আমার কোন শব্দ যেন আর
আমার কোনো শব্দ
যেনো আর সরব না হয়। আমি আর
কথা বলো না শব্দে,
হাহাকার করবো না
এমন বস্তুতে যা হয় ধ্বনিত,
ভালোবাসবো না
বাক্যে
যা শ্রুতিকে আলোড়িত করে।
আমি কথা বলবো
অশব্দে।
আমার ভাষা
দিগন্ত-ছোঁয়া ঘাসের মত সবুজ,
সুখ-অশব্দ শিশির,
হাহাকার
অশব্দ নীলিমার পর অশব্দ নীলিমা।
আমার গান
সবুজ পাতার ওপর
ভুল-ক’রে-ঘুমিয়ে-পড়া প্রজাপতি,
ভালোবাসা
জলে ডোবা চাঁদ নীরব নির্জন।
=========
থাবা
সবুজ তরুর পাশে জ্বলন্ত অঙ্গার লাল দীপ্র থাবা জ্বলে।
অদ্ভুত ভীতিতে কাঁপে জলস্থল; সৌধাবলি নগ্ন পদতলে
ভয়ার্ত চিৎকারসম প’ড়ে আছে। বেজে যায় পাথরের ধাতব রাগিনী–
থাবা মেলে আছো তুমি সর্বলোক অপরূপা অভিচারী অদৃশ্য বাঘিনী।
তোমার অদৃশ্য থাবা সর্বগ্রাসী, অলৌকিক লাল গ্রন্থ, প্রতিটি অক্ষরে–
মরুঝড় অগ্ন্যুৎপাত, কাগজের মতো ছিঁড়ো ধাতু-লোহা-শব্জি-পুষ্পরে।
অত্যন্ত ভেতরে জ্বলে বাক্যমালা- দাবানলে পোড়ে নরলোক।
বৃক্ষের ব্যুৎপত্তি শিখি, পাঠ করি কিসে সারে মাংসের অসুখ
পাখি আর পশুদের মানুষের, স্বপ্নের নির্মাণ নিয়ে করি গবেষণা,
যতো দিন কবি আছে ততো দিন জেগে রবে অচেনা প্রেরণা।
তোমার আগুনে গাছে ফুল ফোটে তোমার আদরে জলে বয় দীর্ঘ নদী
তোমার দংশনে মাটি অরণ্যের শোভা পায় দক্ষিণের সমুদ্র অবধি;
তোমার দহনে ওষ্ঠ প্রেম শেখে, রক্তমাংস শেখে নর্মক্রিয়া–
থাম ওঠে সভ্যতার; জন্ম নেয় ভারত, মিসর, সিন্ধু, মেসোপটেমিয়া।
নদী ও মাটির বাক্য পথেপথে, চতুর্দিকে জল ও স্থলের প্রতীক,
চোখের চিত্রকল্প দৃষ্টি জুড়ে, বিশেষণপুঞ্জ ধ্যানী গভীর স্বাপ্নিক;
পাপ ও পূণ্যের তুমি যুগ্মশয্যা, আলিঙ্গনে সলোমন-শাবা-
ব্যাপক মেদিনী ভ’রে দগদগে পুষ্পের মতো চিরকাল মেলে আছো থাবা।
=========
পেরোনোর কিছু নেই
ধুধু মাঠ;-পার হয়ে যেতে হবে সন্ধ্যার আগেই।
একলা হাঁটছি, দৌড়চ্ছি, দেখছি রাত প্রস্তুতি নিচ্ছে
বিদ্যুতে মাটিতে; কেঁপে উঠছি, জ’মে যাচ্ছি, ভেঙ্গে পড়ছি;
হয়তো পেরোতে পারবো না, হয়তো হারিয়ে যাবো অন্ধকারে।
তারপর দেখি সন্ধ্যার আগেই পৌছে গেছি মাঠের এপারে।
নদী;-পার হয়ে যেতে হবে; ঢেউ ছাড়া কোনো নৌকো
নেই; ঢেউয়ে চ’ড়ে পার হ’তে হবে। পা রেখেছি ঢেউয়ে
যেমন মাঝি পা রেখে নৌকোর গলুইয়ে; তারপর শুধুই সাঁতার।
খল জল টানে দশ হাতে, অবিরল ঘূর্ণিপাক চেপে ধরে গলা,
বাহুতে সাঁতার, তারপর তাকিয়ে দেখি নদী হয়ে গেছি পার।
পাহাড়;-দাঁড়ানো পথ জুড়ে, খাড়া উঠে গেছে মেঘে;-পার
হয়ে যেতে হবে। পিছলে পড়েছি, দাঁড়িয়েছি, মাঝরাতে ঝুলে
থেকেছি শিংয়ের মতো পাথরের কোণা ধ’রে জমে গেছি শীতে,
খাঁদে কাটিয়েছি দীর্ঘ রাত, আবার উঠেছি দেহ বেয়ে,
এক সময় দেখেছি পাহাড় থেকে নামছি সমতল সবুজ ভূমিতে।
মরুভূমি;-পার হ’তে হবে; আগুনই সত্য, ঢুকেছি আগুনে।
ছিটকে পড়েছি, মাথা গুঁজে প’ড়ে থেকেছি দুপুরে মরুভূমি
জুড়ে, স্বপ্নে দেখেছি সবুজ, চোখের সামনে বয়ে গেছে মায়ানদী,
জলের তৃষ্ণায় কঙ্কাল জড়িয়ে প’ড়ে থেকেছি বালুতে।
এক সময় দেখতে পেলাম পার হয়ে গেছি মরুভূমি।
আজ পেরোনোর কিছু নেই, ব’সে আছি-স্তব্ধ, শুনি শূন্য বাতাসের
শব্দ, দেখি অন্ধকার নেমে আসে মাঠে জলে শস্যে শব্জিতে।
==========
প্রার্থনালয়
ছেলেবেলায় আমি যেখানে খেলতাম
তিরিশ বছর গিয়ে দেখি সেখানে একটি মসজিদ উঠেছে।
আমি জানতে চাই ছেলেরা এখন খেলে কোথায়?
তারা বলে ছেলেরা এখন খেলে না, মসজিদে পাঁচবেলা নামাজ পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় বুড়িগঙ্গার ধারে বেড়াতে গিয়ে
যেখানে একঘণ্টা পরস্পরের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলাম আমি আর মরিয়ম,
গিয়ে দেখি সৌদি সাহায্যে সেখানে একটা লাল ইটের মসজিদ উঠেছে।
কোথাও নিষ্পলক দৃষ্টি নেই চারদিকে জোব্বা আর আলখাল্লা।
পঁচিশ বছর আগে বোম্বাই সমুদ্রপারে এক সেমিনারে গিয়ে
যেখানে আমরা সারারাত নেচেছিলাম আর পান করেছিলাম আর নেচেছিলাম,
১৯৯৫-এ গিয়ে গিয়ে দেখি সেখানে এক মস্ত মন্দির উঠেছে।
দিকে দিকে নগ্ন সন্ন্যাসী, রাম আর সীতা, সংখ্যাহীন হনুমান;
নাচ আর পান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
ফার্থ অফ ফোর্থের তীরের বনভূমিতে যেখানে সুজ্যান আমাকে
জড়িয়ে ধ’রে বাড়িয়ে দিয়েছিলো লাল ঠোঁট,
সেখানে গিয়ে দেখি মাথা তুলেছে এক গগনভেদি গির্জা।
বনভূমি ঢেকে আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত ঝুলছে এক ক্রুদ্ধ ক্রুশকাঠ।
আমি জিজ্ঞেস করি কেনো দিকে দিকে দিকে এতো প্রার্থণালয়।
কেনো খেলার মাঠ নেই গ্রামে?
কেনো নদীর ধারে নিষ্পলক পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকার স্থান নেই?
কেনো জায়গা নেই পরস্পরকে জড়িয়ে ধ’রে চুম্বনের?
কেনো জায়গা নেই নাচ আর পানের?
তারা বলে পৃথিবী ভ’রে গেছে পাপে, আসমান থেকে জমিন ছেয়ে গেছে গুনাহ্য়
তাই আমাদের একমাত্র কাজ এখন শুধুই প্রার্থনা।
চারদিকে তাকিয়ে আমি অজস্র শক্তিশালী মুখমণ্ডল দেখতে পাই,
তখন আর একথা অস্বীকার করতে পারি না।
==========
সেই কবে থেকে
সেই কবে থেকে জ্বলছি
জ্ব’লে জ্ব’লে নিভে গেছি ব’লে
তুমি দেখতে পাও নি।
সেই কবে থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছি
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাতিস্তম্ভের মতো ভেঙে পড়েছি ব’লে
তুমি লক্ষ্য করো নি।
সেই কবে থেকে ডাকছি
ডাকতে ডাকতে স্বরতন্ত্রি ছিঁড়ে বোবা হয়ে গেছি ব’লে
তুমি শুনতে পাও নি‘।
সেই কবে থেকে ফুটে আছি
ফুটে ফুটে শাখা থেকে ঝ’রে গেছি ব’লে
তুমি কখনো তোলো নি।
সেই কবে থেকে তাকিয়ে রয়েছি
তাকিয়ে তাকিয়ে অন্ধ হয়ে গেছি ব’লে
একবারো তোমাকে দেখি নি।
==========
আমাকে ভালোবাসার পর
আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার,
যেমন হিরোশিমার পর আর কিছুই আগের মতো নেই
উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত।
যে কলিংবেল বাজে নি তাকেই মুর্হুমুহু শুনবে বজ্রের মত বেজে উঠতে
এবং থরথর ক’রে উঠবে দরোজাজানালা আর তোমার হৃৎপিন্ড।
পরমুহূর্তেই তোমার ঝনঝন-ক’রে ওঠা এলোমেলো রক্ত
ঠান্ডা হ’য়ে যাবে যেমন একাত্তরে দরোজায় বুটের অদ্ভুদ শব্দে
নিথর স্তব্ধ হ’য়ে যেত ঢাকা শহরের জনগণ।
আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
রাস্তায় নেমেই দেখবে বিপরীত দিক থেকে আসা প্রতিটি রিকশায়
ছুটে আসছি আমি আর তোমাকে পেরিয়ে চ’লে যাচ্ছি
এদিকে-সেদিকে। তখন তোমার রক্ত আর কালো চশমায় এত অন্ধকার
যেনো তুমি ওই চোখে কোন কিছুই দ্যাখো নি।
আমাকে ভালবাসার পর তুমি ভুলে যাবে বাস্তব আর অবাস্তব,
বস্তু আর স্বপ্নের পার্থক্য। সিঁড়ি ভেবে পা রাখবে স্বপ্নের চূড়োতে,
ঘাস ভেবে দু-পা ছড়িয়ে বসবে অবাস্তবে,
লাল টুকটুকে ফুল ভেবে খোঁপায় গুঁজবে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন।
না-খোলা শাওয়ারের নিচে বারোই ডিসেম্বর থেকে তুমি অনন্তকাল দাঁড়িয়ে
থাকবে এই ভেবে যে তোমার চুলে ত্বকে ওষ্ঠে গ্রীবায় অজস্র ধারায়
ঝরছে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল।
তোমার যে ঠোঁটে চুমো খেয়েছিলো উদ্যমপরায়ণ এক প্রাক্তন প্রেমিক,
আমাকে ভালবাসার পর সেই নষ্ট ঠোঁট খঁসে প’ড়ে
সেখানে ফুটবে এক অনিন্দ্য গোলাপ।
আমাকে ভালবাসার পর আর কিছুই আগের মত থাকবে না তোমার।
নিজেকে দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত মনে হবে যেনো তুমি শতাব্দীর পর শতাব্দী
শুয়ে আছো হাসপাতালে। পরমুহূর্তেই মনে হবে
মানুষের ইতিহাসে একমাত্র তুমিই সুস্থ, অন্যরা ভীষণ অসুস্থ।
শহর আর সভ্যতার ময়লা স্রোত ভেঙে তুমি যখন চৌরাস্তায় এসে
ধরবে আমার হাত, তখন তোমার মনে হবে এ-শহর আর বিংশ শতাব্দীর
জীবন ও সভ্যতার নোংরা পানিতে একটি নীলিমা-ছোঁয়া মৃণালের শীর্ষে
তুমি ফুটে আছো এক নিষ্পাপ বিশুদ্ধ পদ্ম-
পবিত্র অজর।
==========
Tags
হুমায়ুন আজাদ