শ্রীজাতের কবিতা সংগ্রহ



এর পরেও

 এর পরেও চুপ করে থাকা

এর পরেও সংযমী সময়
এর পরেও পতপত পতাকা
এর পরেও দৃঢ় কনভয়

এর পরেও সন্দেহ অতীত

এর পরেও চকচকে স্যালুট
এর পরেও লক্ষ্য শুধু জিত
এর পরেও বাহিনী মজুত

এর পরেও শব্দশালীনতা
এর পরেও স্তুতি আর স্তব
এর পরেও টক শো আর কথা
এর পরেও কবিতা উৎসব

এর পরেও বিশ্বাস, প্রণতি
এর পরেও ঘুম আসবে চোখে
এর পরেও বাকি আছে ক্ষতি
এর পরেও ভোট দেবে লোকে ।


বর্ষার চিঠি

সোনা, তোমায় সাহস করে লিখছি। জানি বকবে
প্রিপারেশন হয়নি কিচ্ছু। বসছি না পার্ট টুতে
মাথার মধ্যে হাজারখানেক লাইন ঘুরছে, লাইন
এক্ষুনি খুব ইচ্ছে করছে তোমার সঙ্গে শুতে

চুল কেটে ফেলেছ? নাকি লম্বা বিনুনিটাই
এপাশ ওপাশ সময় জানায় পেন্ডুলামের মতো
দেখতে পাচ্ছি স্কুলের পথে রেলওয়ে ক্রসিং-এ
ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছ শান্ত, অবনত

এখানে ঝড় হয়ে গেল কাল। জানলার কাচ ভেঙে
ছড়িয়ে পড়েছিল সবার নোংরা বিছানায়
তুলতে গিয়ে হাত কেটেছে। আমার না, অঞ্জনের
একেকজনের রক্ত আসে একেক ঝাপটায়

সবাই বলছে আজও নাকি দেদার হাঙ্গামা
বাসে আগুন, টিয়ার গ্যাস, দোকান ভাঙচুর
কিন্তু আমি কোনও আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না
বৃষ্টি এসে টিনের ছাদে বাজাচ্ছে সন্তুর…

ঝালা চলছে। ঘোড়া যেমন সমুদ্রে দৌড়য়
ভেতর-ভেতর পাগল, কিন্তু সংলাপে পোশাকি…
তুমিই উড়ান দিও, আমার ওড়ার গল্প শেষ
পালক বেচি, আমিও এখন এই শহরের পাখি


শেষ দিনঃ ২০০১

কোনওদিন তোকে বলাও হবে না জানি
আমি কোন-কোন সুড়ঙ্গে বেঁচে থাকি
কপ্টার থেকে ত্রাণের বদলে কারা
বিষ ছুড়েছিল… কলেজে-পালানো পাখি—

কোনওদিন তোকে বোঝানো যাবে না, কেন
কবিতায় আর বিশ্বাস থাকছে না
তার চে’ আমার নতুন চেহারা ভাল,
ফুটপাত থেকে দরদাম করে কেনা—

চাপিয়ে নিয়েছি। শহরের ধোঁয়াপথে
ভাঙা ভাঁড়ে লাথি মারতে-মারতে হাঁটি
চির অদৃশ্য গোলকিপারের দিকে
থুতু ছুঁড়ে দিই… ফিরে আসে… থুতু চাটি…

রোজ ভোরবেলা আয়নায় ক্রীতদাস
দাঁত মেজে যায়, বলতে পারি না কিছু
আমার শরীরে বসে থাকে সারাদিন
দুটো করে স্মৃতি খুলে দেয় মাথাপিছু

বিকেল হলেই মৃদু নার্সিংহোম…
ভাই আর্মিতে। যুদ্ধ লাগতে পারে।
নিয়তির কাছে গরীবের প্রার্থনা—
সব ক্ষত যেন বোরোলীন দিয়ে সারে

কোনওদিন তোকে দেখানো যাবে না তবু
চামড়ার নীচে রেডিয়ো অ্যাকটিভিটি
অথচ মগজে অতীতের ঠোঙাওয়ালা
বিজ্ঞাপনের পাতায় খুঁজছে চিঠি

নাকচোখমুখকান দিয়ে হু-হু করে
শরীরে তখন ঈশ্বর ঢুকছেন—
শীতের সন্ধে। আটটা সতেরো বাজে।
কলকাতা ছেড়ে উড়ে গেছে তোর প্লেন…



স্বপ্ন

বিকেলবেলা বাড়ি থাকাও পাপ
বাইরে হাওয়া, ঘরে নতুন টিউব
মাথায় বাজে একলা ডায়াল টোন

গ্যাসের দাম বাড়ছে, প্রেম নেই,
দুটো প্রাচীন টিউশানি হারালাম
তবু আমায় চিনছে এতজন…

একেকদিন বাড়ি ফেরার পথে
একেকদিন, সত্যি মনে হয়
আমি বোধহয়… আমি বোধহয় ক্লোন !

এখন আমার স্বপ্ন বলতে শুধু
পাড়ার ছোট ছেলেমেয়ের হাতে
নানা রঙের মুখোশ বিতরণ



ধর্ম

এখনও

এখনও আসে নতুন লেখা, মগজ থেকে শব্দ নামে ঠোঁটে
এখনও মাথাখারাপ, ঘোড়া দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছোটে

বাচ্চাদের গান শেখাই, ছাত্রপিছু দেড়শো টাকা মোটে
শুঁকে বেড়াই ঘরদুয়ার, কোথাও যদি কিছু একটা জোটে

এখনও পাড়া সাজানো হয়। সবাই মিলে ছুটি কাটায় ভোটে
কোনও হাতের ছাপ পড়ে না গান্ধীজির হাসিতে ভরা নোটে

এখনও জমে ক্রিকেট ম্যাচ, উত্তেজিত মানুষ নখ খোঁটে
ঘাড়ে রদ্দা পড়লে কথা বেরিয়ে যায় ভেদবমির চোটে

এখনও লোকে হাঁপায় আর টিকটিকিরা দেয়ালে মাথা কোটে
এখনও প্রেম জনপ্রিয়। এখনও টবে গোলাপফুল ফোটে…

তোমার কথা ভাবলে আজও পুরুষাঙ্গ শক্ত হয়ে ওঠে


, নইলে বেড়ে যায় সবরকম রোগই

ভিখ পেতে পেতে তুমি রাজা হয়ে ওঠো, গেঁয়ো যোগী।

উঠেই নির্দেশ দাও, ধর্মের তলব দিকে দিকে

মৃগয়ায় খুঁজে ফেরো অন্য কোনও ধর্মের নারীকে।

যে–হরিণ মৃত, তারও মাংসে তুমি চাও অধিকার

এমন রাজত্বে মৃত্যু সহজে তো হবে না তোমার।

বাতাসে হাপর নামে, দেশ জুড়ে অধর্মের ছাই...

প্রতি নির্বাচনে আমরা শতাব্দীপিছনে ফিরে যাই।

যেখানে পুরুষধর্ম ধর্ম-পুরুষের অন্য নাম

আর আমি নারীর মৃত্যু পার করেও শিকার হলাম।

আমাকে ধর্ষণ করবে যদ্দিন কবর থেকে তুলে –

কন্ডোম পরানো থাকবে, তোমার ওই ধর্মের ত্রিশূলে!


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন