সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেরা কবিতা সংগ্রহ



 প্রতিক্ষায়

গোলাপে রয়েছে আঁচ, পতঙ্গের ডানা পুড়ে যায়  

 হাওয়া ঘোরে দূরে-দূরে  

 ফুলকে সমীহ করে  

 সূর্যাস্তও থমকে থাকে!  

 দেখো-দেখো  

 আমার বাগানে এক অগ্নিময়  

 ফুল ফুটে আছে  

 তার সৌরভেও কত তাপ!  

 আর সব কুসুমের জীবন-চরিত তুচ্ছ করে  

 সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে চতুর্দিক  

 বৈদুর্ষমণির মতো চোখ মেলে সে রয়েছে প্রতীক্ষায়  

 কার? কার? 

  


কবিতা

আমি তোমাকে এত বেশি স্বপ্নে দেখেছি যে তুমি  

 তোমার বাস্তবতা হারিয়ে ফেলেছো  

 এখনো কি সময় আছে তোমার জীবন্ত শরীর স্পর্শ করার  

 এবং যে ওষ্ঠ থেকে আমার অতি প্রিয় স্বর জন্ম নেয়  

 সেখানে চুম্বন দেবার?…  

 আমি তোমাকে এত বেশি স্বপ্ন দেখেছি যে হয়তো  

 আমার পক্ষে আর জাগাই সম্ভব হবে না  

 আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোই, আমার শরীর সব  

 রকম জীবন ও ভালোবাসার জন্য উন্মুক্ত……  

 আমি তোমার ভুরু ছুঁতে পারি, ওষ্ঠ ছুঁতে পারি এত কম……  

 আমি তোমাকে এত বেশি স্বপ্ন দেখেছি, হেঁটেছি,  

 কথা বলেছি।  

 শুয়েছি তোমার ছায়ার সঙ্গে……  

 মূল কবিতা: রোবেয়ার দেনো 

  


ভালোবাসা 

ভালোবাসা নয় স্তনের ওপরে দাঁত?  

 ভালোবাসা শুধু শ্রাবণের হা-হুতাশ?  

 ভালোবাসা বুঝি হৃদয় সমীপে আঁচ?  

 ভালোবাসা মানে রক্ত চেটেছে বাঘ!  

  

 ভালোবাসা ছিল ঝর্ণার পাশে একা  

 সেতু নেই আকাশে পারাপার  

 ভালাবাসা ছিল সোনালি ফসলে হওয়া  

 ভালোবাসা ছিল ট্রেন লাইনের রোদ।  

  

 শরীর ফুরোয় ঘামে ভেসে যায় বুক  

 অপর বহুতে মাথা রেখে আসে ঘুম  

 ঘুমের ভিতরে বারবার বলি আমি  

 ভালোবাসাকেই ভালবাসা দিয়ে যাবো। 

  



সে কোথায় যাবে 

পৌষের পূর্ণিমা রাত ডেকে বললো, যা-  

 সে কোথায় যাবে?  

 নিঝুম মাঠের মধ্যে সে এখন রাজা  

 একা-একা দুন্দুভি বাজাবে?  

 ছিল বটে রৌদ্রালোকে তারও রাজ্যপাট  

 সোনালি কৈশোরে  

 আজ উল্লুকের পাল হয়েছে স্বরাট  

 চৌরাস্তার মোড়ে  

  

 দাঁতে দাঁত ঘষাঘষি, চোখের টঙ্কার  

 এরকম ভাষা  

 সে শেখেনি, তাই এই রূপকথায় তার  

 জন্ম কীর্তিনাশা!  

  

 গায়ে সে মেখেছে ধুলো, গূঢ় ছদ্মবেশে  

 বোবা ভ্রাম্যমাণ  

 অদৃশ্য সহস্র চোখ তবু নির্মিশেষে  

 ছিলা রাখে টান।  

 পৌষের পূর্ণিমা রাত ডেকে বললো, যা-  

 সে কোথায় যাবে?  

 যেতে সে চায়নি? কেউ খুলেছে দরোজা  

 পুনরায় মনুষ্য স্বভাবে? 

  



প্রেমিকা

কবিতা আমার ওষ্ঠ কামড়ে আদর করে  

 ঘুম থেকে তুলে ডেকে নিয়ে যায়  

 ছাদের ঘরে  

 কবিতা আমার জামার বোতাম ছিঁড়েছে অনেক  

 হঠাৎ জুতোর পেরেক তোলে!  

 কবিতাকে আমি ভুলে থাকি যদি  

 অমনি সে রেগে হঠাৎ আমায়  

 ডবল ডেকার বাসের সামনে ঠেলে ফেলে দেয়  

 আমার অসুখে শিয়রের কাছে জেগে বসে থাকে  

 আমার অসুখ কেড়ে নেওয়া তার প্রিয় খুনসুটি  

 আমি তাকে যদি  

 আয়নার মতো  

 ভেঙ্গে দিতে যাই  

 সে দেখায় তার নগ্ন শরীর  

 সে শরীর ছুঁয়ে শান্তি হয় না, বুক জ্বলে যায়  

 বুক জ্বলে যায়, বুক জ্বলে যায়। 

  


শুধু কবিতার জন্য

শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম, শুধু কবিতার  

 জন্য কিছু খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা  

 ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য  

 অপলক মুখশ্রীর শান্তি একঝলক;  

 শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী, শুধু  

 কবিতার জন্য এতো রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত  

 শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।  

 মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু  

 কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি। 

  



চায়ের দোকানে

লণ্ডনে আছে লাস্ট বেঞ্চির ভীরু পরিমল,  

 রথীন এখন সাহিত্যে এক পরমহংস  

 দীপু তো  শুনেছি খুলেছে বিরাট কাগজের কল  

 এবং পাঁচটা চায়ের বাগানে দশআনি অংশ  

 তদুপরি অবসর পেলে হয় স্বদেশসেবক;  

  

 আড়াই ডজন আরশোলা ছেড়ে ক্লাস ভেঙেছিল পাগলা অমল  

 সে আজ হয়েছে মস্ত অধ্যাপক!  

 কি ভয়ংকর উজ্জ্বল ছিল সত্যশরণ  

 সে কেন নিজের কণ্ঠ কাটলো ঝকঝকে ক্ষুরে-  

 এখনো ছবিটি চোখে ভাসলেই জাগে শিহরণ  

 দূরে চলে যাবে জানতাম, তবু এতখানি দূরে?  

  

 গলির চায়ের দোকানে এখন আর কেউ নেই  

 একদা এখানে সকলে আমরা স্বপ্নে জেগেছিলাম  

 এক বালিকার প্রণয়ে ডুবেছি এক সাথে মিলে পঞ্চজনেই  

 আজ এমনকি মনে নেই সেই মেয়েটিরও নাম। 

  


নিজের আড়ালে

সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে  

 মানুষ দেখে না  

 সে খোঁজে ভ্রমর কিংবা  

 দিগন্তের মেঘের সংসার  

 আবার বিরক্ত হয়  

 কতকাল দেখে না আকাশ  

 কতকাল নদী বা ঝরনায় আর  

 দেখে না নিজের মুখ  

 আবর্জনা, আসবাবে বন্দী হয়ে যায়  

 সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে।  

  

 রমনীর কাছে গিয়ে  

 বারবার হয়েছে কাঙাল  

 যেমন বাতাসে থাকে সুগন্ধের ঋণ  

 বহু বছরের স্মৃতি আবার কখন মুছে যায়  

 অসম্ভব অভিমান খুন করে পরমা নারীকে  

 অথবা সে অস্ত্র তোলে নিজেরই বুকের দিকে  

 ঠিক যেন জন্মান্ধ তখন  

 সুন্দর লুকিয়ে থাকে মানুষের নিজেরই আড়ালে।। 

  



কথা আছে

বহুক্ষণ মুখোমুখি চুপচাপ, একবার চোখ তুলে সেতু  

 আবার আলাদা দৃষ্টি, টেবিলে রয়েছে শুয়ে  

 পুরোনো পত্রিকা  

 প্যান্টের নিচে চটি, ওপাশে শাড়ির পাড়ে  

 দুটি পা-ই ঢাকা  

 এপাশে বোতাম খোলা বুক, একদিন না-কামানো দাড়ি  

 ওপাশে এলো খোঁপা, ব্লাউজের নীচে কিছু  

 মসৃণ নগ্নতা  

 বাইরে পায়ের শব্দ, দূরে কাছে কারা যায়  

 কারা ফিরে আসে  

 বাতাস আসেনি আজ, রোদ গেছে বিদেশ ভ্রমণে।  

 আপাতত প্রকৃতির অনুকারী ওরা দুই মানুষ-মানুষী  

 দু‘খানি চেয়ারে স্তব্ধ, একজন জ্বলে সিগারেট  

 অন্যজন ঠোঁটে থেকে হাসিটুকু মুছেও মোছে না  

 আঙুলে চিকচিকে আংটি, চুলের কিনারে একটু ঘুম  

 ফের চোখ তুলে কিছু স্তব্ধতার বিনিময়,  

 সময় ভিখারী হয়ে ঘোরে  

 অথচ সময়ই জানে, কথা আছে, ঢের কথা আছে। 

  



নীরার পাশে তিনটা ছায়া

নীরা এবং নীরার পাশে তিনটি ছায়া  

 আমি ধনুকে তীর জুড়েছি, ছায়া তবুও এত বেহায়া  

 পাশ ছাড়ে না  

 এবার ছিলা সমুদ্যত, হানবো তীর ঝড়ের মতো–  

 নীরা দু’হাত তুলে বললো, ‘মা নিষাদ!  

 ওরা আমার বিষম চেনা!’  

 ঘূর্ণি ধুলোর সঙ্গে ওড়ে আমার বুক চাপা বিষাদ–  

 লঘু প্রকোপে হাসলো নীরা, সঙ্গে ছায়া-অভিমানীরা  

 ফেরানো তীর দৃষ্টি ছুঁয়ে মিলিয়ে গেল  

 নীরা জানে না! 

  




















একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন