সবার আমি ছাত্র
আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হাতে ভাইরে,
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর কাছে পাই রে।
পাহাড় শিখায় তাহার সমান-
হই যেন ভাই মৌন-মহান,
খোলা মাঠের উপদেশে-
দিল-খোলা হই তাই রে।
সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয়
আপন তেজে জ্বলতে,
চাঁদ শিখাল হাসতে মোরে,
মধুর কথা বলতে।
ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর-
অন্তর হোক রত্ন-আকর,
নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম
আপন বেগে চলতে।
মাটির কাছে সহিষ্ণুতা
পেলাম আমি শিক্ষা,
আপন কাজে কঠোর হতে
পাষান দিন দীক্ষা।
ঝরনা তাহার সহজ গানে,
গান জাগাল আমার প্রাণে,
শ্যাম বনানী সরসতা
আমায় দিল ভিক্ষা।
বিশ্বজোড়ে পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
নানান ভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্রে।
এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়,
পাঠ্য যেসব পাতায় পাতায়
শিখছি সে সব কৌতূহলে,
নেই দ্বিধা লেশমাত্র।
আমরা কিশোর
কিশোর মোরা ঊষার আলো, আমার হাওয়া দুরন্ত
মনটি চির বাঁধন হারা পাখির মত উরন্ত।
আমরা আসি এই জগতে ছড়িয়ে দিতে আনন্দ,
সজীবতায় ভরিয়ে দিতে এই ধরণীর আনন তো।
আমরা সরল কিশোর শিশু ফুলের মত পবিত্র,
অন্তরেতে গোপন মোদের শিল্প, গীতি, কবিত্ব।
জাগাই যদি, লাগাই তাদের এই দুনিয়ার হিতার্থ,
ভবিষ্যতের নবীন ধরা হবেই তবে কৃতার্থ।
যে বাজী আছে মনের মাঝে চায় যে তারা আহার্য,
ফসল লয়ে ফলবে সে বাজী একটু পেলে সাহায্য।
একান্ত যার ইচ্ছা আছে, দাম আছে তার কথার তো,
এই জগতে অবশ্য সে মানুষ হবে যাথার্থ।
শোনরে কিশোর ভাইরা আমার, সত্য পথের শরণ নে,
হারিয়ে তোরা যাস নে যেন অমানুষের অরণ্যে।
আলোর মৌচাক
চাঁদটা যেন সত্যিকারের
আলোর-ই মৌচাক--
দুষ্টু-ছেলের ঢিল টি লেগে
হঠাৎ হোলো ফাঁক।
আজকে রে তাই সাঁঝের-বেলায়
আলোর মধু সব ঝরে যায়,--
হাজার তারা--মৌমাছিরা
উড়লো ঝাঁকে ঝাঁকে,--
নীল-আকাশের নিতন নীড়
উড়লো ঝাঁকে ঝাঁকে।
চাঁদটা যেন সত্যিকারের
আলোর-ই মৌচাক।
গন্ধে আমি এলাম ছুটে
খোলা-মাঠের পর,--
নেশায় নেশায় মাতল বাতাস--
ভরলো দিগন্তর।
ভোমরা-গুলো চাখতে এসে
আলোর মধু মাখলো শেষে,
জ্বল জ্বলিয়ে জোনাক হয়ে
উঠলো লাখে লাখ--
কালো-ভোমর আলোর ছোঁইয়ায়
জ্বললো লাখে লাখ।
চাঁদটা যেন সত্যিকারের
আলোর-ই মৌচাক।
জরির চাদর গায়ে জড়ালো
হলুদ-দীঘির বাঁধ,
মধুর ঝাঁঝে সাঝঁ-প্রহরেই
ঘুমের গেছে সাধ।
চপল-হাওয়া ঘুম ভাঙ্গে তার,
আস্তে সে তার বাজায় সেতার,
টটুল চালে নাচলে তালে
খাচ্ছে সে ঘুরপাক--
বন বন বন বন-কিনারে
খাচ্ছে সে ঘুরপাক।
চাঁদটা যেন সত্যিকারের
আলোর-ই মৌচাক।
ওরে বাবা ওটা কে রে!
ওরে বাবা, ওটা কেরে, চেহারা বিকট,
কোন মতলবে এলো আমার নিকট?
তোফা ছিনু একা একা ঘরের ভিতর,
হঠাৎ এলো কে ওটা, কোন সে ইতর?
ধ্বক-ধ্বক চোখে যেন আগুন ঝরায়,
লক-লকে জিভে খালি লাল যে গড়ায়,
আড়-চোখ বারে বারে ঘুরিছে পাজীর,
মনে হয় যমদূত স্বয়ং হাজির।
মিট মিটে হাসি হেসে ভুরূটি বাঁকায়,
মুখখানা কেলে-হাঁড়ি যেন আবলুস,
ফেটে যেন পড়ে ওরে রূপের জলুস।
নোখগুলো খাড়া যেন কাঠি সে ঝাঁটার।
সারাগায়ে ভরা লোম--কালচিটে রং,
উড়ে এসে জুড়ে বসে উজবুক সং।
বন্ধু বলে বোধ ওরে হয় না ও-ভাই,
এখনি সুযোগ পেলে করিবে জবাই।
ভাগ্যে এই টব ছিল ঘরের মাঝার,
নইলে মোটেই রক্ষা ছিলনা আজ আর।
টবের ও পাশে গিয়ে দাঁড়াই দু'পায়,
এ-ছাড়া এখন কোনো দেখিনা উপায়।
সব করেছে মাটি
শোনরে মানুষ, বন-মানুষের বুদ্ধিটা নয় সোজা,
বানিয়েছি এই আজব বিমান সাতটি বেলুন গোঁজা।
ফুর-ফুর-ফুর হালকা হাওয়ায় উড়ল বিমানখানা,
আকাশ-পথে চলছি উড়ে, সঙ্গী শোয়োর-ছানা।
শক্ত ঝুড়ির ভিতর মোরা বসছি এঁটে-সেঁটে,
বুঝলে তো ভাই বন-মানুষের বুদ্দি কত পেটে!
আকাশ-পথে হঠাৎ যদি বিপদ ঘটে কোনো,
তারও আছে প্রতিবিধান, বলছি সেটা শোনো।
শূন্যপথে ঘটলে বিপদ একান্ত বিদঘূটে,
সরাৎ করে আসব নেমে ছাতার প্যারাসুটে।
কলকব্জার বালাই যে নাই, ঘোরপ্যাঁচ নাই কিছু,
বেলুনগুলোর সুতো টেনে চালাই আগুপিছু।
বাঃ-বাঃ-বাঃ কেমন মজা, শূন্যে উঠি বেগে,
উড়ছে রঙ্গীন বেলুনগুলো আলতো বাতাস লেগে।
আকাশ-পথে শোঁ-শোঁ-শোঁ চলবে উড়ে উড়ে,--
ইচ্ছামত বিশ্বখানা দেখবো ঘুরে ঘুরে।
এই মরেছে,--বিমানটা যে হঠাৎ গেল ফেঁসে,--
সঙ্গী আমার ঝুড়ির ফুটায় বেরিয়ে এলো শেষে?
শূন্যপথে ডিগবাজি খায়, শিউরে ওঠে গা'টি,--
লক্ষীছাড়া শুয়োর-ছানা সব করেছে মাটি।
সামিয়ানা
চৌধুরীদের সামিয়ানা
বাইরে সেদিন হলো আনা,
সবাই বলে এ উহারে--'ব্যাপারটা কি, ব্যাপারটা কি?
চৌধুরীদের ছোট মেয়ের বিয়ে নাকি!'
কেউ বা বলে-- 'হয়তো নাতির অন্নপ্রাশন--
হচ্ছে বিপুল তাই আয়োজন।'
বল্লে কেহ ফিস ফিসিয়ে মিহিন সুরে,--
'চৌধুরীদের মেজ ছেলে হয়তো আজি
আসছে ফিরে বিদেশ ঘুরে।'
কৌতহলে স্কুলের ছেলে জুটল সবাই দলে দলে,
এ উহারে ডেকে বলে---
'যাত্রা হবে রাত্রে আজি আসতে হবে সন্ধ্যাবেলা!'
আশে পাশে জমলো বহুলোকের মেলা।
হাটের লোকে, ঘাটের মাঝি, ইষ্টিশনের যতেক কুলী
কাজ কর্ম সকল ভুলি
সবাই হলো সেথায় জড়ো।
যতেক জোয়ান, ছোট বড়।
সবার মুখে একই কথা, হদ্দ ভেবে সবাই তারা,--
সবাই হোলো ভেবে সারা।
ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়েছিল পাড়ার প্রাচীন দীনু বুড়ো--
নিতাই এসে বল্লে তাঁরে, 'ব্যাপার কিহে বুঝছো খুড়ো?'
বল্লে আরো হেসে নিতাই
-অনেক দিনের পরে এবার পড়বে পেটে মন্ডা মিঠাই,
সুঁট কে ভায়া আছি মরে,
ছা-পোষা লোক, জুটবে বেশী কেমন করে!'
ও দিকেতে লাগায় বাজি গদাই এবং পাড়ার হেবো--
বল্লে-'যে ঠিক বলবে তারে পাঁচটি টাকা ইনাম দেব।'
গদাই বলে- 'চৌধুরী-বৌ ভাঙ্গবে ব্রত রাত্রে আজি।'
বল্লে হেবো- 'মানতে আমি একটুও তা নাইক রাজী।'
'আসবে আজি জমিদারের জামাই'
ভীড়ের থেকে চেঁচিয়ে বলে রামাই।
এমন সময় তর তরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে এক্কেবারে
চৌধুরীদের নায়েব মশাই নেমে এলেন বাইরে দ্বারে।
সবাই বলে নিশেষ ফেলে--'এবার সকল যাবে জানা
আজকে কেন বার হোল এ বিরাট বিপুল সামিয়ানা।'
সাহস করে এগিয়ে তখন বল্লে গাঁয়ের নন্দ-গোঁসাই-
'সামিয়ানা বাইরে কেন, ব্যাপারটা কি নায়েব মশাই।'
কাষ্ঠ হেসে যষ্টি ঠুকে বল্লে তখন নায়েব মশাই---
'উই ধরেছে সামিয়ানায়, --বাইরে রোদে দিয়েছি তাই।'
হবুচন্দ্রের আইন
হবুচন্দ্র রাজা বলেন, গবুচন্দ্রে ডেকে--
'আইন জারি করে দিও রাজ্যেতে আজ থেকে,
মোর রাজ্যের ভিতর
হোকনা গরীব, ভদ্র কিম্বা ইতর,
কাঁদতে কেহ পারবেনা'ক, যতই মরুক শোকে,
হাসবে আমার যতেক প্রজা, হাসবে যত লোকে।
শান্ত্রী-সেপাই, প্যায়দা-পাইক ঘুরবে ছদ্মবেশে,
কাঁদলে কেহ, আনবে বেঁধে, শাস্তি হবে শেষে।'
বল্লে গবু-- 'হুজুর,--
ভয় যদি কেউ পায় কখনো দৈত্য, দানা, জুজুর,
কিম্বা যদি পিছলে প'ড়ে মুন্ডু ফাটায় কেহ,
গাড়ীর তলে কারুর যদি থেঁতলিয়ে যায় দেহ,
কিম্বা যদি কোনো প্রজার কান দুটি যায় কাটা,
কিম্বা যদি পড়ে কারুর পিঠের উপর ঝাঁটা,
সত্যিকারের বিপন্ন হয়ে যদি,
তবুও কি সবাই তারা হাসবে নিরবধি?'
রাজা বলেন,---'গবু,
আমার আইন সকল প্রজার
মানতে হবে তবু।
কেউ যদি হয় খুন বা জখম,
হাড্ডিতে ঘুণ ধরে,
পাজঁরা যদি ঝাঁঝরা হয়ে
মজ্জা ঝ'রে পড়ে,
ঠ্যাংটি ভাঙে, হাতটি কাটে,
ভুঁরিটি যায় ফেঁসে,
অন্ধকারে স্কন্ধকাটা
ঘাড়টি ধরে ঠেসে,
কিম্বা যদি ধড়ের থেকে
মুন্ডুটি যায় উড়ে,
কাঁদতে কেহ পারবে নাক বিশ্রী বিকট সুরে।
হবু চন্দ্রের দেশে---
মরতে যদি হয় কখনো, নরতে হবে হেসে।'
পিটিয়ে দিল ঢ্যাঁড়া গবু রাজার আদেশ পেয়ে--
'কাঁদতে কেহ পারবেনা আর, পুরুষ কিম্বা মেয়ে,
যতই শোকের কারণ ঘটুক, হাসতে হবে তবু,
আদেশ দিলেন রাজাধিরাজ হবু,
রাজার আদেশ কেউ যদি যায় ভুলে,
চড়তে হবে শূলে।'
সেদিন হতে হবুর দেশে
উল্টে গেল রীতি,
হররা-হাসির হট্রগোলে,
অট্র-হাসির অট্ররোলে,
জাগলো তুফান নিতি।
হাসির যেন ঝড় বয়ে যায়
রাজ্যখানি জুড়ে,
সবাই হাসে যখন তখন
প্রাণ-কাঁপানো সুরে।
প্যায়দা-পাইক ছদ্মবেশে হদ্দ অবিরত,
কান্না কারো শুনতে না পায়, হাঁপায় রীতিমত।
সবাই হাসে আশে-পাশে,
বিষম খেয়ে ভীষণ হাসে,
আস্তাবলে সহিস হাসে, আস্তাকুঁড়ে মেথর,
হাসছে যত মুমূর্ষুরা হাসপাতালের ভেতর।
আইন জেনে সর্ব্বনেশ
ঘাটের মড়া উঠছে হেসে,
বেতো-রোগী দেঁতো-হাসি হাসছে বসে ঘরে!
কাশতে গিয়ে কেশো বুড়ো হাসতে সুরু করে।
হাসছে দেশের ন্যাংলাফ্যাচাং হ্যাংলো-হাঁদা যত,
গোমরা-উদো-নোংরা-ডোঁপো-চ্যাংড়া শত শত,
কেউ কাঁদে না কান্না পেলেও,
কেউ কাঁদে না গাঁট্রা খেলেও,
পাঠশালাতে বেত্র খেয়ে ছাত্রদলে হাসে,
কান্না ভুলে শিশুর দলে হাসছে অনায়াসে।
রাজা হবু বলেন আবার গবচন্দ্রে ডাকি,
'আমার আইন মেনে সবাই
আমায় দিল ফাঁকি!
রাজ্যে আমার খাঁদার কথা
সবাই গেল ভুলে,
কেউ গেলনা শূলে?
একটা লোকও পেলামনা এইবারে
শূলে চড়াই যারে।
নিয়ম আমার কড়া
প্রতিদিনই একটি লোকের
শূলেতে চাই চড়া।
যা হোক, আজই সাঁঝের আগে
শূলে দেবার তরে---
যে করে হোক একটি মানুষ আনতে হবে ধরে।'
গবুচন্দ্র বল্লে হেসে
চেয়ে রাজার মুখে,
'কাঁদতে পারে এমন মানুষ
নাই যে এ মুলুকে
আমি না হয় নিজেই কেঁদে
আইন ভেঙে তবে
চড়ব শূলে, মহারাজের
নিয়ম রক্ষা হবে
কিন্তু একি, আমিও যে
কাঁদতে গেছি ভুলে
কেমন করে চড়ব তবে শূলে?'
রাজা বলেন, 'তোমার মত মূর্খ দেখি নাযে,
কাঁদতে তুমি ভুলে গেছ এই ক'দিনের মাঝে?
এই দ্যাখোনা কাঁদে কেমন করে'---
এই না বলে হবু রাজা কেঁদে ফেললেন জোরে।
মন্ত্রী গবু বল্লে তখন, 'এবার তবে রাজা---
নিজের আইন পালন করুন, গ্রহণ করুন সাজা।'
বলেন হবু, 'আমার হুকুম নড়বে না এক চুল,
আমার সাজা আমিই নেব, তৈরি কর শূল।'
সব-পেয়েছির দেশে
গল্প না ভাই, কল্পনা নয়,
স্বপন-বুড়ো এসে
আমায় নিয়ে উধাও হোলো
সব-পেয়েছির দেশে।
স্বপন-বুড়োর লম্বা দাড়ি,
পোষাকটি তার রং-বাহারী,
আমায় নিয়ে দিচেছ পাড়ি
হাল্কা-হাওয়ায় ভেসে;
সব-পেয়েছির দেশে রে ভাই,
সব-পেয়েছির দেশে।
স্বপন-বুড়ো, রসিক-চূড়ো
নিদ্-মহলের রাজা,
থুর্থুরে তার শরীর বটে,
মনটি আজও তাজা;
সব-পেয়েছির দেশে চলো
সকল ছেলে মেয়ে,
উঠব মেতে সবাই সেথায়
সকল জিনিস পেয়ে,
সেথায় হাসির ঝর্ণা হাসে,
আমোদ খুশির বন্যা আসে,
মাতিয়ে তোলে শিশুর দলে
অসীম ভালোবেসে,
সব-পেয়েছির দেশে রে ভাই
সব-পেয়েছির দেশে।
বাংলাদেশের কিশোর-শিশু
তোমরা যারা আছো,
নাচার মতো নাচো তারা
বাঁচার মতো বাঁচো।
আধ-মরা আর ঘুণে ধরারা
বুড়োর কথা শুনবে যারা,-
সত্যিকারের মানুষ তারা
হবেই অবশেষেসব-
সব-পেয়েছির দেশে রে ভাই
সব-পেয়েছির দেশে।