হুমায়ুন আজাদের সবগুলো কবিতা সংগ্রহ

 

ভালো থেকো

ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।  

ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।  

ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।  

ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।  

ভালো থেকো।   

 

ভালো থেকো চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।  

ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।  

ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।  

ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।  

ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।  

ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।  

ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাশিঁ।  

ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি।  

ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।  

ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।  

ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,  

ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল,  

ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো।  

ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।  

ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।  

  

====== 


ব্যাধিকে রূপান্তর করেছি মুক্তোয়

একপাশে শূন্যতার খোলা, অন্যপাশে মৃত্যুর ঢাকনা,  
প’ড়ে আছে কালো জলে নিরর্থক ঝিনুক।  
অন্ধ ঝিনুকের মধ্যে অনিচ্ছায় ঢুকে গেছি রক্তমাংসময়  
আপাদমস্তক বন্দী ব্যাধিবীজ। তাৎপর্য নেই কোন দিকে-  
না জলে না দেয়ালে-তাৎপর্যহীন অভ্যন্তরে ক্রমশ উঠছি বেড়ে  
শোণিতপ্লাবিত ব্যাধি। কখনো হল্লা ক’রে হাঙ্গরকুমীরসহ  
ঠেলে আসে হলদে পুঁজ, ছুটে আসে মরা রক্তের তুফান।  
আকষ্মিক অগ্নি ঢেলে ধেয়ে আসে কালো বজ্রপাত।  
যেহেতু কিছুই নেই করণীয় ব্যাধিরূপে বেড়ে ওঠা ছাড়া,  
নিজেকে-ব্যাধিকে-যাদুরসায়নে রূপান্তরিত করছি শিল্পে-  
একরত্তি নিটোল মুক্তোয়!  
  
====== 

বাঙলা ভাষা

শেকলে বাঁধা শ্যামল রূপসী, তুমি-আমি, দুর্বিনীত দাসদাসী-  
একই শেকলে বাঁধা প’ড়ে আছি শতাব্দীর পর শতাব্দী।  
আমাদের ঘিরে শাঁইশাঁই চাবুকের শব্দ, স্তরে স্তরে শেকলের ঝংকার।  
তুমি আর আমি সে-গোত্রের যারা চিরদিন উৎপীড়নের মধ্যে গান গায়-  
হাহাকার রূপান্তরিত হয় সঙ্গীতে-শোভায়।   
  
লকলকে চাবুকের আক্রোশ আর অজগরের মতো অন্ধ শেকলের  
মুখোমুখি আমরা তুলে ধরি আমাদের উদ্ধত দর্পিত সৌন্দর্য:  
আদিম ঝরনার মতো অজস্র ধারায় ফিনকি দেয়া টকটকে লাল রক্ত,  
চাবুকের থাবায় সুর্যের টুকরোর মতো ছেঁড়া মাংস  
আর আকাশের দিকে হাতুড়ির মতো উদ্যত মুষ্টি।   
  
শাঁইশাঁই চাবুকে আমার মিশ্র মাংসপেশি পাথরের চেয়ে শক্ত হয়ে ওঠে  
তুমি হয়ে ওঠো তপ্ত কাঞ্চনের চেয়েও সুন্দর।  
সভ্যতার সমস্ত শিল্পকলার চেয়ে রহস্যময় তোমার দু-চোখ  
যেখানে তাকাও সেখানেই ফুটে ওঠে কুমুদকহ্লার  
হরিণের দ্রুত ধাবমান গতির চেয়ে সুন্দর ওই ভ্রূযুগল  
তোমার পিঠে চাবুকের দাগ চুনির জড়োয়ার চেয়েও দামি আর রঙিন  
তোমার দুই স্তন ঘিরে ঘাতকের কামড়ের দাগ মুক্তোমালার চেয়েও ঝলোমলো  
তোমার ‘অ, আ’ –চিৎকার সমস্ত আর্যশ্লোকের চেয়েও পবিত্র অজর   
  
তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চন্ডীদাস  
শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন  
তোমার থরোথরো প্রেমের নাম রবীন্দ্রনাথ  
বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ  
তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম   
  
শাঁইশাঁই চাবুকের আক্রোশে যখন তুমি আর আমি  
আকাশের দিকে ছুঁড়ি আমাদের উদ্ধত সুন্দর বাহু, রক্তাক্ত আঙুল,  
তখনি সৃষ্টি হয় নাচের নতুন মুদ্রা;  
ফিনকি দেয়া লাল রক্ত সমস্ত শরীরে মেখে যখন আমরা গড়িয়ে পড়ি  
ধূসর মাটিতে এবং আবার দাঁড়াই পৃথিবীর সমস্ত চাবুকের মুখোমুখি,  
তখনি জন্ম নেয় অভাবিত সৌন্দর্যমন্ডিত বিশুদ্ধ নাচ;  
এবং যখন শেকলের পর শেকল চুরমার ক’রে ঝনঝন ক’রে বেজে উঠি  
আমরা দুজন, তখনি প্রথম জন্মে গভীর-ব্যাপক-শিল্পসম্মত ঐকতান-  
আমাদের আদিগন্ত আর্তনাদ বিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধের  
একমাত্র গান।  
  
====== 

ফুলেরা জানতো যদি

মুলঃ হেনরিক হাইনে  
ফুলেরা জানতো যদি আমার হৃদয়  
ক্ষতবিক্ষত কতোখানি,  
অঝোরে ঝরতো তাদের চোখের জল  
আমার কষ্ট আপন কষ্ট মানি ।   
  
নাইটিংগেল আর শ্যামারা জানতো যদি  
আমার কষ্ট কতোখানি-কতোদুর,  
তাহলে তাদের গলায় উঠতো বেজে  
আরো ব হু বেশী আনন্দদায়ক সুর ।   
  
সোনালী তারারা দেখতো কখনো যদি  
আমার কষ্টের অশ্রুজলের দাগ,  
তাহলে তাদের স্থান থেকে নেমে এসে  
জানাতো আমাকে সান্ত্বনা ও অনুরাগ ।   
  
তবে তারা কেউ বুঝতে পারেনা তা-  
একজন,শুধু একজন,জানে আমার কষ্ট কতো;  
আমার হৃদয় ছিনিয়ে নিয়েছে যে  
ভাংগার জন্য-বারবার অবিরত ।  
  
====== 

প্রেমিকার মৃত্যুতে 

খুব ভালো চমৎকার লাগছে লিলিআন,  
মুহুর্মুহু বিস্ফোরণে হবো না চৌচির।  
তরঙ্গে তরঙ্গে ভ্রষ্ট অন্ধ জলযান  
এখন চলবে জলে খুব ধীরস্থির।  
অন্য কেউ ঢেলে নিচ্ছে ঠোঁট থেকে লাল  
মাংস খুঁড়ে তুলে নিচ্ছে হীরেসোনামণি;  
এই ভয়ে কাঁপবে না আকাশপাতাল,  
থামবে অরণ্যে অগ্নি আকাশে অশনি।   
  
আজ থেকে খুব ধীরে পুড়ে যাবে চাঁদ,  
খুব সুস্থ হয়ে উঠবে জীবনযাপন।  
অন্নে জলে ঘ্রাণে পাবো অবিকল স্বাদ,  
চিনবো শত্রুর মুখে কারা-বা আপন।  
বুঝবো নিদ্রার জন্যে রাত্রি চিরদিন,  
যারা থাকে ঘুমহীন তারা গায় গান।  
রঙিন রক্তের লক্ষ্য ঠাণ্ডা কফিন;  
খুব ভালো চমৎকার লাগছে লিলিআন।  
  
====== 


দ্বিতীয় আগমন 
মূলঃ ডব্লিউ বি ইএট্স্  
বড়ো থেকে বড়ো বৃত্তে পাক খেতে খেতে  
বাজ শুনতে পায় না বাজের প্রভুকে;  
সবকিছু ধ’সে পড়ে; কেন্দ্র ধ’রে রাখতে পারে না;  
নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্ব জুড়ে,  
ছাড়া পায় রক্তময়লা প্রবাহ, আর চারদিকে  
আপ্লাবিত হয় নিষ্পাপ উৎসব;  
শ্রেষ্ঠরা সমস্ত বিশ্বাসরিক্ত, যখন নষ্টরা  
পরিপূর্ণ সংরক্ত উৎসাহে।  
নিশ্চয়ই কোনো প্রত্যাদেশ এখন আসন্ন;  
নিশ্চয়ই দ্বিতীয় আগমন এখন আসন্ন;  
দ্বিতীয় আগমন! যেই উচ্চারিত হয় ওই শব্দ  
অমনি মহাস্মৃতি থেকে এক প্রকাণ্ড মূর্তি  
পীড়া দেয় আমার দৃষ্টিকে: কোথাও কোন মরুভূর বালুর ওপরে  
সিংহের শরীর আর মানুষের মুণ্ডধারী এক অবয়ব,  
সূর্যের মতোন শূন্য আর অকরুণ এক স্থিরদৃষ্টি,  
চালায় মন্থর উরু, আর তাকে ঘিরে  
সব কিছু ঘূর্ণিপাকে ছায়া ফেলে মরুভূর বিক্ষুদ্ধ পক্ষীর।  
অন্ধকার নামে পুনরায়; তবে আমি জানি  
বিশ শতাব্দীর পাথুর নিদ্রাকে  
একটি আন্দোলিত দোলনা পরিণত করেছে বিক্ষুদ্ধ দূঃস্বপ্নে,  
কোন্ রুক্ষ পশু, তার সময় এসেছে অবশেষে,  
জন্ম নেয়ার জন্য জবুথুবু কুশ্রী ভঙ্গিতে এগোয় বেথলেহেমের অভিমুখে?  
  
====== 

তোমার দিকে আসছি 

অজস্র জন্ম ধরে  
আমি তোমার দিকে আসছি  
কিন্তু পৌঁছুতে পারছি না।  
তোমার দিকে আসতে আসতে  
আমার এক একটা দীর্ঘ জীবন ক্ষয় হয়ে যায়  
পাঁচ পঁয়সার মোম বাতির মত।   
  
আমার প্রথম জন্মটা কেটে গিয়েছিলো  
শুধু তোমার স্বপ্ন দেখে দেখে,  
এক জন্ম আমি শুধু তোমার স্বপ্ন দেখেছি।  
আমার দুঃখ,  
তোমার স্বপ্ন দেখার জন্যে  
আমি মাত্র একটি জন্ম পেয়েছিলাম।   
  
আরেক জন্মে  
আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পরেছিলাম তোমার উদ্দেশ্য।  
পথে বেরিয়েই আমি পলি মাটির উপর আকাঁ দেখি  
তোমার পায়ের দাগ  
তার প্রতিটি রেখা  
আমাকে পাগল করে তোলে।  
ঐ আলতার দাগ,আমার চোখ,আর বুক আর স্বপ্নকে  
এতো লাল করে তুলে,  
যে আমি তোমাকে সম্পূর্ন ভুলে যাই  
ঐ রঙ্গীন পায়ের দাগ প্রদক্ষীন করতে করতে  
আমার ঐ জন্মটা কেটে যায়।  
আমার দুঃখ !  
মাত্র একটি জন্ম  
আমি পেয়েছিলাম  
সুন্দর কে প্রদক্ষীন করার।  
আরেক জন্মে  
তোমার কথা ভাবতেই-  
আমার বুকের ভিতর থেকে সবচে দীর্ঘ  
আর কোমল,আর ঠাণ্ডা নদীর মত  
কি যেন প্রবাহিত হতে শুরু করে।  
সেই দীর্ঘশ্বাসে তুমি কেঁপে উঠতে পারো ভেবে  
আমি একটা মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে  
কাটিয়ে দেই সম্পুর্ন জন্মটা।  
আমার দুঃখ ,আমার কোমলতম দীর্ঘশ্বাসটি ছিল  
মাত্র এক জন্মের সমান দীর্ঘ  
আমার ষোঁড়শ জন্মে  
একটি গোলাপ আমার পথ রোধ করে,  
আমি গোলাপের সিঁড়ি বেয়ে তোমার দিকে উঠতে থাকি-  
উঁচুতে ! উঁচুতে !! আরো উঁচুতে !!!  
আর এক সময় ঝড়ে যাই চৈত্রের বাতাসে।   
  
আমার দু:খ মাত্র একটি জন্ম  
আমি গোলাপের পাপঁড়ি হয়ে  
তোমার উদ্দেশ্য ছড়িয়ে পরতে পেরেছিলাম।   
  
এখন আমার সমস্ত পথ জুড়ে  
টলমল করছে একটি অশ্রু বিন্দু।   
  
ঐ অশ্রু বিন্দু পেরিয়ে এ জন্মে হয়তো  
আমি তোমার কাছে পৌঁছুতে পারবনা;  
তাহলে ,আগামী জন্ম গুলো আমি কার দিকে আসবো ?  
  
====== 


তোমার ক্ষমতা

তুমি ভাঙতে পারো বুক শুষে নিতে পারো সব রক্ত ও লবণ  
বিষাক্ত করতে পারো ঘুম স্বপ্নময় ঘুমের জগত  
তছনছ ক’রে দিতে পারো তুমি বন উপবন  
উল্টেপাল্টে দিতে পারো সব সিঁড়ি লিফট্ রাজপথ   
  
মিশিয়ে দিতেও পারো সঙ্গীতের সুরেসুরে বিষ  
আমাকে প্রগাঢ় কোনো আত্নহত্যায় উৎসাহিত ক’রে দিতে পারো  
ম’রে যাবে ধানক্ষেত ঝ’রে যাবে পাখিদের শিস  
তোমার ক্ষমতা আছে পারো তুমি আরো   
  
আমাকে মাতাল ক’রে ছেড়ে দিতে পারো তুমি গলির ভেতরে  
সমস্ত সড়কে তুমি জ্বালতে পারো লাল সিগনাল  
বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ ক’রে দিতে পারো জীবনের সবগুলো ঘরে  
এর বেশি আর তুমি কি পারো তমাল?  
  
====== 




তৃতীয় বিশ্বের একজন চাষীর প্রশ্ন

আগাছা ছাড়াই, আল বাঁধি, জমি চষি, মই দিই,  
বীজ বুনি, নিড়োই, দিনের পর  
দিন চোখ ফেলে রাখি শুকনো আকাশের দিকে। ঘাম ঢালি  
খেত ভ’রে, আসলে রক্ত ঢেলে দিই  
নোনা পানিরূপে; অবশেষে মেঘ ও মাটির দয়া হলে  
খেত জুড়ে জাগে প্রফুল্ল সবুজ কম্পন।  
খরা, বৃষ্টি, ঝড়, ও একশো একটা উপদ্রব কেটে গেলে  
প্রকৃতির কৃপা হ’লে এক সময়  
মুখ দেখতে পাই থোকাথোকা সোনালি শস্যের।  
এতো ঘামে, নিজেকে ধানের মতোই  
সিদ্ধ করে, ফলাই সামান্য, যেনো একমুঠো, গরিব শস্য।  
মূর্খ মানুষ, দূরে আছি, জানতে ইচ্ছে করে  
দিনরাত লেফ-রাইট লেফ-রাইট করলে ক-মণ শস্য ফলে  
এক গন্ডা জমিতে?  
  
====== 

তুমি হাতখানি রাখো

মূলঃ হেনরিক হাইনে  
প্রিয়তমা, তুমি হাতখানি রাখো আমার গুমোট বুকে।  
শুনতে পাচ্ছো শব্দ? কে যেনো হাতুড়ি ঠুকে চলছে?  
সেখানে এক মিস্ত্রি থাকে,যে বানিয়ে চলেছে  
এক শবাধার ।  
কার জন্যে জানো?—– আমার, আমার ।   
  
উল্লাসে বিদ্বেষে নিরন্তর সে হাতুড়ি  
ঠুকছে দুই হাতে,  
কিছুতে ঘুমোতে পারছিনা আমি,  
দিনে কিংবা রাতে।   
  
মিস্ত্রি, দ্রুত করো, তুমি কাজ  
শেষ করো তাড়াতাড়ি,  
যাতে আমি অবশেষে শান্তিতে ঘুম যেতে পারি ।।  
  
====== 

গোলামের গর্ভধারিণী 

আপনাকে দেখিনি আমি; তবে আপনি  
আমার অচেনা  
নন পুরোপুরি, কারণ বাঙলার  
মায়েদের আমি  
মোটামুটি চিনি, জানি। হয়তো  
গরিব পিতার ঘরে  
বেড়ে উঠেছেন দুঃক্ষিণী  
বালিকারূপে ধীরেধীরে;  
দুঃক্ষের সংসারে কুমড়ো ফুলের  
মতো ফুটেছেন  
ঢলঢল, এবং সন্ত্রস্ত ক’রে  
তুলেছেন মাতা  
ও পিতাকে। গরিবের ঘরে ফুল  
ভয়েরই কারণ।  
তারপর একদিন ভাঙা পালকিতে চেপে  
দিয়েছেন  
পাড়ি, আর এসে উঠেছেন আরেক গরিব  
ঘরে;  
স্বামীর আদর হয়তো ভাগ্যে  
জুটেছে কখনো, তবে  
অনাদর জুটেছে অনেক। দারিদ্র্য,  
পীড়ন, খণ্ড  
প্রেম, ঘৃণা, মধ্যযুগীয়  
স্বামীর জন্যে প্রথাসিদ্ধ  
ভক্তিতে আপনার কেটেছে জীবন।  
বঙ্গীয় নারীর  
আবেগে আপনিও চেয়েছেন বুক জুড়ে  
পুত্রকন্যা,  
আপনার মরদ বছরে একটা নতুন  
ঢাকাই  
শাড়ি দিতে না পারলেও বছরে বছরে  
উপহার  
দিয়েছেন আপনাকে একের পর এক  
কৃশকায়  
রুগ্ন সন্তান, এবং তাতেই আপনার  
শুষ্ক বুক  
ভাসিয়ে জেগেছে তিতাসের তীব্র  
জলের উচ্ছ্বাস।  
চাঁদের সৌন্দর্য নয়, আমি জানি  
আপনাকে মুগ্ধ  
আলোড়িত বিহ্বল করেছে সন্তানের  
স্নিগ্ধ মুখ,  
আর দেহের জ্যোৎস্না। আপনিও  
চেয়েছেন জানি  
আপনার পুত্র হবে সৎ, প্রকৃত  
মানুষ। তাকে  
দারিদ্র্যের কঠোর কামড় টলাবে  
না সততার  
পথ থেকে, তার মেরুদণ্ড হবে দৃঢ়,  
পীড়নে বা  
প্রলোভনে সে কখনো বুটদের সেজদা  
করবে না।  
আপনার উচ্চাভিলাষ থাকার তো কথা  
নয়, আপনি  
আনন্দিত হতেন খুবই আপনার পুত্র  
যদি হতো  
সৎ কৃষিজীবী, মেরুদণ্ডসম্পন্ন  
শ্রমিক, কিংবা  
তিতাসের অপরাজেয় ধীবর। আপনি  
উপযুক্ত  
শিক্ষা দিতে পারেন নি  
সন্তানকে;- এই পুঁজিবাদী  
ব্যবস্থায় এটাই তো স্বাভাবিক,  
এখানে মোহর  
ছাড়া কিছুই মেলে না, শিক্ষাও  
জোটে না। তবে এতে  
আপনার কোনো ক্ষতি নেই জানি;  
কারণ আপনি  
পুত্রের জন্যে কোনো রাজপদ, বা ও  
রকম কিছুই  
চান নি, কেবল চেয়েছেন আপনার  
পুত্র হোক  
সৎ, মেরুদণ্ডী, প্রকৃত মানুষ।  
আপনার সমস্ত  
পবিত্র প্রার্থনা ব্যর্থ ক’রে  
বিশশতকের এই  
এলোমেলো অন্ধকারে আপনার পুত্র  
কী হয়েছে  
আপনি কি তা জানেন তা, হে অদেখা  
দরিদ্র জননী?  
কেনো আপনি পুত্রকে  
পাঠিয়েছিলেন মুঘলদের  
এই ক্ষয়িষ্ণু শহরে, যেখানে  
কৃষক এসে লিপ্ত  
হয় পতিতার দালালিতে, মাঠের  
রাখাল তার  
নদী আর মাঠ হ’য়ে ওঠে হাবশি  
গোলাম?  
আপনি কি জানেন, মাতা, আপনার  
পুত্র শহরের  
অন্যতম প্রসিদ্ধ গোলাম আজ?  
আপনি এখন  
তাকে চিনতেও ব্যর্থ হবেন,  
আপনার পুত্রের দিকে  
তাকালে এখন কোনো মস্তক পড়ে না  
চোখে, শুধু  
একটা বিশাল কুঁজ চোখে পড়ে।  
দশকে দশকে  
যতো স্বঘোষিত প্রভু দেখা  
দিয়েছেন মুঘলদের  
এ-নষ্ট শহরে, আপনার পুত্র তাদের  
প্রত্যেকের  
পদতলে মাথা ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে  
পৃষ্ঠদেশ জুড়ে  
জন্মিয়েছে কুঁজ আর কুঁজ; আজ তার  
পৃষ্ঠদেশ  
একগুচ্ছ কুঁজের সমষ্টি;-  
মরুভূমিতে কিম্ভুত  
বহুকুঁজ উটের মতোই এখন দেখায়  
তাকে।  
সে এখন শহরের বিখ্যাত গোলাম  
মজলিশের  
বিখ্যাত সদস্য, গোলামিতে সে ও  
তার ইয়ারেরা  
এতোই দক্ষ যে প্রাচীন,  
ঐতিহাসিক গোলামদের  
গৌরব হরণ ক’রে তারা আজ মশহুর  
গোলাম  
পৃথিবীর। এখন সে মাথা তার  
তুলতে পারে না,  
এমনকি ভুলেও গেছে যে একদা তারও  
একটি  
মাথা ছিলো, এখন সে বহুশীর্ষ  
কুঁজটিকেই মাথা  
ব’লে ভাবে। খাদ্যগ্রহণের পর  
স্বাভাবিক পদ্ধতিও  
বিস্মৃত হয়েছে সে, প্রভুদের  
পাদুকার তলে  
প’ড়ে থাকা অন্ন চেটে খাওয়া ছাড়া  
আর কিছুতেই  
পরিতৃপ্তি পায় না আপনার পুত্র,  
একদা আপনার  
স্তন থেকে মধুদুগ্ধ শুষে নিয়ে  
জীবন ধারণ  
করতো যে বালক বয়সে। এখন সে  
শত্রু পাখি  
ও নদীর, শত্রু মানুষের, এমন কি  
সে আপনার  
স্তন্যেরও শত্রু। তার জন্য  
দুঃক্ষ করি না, কতোই  
তো গোলাম দেখলাম এ-বদ্বীপে  
শতকে শতকে।  
কিন্তু আপনার জন্যে, হে গরিব  
কৃষক-কন্যা, দুঃক্ষী  
মাতা, গরিব-গৃহিণী, আপনার জন্যে  
বড় বেশি  
দুঃখ পাই;- আপনার পুত্রের  
গোলামির বার্তা আজ  
রাষ্ট্র দিকে দিকে, নিশ্চয়ই তা  
পৌঁছে গেছে তিতাসের  
জলের গভীরে আর কুমড়োর খেতে,  
লাউয়ের  
মাঁচায়, পাখির বাসা আর চাষীদের  
উঠানের কোণে।  
তিতাসের জল আপনাকে দেখলে ছলছল  
ক’রে  
ওঠে, ‘ওই দ্যাখো গোলামের  
গর্ভধারিণীকে’; মাঠে  
পাখি ডেকে ওঠে, ‘দ্যাখো গোলামের  
গর্ভধারিণীকে’;  
আপনার পালিত বেড়াল দুধের বাটি  
থেকে  
দু-চোখ ফিরিয়ে বলে, ‘গোলামের  
গর্ভধারিণীর  
হাতের দুগ্ধ রোচে না আমার জিভে’,  
প্রতিবেশী  
পুরুষ-নারীরা অঙ্গুলি সংকেত  
ক’রে কলকণ্ঠে  
বলে, ‘দ্যাখো গোলামের  
গর্ভধারিণীকে।’ এমন কি  
প্রার্থনার সময়ও আপনি হয়তো বা  
শুনতে পান  
‘গোলামের গর্ভধারিণী, ধারিণী’  
স্বর ঘিরে ফেলছে  
চারদিক থেকে। আপনি যখন অন্তিম  
বিশ্রাম  
নেবেন মাটির তলে তখনো হয়তো  
মাটি ফুঁড়ে  
মাথা তুলবে ঘাসফুল, বাতাসের  
কানে কানে ব’লে  
যাবে, ‘এখানে ঘুমিয়ে আছেন এক  
গর্ভধারিণী  
গোলামের।’ ভিজে উঠবে মাটি  
ঠাণ্ডা কোমল অশ্রুতে।  
কী দোষ আপনার? মা কি কখনোও জানে  
দশমাস  
ধ’রে যাকে সে ধারণ করছে সে মানুষ  
না গোলাম?  
  
====== 

গোলাপ ফোটাবো

ওষ্ঠ বাড়িয়ে দাও গোলাপ ফোটাবো,  
বঙ্কিম গ্রীবা মেলো ঝরনা ছোটাবো।  
যুগল পাহাড়ে পাবো অমৃতের স্বাদ,  
জ্ব’লে যাবে দুই ঠোঁটে একজোড়া চাঁদ।  
সুন্দরীর নৌকো ঢুকাবো বঙ্গোপসাগরে,  
অতলে ডুববো উত্তাল আশ্বিনের ঝড়ে।  
শিউলির বোঁটা থেকে চুষে নেবো রস,  
এখনো আমার প্রিয় আঠারো বয়স।  
তোমার পুষ্পের কলি মধুমদগন্ধময়,  
সেখানে বিন্দু বিন্দু জমে আমার হৃদয়।  
  
====== 

গরীবের সৌন্দর্য 

গরিবেরা সাধারণত সুন্দর হয় না।  
গরিবদের কথা মনে হ’লে সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ে না কখনো।  
গরিবদের ঘরবাড়ি খুবই নোংরা, অনেকের আবার ঘরবাড়িই নেই।  
গরিবদের কাপড়চোপড় খুবই নোংরা, অনেকের আবার কাপড়চোপড়ই নেই।  
গরিবেরা যখন হাঁটে তখন তাদের খুব কিম্ভুত দেখায়।  
যখন গরিবেরা মাটি কাটে ইট ভাঙে খড় ঘাঁটে গাড়ি ঠেলে পিচ ঢালে তখন তাদের  
সারা দেহে ঘাম জবজব করে, তখন তাদের খুব নোংরা আর কুৎসিত দেখায়।  
গরিবদের খাওয়ার ভঙ্গি শিম্পাঞ্জির ভঙ্গির চেয়েও খারাপ।  
অশ্লীল হাঁ ক’রে পাঁচ আঙ্গুলে মুঠো ভ’রে সব কিছু গিলে ফেলে তারা।  
থুতু ফেলার সময় গরিবেরা এমনভাবে মুখ বিকৃত করে  
যেনো মুখে সাতদিন ধ’রে পচছিলো একটা নোংরা ইঁদুর।  
গরিবদের ঘুমোনোর ভঙ্গি খুবই বিশ্রী।  
গরিবেরা হাসতে গিয়ে হাসিটাকেই মাটি ক’রে ফেলে।  
গান গাওয়ার সময়ও গরিবদের একটুও সুন্দর দেখায় না।  
গরিবেরা চুমো খেতেই জানে না, এমনকি শিশুদের চুমো খাওয়ার সময়ও  
থকথকে থুতুতে তারা নোংরা করে দেয় ঠোঁট নাক গাল।  
গরিবদের আলিঙ্গন খুবই বেঢপ।  
গরিবদের সঙ্গমও অত্যন্ত নোংরা, মনে হয় নোংরা মেঝের ওপর  
সাংঘাতিকভাবে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে দু’টি উলঙ্গ অশ্লীল জন্তু।  
গরিবদের চুলে উকুন আর জট ছাড়া কোনো সৌন্দর্য নেই।  
গরিবদের বগলের তলে থকথকে ময়লা আর বিচ্ছিরি লোম সব জড়াজড়ি করে।  
গরিবদের চোখের চাউনিতে কোনো সৌন্দর্য নেই,  
চোখ ঢ্যাবঢ্যাব ক’রে তারা চারদিকে তাকায়।  
মেয়েদের স্তন খুব বিখ্যাত, কিন্তু গরিব মেয়েদের স্তন শুকিয়ে শুকিয়ে  
বুকের দু-পাশে দুটি ফোড়ার মতো দেখায়।  
অর্থাৎ জীবনযাপনের কোনো মুহূর্তেই গরিবদের সুন্দর দেখায় না।  
শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়।  
  
====== 

এইতো ছিলাম শিশু

এই তো ছিলাম শিশু এই তো ছিলাম বালক  
এই তো ইস্কুল থেকে ফিরলাম এই তো পাখির পালক  
কুড়িয়ে আনলাম এই তো মাঘের দুপুরে  
বাসা ভাঙলাম শালিকের সাঁতরিয়ে এলাম পুকুরে  
এই তো পাড়লাম কুল এই তো ফিরলাম মেলা থেকে  
এই তো পেলাম ভয় তেঁতুলতলায় এক সাদাবউ দেখে  
এই তো নবম থেকে উঠলাম দশম শ্রেণীতে  
এই তো রাখলাম হাত কিশোরীর দীঘল বেণীতে  
এই তো নিলাম তার ঠোঁট থেকে রজনীগন্ধা ।  
এরই মাঝে এতো বেলা ? নামলো সন্ধ্যা ?  
  
====== 

এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?

এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় ?  
তেমন যোগ্য সমাধি কই ?  
মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো  
অথবা সুনীল-সাগর-জল-  
সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই !  
তাইতো রাখি না এ লাশ  
আজ মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,  
হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।  
  
====== 

আত্মহত্যার অস্ত্রাবলি

রয়েছে ধারালো ছোরা স্লিপিং টেবলেট  
কালো রিভলবার  
মধ্যরাতে ছাদ  
ভোরবেলাকার রেলগাড়ি  
সারিসারি বৈদ্যুতিক তার।   
  
স্লিপিং টেবলেট খেয়ে অনায়াসে ম’রে যেতে পারি  
বক্ষে ঢোকানো যায় ঝকঝকে উজ্জ্বল তরবারি  
কপাল লক্ষ্য ক’রে টানা যায় অব্যর্থ ট্রিগার  
ছুঁয়ে ফেলা যায় প্রাণবাণ বৈদ্যুতিক তার  
ছাদ থেকে লাফ দেয়া যায়  
ধরা যায় ভোরবেলাকার রেলগাড়ি  
অজস্র অস্ত্র আছে  
যে-কোনো একটি দিয়ে আত্মহত্যা ক’রে যেতে পারি   
  
এবং রয়েছো তুমি  
সবচেয়ে বিষাক্ত অস্ত্র প্রিয়তমা মৃত্যুর ভগিনী  
তোমাকে ছুঁলে  
দেখলে এমনকি তোমার নাম শুনলে  
আমার ভেতরে লক্ষ লক্ষ আমি আত্মহত্যা করি।  
  
====== 




আমি সম্ভবত খুব ছোট কিছুর জন্য

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো  
ছোট ঘাসফুলের জন্যে  
একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে  
আমি হয়তো মারা যাবো চৈত্রের বাতাসে  
উড়ে যাওয়া একটি পাঁপড়ির জন্যে  
একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে।  
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো  
দোয়েলের শিসের জন্যে  
শিশুর গালের একটি টোলের জন্যে  
আমি হয়তো মারা যাবো কারো চোখের মণিতে  
গেঁথে থাকা একবিন্দু অশ্রুর জন্যে  
একফোঁটা রৌদ্রের জন্যে।  
আমি সম্ভবতখুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো  
এক কণা জ্যোৎস্নার জন্যে  
এক টুকরো মেঘের জন্যে  
আমি হয়তো মারা যাবো টাওয়ারের একুশ তলায়  
হারিয়ে যাওয়া একটি প্রজাপতির জন্যে  
এক ফোঁটা সবুজের জন্যে।  
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট  কিছুর জন্যে মারা যাবো  
খুব ছোট একটি স্বপ্নের জন্যে  
খুব ছোট দুঃখের জন্যে  
আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভেতরে  
একটি ছোটো দীর্ঘশ্বাসের জন্যে  
একফোঁটা সৌন্দর্যের জন্যে।  
  
====== 

সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে

আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।  
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক  
সব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে  
চ’লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল  
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র  
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদের  
অধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর ধানক্ষেত  
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক  
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ পবিত্র প্যাগোডা।  
অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ’লে গেছে, জনতাও যাবে;  
চাষার সমস্ত স্বপ্ন আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন  
সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।   
  
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।  
কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার চাঁদ  
নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ  
শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে।  
রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবিশংকরের  
সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙুর  
ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল  
কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে।  
চলে যাবে সেই সব উপকথাঃ সৌন্দর্য-প্রতিভা-মেধা;  
এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা  
নির্বাধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে  
অত্যন্ত উল্লাসভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।   
  
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।  
সবচে সুন্দর মেয়ে দুইহাতে টেনে সারারাত  
চুষবে নষ্টের লিঙ্গ; লম্পটের অশ্লীল উরুতে  
গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী। চ’লে যাবে,  
কিশোরীরা চ’লে যাবে, আমাদের তীব্র প্রেমিকারা  
ওষ্ঠ আর আলিঙ্গন ঘৃণা ক’রে চ’লে যাবে, নষ্টদের  
উপপত্নী হবে। এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র  
শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের স্বর  
গদ্য পদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স-লেনিন,  
আর বাঙলার বনের মত আমার শ্যামল কন্যা-  
রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক  
আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে।  
  
====== 

বাংলাদেশের কথা (আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম)

যখন আমরা বসি মুখোমুখি, আমাদের দশটি আঙুল হৃৎপিন্ডের মতো কাঁপতে থাকে  
দশটি আঙুলে, আমাদের ঠোঁটের গোলাপ ভিজে ওঠে আরক্ত শিশিরে,  
যখন আমরা আশ্চর্য আঙুলে জ্বলি, যখন আমরাই পরষ্পরের স্বাধীন স্বদেশ,  
তখন ভুলেও কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা জিজ্ঞেস করো না;  
আমি তা মূহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, -তার অনেক কারণ রয়েছে।  
তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।  
জানতে চেয়ো না তুমি নষ্টভ্রষ্ট ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের কথা, তার রাজনীতি,  
অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমন্ডলি, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ,  
মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন ক’রে আমাকে পীড়ন কোরো না;  
আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, – তার অনেক কারণ রয়েছে ।   
  
তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।  
জানতে চেয়ো না তুমি নষ্ট ভ্রষ্ট ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ  
মাইলের কথা: তার রাজনীতি  
অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যম-লী  
জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ  
মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন  
করে আমাকে পীড়ন কোরো না   
  
তার ধানক্ষেত এখনো সবুজ, নারীরা এখনো রমনীয়, গাভীরা এখনো দুগ্ধবতী,  
কিন্তু প্রিয়তমা, বাঙলাদেশের কথা তুমি কখনো আমার কাছে জানতে চেয়ো না;  
আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, তার অনেক কারণ রয়েছে।  
  
====== 
















একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন