কায়কোবাদ এর কবিতা সংগ্রহ



 আযান

কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি।  

মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর  

আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।  

কি মধুর আযানের ধ্বনি!  

আমি তো পাগল হয়ে সে মধুর তানে,  

কি যে এক আকর্ষণে, ছুটে যাই মুগ্ধমনে  

কি নিশীথে, কি দিবসে মসজিদের পানে।  

হৃদয়ের তারে তারে, প্রাণের শোণিত-ধারে,  

কি যে এক ঢেউ উঠে ভক্তির তুফানে-  

কত সুধা আছে সেই মধুর আযানে।  

নদী ও পাখির গানে তারই প্রতিধ্বনি।  

ভ্রমরের গুণ-গানে সেই সুর আসে কানে  

কি এক আবেশে মুগ্ধ নিখিল ধরণী।  

ভূধরে, সাগরে জলে নির্ঝরণী কলকলে,  

আমি যেন শুনি সেই আযানের ধ্বনি।  

আহা যবে সেই সুর সুমধুর স্বরে,  

ভাসে দূরে সায়াহ্নের নিথর অম্বরে,  

প্রাণ করে আনচান, কি মধুর সে আযান,  

তারি প্রতিধ্বনি শুনি আত্মার ভিতরে।  

নীরব নিঝুম ধরা, বিশ্বে যেন সবই মরা,  

এতটুকু শব্দ যবে নাহি কোন স্থানে,  

মুয়াযযিন উচ্চৈঃস্বরে দাঁড়ায়ে মিনার ‘পরে  

কি সুধা ছড়িয়ে দেয় উষার আযানে!  

জাগাইতে মোহমুদ্ধ মানব সন্তানে।  

আহা কি মধুর ওই আযানের ধ্বনি।  

মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সমধুর  

আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।  

  



দেশের বাণী

কে আর বুঝিবে হায় এ দেশের বাণী?  

এ দেশের লোক যারা,  

সকলইতো গেছে মারা,  

আছে শুধু কতগুলি শৃগাল শকুনি!  

সে কথা ভাবিতে হায়  

এ প্রাণ ফেটে যায়,  

হৃদয় ছাপিয়ে উঠে – চোখ ভরা পানি।  

কে আর বুঝিবে হায় এ দেশের বাণী!  

এ দেশের লোক যত  

বিলাস ব্যসনে রত  

এ দেশের দুঃখ কিছু নাহি বুঝে তারা।  

দেশ গেল ছারেখারে,  

এ কথা বলিব কারে?  

ভেবে ভেবে তবু মোর হয়ে গেছে সারা!  

প্রাণভরা হাহাকার  

চোখ ভরা অশ্রুধার,  

এ হৃদি যে হয়ে গেছে মরুভূমি-পারা!  

  



বঙ্গভূমি ও বঙ্গভাষা 

বাংলা আমার মাতৃভাষা  

বাংলা আমার জন্মভূমি।  

গঙ্গা পদ্মা যাচ্ছে ব’য়ে,  

যাহার চরণ চুমি।  

ব্রহ্মপুত্র গেয়ে বেড়ায়,  

যাহার পূণ্য-গাথা!  

সেই-সে আমার জন্মভূমি,  

সেই-সে আমার মাতা!  

আমার মায়ের সবুজ আঁচল  

মাঠে খেলায় দুল!  

আমার মায়ের ফুল-বাগানে,  

ফুটছে কতই ফুল!  

শত শত কবি যাহার  

গেয়ে গেছে গাথা!  

সেই-সে আমার জন্মভূমি,  

সেই-সে আমার মাতা!  

আমার মায়ের গোলা ছিল,  

ধন ধান্যে ভরা!  

ছিল না তার অভাব কিছু,  

সুখে ছিলাম মোরা!  

বাংলা মায়ের স্নিগ্ধ কোলে,  

ঘুমিয়ে রব আমি!  

বাংলা আমার মাতৃভাষা  

বাংলা জন্মভূমি!..  

  


সায়াহ্নে

হে পান্থ, কোথায় যাও কোন্ দূরদেশে  

কার আশে? সে কি তোমা করিছে আহ্বান?  

সম্মুখে তামসী নিশা রাক্ষসীর বেশে  

শোন না কি চারিদিকে মরণের তান!  

সে তোমারে ওহে পান্থ, হাসিমুখে এসে,  

সে তোমারে ছলে বলে গ্রাসিবে এখনি।  

যেয়োনা একাকী পান্থ, সে দূর বিদেশে,  

ফিরে এসো, ওহে পান্থ, ফিরে এসো তুমি।  

এ ক্ষুদ্র জীবন লয়ে কেন এত আশা?  

জান না কি এ জগত্ নিশার স্বপন?  

মায়া মরীচিকী প্রায় স্নেহ ভালবাসা---  

জীবনের পাছে ওই রয়েছে মরণ  

হে পান্থ হেথায় শুরু আঁধারের স্তর;  

মৃত্যুর উপর মৃত্যু, মৃত্যু তার পর!  

  




সুখ

“সুখ সুখ” বলে তুমি, কেন কর হা-হুতাশ,  

সুখ ত পাবে না কোথা, বৃথা সে সুখের আশ!  

পথিক মরুভূ মাঝে খুঁজিয়া বেড়ায় জল,  

জল ত মিলে না সেথা, মরীচিকা করে ছল!  

তেমতি এ বিশ্ব মাঝে, সুখ ত পাবে না তুমি,  

মরীচিকা প্রায় সুখ, - এ বিশ্ব যে মরুভূমি!  

ধন রত্ন সুখৈশ্বর্য কিছুতেই সুখ নাই,  

সুখ পর-উপকারে, তারি মাঝে খোঁজ ভাই!  

‘আমিত্ব’কে বলি দিয়া স্বার্থ ত্যাগ কর যদি,  

পরের হিতের জন্য ভাব যদি নিরবধি!  

নিজ সুখ ভুলে গিয়ে ভাবিলে পরের কথা,  

মুছালে পরের অশ্রু – ঘুচালে পরের ব্যথা!  

আপনাকে বিলাইয়া দীনদুঃখীদের মাঝে,  

বিদূরিলে পর দূঃখ সকালে বিকালে সাঁঝে!  

তবেই পাইবে সুখ আত্মার ভিতরে তুমি,  

যা রুপিবে - তাই পাবে, সংসার যে কর্মভূমি!  

  



প্রণয়ের প্রথম চুম্বন

(১)  

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!  

যবে তুমি মুক্ত কেশে  

ফুলরাণী বেশে এসে,  

করেছিলে মোরে প্রিয় স্নেহ-আলিঙ্গন!  

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন?  

  

(২)  

প্রথম চুম্বন!  

মানব জীবনে আহা শান্তি-প্রস্রবণ!  

কত প্রেম কত আশা,  

কত স্নেহ ভালবাসা,  

বিরাজে তাহায়, সে যে অপার্থিব ধন!  

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!  

  

(৩)  

হায় সে চুম্বনে  

কত সুখ দুঃখে কত অশ্রু বরিষণ!  

কত হাসি, কত ব্যথা,  

আকুলতা, ব্যাকুলতা,  

প্রাণে প্রাণে কত কথা, কত সম্ভাষণ!  

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!  

  

(৪)  

সে চুম্বন, আলিঙ্গন, প্রেম-সম্ভাষণ,  

অতৃপ্ত হৃদয় মূলে  

ভীষণ ঝটিকা তুলে,  

উন্মত্ততা, মাদকতা ভরা অনুক্ষণ,  

মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!  

  




ভুল ভেঙে দাও

প্রভু ভুল ভেঙ্গে দাও।  

যে ভুলে তোমারে ভুলে - হীরা ফেলে কাঁচ তুলে।  

ভিখারী সেজেছি আমি  

আমার সে ভুল প্রভু  

তুমি ভেঙ্গে দাও।  

প্রভু ভুল ভেঙ্গে দাও।  

তুমি বিভু অন্তর্যামী - আমার প্রাণের স্বামী।  

তুমি ভিন্ন এ জগতে  

নাহি মোর কেউ  

প্রভু ভুল ভেঙ্গে দাও।  

সংসারের মায়া মোহে তোমারে ভুলিয়া।  

যে ডেকেছে তারি পাশে - গেছি ছুটে উর্ধ্বশ্বাসে।  

কে আপন কে বা পর  

দেখিনি চাহিয়া।  

সেই মারাত্বক ভুলে - তোমারে গিয়েছি ভুলে।  

আমার সে ভুল প্রভু  

তুমি ভেঙ্গে দাও।  

ভাই ভগ্নি স্রুত দ্বারা - 'দূর দূর' করে তারা।  

কেউ না জিজ্ঞাসে মোরে  

দুটি কথা বলি।  

দিন তো চলিয়া গেল - কালো নিশি এলো এলো।  

কে দিবে দেখায়ে পথ  

যাব কোথা চলি।  

চৌদিকে শত্রুর দল - করিতেছে কোলাহল।  

আতংকে হৃদয় কাঁপে  

সঙ্গে নাহি কেউ।  

যে ভুলে তোমারে ভুলে - গিয়েছি মনের ভুলে।  

আমার সে ভুল প্রভু  

তুমি ভেঙ্গে দাও।  

বাস্তব ছাড়িয়া আমি অবাস্তব পাছে।  

ঘুরিয়াছি নিশি দিন - তবে মোর তনু ক্ষীণ।  

তুমি ভিন্ন এ জগতে  

কে আমার আছে?  

তুমি আমার স্বামী - পথ ভ্রান্ত পাপী আমি।  

হাতে ধরে প্রভু তুমি, কূলে তুলে নাও।  

প্রভু ভুল ভেঙ্গে দাও।  

  


প্রেম-প্রতিমা

(১)  

আমি দেখিতাম শুধু তারে!  

মধুর চাঁদনীময়ী, মধুরা যামিনী,  

শশধর হাসিত অম্বরে!  

সে থখন ধীরে ধীরে, এসে এই নদীতীরে  

গাইত প্রেমের গীত মাতায়ে ধরণী;  

তাহার মধুর স্বরে, মুকুতা পড়িত ঝরে  

নীরবে বহিয়া যেত আকুলা তটিনী!  

আমি দেখিতাম শুধু তারে!  

  

(২)  

সে আমার সুখে দুঃখে প্রাণের সঙ্গিনী!  

তারি তরে বেঁচে আছি ভবে!  

জীবন-জলধি-পাড়ে, আর কি পাইব তারে  

এক দুই করে আমি মাসদিন গণি!  

সে চাঁদ ওঠে না আর, ঢালে না সে সুধা ধার,  

আমি তার সে আমার---শুধু এই জানি!  

সে আসবে কবে!  

  

(৩)  

তাহারি চরণ চুমি বনকমলিনী  

ফুটিয়া উঠিত থরে থরে!  

সে নিত উন্মুক্ত কেশে, ফুলরাণী-বেশে প্রাণ  

বিহগ শিখিত সেই প্রেমের রাগিনী!  

আমি দেখিতাম শুধু তারে!  

  

(৪)  

সে সদা কুসুম-সাজে এলাইয়া বেণী  

আমার এ প্রাণ নিত কেড়ে!  

চারিধারে পুষ্প-তরু, বায়ু ব'ত ঝরু ঝরু  

কোকিল তুলিত কত কুহু কুহু ধ্বনি!  

হেরি তার রূপরাশি, হেরি তার প্রেমহাসি,  

পাপিয়া আকুল প্রাণে হ'ত পাগলিনী!  

আমি দেখিতাম শুধু তারে!  

  

(৫)  

তাহারি রূপের ছটা উজলি ধরণী  

ঝরিয়া পড়িত চারি ধারে!  

আকাশে চন্দ্রমা-তারা, তারি প্রেমে মাতোয়ারা  

নয়নে খেলিত তার চঞ্চলা দামিনী!  

বুকেতে অমৃত-খনি, কন্ঠে সুধা-নির্ঝরণী  

সৌন্দর্য-সরসে সে যে ফুটন্ত নলিনী!  

আমি দেখিতাম শুধু তারে!  

  




কে তুমি

(১)  

কে তুমি?---কে তুমি?  

ওগো প্রাণময়ী,  

কে তুমি রমণী-মণি!  

তুমি কি আমার, হৃদি-পুষ্প-হার  

প্রেমের অমিয় খনি!  

কে তুমি রমণী-মণি?  

  

(২)  

কে তুমি?---  

তুমি কি চম্পক-কলি?  

গোলাপ মতি  

তুমি কি মল্লিকা যুথী ফুল্ল কুমুদিনী?  

সৌন্দর্যের সুধাসিন্ধু,  

শরতের পূর্ণ ইন্দু  

আধাঁর জীবন মাঝে পূর্ণিমা রজনী!  

কে তুমি রমণী-মণি?  

  

(৩)  

কে তুমি?---  

তুমি কি সন্ধ্যার তারা, সুধাংশু সুধা-ধারা  

পারিজাত পুষ্পকলি  

বিশ্ব বিমোহিনী  

অথবা শিশির স্নাতা, অর্ধস্ফুট, অনাঘ্রাতা  

প্রণয়-পীযূষ ভরা, সোনার নলিনী!  

কে তুমি রমণী-মণি?  

  

(৪)  

কে তুমি?---  

তুমি কি বসন্ত-বালা, অথবা প্রেমের ডালা,  

প্রাণের নিভৃত কুঞ্জে  

সুধা-নির্ঝরিনী!  

অথবা প্রেমাশ্রু-ধারা, শোকে দুঃখে আত্মহারা  

প্রেমের অতীত স্মৃতি,  

বিধবা রমণী!  

কে তুমি রমণী-মণি?  

  

(৫)  

কে তুমি?---  

তুমি কি আমার সেই  

হৃদয়-মোহিনী?  

সেই যদি,--কেন দূরে? এস, এই হৃদি-পুরে  

এস' প্রিয়ে প্রাণময়ী,  

এস' সুহাসিনী!  

এস' যাই সেই দেশে,--ফুল ফুটে চাঁদ হাসে  

দয়েলা কোয়েলা গায়  

প্রাণের রাগিণী!  

জরা নাই--মৃত্যু নাই, প্রণয়ে কলঙ্ক নাই  

চল যাই সে দেশে  

এস' সোহাগিনী!  

কে তুমি রমণী-মণি?  

  





বিদায়ের শেষ চুম্বন

(১)  

আবার, আবার সেই বিদায়-চুম্বন,  

আলেয়ার আলো প্রায়,  

আধাঁরে ডুবায়ে যায়,  

স্মৃতিটি রাখিয়া হায় করিত দাহন!  

  

(২)  

বিদায়-চুম্বন,  

উভয়েরি প্রাণে করে অগ্নি বরিষণ,  

উভয়ে উভয় তরে,  

আকুলি ব্যাকুলি করে,  

উভয়েরি হৃদিস্তরে যাতনা-ভীষণ!  

এমনি কঠোর হায় বিদায়-চুম্বন!  

  

(৩)  

প্রণয়ের মধুমাখা প্রথম চুম্বনে,  

শুধু সুখ সমুল্লাস;  

এতে ঘন হাহুতাশ,  

কেবলি যে বহে হায় উভয়েরি মনে!  

  

(৪)  

সে চুম্বনে এ চুম্বনে কি দিব তুলনা,  

সে স্বর্গের পরিমল,  

এ মর্তের হলাহল,  

তাহাতে উল্লাস, এতে কেবলি যাতনা!  

  

(৫)  

সে যে শরতের স্নিগ্ধ সুধাংশু-কিরণ,  

মুহুর্তে মাতায় ধরা,  

এ যে শুধু ক্লেশ ভরা  

বৈশাখের ঘন ঘোর ঝটিকা ভীষণ!  

  




নিবেদন

১ 

আঁধারে এসেছি আমি 

আধারেই যেতে চাই ! 

তোরা কেন পিছু পিছু 

আমারে ডাকিস্‌ ভাই ! 

আমিতো ভিখারী বেশে 

ফিরিতেছি দেশে দেশে 

নাহি বিদ্যা, নাহি বুদ্ধি 

গুণ তো কিছুই নাই ! 


২ 

আলো তো লাগে না ভাল 

আধারি যে ভালবাসি ! 

আমিতো পাগল প্রাণে 

কভূ কাঁদি, কভূ হাসি ! 

চাইনে ঐশ্বর্য-ভাতি, চাইনে যশের খ্যাতি 

আমিযে আমারি ভাবে মুগ্ধ আছি দিবানিশি ! 


৩ 

অনাদার-অবজ্ঞায় 

সদা তুষ্ট মম প্রাণ, 

সংসার-বিরাগী আমি 

আমার কিসের মান ? 

চাইনে আদর স্নেহ, চাইনে সুখের গেহ 

ফলমূল খাদ্য মোর 

তরুতলে বাসস্থান ! 


৪ 

কে তোরা ডাকিস মোরে 

আয় দেখি কাছে 

কি চাস আমার কাছে 

আমি যে ভিখারী হায় ! 

ধন নাই, জন নাই,, কি দিব তোদেরে ভাই, 

আছে শুধু ‘অশ্রু-জল’ 

তোরা কি তা নিবি হায় ! 


৫ 

শোকে তাপে এ হৃদয় 

হয়ে গেছে ঘোর কালো ; 

আঁধারে থাকিতে চাই 

ভাল যে বাসিনে আলো ! 

আমি যে পাগল কবি, দীনতার পূর্ণ ছবি, 

সবি করে ‘দূর ‘দূর’ 

তোরা কি বাসিস্‌ ভাল ? 











একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন