রফিক আজাদ এর সেরা কবিতা সংগ্রহ

ছবিঃ ডেইলি ইনকিলাব 


ভালোবাসার সংজ্ঞা 

ভালোবাসা মানে দুজনের পাগলামি, 

পরস্পরকে হৃদয়ের কাছে টানা; 

ভালোবাসা মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া, 


বিরহ-বালুতে খালিপায়ে হাঁটাহাঁটি; 

ভালোবাসা মানে একে অপরের প্রতি 

খুব করে ঝুঁকে থাকা; 

ভালোবাসা মানে ব্যাপক বৃষ্টি, বৃষ্টির একটানা 

ভিতরে-বাহিরে দুজনের হেঁটে যাওয়া; 

ভালোবাসা মানে ঠাণ্ডা কফির পেয়ালা সামনে 

অবিরল কথা বলা; 

ভালোবাসা মানে শেষ হয়ে-যাওয়া কথার পরেও 

মুখোমুখি বসে থাকা। 



তোমার কথা ভেবে

তোমার কথা ভেবে রক্তে ঢেউ ওঠে— 

তোমাকে সর্বদা ভাবতে ভালো লাগে, 

আমার পথজুড়ে তোমারই আনাগোনা— 

তোমাকে মনে এলে রক্তে আজও ওঠে 

তুমুল তোলপাড় হূদয়ে সর্বদা… 

হলো না পাশাপাশি বিপুল পথ-হাঁটা, 

এমন কথা ছিল চলব দুজনেই 

জীবন-জোড়া পথ যে-পথ দিকহীন 

মিশেছে সম্মুখে আলোর গহ্বরে…। 


নত হও, কুর্নিশ 

হে কলম, উদ্ধত হ’য়ো না, নত হও, নত হতে শেখো, 

তোমার উদ্ধত আচরনে চেয়ে দ্যাখো, কী যে দু:খ 

পেয়েছেন ভদ্রমহোদয়গণ, 


অতএব, নত হও, বিনীত ভঙিতে করজোড়ে 

ক্ষমা চাও, পায়ে পড়ো, বলো: কদ্যপি এমনটি হবে না, স্যার, 

বলো: মধ্যবিত্ত হে বাঙালী ভদ্রমহোদয়গণ, 

এবারকার মতো ক্ষমা করে দিন… 




জীবন একটা নদীর নাম

জীবন একটি নদীর নাম, 

পিতামাতার ঐ উঁচু থেকে 

নেমে-আসা এক পাগলা ঝোরা— 

ক্রমশ নিম্নাভিমুখী; 

পাথুরে শৈশব ভেঙে 

কৈশোরের নুড়িগুলি বুকে নিয়ে 

বয়ে চলা পরিণামহীন 

এক জলধারা— 

গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে বেলে-এঁটেল-দোআঁশ 

মাটি ভেঙে-ভেঙে সামনে চলা 

এক ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী; 

এই বয়ে চলা পথে 

বিভিন্ন বৃক্ষের সঙ্গে চলে 

দ্বিরালাপ; 

একবার এক বৃদ্ধ অশ্বথের সঙ্গে 

হয় তার অল্পক্ষণ স্থায়ী 

আদাব-সালাম বিনিময়, 

তাকে বলেছিলো সেই বুড়ো: 

“এ্যাতো তাড়াহুড়ো করো না হে, 

ধীরে বয়ে যাও, তোমার চলার পথে 

পড়বে অনেক বৃক্ষ— সবুজ, সতেজ— 

তাদের শাখায় আছে পাখিদের প্রিয় ঘরবাড়ি, 

পাখিদের শাবকেরা আছে— তাদের রয়েছে খুব 

নরম পালক, 

যেন ঐ বৃক্ষ আর তার আশ্রিতজনের 

কোনো ক্ষতি না হয় তোমার দ্বারা; 

যদি পারো ঊষর মাটির মধ্য দিয়ে 

বয়ে যেয়ো, সর্বদা এড়িয়ে যেয়ো 

পাখির নিবাস… 

আমি তাকে কোনো কথাই পারিনি দিতে; 

নদীর ধর্ম তো অবিরাম বয়ে চলা, 

বহমান তার স্রোতধারা ভেঙে নিয়ে চলে 

পাড়ের সমৃদ্ধ মাটি, 

গৃহস্থের আটচালা, মাটির উনুন, 

প্রবীণ লাঙল, ধানী মরিচের টাল, 

তরমুজের ক্ষেত, পোষা বেড়ালের মিউ, 

ফলবান বৃক্ষের বাগান, কাঁথা ও বালিশসহ সম্পন্ন সংসার। 

তেমন আহ্লাদ নেই তার ভেঙে ফেলতে দু’পাড়ের 

সোনার সংসার; 

সে তো খুব মনস্তাপে পোড়ে, 

নিরুপায় অশ্রুপূর্ণ চোখে 

দীর্ঘশ্বাস চেপে সে-ও দু’পাড়ে তাকায়: 

এক পাড়ে দাঁড়ানো নারীকে বাঁচাতে গিয়ে 

অপর পাড়ের নিরুদ্বিগ্ন পাখিদের বাসা 

তছনছ করে ছোটে, 

তাকে তো ছুটতে হয়, সে যে নিরুপায় 

তার কষ্ট থাকে তার বুকে; 

তারও বুক ভেঙে যেতে পারে— বুকভাঙা অভিজ্ঞতা 

তারও তো রয়েছে— থাকতে পারে, থাকে… 

সে কথা ক’জন জানে। 

নদীকে তোমরা জানো ভাঙচুরের সম্রাট! 

দু’কূল-ছাপানো তার আবেগে উদ্বেল 

পলি তোমাদের জীবনে কি এনে দ্যায়নি কখনো 

শস্যের সম্ভার? 






বৃষ্টি 

১. 

খররৌদ্রময় এই দিন— 

শ্যামল বাংলায় বুঝি ফের নেমে আসে খরা! 

খরতাপে রুদ্ধশ্বাসক্ষুদ্র এই গ্রামীণ শহর, 

এ রকম এই দিনে চেতনায়ও খরার প্রদাহ— 

নির্বাচনে হেরে-যাওয়া প্রার্থী যেন: বিরক্ত, বিব্রত; 

এ রকম দুঃসময়ে এল বৃষ্টির শব্দের মতো 

সুখকর এই পত্র—প্রাগের প্রাচীর থেকে উড়ে! 

কুপিত, বিব্রতকর এই রোদে খামটি খুলিনি; 

আমি তো অপেক্ষা জানি: এই খররৌদ্রে কখনো কি 

প্রিয় বান্ধবীর লেখা চিঠি খোলা চলে? 

অতএব, রেখে দিই যত্ন করে নিজস্ব ড্রয়ারে! 

১১ জুলাই রাতে অকস্মাৎ বৃষ্টি নেমে এল 

যেন দীর্ঘদিন পর হঠাৎ হারিয়ে-যাওয়া আমার সন্তান 

ঘরে ফিরে এল। 

বাইরে এখন বৃষ্টি, 

বৃষ্টির স্নিগ্ধতা বহু দিন পর যেন 

আমার হূদয়ে প্রীত মধ্যযুগ ভরে দিয়ে গেল! 


এখনো বাইরে বৃষ্টি: জানালায় জলের প্রপাত— 

এই বুঝি প্রকৃষ্ট সময় যখন প্রশান্ত মন, 

হূদয়ে যখন আর খেদ নেই কোনো, ভারাতুর 

নয় আর মন, ক্রোধ নেই, ঘৃণা নেই—অবিশ্বাস্য 

শান্তিপ্রিয় আজ এই মাঞ্চুরীয় রাখাল বালক; 

হূদয়ে কোনোই শোক নেই—শোকানুভূতিও নেই— 

অসম্ভব শান্ত আজ—সমাহিত—আমার হূদয়! 

নষ্ট করে ফেলে-দেয়া জীবনের জন্য নেই কোনো 

শোচনা ও তাপ;—বৃষ্টির সৌগন্ধে ভরে আছে মন! 

মনে হচ্ছে আমার মতন সুখী কেউ নেই আর 

পৃথিবীর কোনো প্রান্তে ১১ জুলাই এই রাতে! 




চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া

স্পর্শকাতরতাময় এই নাম 

উচ্চারণমাত্র যেন ভেঙে যাবে, 

অন্তর্হিত হবে তার প্রকৃত মহিমা,— 

চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে-ভেতরে 

খুব শক্তিশালী 

মারণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। 


মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব। 

চুনিয়া তো ভালোবাসে শান্তস্নিগ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ, 

চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ-স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি; 

চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি। 

চুনিয়া কখনো কোনো হিংস্রতা দ্যাখে নি। 

চুনিয়া গুলির শব্দে আঁতকে উঠে কি? 

প্রতিটি গাছের পাতা মনুষ্যপশুর হিংস্রতা দেখে না-না ক’রে ওঠে? 

—চুনিয়া মানুষ ভালোবাসে। 


বৃক্ষদের সাহচার্যে চুনিয়াবাসীরা প্রকৃত প্রস্তাবে খুব সুখে আছে। 

চুনিয়া এখনো আছে এই সভ্যসমাজের 

কারু-কারু মনে, 

কেউ-কেউ এখনো তো পোষে 

বুকের নিভৃতে এক নিবিড় চুনিয়া। 


চুনিয়া শুশ্রূষা জানে, 

চুনিয়া ব্যান্ডেজ জানে, চুনিয়া সান্ত্বনা শুধু— 

চুনিয়া কখনো জানি কারুকেই আঘাত করে না; 

চুনিয়া সবুজ খুব, শান্তিপ্রিয়—শান্তি ভালোবাসে, 

কাঠুরের প্রতি তাই স্পষ্টতই তীব্র ঘৃণা হানে। 

চুনিয়া গুলির শব্দ পছন্দ করে না। 


রক্তপাত, সিংহাসন প্রভৃতি বিষয়ে 

চুনিয়া ভীষণ অজ্ঞ; 

চুনিয়া তো সর্বদাই মানুষের আবিষ্কৃত 

মারণাস্ত্রগুলো 

ভূমধ্যসাগরে ফেলে দিতে বলে। 

চুনিয়া তো চায় মানুষের তিনভাগ জলে 

রক্তমাখা হাত ধুয়ে তার দীক্ষা নিক। 

চুনিয়া সর্বদা বলে পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রগুলি 

সুগন্ধি ফুলের চাষে ভ’রে তোলা হোক। 


চুনিয়ারও অভিমান আছে, 

শিশু ও নারীর প্রতি চুনিয়ার পক্ষপাত আছে; 

শিশুহত্যা, নারীহত্যা দেখে-দেখে সেও 

মানবিক সভ্যতার প্রতি খুব বিরূপ হয়েছে। 


চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনেপ্রাণে 

নিশিদিন আশার পিদ্দিম জ্বেলে রাখে। 

চুনিয়া বিশ্বাস করে: 

শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে 

পরস্পর সৎপ্রতিবেশী হবে। 




নর্তকী 

মৃত নর্তকীর পদশব্দগুলো আমি বুনে যাই 

আমার নূপুর-শব্দে; আদিম গুহার মধ্যে শুরু 

হয়েছিল যেই নৃত্য—তাকেই সযত্নে 

সম্মুখের দিকে নিয়ে যাওয়া;—আমার যেটুকু সাধ্য, 

করি সেইটুকু—এইভাবে সমস্ত জীবনব্যাপী 

একটি নাচের মুদ্রা তৈরি ক’রে ফেলি। 

প্রতিটি নাচের শেষে কোনো তৃপ্তি নেই, 

সর্বশেষ ব’লে আর কোনো কথা নেই! 

আমার যেখানে শেষ অন্য কারু শুরু সেইখানে। 

পরবর্তী স্পন্দিত পায়ের কাছে নিজের সযত্ন 

শিল্প তুলে দিয়ে পাই ক্ষণিক বিশ্রাম। 

অবিচ্ছিন্ন নৃত্যধারা; 

উদয়েরও পরে ঘটে নব-নব নিত্য অভ্যুদয়। 

উদয়েই শেষ নয়— 

কৃষকের হাতের লাঙল উত্তরাধিকারসূত্রে 

পায় তার প্রিয় সন্তানেরা; 

এইভাবে ক্রমাগত ধারাবাহিকতা: 

আমাকেও চ’লে যেতে হবে ঘুঙুর ও ঘাঘরা ফেলে, 

শিল্পিত চঞ্চল ক্ষিপ্র অন্য কারু পায়ে তুলে দিয়ে… 



সৌন্দর্যতত্ব

দেখি: 

মধ্যরাতে 

জ্যোত্স্নায় জ্বলছে ক’টি ঘোড়া, 

তাদের শরীর থেকে ঝরছে বিদ্যুৎ— 

গর্বিত গ্রীবায় নয় সারা দেহে ঝরে স্নিগ্ধ নান্দনিক দ্যুতি! 

মধু ও সেগুনকাঠে 

তৈরি হ’লে যা দাঁড়াতো 

চোখ জুড়ে 

তেমন গায়ের রঙ—পেলব, মসৃণ ! 

পা ঠুকছে ঘোড়াগুলি 

চৈত্রেফাটা শস্যহীন মাঠে 

—অনিন্দ্য, সুন্দর!। 



এই রাতে

এই রাতে 

অন্যকিছু নয় 

বাতাসের শব্দ শোনো, 

শুধুমাত্র বাতাসের শব্দ— 

এই দীর্ঘ দীর্ঘায়িত রাতে 

অন্য কিছু নয়; 

নয় কোনো নিদ্রারোগী 

বৃদ্ধের কাশির শব্দ, 

কিংবা নয় কোনো সৈনিকের 

ভারী বুট, ট্যাঙ্কের ঘর্ঘর; 

নিদ্রাভিভূতেরও চলাফেরা নয়— 

শুধু বাতাসের শব্দ—অন্য কিছু নয়; 

আমলকি-পাতা ঝরার শব্দ-ও নয়, 

আশশ্যাওড়ার ঝোপ থেকে উঠে-আসা 

অবাঞ্ছিত কান্না নয় কোনো— 

এমনকি, নবজাতকের কান্না নয়; 

শুধু বাতাসের শব্দ, শুধুই বাতাস 

দীর্ঘশ্বাসময়, আর কিছু নয়— 

এই রাতে।। 




 বালক ভুল করে নেমেছ ভুল জলে

বালক জানে না তো পুষবে অনুরাগ 

হৃদয়ে কতদিন, কার বা চলা-পথে 

ছড়াবে মুঠো-মুঠো বকুল ফুলগুলো; 

কোথায় যেতে হবে, যাবে না কোন দিকে, 

ব্যাপক হাঁটাহাঁটি করবে কোন পথে! 


বালক জানলো না—মানুষ ম্লানমুখে 

কেন যে তারা গোনে; পায়ের নীচে কার 

কেন যে ফুল ঝরে, কতটা ফুল ঝরে! 

মানুষ ভুল পথে গিয়েছে কত দূর, 

বেপথু কাকে বলে বালক জানে না তা! 


বালক জানে না তো কতটা হেঁটে এলে 

ফেরার পথ নেই—থাকে না, নিরুপায়— 

যে আসে সে-ই জানে—ভুলের দামে কিনে 

আনে সে প্রিয় ম্যাপ—পথিক ম্রিয়মাণ, 

উল্টোরথে চ’ড়ে চলেছে মূল পথ! 


বালক জানে না তো অর্থনীতি আর 

মৌল রাজনীতি—উল্টো ক’রে ধরে 

সঠিক পতাকাটি—পতাকা দশদিশে 

যেনবা কম্পাস স্বদেশ ঠিক রাখে। 


বালক জানে না সে বানানে ভুল ক’রে 

উল্টাসিধা বোঝে : সঠিক পথজুড়ে 

পথের সবখানে কাঁটার ব্যাপকতা! 

বালক ভুল ক’রে পড়েছে ভুল বই, 

পড়ে নি ব্যাকরণ, পড়ে নি মূল বই! 

বালক জানে না তো সময় প্রতিকূল, 

সাঁতার না শিখে সে সাগরে ঝাঁপ দ্যায়, 

জলের চোরাস্রোত গোপনে ব’য়ে যায়, 

বালক ভুল ক’রে নেমেছে ভুল জলে! 


বালক জানে না তো জীবন থেকে তার 

কতটা অপচয় শিল্পে প্রয়োজন। 


পাথর বেশ ভারী, বহনে অপারগ 

বালক বোঝে না তা—বালক সিসিফাস 

পাহাড়ে উঠে যাবে, পাথর নেমে যাবে 

পাথুরে পাদদেশে!—বিমূঢ়, বিস্মিত 

বালক হতাশায় অর্তনাদ ক’রে 

গড়িয়ে প’ড়ে যাবে অন্ধকার খাদে। 

বালক জানে না তো সময় প্রতিকূল, 

ফুলের নামে কত কাঁটারা জেগে থাকে 

পুরোটা পথজুড়ে, দীর্ঘ পথজুড়ে— 

বালক জানে না তা, বালক জানে না তো! 

বালক জানে না তো কতটা হেঁটে এলে 

ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।। 












একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন