অনুবাদ কবিতা সংগ্রহ

 ভাষান্তর ও প্রারম্ভিকাঃ আরিফুল ইসলাম ইমন

তাঁর জন্ম ১৯০৭ সালে, রাশিয়ার উকরেইন শহরে। ১৯২৩ সালে মস্কোতে চলে যান জার্নালিস্ট হিসেবে। এসময় তাঁর কিছু কবিতা প্রকাশ পায়। তবে, তখন তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ট অনুবাদক। হয়তো আনা আখমাতোভার কবিতাও তাঁকে এসময়ে প্রভাবিত করে। তুর্কেমেনী, আর্মেনিয়, এশিয়ান এবং আরবী ভাষী কবিদের কবিতা তিনি অনুবাদ করেন।

এরপর তিনি যোগদান করেন সোভিয়েত ইউনিয়ন আর্মি দলের পত্রবাহক হিসেবে। এসময় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। যুদ্ধ নিয়ে লেখা তাঁর কিছু বিখ্যাত কবিতা রয়েছে।

আমি মূলত তাঁর জীবনের শুরুর দিকের কিছু কবিতা অনুবাদ করি, যার সময় সীমা ১৯২৫ থেকে ১৯৪৫। অনেকেই বলে থাকেন তাঁর চূড়ান্ত সার্থক কবিতাগুলো প্রায় শেষ জীবনে লেখা। কিন্তু, আমার বিশ্বাস কোন কবির প্রথম জীবনের কবিতাগুলোতে এমন কিছু থাকে যার প্রেরনায় সে বাকি জীবন কবি হবার বাসনায় যাপন করেন। আমি তাঁর কবিতা অনুবাদ করে যা পেয়েছি তা হল ‘পিউর ইমেজ’। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্যঃ ‘মোমবাতি’, ‘একটি প্রতিকৃতি’ এবং ‘এই টেবিল সাঁজে সন্ধ্যা ছ’টা’। কখন হৃদয় থেকে সত্যিকারের কবিতা বের হয়? তিনি তার ডায়েরীতে লিখেছিলেনঃ

       “একজন পুরোপুরি সুখী মানুষ কবিতা লিখতে পারে না, আমার মনে আছে, তখন ১৯৫২। অনেক খারাপ সময়, আমার স্ত্রী অসুস্থ, আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, আমি কাওকে তার ধারে কাছে আসতে দিতাম না। আমি নিজেই তার খেয়াল নিতাম। আর তখনই আমি অনেকগুলো কবিতা লিখে ফেলি, খুব লিখি। যেসকল আধ্যাত্মিক অনুভূতি, যা ছিল- সব লেখাতে দিয়ে দিই।”

আর্সেনি তারকোভস্কি মারা যান ১৯৮৯ তে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এর ভাঙ্গনের আগ-মুহূর্তে। কিন্তু, রেখে যান অসমান্য কিছু কবিতা। তাঁর পুত্র আন্দ্রেই তারকোভস্কি তাঁর প্রায় সব মুভিতেই বাবার কবিতা ব্যবহার করেছেন।
প্রথম পাঠেই আর্সেনি তারকোভস্কির কবিতার প্রেমে পড়েছিলাম আমি। এরপর অন্তর্জালের আশীর্বাদে খুঁটিনাটি জেনেছি, রাশিয়ান জানিনা বলে ইংরেজীতে তর্জমা করা কিছু বইয়ে তাঁর কবিতা পড়েছি। অনুবাদে আমি স্বাধীনতা প্রচুর দিয়েছি বা নিয়েছি এরকমটা বললে ভুল হবে; আমি কবিকে অনুসরণ করেছি। তাঁর একটি কবিতার কিছু লাইন আমার তাঁর প্রতি সত্যিকারের  অনুভূতির প্রকাশ ঘটায়ঃ

       গ্রীষ্মকাল, যখন মাঠে গা এলিয়ে শুয়ে থাকো,
       এবং মাঝে মাঝে তাকাও ওই আকাশে,
       দেখবে মাথার উপর কড়া রৌদ্র-
       দোলনার মতো দোলে, এপাশ থেকে ওপাশে,
       পাবে অনুভূতির ঘ্রাণ, নবঃ নবঃ।



মোমবাতি (A Candle)


একটি হলুদ জিহ্বা জ্বলে মিটিমিটি,
মোম গলে যায় পরতে পরতে,
এভাবেই তো বেঁচে আছি, প্রিয়তমা তুমি এবং আমি-
আমাদের আত্মা দাউ দাউ করে জ্বলে, দেহটা ছাই হয়ে যায়।


প্রতিকৃতি (Portrait)

শূন্য এই ঘরে, আমি ছাড়া- দেয়ালে ঐ এক প্রতিকৃতি , এক বৃদ্ধ মহিলার।
মাছি,
মাছি,
মাছি, উড়ে আসে- বৃদ্ধ মহিলার অন্ধ চোখে,
আমি শুধাই তাদের- ‘পাও কি মজা, গ্লাসের ভিতর, স্বর্গ তোমার?
একটি মাছি টপকে এল তার গালে।

মহিলাটি বলে- ‘একলা এই ঘরে বসে,- পাও কি মজা একা থেকে?’


সন্ধ্য ছ’টায় এই টেবিল সাজানো হয়  ( The table is set for six)

সন্ধ্যা ছ’টায় এই টেবিল সাজানো হয়,
হরেক গোলাপ এবং কাঁচের পেয়ালায়,
আমার অতিথিরা এলে- সব দুঃখ, হতাশা মিলায়।

প্রথমেই এল আমার বাবা,
এরপর এল আমার ভাই,
কাটাতে এই ঘণ্টাগুলো, এই সময়।
তারপর দরজায় দিল টোকা, আরেকজন-

তার হাত ছুঁয়ে দেখি, ঠিক বারো বছর আগের মতোই,
হিম শীতলা,
আর তার সূতোয় বোনা আদিকালের জামা,
এখনো ফ্যাশনদুরস্ত।

রাত ঘনিয়ে এলে মদেরা গেয়ে উঠে,
মৃদু কম্পনে বাজে পেয়ালা,
“কত, কত ভালোবেসেছি তোমায়,
কত শৈত্য মৌসুমের আগে”

আমার বাবা তাকিয়ে হাসবে আমার দিকে,
পেয়ালায় ঢালবে আরেকটু মদ ,আমার ভাই।
আর মহিলাটির আংটিহীন হাত, থাকবে আমার হাতে,
আর মহিলাটি গাইবে-

“আজ এই পা দুটো, পৃথিবীর ধূলোয়-
মিশে আছে একাকার,
চুলের বিনুনি আজ খোলা,
পৃথিবীর অতল থেকে-
শুনবে আজ আমাদের কথা”


গতকাল তোমার আসবার কথা ছিল (Yesterday morning I began waiting for you)

গতকাল তোমার আসবার কথা ছিল,
সকাল থেকেই ছিলাম অপেক্ষায়, যতক্ষণ না রাত এল।
কিন্তু কিভাবে যেন তারা জেনে গেল- তুমি আজ আসবে না।
মনে আছে উৎসবের আবহাওয়া?
আমি মোটা জামা না পড়েই বাসা থেকে বেরুলাম,
বাইরে দাঁড়িয়ে করছিলাম অপেক্ষা।

আজ তুমি এলে, কিন্তু দেখো- কি দিন আজ!
তারাই করেছে এসব।
মনমরা, বৃষ্টি ঝরছে সকাল থেকে।

অনেক দেরি হল -এখনো বৃষ্টি, কালো কালো বাদল।

ডালে ডালে কঞ্চিতে নুইয়ে পড়ে বৃষ্টির ফোঁটা।

কোন কথাই আজ পারবে না থামাতে এদের, পারবে না কোন হাত ধুইয়ে সাফ করে দিতে এইসব।


একদা এখানে এক বাড়ি ছিল (Here, a house once stood. Inside, some old man)

এখানেই ছিল এক বসতবাড়ি, থাকত এক দাদু কিছু বাল-বাচ্চা নিয়ে, আজ এই ভিটে বাড়িটি হারালো।

একশ কেজি বারুদের বোমা মাটিকে করে দিলো কালোর থেকেও নিকষ কালো।
একটি বাড়ি, এখন কোথাও নেই, এই যুদ্ধ- আর কত দেখাবে তামাশা?

গাদ করা ছেঁড়া জামাকাপড়ের উপরে একটি ধান রাখবার হাড়ি এবং জামা রাখবার তোষাখানা।  অদূরেই একটি ঘোড়া, তার উপরে বয়ে চলে শীতাকুন্ড ঝর্ণা।

এই বাড়ির ভাঙা দেয়ালের সামনেই কিছু পাতিহাঁসের পায়ের ছোপ, সেখান থেকে জন্ম নিবে কিছু আগাছা।
তাদেরকে ছাড়াই হতভাগ্য যুদ্ধের ভূত এইখানেই ঘর তুলবে।

কে গোঙাবে রাত্রিবেলা আর? আর কে ধরাবে চুলায় আগুন? দুই আঙ্গুলের মাঝে আর কে বাজাবে বাঁশি?

 

ক্রিস্টপোলের নোটবুক (Christopol Notebook)

খারাপ তকদিরের দাসত্বে বনেছিলাম- কমজোর,
ঠুনকো এবং শক্তপোক্ত।
গতবার তুমি যখন বলেছিলে বেঁচে থাকার কথা,
সেটা বেঁচে থাকা নয়, সে এমন এক পীড়া, যা শুধু যন্ত্রনার হূল ফোঁটায়।

নবীর অঙ্গীকারবদ্ধ চিৎকার পারবে না জোড়া লাগাতে এই পৃথিবীর ছেড়া অংশ,
কি লাভ, দুলিয়ে ব্রেসলেট কিংবা চোখের জল?
যখন কানের পাশ দিয়ে যায় কবরের গন্ধ?

নিয়তির এই যুদ্ধ,  যুদ্ধের তান্ডবে- ওয়াদা সব টুটলো, 
সব জবান গেল জলে,
হায়, তুমি এক ক্ষণিকের মানুষ, আমি অমর না,

আর কিছুই নেই, না একটি ঘর না শান্তি,
নক্ষত্রহীন নরকে নাই দেবদূতের সাওয়ার,
এবং আমি একা, এই পুরো ব্রহ্মাণ্ডে আমি একা।

 

শরণার্থী (Refugee)

কিছু নুন দিলে খেতে আর নিতে এই পুরো অভিযানে,
যখন ঢেলে দিলে এত নুন রাস্তায়, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল,
হায়, পবিত্র শীতকাল, কামদেবতা, তুমি জ্বলে উঠো আলোর মতো,
আমি একা, শীতকালীন মাঠের ঘূর্ণির মতো।

বদমেজাজী তোমরা।
ও মা, একটু খেতে দাও, রুটির কিছু টুকরো দাও,
বাকি সব তুষারকণায় ঢেকে আছে,
আমার অনেক ক্ষিদে পেয়েছে, আমার ব্যাগ অনেক ভারী,
দাও দুঃখ এই সর্বনাশের দরুন।

আমার পায়ে এসব বরফ যন্ত্রনা দিচ্ছে,
আমাকে বা কার চাই, আমি যে শরণার্থী,
তোমাদের কি আসে যায়, আমি মরি বা বাঁচি?


যদি হতাম আগের সেই দর্পভরা অহংকারী ( If I were the arrogant man I once was)

যদি হতাম-আগের মতোই দর্প ভরা অহংকারী, তবে ছেড়ে যেতাম তোমাকে তৎক্ষণাৎ। হারাবার যা ছিল না তাকেই জানাতাম আল্লাহ হাফেজ । শুধু শুধু কষ্ট পেয়েছি, যেটার
কোন মানেই ছিল না।

সব কিছুকেই জানাতাম বিদায়

আমি শুধিয়ে বলব- যাও যাও, পাকড়াও করো একশটা ‘কসম’ তার, একশটা উৎসব। একশটা কথা তার। যাও যাও….

সব ছেড়ে দিতাম ঠান্ডা ঊষাকালে, ধীরে চলতি শত ঠেলাগাড়ি, শত বৃষ্টির ফোঁটা অলিগলিতে, একশটা সড়ক, একশটা বৃষ্টির ফোঁটা যা ভাগছে তোমার দিকে।


খসড়া (Manuscript)

বইটি পড়া শেষ, এখনো খোলা তার শেষ চ্যাপ্টার,
আমি ঘুণাক্ষরেও তাকাবো না সেদিকে।
যখন আত্মা খোলাসা হয়েছে চামড়া ছিঁড়ে-
কিছু লাইনের মাঝে দগ্ধ আমার ভাগ্য-ললাট।

এভাবেই বড়লোকের ছেলেরা খুলে ফেলে- আলখাল্লা,
এভাবেই নবীরা দিয়ে থাকে অভিশাপ এবং আশীর্বাদ-
সমুদ্রের লবণ এবং মর্ত্যের ধূলিকণাকে, আর-
দেবদূতকে ছুড়ে দেয় চ্যালেঞ্জ কুস্তিগিরিতে!
আমি এই পরমায়ুতে, আমি না, অন্য কেও,
আমি সংগীত শুনি, গান গাই সকলের সাথে।

মানুষ এবং পাখির বংশের সামান্য বিজ্ঞানী আমি।
তাদের অদ্য যোগাযোগের ব্যাকরণবিদ আমি,
এই মর্ত্যের আলাপ ছেড়ে আমি উঠব না সহজে।


কানা লোকটি যাচ্ছে ট্রেনে চড়ে (A blind man was riding an unheated train)

কানা এক লোক যাচ্ছে ট্রেনে চেপে-
বাড়ি ফেরার নামে সাথে তার কপাল নিয়ে,

হায় কানা, ভাগ্য তোর সাথে ছিল রে,
তোমার কি ভয় অন্ধত্বের দাবিতে কিংবা যুদ্ধের তান্ডবে,

এক মহিলা বলে যাচ্ছে এসব, ‘যা হয়েছে ভালো হয়েছে
কানা আর গরীব না হলে যুদ্ধে তারা মেরেই ফেলত তোমাকে,

ভেবো না, ওই জার্মানি শালারা তোমাকে আর মারবে না, তুমি অন্ধ বটে, তাদের কাছে
মামুলি!
দাও, তোমার কাঁধের ব্যাগ টা আমি ধরি’

কানা লোকটা বাড়ি যাচ্ছে তার কি কপাল!

কানা হওয়াতেই তার এখন সুখ, ঈশ্বর তোমাকে ধন্যবাদ।



আনা আখমাতোভার দুটি কবিতা

ভাষান্তর: রিয়া রিয়া

14877007_1730053010653270_297597334_n.jpg
রিয়া রিয়া: ১৯৭৭। কবি, গদ্যশিল্পী ও চিত্রকর। দীর্ঘদিন লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। বহু পত্রপত্রিকায় লিখেছেন। অনুবাদ তাঁর একটি অন্যতম প্যাশন।


স্ফটিকের মতো

অন্ধকার, শীতল কূপের গভীরে
যেমন একটি স্ফটিক জ্বলজ্বল করে,
আমার মনেও একটি গভীর স্মৃতির ছায়া
আজও প্রজ্জ্বলিত –
যাকে আমি মুছতে চাইনা, মুছতে পারিনা।

আমি মনেকরি, কেউ একজন
আমার চোখের গভীরে তাকিয়ে
আমার মনকে পড়বে।
তাঁর চিন্তাকেও দুঃখ গ্রাস করবে
যেন সে কোনো শোকগাঁথা শুনছে।

আমি জানি, ভীষণ রাগে, ঈশ্বর
মানুষের পরিবর্তন করেছিলেন;
কিন্তু তিনি তাদের আবেগ, অনুভূতির
পরিবর্তন করেননি,
তাদের কষ্টের দিনগুলো মনে
জীবন্ত রাখার জন্য।

আমার স্মৃতির ভেতরে কিন্তু
তুমিই আমাতে পরিবর্তিত হয়েছ,
আমার স্বর্গীয় দুঃখগুলোকে
অবিনশ্বর রাখতে।

মৃত্যু তোমাকে

একসময় না একসময় তুমি
গ্রহণ করবে আমায় –
এখনি নয় কেন?

তোমারই প্রতিক্ষায় আছি –
সহ্যের সব বাঁধ ভেঙেছে,
অন্ধকারে, দরজা খুলে রেখেছি।
সাথে এনো যন্ত্রণা উপশমের
আশ্চর্য কোনো যাদুকরী মলম।
যদি কোন মন ভোলানো ছদ্মবেশ ধরতে হয়,
তবে ছদ্মবেশেই এসো।
দস্যুর মতো বুকে বিঁধে দিতে চাও বিষাক্ত তীর,
যদি মারণব্যাধির জীবাণু রূপ নিতে চাও,
সে ভাবেই এসো।

না হয় এসো একটা বিভৎস গল্পের মতো
যার সমাপ্তি সবার জানা।
নীল টুপি পরা পুলিশের মাঝখানে
গৃহস্বামীর বিবর্ণ মুখ।
এইসব আমার সহ্যের মধ্যে।
ফুলে ওঠে এস্নেই নদীর জল,
আকাশে প্রজ্জ্বলিত ধ্রুবতারা,
প্রিয়জনের নীল চোখের আলোয়
মুছে দেয় আতঙ্ক আর ভয়।




ইয়েটসের বাছাই পাঁচ | ভাষান্তর: কালপুরুষ

11007729_349381285249290_6539297826710954116_n
কালপুরুষ: কবি। প্রকাশিত কবিতার বই- এই শহরে রাজহাঁস নিষিদ্ধ (২০১৫), রোহিণীর জন্য একটি রাষ্ট্র (২০১৬)।


দ্বিতীয় আগমন

ক্রমেই ঘুরে চলে বাজ নিজের বলয়ে
যতক্ষণ না শুনতে পায় শিকারির চিৎকার
সবকিছু ভেঙে পড়ে, কেন্দ্রভূত থাকে না;
পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে নৈরাজ্য
শোণিতধারার বাঁধ ভেঙে যায়
পবিত্রতার উৎসব ডুবে যায় চারপাশ নিমিষে
বিশ্বাস হারায় শ্রেষ্ঠরা আর
প্রবল আতিশয্যে শাসন করে নিকৃষ্ট।

খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে সত্য,
নিশ্চিতভাবেই দ্বিতীয়াগমন আসন্ন।
দ্বিতীয় আগমন! উচ্চারিত হতেই
পৃথিবীর ভীষণ আত্মা এক সিংহ ও মানুষের মাথার রূপ নিয়ে
চোখ ধাঁধিয়ে বেরিয়ে আসে
মরুভূমির উষ্ণ বালির প্রান্তর জুড়ে

বিহ্বল শূন্য দৃষ্টি, সূর্যের মতো নির্দয়;
ঊরুসমূহ প্রসারিত কোরে ধীরে টেনে নিয়ে চলছে,
যখন চারিদিকে ক্ষুব্ধ মরুপাখির
ডানার ছায়া চক্রাকারে ঘুরছে;
অন্ধকার নামলো আবার, আমি জানি তবু
দীর্ঘ এই বিশ শতাব্দীর গভীর ঘুমও ক্লান্ত আজ
দেখে দুঃস্বপ্নে এ অলৌকিক ঘূর্ণন
এবং এই যে অদ্ভুত জন্তুটা, হয়ে এলো সময় যার
শ্রান্ত চলছে বেথলেহেমে, জন্ম নিতে তাঁর?

পৃথিবী সৃষ্টির আগে

যদি চোখের পাপড়িকে আরও গাঢ় কোরে তুলি
চোখেদের কোরে তুলি উজ্জ্বল ভীষণ
আর অধর দু’টি কোরে রাখি রঙিন খুব,
এবং আয়নার পর আয়নাকে জিজ্ঞেস কোরে যাই—
“সব কিছু ঠিক আছে তো?”
সে আমার অহমিকা নয় রূপের
আমি তো খুঁজছি কেবল সে মুখ
যে মুখ ছিলো আমার
এই পৃথিবী সৃষ্টির আগে;

তাকাই যদি কোনো পুরুষের দিকে এমনকি
হয়ও যদি সে প্রেমিক আমার,
তখনও আমার রক্ত উষ্ণ যদি না হয়,
আর আত্মা হয়ে থাকে পাথরের মতো নিথর?
তার কি উচিৎ আমায় নিষ্ঠুর ভেবে নেয়া,
অথবা প্রতারিত করছি তাকে?
আমি তো চেয়েছি বরং সে ভালোবাসুক
যে ছিলো পৃথিবী সৃষ্টির আগে।

দীর্ঘ নীরবতার পর

দীর্ঘ নীরবতার পর আবার কথা হলো; আর এটাই সত্যি—
সকল প্রেমিকই ছেড়ে গ্যাছে অথবা আজ তারা মৃত,
মৃদু প্রদীপশিখা নিজস্ব ছায়ার ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে,
এবং কাফনে আবৃত যেন ক্লান্ত রাতটির মুখ;

এটাই সঠিক সময় যখন আমরা আলোচনা করতে পারি
শিল্প আর সঙ্গীতের মহৎ দিকগুলো নিয়ে:
শরীরের জরাগ্রস্ততার সেই জ্ঞান; আর যখন যুবক ছিলাম
যখন আমরা ভালোবেসে গেছি দু’জন দু’জনকে, সকল মৃত্যুকে উপেক্ষা কোরে।

ইনিস্ফ্রির এক দ্বীপে

এখুনি জেগে উঠবো আমি, চলে যাবো আমি;
চলে যাবো ইনিস্ফ্রি;
এক বানাবো কুটির মাটি ও বাঁশ দিয়ে
শিম গাছের নয়টি সারি আর মৌমাছির জন্য এক ঘর
ভ্রমরের গানে অতপরঃ একা অরণ্যযাপন

সেখানে আমি সৃষ্টি কোরবো কিছু শান্তি
আর কিছু শান্তি ধীরে নেমে আসবে
অবগুণ্ঠিত ভোর হতে যেখানে ঝিঁঝিঁরা ডেকে যায়
যেখানে মধ্যরাত ক্ষীণ জ্বলে, বেগুনি আলোয় রাঙে দুপুর;
সন্ধ্যে ভরে ওঠে লিনেটের ডানার চিৎকারে।

এখুনি জেগে উঠে চলে যাবো আমি, চিরকালের জন্য;
শুনতে পাবো তীরবর্তী জলের মৃদু গল্পের স্বর
যখন দাঁড়াবো কোনো পথে কিনারে অথবা ধূসর
পা’য়ে চলা পথে;— পাবো টের
হৃদয়ের অনেক গভীর উৎসের

রক্ত ও তেল

সমাধি, যা বানানো হয়েছে স্বর্ণ এবং নীলকান্তমনি পাথর দ্বারা
মানব-মানবীর পবিত্র দেহ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে
বেগুনী গন্ধের অলৌকিক তেল

কিন্তু পদদলিত মাটির নিচে শায়িত রয়েছে
রক্তপূর্ণ ভ্যাম্পায়ারদের শরীর;
তাদের কাফন রক্তাক্ত ও ঠোঁটগুলো সিক্ত।



ডব্লিউ বি ইয়েটসের আটটি কবিতা | ভাষান্তর: মেহেরাব ইফতি

যখন তুমি বুড়ো
When You Are Old

যখন তুমি জীর্ণ এবং ধূসর ঘুমে পরিপূর্ণ,
এই আগুনের পাশে অল্প সময়ের জন্য,
বইটা হাতে ধরো,
এবং
ধীরে ধীরে পড়ো,
যে কোমল সুরৎ (বর্ণ) স্বপ্ন দেখো তুমি-
উপচে পড়েছিল চোখ থেকে চুমি,
অতঃপর, তাদের প্রতিচ্ছায়াও গভীর;

কতলোক আহ্লাদের চটুলতায় ভেসে গিয়ে ভালোবাসতো তোমাকে,
সত্যের মিথ্যার সাথে মিথ্যার কপট সততায়-
ভালোবাসতো স্রেফ তোমার রূপকে,
কিন্তু একজন, তোমার নবাগত আত্মাকে তীর্থযাত্রী রূপে
ভালোবাসায় লিপ্ত,
তোমার মুখের বাঁকে বাঁকে যে দুঃখ (যা আমারও অচেনা)-
তাকেও ভালোবাসতো নির্লিপ্ত;

প্রদীপ্ত কারাগারের পাশে নুয়ে পড়া গুঞ্জন,
ফ্যাসাদ, একটু দুঃসময়, (যাই-হোক) পালিয়ে গেলো প্রেম
উদ্ভাসিত পর্বতে
এবং
তারার ভিড়ে সে তাঁর মুখ লুকালো।

মাতাল পদ্য
A Drinking Song

এবং গলায় মাল ঢালা অবস্থায়
ভালোবাসা জেগে উঠে চোখ টাটায়;
এই-
যাকে আমরা সত্য বলে জানি
বুড়ো হাবড়া হয়ে টেঁসানো পর্যন্ত মানি।
আর আমি যখন গেলাস তুলে ধরি
এবং তোমার দিকে তাকাই
কিন্তু সেখানে কোন ভালোবাসা নাই…(দীর্ঘশ্বাস)।

একটি গাঢ় প্রতিশ্রুতি
A Deep-sworn Vow

অধিকন্তু, তোমরা যে ওয়াদা পালনে ব্যর্থ
সে নিগুঢ় প্রতিশ্রুতি আমার জীবন সহচর;
অথচ, মৃত্যুর ছাপ দেখি ক্রমাগত
নিদ্রালু স্বপ্নে হামাগুড়ি রত,
অথবা ওয়াইনে হই যখন চুর,
কেনো জানি তোমাদের চেহারাই ভেসে আসে-
দূর থেকে বহুদূর।

পলিটিক্স
Politics

‘আমাদের এ সময়ে রাজনৈতিক শর্তাবলিই ঠিক করে মানুষের নিয়তি’
–টমাস মান

ক্যামন করে আমি জানবো, অই মেয়েটি রয়েছে দাঁড়িয়ে,
আমার মনোনিবেশ ছিল ঠিক
রোমান, রুশ অথবা স্প্যানিশ পলিটিক্সের দিক,
অথচ, এখানে এক দার্শনিক
যে জানে
যা বলেছে তার মানে,
এবং সেখানে এক রাজনৈতিক দূত
যিনি (উভয়) জ্ঞান ও চিন্তায় অগ্রদূত,
সম্ভবত তাঁরা যা বলে সঠিক
যুদ্ধ এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত অশনি দিক,
কিন্তু, ওহ! আমি যদি তরুণ হতাম
এবং, মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরতাম।

অ্যানা গ্রেগরীকে
For Anne Gregory

‘এমন যুবককে ভালোবেসো না,
যে মরিয়া তোমার সোনালী চুলের প্রতি
কুন্তল লতিকা বেয়ে নেমে আসা স্বর্ণোজ্বল ঢেউ…আহা! মস্তক অবনতি।
যে তোমাকে ভালোবাসে স্রেফ তোমার জন্য
রেশমি সোনালী চুল কিংবা বাকি সব গৌণ
এমন যুবককে চাও।’

‘কিন্তু, আমি একটা হেয়ার-ড্রাই কিনেছি,
বাদামি, কালো কিংবা কমলা কোরেছি,
তবুও অই যুবক মরিয়া-
আমাকে ভালোবাসে স্রেফ আমার জন্য
রেশমি সোনালী চুল কিংবা বাকি সব গৌণ।’

‘আমি এক ধর্মভীরু বুড়ো’র কাছ থেকে, জেনেছি হে প্রিয়
গতকাল রাতে যে ঘোষণা সে দিল, তাও শুনে নিও
তাঁর কাছে নাকি কোন পুঁথি আছে, প্রমাণের জন্য
একমাত্র স্রষ্টাই নাকি ভালোবাসতে পারে তোমাকে, স্রেফ ভালোবাসার জন্য
রেশমি সোনালী চুল কিংবা বাকি সব গৌণ।’

অই মহতী দিনে
THE GREAT DAY

বিপ্লব বলে উল্লাসে ফেটে যান এবং ইচ্ছে মতো তোপ দাগান!
এক অধম পায়ে হেঁটে চলে, আরেকজন ঘোড়া সাথে
অধমের তরে চাবুক দাগায়, নিষ্ঠুর কশাঘাতে।
বিপ্লব বলে উৎফুল্লে ফেটে যান এবং পুনঃপুন নগ্ন- তোপ দাগান!
যদিও অধমের ভাগ্য বদলে যায়,
তবুও চাবুকের তোপ হয় না সহায়।

পার্নেল
PARNELL

পার্নেল রাস্তায় নেমে এলেন, এক খোশামুদি উৎফুল্ল
লোককে বললেনঃ
‘আয়ারল্যান্ড স্বাধীনতা পাবে
তবুও তুমি অনবরত সংযত পাথরই ভাঙ্গবে।’

বিনষ্ট খতিয়ান
WHAT WAS LOST

এক রণক্ষেত্র থেকে আরেক রণাঙ্গনে হেঁটে যাই
গেয়ে উঠি গান;
সন্ত্রস্ত হয়ে করি লাভের সন্ধান,
ক্ষতির হিসাবের জের ধরে টান,
পথভ্রষ্ট রাজা আমার, এবং পথচ্যুত ব্যর্থ সিপাহী বেশুমার;
এবং,
তারা সম্বিত ফিরে পায় সবসময়,
পথভ্রষ্ট আরাধনায় লিপ্ত চরণযুগল যখন বাধাপ্রাপ্ত হয়।


মেহেরাব ইফতিমেহেরাব ইফতি: কবি ও প্রাবন্ধিক। 


জালালুদ্দিন রুমির কবিতা | ভাষান্তর : ফাতিন আরেফিন


স্থিরতা

মৃত হও, নতুন এই ভালোবাসা— মৃত হও এর অভ্যন্তরে—
তোমার যে পথ, তার শুরু— ঠিক এর অন্যপাশে।

বিস্তৃত আকাশ হও তুমি—
কুঠারে আঘাত হানো কারাগার দেয়ালে
—পালাও, মুক্ত হও—
বেড়িয়ে পড়ো অসীমে,
বেড়িয়ে পড়ো এমন, যেনো কেউ মাত্রই জন্ম নিয়েছে হটাত রঙে
জলদি, এক্ষুনি!
—ঘন মেঘাবৃত তুমি—
সরে পড়ো অন্যপাশে— মৃত হও এবং স্থির…
স্থিরতা একটি নিশ্চিত নিদর্শন যে তুমি মারা গ্যাছো—
তোমার অতীত জীবন যা ছিলো নিরবতা থেকে এক ক্ষিপ্র দৌড়;

আশ্চর্য-নির্বাক করা পূর্ণিমার চাঁদ দ্যাখো— বেরিয়ে এসেছে এখন!

অতিথিশালা

এই মানবসত্তা একটা অতিথি ঘর—
প্রতি সকালেই একজন নতুন মেহমান।

একজন সুখ, একজন হতাশা, একজন ক্ষুদ্রতা,
অপ্রত্যাশিত অতিথি হয়ে আসেন—
ক্ষণস্থায়ী কজন সচেতনতা…

স্বাগত জানাও এবং আপ্যায়িত করো তাদের সবাইকে
—তা যদি এক দঙ্গল দুকখোও হয়,
যা ঠেলে সরায় গৃহের সকল আসবাব সহিংসভাবে,
এরপরও, আন্তরিকচিত্তে গ্রহণ করো সবাইকে—
হয়তো সে তোমাকে পরিষ্কৃত করছে জেনো,
নতুন কিছু আনন্দআগমন উপলক্ষে।

অন্ধকার আশংকা, অপমান, আক্রোশ, ঘৃণা— সবকিছু,
হাসিমুখে এগিয়ে নাও দরোজায়
এবং আমন্ত্রণ জানাও গৃহের ভেতরে।

যেই আসুক না ক্যানো— কৃতজ্ঞ হও,
কারণ এক উপদেষ্টা হিসেবে ঘরে
প্রত্যেককেই পাঠানো হয়েছে অর্ন্তলোক থেকে।

আমি কি বলিনি তোমায়!

আমি কি বলিনি তোমায়—
ছেড়ে যেও না আমায় কখনো,
একমাত্র বন্ধু তো কেবল আমিই—
আমিই চিরবসন্ত জীবনের…

শত-সহস্র বছরও যদি আমাকে ঢেলে
দূরে থাকো তুমি ক্রুদ্ধ রিদয়ে,
তবুও ফিরবে তুমি, ফিরে আসতেই হবে তোমায়—
ক্যানোনা আমিই তোমার গন্তব্য, আমিই তোমার শেষ…

আমি কি বলিনি তোমায়—
মোহে পরো না রঙিন পৃথিবীর,
যেহেতু আমিই সবার সেরা— চিত্রশিল্পী সর্বশ্রেষ্ঠ!

আমি কি বলিনি তোমায়—
তুমি মাছ— যেও না কখনো ঐ শুষ্কভূমিতে
যেহেতু সবচেয়ে গভীর— আমিই সমুদ্র— তোমার জন্য যথেষ্ট!

আমি কি বলিনি তোমায়—
ঝালে আটকে পোরো না পাখিদের মতো
কেনোনা আমিই তোমার ডানা— আলোর শক্তি সঞ্চালক…

আমি কি বলিনি তোমায়—
ওদেরকে ব্যর্থ করো তোমাকে বরফে পরিণত করতে,
যেহেতু, আমিই আলোর শিখা, তোমার যথেষ্ঠতম উষ্ণতা

আমি কি বলিনি তোমায়—
ওরা দূষিত করবে তোমাকে এবং বাধ্য করবে ভুলে যেতে,
আর জেনো— আমিই বসন্ত সর্বগুণের…

আমি কি বলিনি তোমায়—
প্রশ্ন করো না আমার প্রক্রিয়া নিয়ে
কারণ, সবকিছুই নির্দেশিত এবং আমিই এর স্রষ্টা…

আমি কি বলিনি তোমায়—
তোমার রিদয় তোমাকে গৃহে ফিরিয়ে নেবে
কারন সে জানে, আমিই তার প্রভু!

কেবলমাত্রই নিঃশ্বাস

না খ্রিস্টান, ইহুদী— না মুসলিম
না হিন্দু, বৌদ্ধ, সূফী— অথবা জেন

কোন ধর্ম কিংবা সাংস্কৃতিক রীতি থেকে নয়

আমি আসিনি প্রাচ্য থেকে, আসিনি পাশ্চাত্য থেকে
আসিনি সমুদ্রের অভ্যন্তর কিংবা মাটির উপর থেকে

না আমি প্রাকৃতিক, না অলৌকিক—
কোন উপাদানেই তৈরি না,
আমি অস্তিত্বশীল সত্তা নই—
না এই পৃথিবীর, না এর পরের
প্রেরিত হয়নি আদম এবং হাওয়া
অথবা অন্য কোন উৎপত্তি ইতিহাস থেকে

আমার অবস্থান— অবস্থানহীন, আমার গমনপথ— পথচিহ্নহীন
না দেহে না আত্মায়

আমি সংযুক্ত আমার প্রিয়তমের সাথে, যেখানে দেখেছি দুইটি পৃথিবী
একটি হিসেবে, যা ইঙ্গিত দেয় এবং জানায়—

প্রথম, শেষ, ভেতর, বাহির—
এই নিঃশ্বাসটুকুর আশ্রয়ে কেবল মানুষ।

গল্প এবং জল

একটা গল্প হলো পানির মতো, যা তুমি
উত্তপ্ত করো গোসলের জন্য।

এটা ধারণ করে তোমার ত্বক ও আগুণের মধ্যবর্তী সংবাদ,
সাক্ষাত ঘটায় উভয়ের এবং পরিষ্কার করে দেহকে।

কেবল অল্প সংখ্যকই পারে বিশ্রাম নিতে আগুণে—
ইব্রাহিম কিংবা স্যালমান্ডারের মতো
যেক্ষেত্রে আমাদের  প্রয়োজন কোন মধ্যস্ততাকারীর।

স¤পূর্নতার অনুভ’তি আসে—
কিন্তু তা সচরাচর আনতে প্রয়োজন অর্থের…

যদিও বা সৌন্দর্য আমাদের ঘিরে আছে
কিন্তু তা জানতে আমদের  যেতে হয় বাগানে

দেহ নিজেই একটা আবরক
এবং তা তোমার অস্তিত্বের ভেতরে প্রজ্বলিত আলোর
সামান্যই প্রকাশ করে বাইরে।

পানি, গল্প, দেহ, আমাদের করা সমস্তকিছু
এক একটি ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যম
যা অজ্ঞাতকে গোপন করে আবার করে প্রকাশ।

অধ্যয়ন করো এসব
এবং উপভোগ করো একে যা একটি রহস্য নিয়ে মুছে যায়
কখনো আমরা তা জানি, অতপর, একটু পরেই তা জানি না।

লহুতে মিশে আছে নৃত্য—১

আমাদের মধ্যে একটি গোপন আবর্তন
আবর্তিত করায় মহাবিশ্বকে,
শির অনবহিত পায়ের
পা অনবহিত শিরের;
কেউই তত্ত্বাবধায়ক নয় কারো—

কেবল তারা ঘুরেই চলে শুধু…

যখন আমি মারা যাই

যখন আমি মারা যাই
যখন আমাকে কফিনে আটকে নাও,
কখনোই মনে করো না তুমি—
এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছি আমি

চোখের জল ফেলো না কোন
কোরো না আর্তনাদ কিংবা অনুভব দুঃখ—
আমি পতিত হচ্ছি না কোন দানবের নরকে

যখন আমার লাশ বহিত হয়
আমার চলে যাওয়ায় অশ্র“ ফেলো না
আমি ছেড়ে যাচ্ছি না,
আমি পৌঁছে যাচ্ছি— শাশ্বত ভালোবাসায়

আমাকে যখন কবরে ছেড়ে যাও
বিদায় বোলো না তুমি
কবর তো কেবল একটি পর্দা, যার পেছনে অনন্ত স্বর্গোদ্যান

আমাকে তো দেখবে শুধু কবরে নামাতে
এখন দ্যাখো উঠে আসতে
কিভাবে শেষ হতে পারে ওখানে
যখন সূর্য অস্তমিত হয় অথবা চাঁদ ডুবে যায়

এটা দেখে মনে হয় শেষ
যা অনেকটা সূর্যাস্তের মতো
কিন্তু বাস্তবে, এটা কেবলই নিুগামী হওয়া
তোমাকে যখন কবরে আটকে দেয়া হয়
এটা সেই মুহুর্ত, যখন তোমার আত্মার চির স্বাধীন
তুমি কি দেখেছো কখনো—
পৃথিবীতে বপিত হয়েছে একটা বীজ
যেটা জেগে ওঠেনি নতুন এক জীবন নিয়ে,
ক্যানো তুমি একটা মানুষ নামের বীজের উঠে আসাতে সন্দেহ করবে!

তুমি কি দেখেছো কখনো
ক’পে নোয়ানো কোন বালতি
ফিেের এসেছে খালি,
ক্যানো একটা আত্মার জন্য বিলাপ করো
যদি তা ফিরে আসতে পারে আবার
যেভাবে ইউসুফ ফিরে এসেছে ক’প থেকে!

যখন শেষবারের মতো তুমি
তোমার মুখ বন্ধ করো,
তোমার শব্দ এবং আত্মা
এমন এক জগতে যুক্ত হবে—
যেখানে নেই কোন সময়,  যার নেই কোন ঠিকানা


বিশ্বকবিতা নির্বাচিত অনুবাদ গ্রন্থ থেকে একগুচ্ছ

আশরাফ ফায়াদ

পৃথিবীই হচ্ছে সেই নরক যা শরণার্থীদের জন্য তৈরি


দারিদ্রের নিদর্শন রেখে যাওয়া ছাড়া খনিজ তেল তেমন কোনো ক্ষতি করে না
সেইদিন, যখন আর একটি তেলকূপ খুঁজে পেয়ে আঁধারে তাদের মুখ আচ্ছন্ন হয়েছিলো,
যখন জীবন আপনার হৃদপিণ্ডকে ক্লান্ত কোরে তুলেছিলো,
আপনার আত্মা হতে আরো বেশি তেল টেনে বের করার লক্ষ্যে,
জনগণের কল্যাণে…

সেটাই হলো তেলের প্রতিশ্রুতি, একটি প্রকৃত প্রতিশ্রুতি
এবং শেষ


বলা হয়েছিলো: বসতি স্থাপন করুন
কিন্তু আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা সকলের জন্য ক্ষতিকর
সুতরাং এটা স্থগিত থাক

নদীর গভীর হতে নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখুন
যারা উপরে অবস্থান করছেন, তাদের উচিৎ কিছু করুণা প্রদর্শন করা নিচে অবস্থানকারীদের প্রতি

গৃহচ্যুত মানুষেরা অসহায়—
এতটাই যে, তেলের বাজারে এদের রক্তের কোনো মূল্য নেই!


ক্ষমা করো, ক্ষমা করো আমাকে
তোমার জন্য আরো বেশি কান্না প্রকাশ না করতে পারার কারণে
এবং স্মৃতিকাতরতার মধ্যে অস্ফুটস্বরেও আমি উচ্চারণ করতে পারিনি তোমার নাম
অথচ আমি প্রতীক্ষা কোরে ছিলাম তোমার আলিঙ্গনের উষ্ণতার জন্য
তুমি ছাড়া আমার আর কোনো ভালোবাসা নেই, একমাত্র তুমি—
আর আমিই সে—
তোমার প্রথম অনুসন্ধানকারী


রাত্রি,
সময়ের বিষয়ে তুমি অভিজ্ঞ নও
আর সেই বৃষ্টিরও অভাব
যা মুছে দিতে পারতো তোমার অতীতের সমস্ত দুঃখ
এবং তোমাকে মুক্তি দিতে পারতো সেই বন্দীত্ব থেকে, যার নাম দেয়া হয়েছে ধর্মপ্রেম—
ভালোবাসতে সক্ষম তোমার সেই হৃদয়ের সন্দেহপ্রবণ বিশ্বাস থেকে
এবং পৃথক করতে পারতো অস্পষ্ট ধর্ম থেকে তোমার অবৈধ প্রত্যাহার
সেই কপট দৈব নির্দেশ আর
সেই ঈশ্বরদের থেকে

যারা তাদের গৌরব হারিয়েছেন


তুমি ঢেঁকুর তুলছো, তোমার শক্তির চেয়ে অধিক পরিমাণে;
মদের দোকানগুলো যেমন কোরে তাদের খরিদ্দারদের মহিমান্বিত করে
আবৃত্তি আর সম্মোহনী নর্তকীদের দ্বারা

ডিজেকে সঙ্গে নিয়ে
তুমি আবৃত্তি করে চলেছো তোমার অলৌকিক বিশ্বাসসমূহকে
এবং ছুড়ে দিচ্ছো তোমার প্রশংসা এই সব নর্তকীদের দিকে
যারা নির্বাসিত কবিতার সাথেও তাদের শরীরকে দোলাচ্ছে


তার অধিকার নেই হাঁটার,
আন্দোলিত হওয়া কিংবা কাঁদারও অধিকার পায়নি সে
আত্মার জানালা খোলার কোনো অধিকার তার নেই;
যা তার নিঃশ্বাস, তার ধ্বংস এবং তার চোখের জলকে
পুনরায় শুদ্ধ কোরে তুলতে পারে

তবু তুমি ভুলে যেতে চাও যে,
এক টুকরো রুটি ছাড়া তুমি আর কিছুই নও


নির্বাসনের দিনটিতে, তারা নগ্ন দাড়িয়ে ছিলো;
যখন তুমি নর্দমার ময়লা জলের মধ্যে সাঁতার কাটছিলে, নগ্ন পায়ে…
হতে পারে সেটা তোমার পায়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো

কিন্তু পৃথিবীর জন্য নয়


ধর্মপ্রবক্তারা অবসর নিয়েছেন
সুতরাং তারা তোমার কাছে ফিরে আসবে— এই প্রতীক্ষা অর্থহীন

এবং তোমার জন্য
শুধু তোমার জন্য উপদেষ্টারা নিয়ে আসে তাদের দৈনন্দিন রিপোর্ট
এবং ভালো মূল্যও পায়

একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য
তুমি তো জানো, টাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ!

আমার পিতামহ প্রতিদিন নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন,
নির্বাসনহীন, স্বর্গীয় কোনো সৃষ্টি ছাড়াই…
আত্মায় কোনো অলৌকিক আঘাত ছাড়াই ইতিমধ্যে নিজেকে একবার পুনরুজ্জীবিত করেছি;

পৃথিবীতেই পেয়ে চলছি নরকের প্রকৃত অভিজ্ঞতা
কারণ পৃথিবীই হচ্ছে সেই নরক যা শরণার্থীদের জন্য তৈরি

১০
তোমার মূক রক্ত কোনো কথা বলবে না
যতদিন তুমি তোমার মৃত্যুতে গর্ব অনুভব করবে
যতদিন তুমি তোমার সিদ্ধান্তে গোপনে স্থির থাকবেঃ
তুমি তোমার আত্মাকে সেইসব হাতে তুলে দিতে
যারা আসলে কিছুই জানে না

আত্মা হারানোর মূল্য তোমাকে সময় দিয়ে পরিশোধ করতে হবে
একটি চোখকে শান্ত হতে যে সময় লাগে, তার চেয়েও দীর্ঘ সে সময়;
তোমার যে চোখ হতে অশ্রু নয় ঝরে পড়ে তেল

These poems appeared in Fayadh’s poetry collection Instructions Within which was published by the Beirut-based Dar al-Farabi in 2008 and later banned from distribution in Saudi Arabia

শার্ল বোদলেয়ার

মাতাল হও

মাতাল হতে হবে তোমাকে
এখানেই আছে সকল সমাধান— এবং এটাই শেষ পথ
সময়ের ভয়ানক ভার যা তোমার মাথাকে নত কোরে রাখে; উপেক্ষা করতে চাও?
সুতরাং মাতাল হতেই হবে তোমাকে, পান করে যেতে হবে ক্রমাগত
কিসে মাতাল হবে?
মদ, কবিতা অথবা ধর্ম; যেমন ইচ্ছে তোমার
কিন্তু মাতাল হতেই হবে তোমাকে

যদি কখনো কোনো এক প্রাসাদের সিঁড়িতে, জলাধার সংলগ্ন সবুজ মাঠে কিংবা
যখন জেগে ওঠো গৃহের বিষাদাক্রান্ত জানালায়,
যখন অনুভব করো মাতলামি শেষ হতে শুরু করেছে তোমার
অথবা সম্পূর্ণ শেষ,
প্রশ্ন করো বাতাসকে, প্রশ্ন করো ঢেউকে,
নক্ষত্র, পাখি, দেয়ালঘড়ি— যা কিছু ওড়ে, যা কিছু কান্নারত,
যা কিছু ঘূর্ণায়মান, যা কিছু গায়, যা কিছু করে চিৎকার—
প্রশ্ন করো তুমি, এখন কিসের সময়?
হাওয়া, ঢেউ, নক্ষত্র ,পাখি ও ঘড়ি— প্রত্যেকে ওরা দেবে উত্তর—
এখন সময় মাতাল হবার

সময়ের ক্রীতদাস না হয়ে বরং মাতাল হও;
এক মুহূর্ত সুস্থতা নয়
মদ, কবিতা কিংবা ধর্মে; যেমন ইচ্ছে তোমার— মাতাল হও!

Be Drunk

পাউল সেলান

মৃত্যুসঙ্গীত

সকালের কালো দুধ— আমরা একে পান করি সন্ধ্যায়
আমরা একে পান করি মধ্যাহ্নে সারা সকাল ধরে পান করি রাতে
পান করি এবং পান করি
মৃদু হাওয়ায় আমরা কবর খুঁড়ি এক সেখানে শুয়ে থাকে স্বাধীন একজন;
একজন মানুষ সেই ঘরে থাকে আর সাপেদের সঙ্গে খেলা করে
সে লেখে
সে লিখে রাখে তোমার সোনালী চুল, মার্গারেট—
যখন অন্ধকার নেমে আসে জার্মানিতে
সে লেখে তাকে আর ঘরের বাইরে পা দিয়ে আশঙ্কাগ্রস্ত তারাগুলো দ্যাখে
আর শিস দিয়ে তার ইহুদীদের পৃথিবীর মাঠে ডেকে নিয়ে যায়, বাধ্য করে কবর খুঁড়তে
এবং আমাদের নৃত্য করতে আদেশ করে

ভোরের কালো দুধ— তোমাকে আমরা পান করি রাতে
আমরা তোমাকে পান করি মধ্যাহ্নে সারা সকাল ধরে পান করি সন্ধ্যায়
পান করি এবং পান করি তোমাকে
একজন মানুষ সেই ঘরে থাকে আর সাপেদের সঙ্গে খেলা করে
সে লেখে
যখন অন্ধকার নেমে আসে জার্মানিতে
সে লিখে রাখে তোমার সোনালী চুল, মার্গারেট—
তোমার ধূসর চুল শুলোমিথ— মৃদু হাওয়ায় আমরা কবর খুঁড়ি এক
সেখানে শুয়ে থাকে স্বাধীন একজন;

সে চিৎকার করে— গভীরভাবে খোঁড়ো পৃথিবীকে, গান গাও বেদনার
আর খেলা করো
সে তার বেল্টের লোহা মুঠিবদ্ধ কোরে দোলায় তার চোখ নীল হয়ে ওঠে
গভীরভাবে খোঁড়ো পৃথিবীকে কোদাল দিয়ে, অন্যরা নাচের সঙ্গে সঙ্গে
খেলতে থাকো

সকালের কালো দুধ— তোমাকে আমরা পান করি রাতে
আমরা তোমাকে পান করি মধ্যাহ্নে সারা সকাল ধরে পান করি সন্ধ্যায়
পান করি এবং পান করি তোমাকে
একজন মানুষ সেই ঘরে থাকে তোমার সোনালী চুল, মার্গারেট—
তোমার ধূসর চুল শুলোমিথ সে খেলা করে সাপেদের সঙ্গে
মধুর স্বরে সে মৃত্যুকে খেলতে ডাকে মৃত্যু হলো জার্মানির প্রভু
গভীরতম স্বরে সে মৃত্যুকে বাজাতে বলে কালো সুর
যাতে হাওয়ায় তোমরা মিলিয়ে যাও ধোঁয়ার মতো
তোমরা সেখানে মেঘের মধ্যে খুঁজে পাবে এক কবর যেখানে
শুয়ে আছে স্বাধীন একজন;

সকালের কালো দুধ— তোমাকে আমরা পান করি রাতে
আমরা তোমাকে পান করি মধ্যাহ্নে মৃত্যু হলো জার্মানির প্রভু
আমরা তোমাকে পান করি সন্ধ্যায় এবং পান করি সকালে
পান করি এবং পান করি তোমাকে
মৃত্যু হলো জার্মানির প্রভু তার চোখ হলো নীল
সে তোমাকে বিদ্ধ করবে সীসার বুলেট সে জানে তার সঠিক গন্তব্য
একজন মানুষ সেই ঘরে থাকে তোমার সোনালী চুল, মার্গারেট—
সে আমাদের জন্য আকাশে তৈরি করে দেয় এক বিশাল কবর
সে খেলা করে সাপ এবং দিবাস্বপ্নের সঙ্গে মৃত্যু হলো জার্মানির প্রভু

তোমার সোনালী চুল মার্গারেট
তোমার ধূসর চুল শুলোমিথ
Death Fugue

নিকানোর পাররা

এন্টিপোয়েম

এন্টি পোয়েট্রি কী?

কফিন আর শবাধারের কোনো সওদাগর?
এমন একজন সেনানায়ক যে নিজের উপর আস্থাশীল নয়?
একজন যাজক যার বিশ্বাস নেই কিছুতেই?
একজন যাযাবর যে সবকিছু নিয়ে কৌতুক করে এমনকি
বার্ধক্য ও মৃত্যু নিয়েও?
একজন অবিশ্বাসী কোনো ভাষণদাতা?
উঁচু পাহাড়ের সীমান্তে দাঁড়ানো কোনো নাচিয়ে?
এমন এক নার্সিসিস্ট যে সবকিছুতেই খুঁজে পায় সৌন্দর্য?
এমন একজন ভাঁড় যে জঘন্যভাবে কাউকে হারিয়ে দেয়
কেবলমাত্র তামাশার জন্য?
সারারাত চেয়ারে বসে ঘুমায় এমন এক বিখ্যাত কবি?
একজন আধুনিক অপরসায়নবিদ?
একজন ভীতু বিপ্লবী?
একজন নগন্য শিল্পপতি?
একজন ভণ্ড?
একজন ঈশ্বর?
একজন সহজ মানুষ?
চিলের সান্তিয়াগো হতে আগত কোনো চাষী?

সঠিক উত্তরটির নিচে দাগ টানুন

এন্টি পোয়েট্রি কী?
চা’য়ের পেয়ালায় ঝড়?
পাথরের গা’য়ে তুষার চিহ্ন?
ফাদার সালভাতিয়ারের মত অনুযায়ী
মানুষের মলে পূর্ণ বিশাল এক প্লেট?
মিথ্যে বলতে পারে না এমন এক আয়না?
লেখক সমিতির সভাপতির গালে এক হঠাৎ থাপ্পর?
( ঈশ্বর তারা আত্মাকে ক্ষমা করুক )
তরুন কবিদের প্রতি এক সাবধানবাণী?
জেট-চালিত কোনো কফিন?
কেন্দ্রপথে ধাবিত এক কফিন?
একটি কফিন ক্যারোসিন চালিত?
শবহীন কোনো লাশকাটা ঘর?

সঠিক উত্তরটিতে একটি X চিহ্ন দিন
Test

কন্সটান্টাইন পি কাভাফি

ইথাকা

যখন তুমি যাত্রা শুরু করবে ইথাকার পথে,
আশা করি তোমার ভ্রমন হবে দীর্ঘতর
অভিজানে ভরপুর, আবিষ্কারে পরিপূর্ণ
দেবতার পালিতো দানব লাইসট্রাইগোরিয়ানস, সাইক্লোপস,
ক্রদ্ধ সমুদ্রদেব পোসাইদোন— তুমি তাদের ভয় পেয়ো না
তোমার ভ্রমণে তাদের পাবে না তুমি কখনোই
যতক্ষণ তোমার চিন্তায় ভয় থাকবে না
যতক্ষন তোমার আত্না এবং দেহে থাকবে সেই বিরল উন্মাদনা
লাইসট্রাইগোরিয়ানস, সাইক্লোপস,
বন্য সমুদ্রদেব পোসাইদোন— তুমি তাদের মুখোমুখি হবেই না
যদি না তুমি তাদের আত্নায় ধারণ করো
যদি না তোমার ভীত আত্না তাদের নিয়ে আসে তোমার সামনে

আশা করি তোমার ভ্রমণ হবে দীর্ঘতর
কামনা করি তোমার ভ্রমণে আসুক এমন অনেক গুলো গ্রীষ্মের সকাল
যখন তুমি দেখবে মারাত্নক আনন্দ এবং উল্লাস নিয়ে
প্রথমবারের মতো সেই অদ্যাখা বন্দরগুলো
তুমি যেতে পারো ফিনিশিয়দের চমৎকার সেই দোকান গুলোতে
এবং কিনতে পারো সব দুর্লভ সামগ্রী
মুক্তো, প্রবাল, অ্যাম্বার এবং আবলুস কাঠ,
সব ধরনের বিলাসী সুগন্ধী,
যতো বেশিই তুমি চাও না কেন
এবং তুমি যেতে পারো মিশরিয় শহরগুলোতে
যেখানে তুমি জানতে পারবে বোদ্ধাদের থেকে

তবে ইথাকা কে ভুলে যেও না
তোমার ভ্রমণের গন্তব্য সেখানেই
তাড়াহুড়ো করো না বরং ভ্রমণে কেটে যাক না কিছু বছর
যাতে পৌঁছতে পৌঁছতে তুমি বৃদ্ধ হয়ে ওঠো
এবং ভ্রমণের অর্জনে ধনী
ইথাকা তোমাকে সম্পদশালী করবে সে আশা কিন্তু রেখো না
ইথাকা দিয়েছে তোমাকে একটি ভ্রমণ, বিস্ময়কর এক ভ্রমণ
তোমাকে দেবার মতো তার কাছে আর কিছুই নেই।

এবং যখন তুমি তাকে দারিদ্রতায় খুঁজে পাবে
ভেবো না তোমাকে ঠকিয়েছে
তুমি জ্ঞানী হয়ে উঠেছো অভিজ্ঞতায়
এবং বুঝেছো ইথাকা কী
Ithaca

কার্ল স্যান্ডবার্গ

জল্লাদ যখন বাড়ি ফেরে

একজন জল্লাদ মূলত কী নিয়ে ভাবতে পারে
যখন সে কাজ সেরে রাতে বাড়ি ফেরে?
যখন সে তার স্ত্রী আর সন্তানদের সাথে
কফি আর ডিম আর শূকরের মাংস খেতে বসে,
তারা কি জানতে চায় সারাদিনের কাজের বর্ণনা?
আর সবকিছু ভালোয় ভালোয় হয়েছে কিনা
কিংবা তারা কি আলোচনা করে এসব বিষয়ে—
যেমনঃ আবহাওয়া, বেস-বল, রাজনীতি
আর কাগজে প্রকাশিত মজার কমিক
আর সিনেমার কথা? তারা কি চেয়ে থাকে
সেই হাতের দিকে যখন সে কফি ঢেলে নেয়
অথবা শূকরের মাংস আর ডিম তুলে নেয়? যদি হঠাৎ
সর্বকনিষ্ঠজন বলে, বাবা, চলো ঘোড়া-ঘোড়া খেলি,
এই যে দঁড়ি— তখন সে কি রসিকতা কোরে বলে:
আমি অনেক দঁড়িই দেখেছি আজ সারাদিন?
নাকি তার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে
যেন বনফায়ার আর সে বলতে শুরু করে:
“এই পৃথিবী যেখানে আমরা বাস করি খুব ভালো ও পোশাকী…”
আর যদি শাদা চাঁদের মুখ দ্যাখা দেয় জানালার ফাঁকে
যেখানে ঘুমুচ্ছে একটি মেয়েশিশু
আর সেই চাঁদের আলোয় দীপ্তিময় হয়ে ওঠে
শিশুর কুসুম কান আর চুলগুলো— তখন সেই জল্লাদ
তাহলে কীভাবে কাজ করে?
এটা হয়তো তার জন্যে খুবই সহজ।
আসলে আমি মনে করি, জল্লাদের জন্য সহজ সকলকিছু।

The Hangman at Home

নিজার কাব্বানী

প্রেমিকার প্রশ্নের উত্তরে

আমার প্রণয়ী আমাকে প্রশ্ন করে—
‘আমি এবং আকাশের মধ্যে পার্থক্য কী?’

পার্থক্য হলো— প্রিয়তমা আমার,
যখন তুমি হাসো
আমি আকাশকে ভুলে যাই

My Lover Asks Me

নিজার কাব্বানী

ওহ প্রিয়তমা আমার

ওহ প্রিয়তমা আমার
তুমি যদি আমার মতো প্রেমে উম্মাদ হয়ে থাকতে

তুমি পরিত্যাগ করতে সকল অহংকার
বিক্রি কোরে দিতে তোমার ভবিষ্যৎ

আর ঘুমিয়ে পড়তে আমার চোখে।

Oh, my love

ভিসেন্তে আলেইকজান্দ্রে

গাছ কখনো ঘুমায় না

গাছ কখনো ঘুমায় না।
ওক গাছের শক্ত পা, কখনো নগ্ন, শুধু পেতে চায় গাঢ় কালো রোদ।
যেন একটি উরু, মাটিতে আঘাত হানে, তারপর থমকে দাঁড়ায়
আর সমস্ত আকাশ ছুটে পালিয়ে যায় ভয়ে।

গাছ একটি উরু, মাটিতে জন্মে, জীবন যেখানে শুরু
হতে চায় না গাঢ় অথবা হালকা গোলাপী
অথচ হয়েছে সবুজ, কঠিন চোখের মতো নির্মল সবুজ।

প্রশস্ত চিবুক যেখানে নকল মনে হয় না চুম্বন
যেন গায়ে পিঁপড়ের হামাগুড়ি
যেখানে নরোম ফিতের মতো চাঁদ পড়ে না কোমল হয়ে
কারণ যে শাদা ফেনা কোনো এক রাতে তার উপর বিচরণ করবে
সকালে হয়ে যাবে পাথর, শৈবালহীন কঠিন পাথর।
যেখানে রক্তকোষ চুম্বনরত ঠোঁটগুলো কখনো কখনো
অনুভব করে কর্তব্যরত অস্ত্রের দীপ্তি,
অনুভব করে উজ্জ্বল রক্তের বিচ্ছুরিত উষ্ণতা
ক্ষরণের সময় কুশলী পেশিগুলোর নিষ্পেষণে।

হ্যাঁ, কখনো কখনো একটি ফুল হতে চায় শক্তিশালী বাহু।
কিন্তু এমন গাছ কখনো দেখবে না যা অন্যকিছু হতে চায়।
কখনো কখনো মানুষের মন নেচে ওঠে শব্দ-মন্ত্রে
কিন্তু গাছ বিজ্ঞ, যেখানে মূল তার, সেখানেই তার রাজ্য।
সমগ্র আকাশ অথবা একটি স্মিত-লজ্জা এর শাখাগুলোতে বিশ্রাম করে।

এর কুড়িগুলো থেকে বাবুইর বাসাগুলো ঝুলতে ভয় পায়।
এবং পৃথিবীটা নীরব-নিস্তব্ধ আমাদের চোখের সামনে
কিন্তু আমি জানি পৃথিবী কেঁপে উঠতে পারতো সমুদ্রের মতো
এবং তাকে ছুঁতে পারতো।

বহু উঁচুতে মহীয়ান, অনুভব করে তারাগুলো কুঁকড়ে গ্যাছে বাতাসের অভাবে
সোনা ঝরা বাতাস নেই, তবু এক মায়াময় সংগীতের জন্ম হয়।
একটি গাছ জীবন্ত; কাঁদতে পারে অথচ কাঁদে না,
আর কখনো মানুষের জন্য নিজের ছায়া মাটিতে ফ্যালে না—
যে মানুষ মরনশীল।

Tree

পাবলো নেরুদা

আজ রাতে লিখতে পারি সবচেয়ে বিষাদাক্রান্ত পঙক্তিগুলো

সেই বিষাদাক্রান্ত পঙক্তিগুলো
আজ রাতে আমি লিখতে পারি
যেমন ধরো লিখতে পারি, “এই রাত নক্ষত্রালোকিত,
তারাগুলো দূরে গভীর নীল আর উজ্জ্বল হয়ে আছে”
আকাশে রাতের বাতাস নাচে আর গান করে

আজ রাতেই আমি লিখতে পারি
দুঃখভারাক্রান্ত আমার পঙক্তিগুলো
তাকে ভালোবাসতাম আমি, এবং কখনো কখনো
সেও আমাকে ভালোবাসতো
সেই রাতটি ছিলো এমন যে, আমরা আলিঙ্গন করেছিলাম;
অসীম আকাশের নিচে আমরা খেয়েছিলাম প্রথম ও শেষ চুম্বন

সে ভালোবেসেছিলো আমাকে, কখনো আমিও তাকে ভালোবেসেছিলাম
কে আছে পৃথিবীর, তার সমুদ্রের মতো চোখ ভালো না বেসে পারে!

আজ রাতেই আমি লিখে রাখবো
আমি তাকে পাইনি জেনে
এবং জেনে— ফেলেছি হারিয়ে তার প্রেম

শুনি, এই চমৎকার রাতের শব্দ
তাকে ছাড়াও রাতটি চমৎকার!
যেন কবিতারা ঝরে পড়ে আত্মার উপর
যেমন ঘাসের শরীরে শীত ঝরে পড়ে

যদি তাকে না পায় আমার ভালোবাসা
কী এসে যায়?
এই রাত তবু নক্ষত্রালোকিত এবং
সে নেই এই পথে

আর কিছু নেই। দূরে কেউ গান গাইছে। অল্প দূরে—
তাকে হারিয়ে আমার হৃদয় আনন্দিত নয়
আমার চোখগুলি তাকে খুঁজছে যেন তাকে কাছে পায়
আমার হৃদয় তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং সে নেই কাছে
সেই রাত সেই গাছগুলোকে আজও উজ্জ্বল করে তুলছে
কেবল আমরা— সেদিনের আমরা আর নেই

এটা নিশ্চিত যে, আমি আর তাকে ভালোবাসি না
কী করে ভালোবেসেছিলাম!

তবু আমার কণ্ঠস্বর খোঁজে সেই বাতাস
যা তার শ্রুতি শুনতে পায়
সে অন্য কারো হবে, জেনেছি তাকে চুমু দেবার সময়
তার কণ্ঠস্বর, তার উষ্ণ শরীর; তার উজ্জ্বল চোখ

তাকে আমি আর ভালোবাসি না, নিশ্চিত জানি
যদিও হয়তো তাকে ভালোবেসেছিলাম
ভালোবাসা বিষয়টা যদিও ক্ষণিকের, ভুলে যাওয়া দীর্ঘকালের
কারণ আজকের মতোই এই রাতগুলোতে তাকে
জড়িয়ে রাখতাম বুকে

আমার আত্মা আনন্দিত নয় যেন সে তাকে হারিয়ে ফেলেছে চিরদিনের জন্য
এটাই হলো শেষ বিষাদ যা সে আমাকে উপহার দিয়ে গেছে

এবং এটাই শেষ কবিতা আমার যা তার জন্য লিখছি
আজ রাতে লিখতে পারি সবচেয়ে বিষাদাক্রান্ত পঙক্তিগুলো

Tonight I Can Write The Saddest Lines

অঁরি মিশো

একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ

ঘুম ভেঙে বিছানা হ’তে দেয়াল ছুঁতে না পেরে প্লুম আশ্চর্য হলো;
হয়তো পিঁপড়ে খেয়ে ফেলেছে দেয়ালটাকে— ভেবে সে স্বস্তি পেলো
এবং পুনরায় ঘুমিয়ে পড়লো

কিছুক্ষণ পর তার বউ তাকে দ্রুত জাগিয়ে তুলে বকতে শুরু করলো—
“ওহে আলসের বাচ্চা, তুমি যখন মরার মতো ঘুমিয়ে;
ওরা আমার বাড়িটাই চুরি কোরে নিয়ে গ্যাছে”—
“বাহ! চমৎকার”
চারপাশে ছড়ানো আকাশটাকে ঝুলে থাকতে দেখে বোললো প্লুম
তারা দু’জন একটি শব্দ শুনতে পেলো
একটি ট্রেন ভয়ানক চিৎকার কোরে তাদের দিকে তেড়ে আসছে;
এবং সেটা এতই দ্রুত যে, নিশ্চয়ই পালাবার সুযোগ নেই—
এই ভেবে সে আবার ঘুমিয়ে পড়লো
এরপর এক শীতে তার ঘুম ভাঙলো
রক্তে ভেজা সমস্ত শরীর,
পাশেই পড়ে আছে স্ত্রীর আট টুকরো শরীর;
“রক্তারক্তি খুব খারাপ জিনিসের জন্ম দেয়”— সে চিন্তা করলো—
ট্রেনের না আসাটাই ছিলো বরং স্বস্তিদায়ক
কিন্তু এসেই যখন গ্যাছে…
তাই সে আবার ঘুমিয়ে গেলো
তো প্লুম, মহামান্য বিচারক শুরু করলেন— তোমার বউটি অমন নৃশংসভাবে
নিজেকে হত্যা করলো… লোকেরা তাকে আটটি টুকরো হ’তে দেখলো… আর তুমি…
সামান্য বাধা দিলে না এমনকি লক্ষ্য পর্যন্ত কোরলে না! এর কী ব্যখ্যা দেবে তুমি?
মূলত এই আশ্চর্য রহস্যের উপরেই নির্ভর কোরছে সবকিছু

এই মামলায় নিজেকে সাহায্য করার কোনো কারণই আমি দেখছি না—
ভাবলো প্লুম এবং ঘুমিয়ে পড়লো।
“আগামী সকালে তোমার ফাঁসি— কিছু বোলবার আছে, প্লুম?” বিচারক বললেন,

না, আমাকে ক্ষমা করবেন;
সত্যি বলতে শুরু থেকেই কেসটার কিছুই শুনিনি আমি—
সে বোললো এবং ঘুমিয়ে পড়লো

নাজিম হিকমাত

শেষ ইচ্ছে, শেষ সাক্ষ্য

কমরেড, যদি আমি দিনের আলো দেখে না যেতে পারি
—অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভের আগেই যদি আমার মৃত্যু হয়—
আমাকে নিয়ে যাবেন
আর কবর দেবেন আনাতোলিয়ার গ্রাম্য গোরস্থানে।

শ্রমিক ওসমান যাকে হাসান বেগের আদেশে গুলিতে হত্যা করা হয়েছিলো
আমার কবরের একপাশে তাকে শুইয়ে দিতে পারেন, এবং অন্যপাশে
শহীদ আয়েশাকে, যিনি রাইয়ের ক্ষেতে সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন
এবং সেখানেই মারা গিয়েছিলেন চল্লিশ দিনের মাথায়।

ট্রাক্টর আর সঙ্গীত গোরস্থানের পাশ দিয়ে বয়ে যেতে পারে—
ভোরের আলোয়, নতুন লোক, জ্বলন্ত গ্যাসোলিনের ঘ্রাণ,
একই রকম মাঠ, খাল ভরা পানি,
থাকবে না খরা আর পুলিশের ভয়।

অবশ্যই, আমরা শুনবো না ওই গানগুলো:
মৃতরা লম্বা শুয়ে থাকে মাটির নিচে
এবং পচতে থাকে যেমন বৃক্ষ শাখা পচে কালো হয়ে যায়
মাটির নিচে তারা শুয়ে থাকে বধির, বোবা, ও অন্ধ হয়ে।

কিন্তু, আমি ওই গানগুলো গাইতে চাই
সেসব লেখার আগেই,
আমি জ্বলন্ত গ্যাসোলিনের ঘ্রাণ পাই
ট্রাক্টরগুলো মাটিতে নকশা কাটতে শুরু করবার আগেই।

আর আমার প্রতিবেশিরা,
শ্রমিক ওসমান, শহীদ আয়েশা,
বেঁচে থাকতে যাদের অনেক সাধ ছিলো,
হয়তো এসবের কিছুই পাবে না টের।

কমরেড, যদি আমি সেই কাঙ্ক্ষিত দিবসের আগেই মরে যাই, বলতে চাইছি
—এবং কেন যেন মনে হচ্ছে হবেও তাই—
আমায় কবর দেবেন আনাতোলিয়ার এক গ্রাম্য কবরস্থানে,
আর যদি খুব কষ্ট না হয়
শীয়রে রোপন করে দেবেন সাধারণ কোন বৃক্ষ
কোনো পাথর বা স্মৃতিফলকের দরকার পড়বে না আমার।


2 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন