিচ্ছিল, তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে

যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার , যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সালমা-চুমকি- জরি-মাখা প্রতিমা

বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটে নক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি ।


বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল

চিঠি-পত্রের বাক্স বলতে তো কিছু নেই – পাথরের ফাঁক – ফোকরে রেখে এলেই কাজ হাসিল-

অনেক সময়তো ঘর গড়তেও মন চায় ।


মাছের বুকের পাথর ক্রমেই আমাদের বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে

আমাদের সবই দরকার । আমরা ঘরবাড়ি গড়বো – সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ তুলে ধরবো

রূপোলী মাছ পাথর ঝরাতে ঝরাতে চলে গেলে

একবার তুমি ভলবাসতে চেষ্টা করো ।





তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা –শহীদ কাদরী


ভয় নেই

আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী

গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে

মার্চপাস্ট করে চলে যাবে

এবং স্যালুট করবে

কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।


ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো

বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে

কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে

আর্মার্ড-কারগুলো এসে দাঁড়াবে

ভায়োলিন বোঝাই করে

কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।


ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো-

বি-৫২ আর মিগ-২১গুলো

মাথার ওপর গোঁ-গোঁ করবে

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো

চকোলেট, টফি আর লজেন্সগুলো

প্যারাট্রুপারদের মতো ঝরে পড়বে

কেবল তোমার উঠোনে প্রিয়তমা।


ভয় নেই…আমি এমন ব্যবস্থা করবো

একজন কবি কমান্ড করবেন বঙ্গোপসাগরের সবগুলো রণতরী

এবং আসন্ন নির্বাচনে সমরমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায়

সবগুলো গণভোট পাবেন একজন প্রেমিক, প্রিয়তমা!


সংঘর্ষের সব সম্ভাবনা, ঠিক জেনো, শেষ হবে যাবে-

আমি এমন ব্যবস্থা করবো, একজন গায়ক

অনায়াসে বিরোধীদলের অধিনায়ক হয়ে যাবেন

সীমান্তের ট্রেঞ্চগুলোয় পাহারা দেবে সারাটা বৎসর

লাল নীল সোনালি মাছি-

ভালোবাসার চোরাচালান ছাড়া সবকিছু নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, প্রিয়তমা।


ভয় নেই আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে

শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন

আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে

গণচুম্বনের ভয়ে

হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা।


ভয় নেই,

আমি এমন ব্যবস্থা করবো

শীতের পার্কের ওপর বসন্তের সংগোপন আক্রমণের মতো

অ্যাকর্ডিয়ান বাজাতে-বাজাতে বিপ্লবীরা দাঁড়াবে শহরে,


ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো

স্টেটব্যাংকে গিয়ে

গোলাপ কিম্বা চন্দ্রমল্লিকা ভাঙালে অন্তত চার লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে

একটি বেলফুল দিলে চারটি কার্ডিগান।

ভয় নেই, ভয় নেই

ভয় নেই,

আমি এমন ব্যবস্থা করবো

নৌ, বিমান আর পদাতিক বাহিনী

কেবল তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-ঘিরে

নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা।




তুই কি আমার দুঃখ হবি? –আনিসুল হক


তুই কি আমার দুঃখ হবি?

এই আমি এক উড়নচন্ডী আউলা বাউল

রুখো চুলে পথের ধুলো

চোখের নীচে কালো ছায়া

সেইখানে তুই রাত বিরেতে স্পর্শ দিবি।


তুই কি আমার দুঃখ হবি?

তুই কি আমার শুষ্ক চোখে অশ্রু হবি?

মধ্যরাতে বেজে ওঠা টেলিফোনের ধ্বনি হবি?

তুই কি আমার খাঁ খাঁ দুপুর

নির্জনতা ভেঙে দিয়ে

ডাকপিয়নের নিষ্ঠ হাতে

ক্রমাগত নড়তে থাকা দরজাময় কড়া হবি?

একটি নীলাভ এনভেলাপে পুরে রাখা

কেমন যেন বিষাদ হবি?


তুই কি আমার শুন্য বুকে

দীর্ঘশ্বাসের বকুল হবি?

নরম হাতের ছোঁয়া হবি?

একটুখানি কষ্ট দিবি,

নীচের ঠোট কামড়ে ধরা রোদন হবি?

একটুখানি কষ্ট দিবি

প্রতীক্ষার এই দীর্ঘ হলুদ বিকেল বেলায়

কথা দিয়েও না রাখা এক কথা হবি?

একটুখানি কষ্ট দিবি


তুই কি একা আমার হবি?

তুই কি আমার একান্ত এক দুঃখ হবি?




নিঃসঙ্গতা-আবুল হাসান

অতোটুকু চায় নি বালিকা!

অতো শোভা, অতো স্বাধীনতা!

চেয়েছিলো আরো কিছু কম,


আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে

বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিলো

মা বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক!


অতোটুকু চায় নি বালিকা!

অতো হৈ রৈ লোক, অতো ভিড়, অতো সমাগম!

চেয়েছিলো আরো কিছু কম!


একটি জলের খনি

তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিলো


একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!





ওটা কিছু নয় –নির্মলেন্দু গুণ


এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?

একটু দাঁড়াও আমি তৈরী হয়ে নিই ।

এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?

তেমার জন্মান্ধ চোখে শুধু ভুল অন্ধকার । ওটা নয়, ওটা চুল ।

এই হলো আমার আঙ্গুল, এইবার স্পর্শ করো,–না, না, না,

-ওটা নয়, ওটা কন্ঠনালী, গরলবিশ্বাসী এক শিল্পীর

মাটির ভাস্কর্য, ওটা অগ্নি নয়, অই আমি–আমার যৌবন ।


সুখের সামান্য নিচে কেটে ফেলা যন্ত্রণার কবন্ধ–প্রেমিক,

ওখানে কী খোঁজ তুমি ? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ ;

রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,

নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে,–এর ঠিক ডানপাশে , অইখানে

হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাতা রাখো, ওটাই হৃদয় ।


অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্পনি ;

অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল তুমিই থাকো নি ।





শুধু তোমার জন্য –নির্মলেন্দু গুণ

কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে

গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।

তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও

কতবার যে আমি সে কথা বলিনি

সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।

তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য

দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম

আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ

‘এই ওঠো,

আমি, আ…মি…।‘

আর অমি এ-কী শুনলাম

এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে

কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে

কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।

আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,

আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,

আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।

তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,

আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।




তোমার চোখ এতো লাল কেন –নির্মলেন্দু গুণ


আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে , আমি চাই

কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,

শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য ।

বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত ।


আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই

কেউ আমাকে খেতে দিক । আমি হাতপাখা নিয়ে

কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,

আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ

নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী -সেবার দায় থেকে ।

আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুক :

আমার জল লাগবে কি না, নুন লাগবে কি না,

পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা

তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না ।

এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি ।


আমি বলছি না ভলোবাসতেই হবে, আমি চাই

কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা

খুলে দিক । কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক ।

কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে

জিজ্ঞেস করুক : ‘তোমার চোখ এতো লাল কেন ?’




যাত্রাভঙ্গ-নির্মলেন্দু গুণ


হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে

মন বাড়িয়ে ছুঁই,

দুইকে আমি এক করি না

এক কে করি দুই।


হেমের মাঝে শুই না যবে,

প্রেমের মাঝে শুই

তুই কেমন কর যাবি?

পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া

আমাকেই তুই পাবি।


তবুও তুই বলিস যদি যাই,

দেখবি তোর সমুখে পথ নাই।


তখন আমি একটু ছোঁব

হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর

বিদায় দুটি পায়ে,

তুই উঠবি আমার নায়ে,

আমার বৈতরণী নায়ে।


নায়ের মাঝে বসবো বটে,

না-এর মাঝে শোবো,

হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ

দুঃখ দিয়ে ছোঁব।





রোমন্থন-আখতারুজ্জামান আজাদ


জিজ্ঞেস করো ওদের কাছে সবহারাদের মিছিলে —

আমি তোমার কী ছিলাম, আর তুমি আমার কী ছিলে?

যখন তোমার কেউ ছিল না, তোমার পাশে হাঁটল কে?

তোমার ভেতর শীতল জলে শীতেও সাঁতার কাটল কে?


জিজ্ঞেস করো পথের কাছে, জিজ্ঞেস করো পাহাড়কে —

তৃষ্ণাক্ষুধায় জ্বলেছ যখন, দিয়েছে তোমায় আহার কে?


কে শেখাল বাঁচতে তোমায়? মৃত্যু থেকে তুলল কে?

যখন ভুলের পরে ভুল করেছ, ভুলের কথা ভুলল কে?


দেখাই যখন হয়ে গেল, মিলাও একটি অংক আজ —

তোমার মাথায় সিঁদুর কেন? দুহাতে কেন শঙ্খ আজ?




ইচ্ছে ছিলো-হেলাল হাফিজ


ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো

ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে

শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।


ইচ্ছে ছিলো সুনিপূণ মেকআপ-ম্যানের মতো

সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা

পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।


ইচ্ছে ছিলো নদীর বক্ষ থেকে জলে জলে শব্দ তুলে

রাখবো তোমার লাজুক চঞ্চুতে,

জন্মাবধি আমার শীতল চোখ

তাপ নেবে তোমার দু’চোখে।


ইচ্ছে ছিল রাজা হবো

তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,

আজ দেখি রাজ্য আছে

রাজা আছে

ইচ্ছে আছে,

শুধু তুমি অন্য ঘরে।




বলয়াবর্ত


সুক্ষ জালের মাঝে আমি আর কতকাল আটকে থাকব?

জালের ওপাড়ে ওদের গুনগুনানি শুনে

আর কতকাল শিউরে উঠব আমি!

আমার চারপাশে শুধু ওদেরই আনাগোনা।

ওদের লেলিহান দৃষ্টি আমার দিকেই তাক করা

ওরা উদগ্রীব অপেক্ষায় আছে,

আমায় সাধ্য সীমানার মাঝে পাবার;

আয়ত্তে পাবার সাথে সাথে ওরা একা-

কিংবা দল বেধেঁ হুল ফুঁটিয়ে টেনে নিতে থাকবে,

এতদিন যক্ষের মত আগলে রাখা আমার সমস্ত রক্ত;

সবটুকু রক্ত চুষে নিয়ে, ফেলে রাখবে আঁটি সদৃশ নিথর দেহ।

সদা পিপাসার্ত এদের পিয়সা কখনো মেটে না,

ওরা সব থাকে ভার্চুয়াল আবরনের ভিতর-

চোখের সামনে কিন্তু ধরা ছোঁয়ার বাইরে,

দু হাতের তালু চেপে ওদের পিষে মারা যায়না-

ওদের পেট ফাটিয়ে দেখা যায় না

কতটা লাল ছিল রক্তটা –কতটা গাঢ়।

বরং প্রতিবাদ করে মাথা তুলে দাড়ালেই,

ওরাই ফেরত পাঠায় কোন স্পন্দনহীন শরীর।

সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মত আজ এও যেন,

হতে চলেছে অতীব স্বাভাবিক কোন প্রাকৃতিক নিয়ম;

এ নিয়মই কি বয়ে চলবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে-

এই বলয়ের নাগপাশ কি ছিন্ন হবে না কোনদিন?

শুধু প্রশ্নই রেখে যাই-হায়!নিয়তি নির্মম-

কন্ঠে কোন ভাষা নেই-কোন উত্তর জানা নেই।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন