পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতা সংগ্রহ

 


হে সময়, অশ্বারোহী হও

- পূর্ণেন্দু পত্রী

বিরক্ত নদীর মতো ভুরু কুঁচকে বসে আছে আমাদের কাল।
যাচ্ছি যাব, যাচ্ছি যাব এই গড়িমসি করে চূড়ো ভাঙা চাকা ভাঙা রথ
যে রকম ঘাড় গুজে ধুলোয় কাতর, সে রকমই শুয়ে বসে আছে।
খেয়াঘাটে পারাপার ভুলে-যাওয়া, নৌকার মতন, সময় এখন।

মনে হয় সময়ের পায়ে ফুটে গেছে দীর্ঘ পেরেক বা মনসার কাঁটা
ছিড়ে গেছে স্ম্যান্ডেলের স্ট্র্যাপ কিংবা জুতোর গোড়ালি
মনে হয় তার সব কোটপ্যান্ট ধোবার ভাটিতে
হয়তো বা কোনও এক লেকা্যাল ট্রেনের হু হু ভিড়ে
চুরি হয়ে গেছে পার্স, পার্সে ছিল অগ্রিম টিকিট।

প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে নিয়ে যাবে পাহাড়ের সোনালী চূড়োয়
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আকাশের সিথি থেকে সিদুরের টিপ এনে দেবে
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে নক্ষত্রের ক্যামেরায় ছবি তুলে উপহার দেবে অ্যলবাম
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে কলকাতায় এন দেবে শঙ্খের সাগর।

প্রতিশ্রুতি যত্রতত্র ছড়াবার ছিটোবার কথ, থুতু, মলমুত্র নয়
প্রতিশ্রুতি লাল নীল পতাকার ব্যতিব্যস্ত ওড়াউড়ি নয়
প্রতিশ্রুতি প্রেসনোট, দৈববাণী, দেয়ারের লিপিচিত্র নয়।
প্রতিশ্রুতি শীতের চাদর
প্রতিশ্রুতি ভাঙা চালে খড়
প্রতিশ্রুতি সাদা ভাত, ভাতে দুধ, দুধে ঘন সর
প্রতিশ্রুতি চেতনার স্তরে স্তরে সপ্তসিন্ধুজলের মর্মর।

হে সময়, হে বিকলাঙ্গ বিভ্রান্ত সময়
কানা কুকুরের মতো এটো-কাটা ঘাঁটাঘাঁটি ভুলে
পৃথিবীর আয়নায় মুখ রেখে জামা জুতো পরে
সূর্যের বল্লম হাতে, একবার অশ্বারোহী হও।



হালুম
- পূর্ণেন্দু পত্রী

মাথায় মুকুটটা পরিয়ে দিতেই রাজা হয়ে গেলেন তিনি।
আর সিংহাসনে পাছা রেখেই হাঁক পাড়লেন
হালুম।
অমনি মন্ত্রীরা ছুটলো ঘুরঘুট্টি বনে হরিণের মাংস সেকতে
সেনাপতিরা ছুটলো খলখলে সমুদ্রে ফিস-ফ্রাইয়ের খোঁজে
কোতোয়ালরা ছুটলো হাটে-বাজারে যেখান থেকে যা আনা যায় উপড়ে
বরকন্দাজেরা ক্ষেত খামার ল্ড ভণ্ড করে বানালো ফ্রুটল্যলাড।
রাজা সরলেন ব্রেক ফাস্ট।
তারপরেই সিং-দুয়ারে বেজে উঠলো সাত-মণ সোনার ঘন্টা।
এবার রাজদরবার।
আসমুদ্র-হিমাচরের ন্যাংটো, আধ-ন্যাংটো জন্তু-জানোয়ারের ঝাঁক
পিলপিলিয়ে জড়ো হল রাজ-চত্বরে।
মন্ত্রী জানালো, প্রভু!
জনতা হাজির। ওরা প্রসাদ পেতে চায় আপনার অমৃত ভাষণের।
অমনি উত্তরে, দক্ষিণে, পুবে, পশ্চিমে, ঈশানে, নৈঋতে,
গাছে, পাতায়, শিশিরে, শ্মশানে, ধুলোয়, ধোয়ায়, কুয়াশায়
আকাশে, বাতাসে, হাড়ে, মাসে, পেটে, পাঁজরে
গর্জন করে উঠলো, সাড়ে সাতমো অ্যামপ্লিফায়ার
-হালুম।


স্রোতস্বিনী আছে, সেতু নেই
- পূর্ণেন্দু পত্রী

তুমি বললে, রৌদ্র যাও, রৌদ্রে তো গেলাম
তুমি বললে, অগ্নিকুণ্ড জ্বালো, জ্বালালাম।
সমস্ত জমানো সুখ-তুমি বললে, বেচে দেওয়া ভালো
ডেকেছি নীলাম।
তবু আমি একা।
আমাকে করেছ তুমি একা।
একাকিত্বটুকুতেও ভেঙে চুরে শত টুকরো করে
বীজ বপনের মতো ছড়িয়ে দিয়েছ জলে-স্থলে।
তুমি বলেছিলে বলে সাজসজ্জা ছেড়েছি, ছুঁড়েছি।
যে অরণ্য দেখিয়েছ, তারই ডাল কেটেছি, খুঁড়েছি।
যখনই পেতেছ হাত দিয়েছি উপুড় করে প্রাণ
তবু আমি একা।
তবুও আমার কেউ নও তুমি
আমিও তোমার কেউ নই।
আমাদের অভ্যন্তরে স্রোতস্বিনী আছে, সেতু নেই।


সেই সবও তুমি
- পূর্ণেন্দু পত্রী

তোমাকেই দৃশ্য মনে হয়।
তোমার ভিতরে সব দৃশ্য ঢুকে গেছে।
কাচের আলমারি যেন, থাকে থাকে, পরতে পরতে
শরতের, হেমন্তের, বসন্তের শাড়ি গয়না দুল,
নদীর নবীন বাঁকা, বৃষ্টির নুপুর, জল, জলদ উদ্ভিদ।

সাঁচীস্তুপে, কোনারকে যায় যারা, গিয়ে ফিরে আসে
দুধ জ্বাল দিয়ে দিয়ে ক্ষীর করা স্বাদ জিভে নিয়ে
তোমার ভিতরে সেই ভাস্কর্যেরও লাবণ্য রয়েছে।
কোন্‌খানে আছে?
চুলে না গ্রীবায়, নাকি স্তনে?

হাজারিবাগের গাঢ় জঙ্গলের গন্ধ পাই তোমার জঙ্ঘায়।
ভয়াবহ খাদ থেকে নাচের মাদল, বাঁশী ডাকে।
বহুদূর ভেসে যেতে যতখানি ঝর্নাজল লাগে
তাও আছে, কোনখানে আছে?
চোখে, না চিবুকে?

দুমকায় তোমারই মতো একটি পাহাড়ী টিলা
মেঘের আয়নায় মুখ রেখে
খোঁপায় গুজছিল লাল গোধূলির ফুল।
তুমি কালএমন তাকালে
মনে হলো বীরভুমের দিগন্তের দাউ দাউ পলাশ।
জয়পুরের জালি কাটা ঝুল-বারান্দার মতো সমৃদ্ধ খিলান,
তাও আছে। কোন্‌খানে আছে?
ভূরুতে, না ঠোঁটে?

জলপাইগুড়ির কোনো ছাদ থেকে কাঞ্চনজঙঘার
যতটুকু আলো, ওড়না, নীলরশ্মি
সেই সবও তুমি।




সরোদ বাজাতে জানলে
- পূর্ণেন্দু পত্রী

আমার এমন কিছু দুঃখ আছে যার নাম তিলক কামোদ
এমন কিছু স্মৃতি যা সিন্ধুভৈরবী
জয়জয়ন্তীর মতো বহু ক্ষত রয়ে গেছে ভিতর দেয়ালে
কিছু কিচু অভিমান
ইমনকল্যাণ।
সরোদ বাজাতে জানলে বড় ভালো হতো।
পুরুষ কিভাবে কাঁদে সেই শুধু জানে।

কার্পেটে সাজানো প্রিয় অন্তঃপুরে ঢুকে গেছে জল।
মুহুর্মুহু নৌকাডুবি, ভেসে যায় বিরুদ্ধ নোঙর।
পৃথিবীর যাবতীয় প্রেমিকের সপ্তডিঙা ডুবেছে যেখানে
সেখানে নারীর মতো পদ্ম ফুটে থাকে।
জল হাসে, জল তার চুড়িপরা হাতে,
নর্তকীর মতো নেচে ঘুরে ঘুরে ঘাগরার ছোবলে
সব কিছু কেড়ে নেয়, কেড়ে নিয়ে ফের ভরে দেয়
বাসি হয়ে যাওয়া বুকে পদ্মগন্ধ, প্রকাশ্য উদ্যন।
এই অপরূপ ধ্বংস, মরচে-পড়া ঘরে দোরে চাঁপা এই চুনকাম
দরবারী কানাড়া এরই নাম?

সরোদ কাজাতে জানলে বড় ভালো হতো।
পুরুষ কীভাবে বাঁচে সেই শুধু জানে।




যোগো
- পূর্ণেন্দু পত্রী

জলেও কি ট্রাম-বাস চলে?
জলেও কি আছে ছাপাখানা?
২৫শে বৈশাখ এলে জলের ভিতরে মাছ, নক্ষত্রের ঝাঁক
তারাও কি কবিতার খাতা খুলে বসে?
যোগো,
জলের ভিতরে গিয়ে কার কার কবিতা কুড়োলি?
নিজের খাটের চেয়ে শ্যাওলার বিছানা কি অধিক নরম?
তুই কি কলম ফেলে কেবল জলের ঢেউ দিয়ে
কবিতার ভূল-ভাল, পৃথিবীর ভূল-ভাল প্রুফ কেটে-কুটে
সারারাত জেগেছিলি জলে?
যোগো,
জলের ভিতরে দিয়ে কার কার কবিতা কুড়োলি?



ময়ূর দিয়েছে
- পূর্ণেন্দু পত্রী

একটি ময়ুর তার পেখমের সবটুকু অভ্র ও আবীর দিয়েছে আমাকে।
একটি ময়ূর তার হৃদয়ের বিছানা বালিশে
মশারির টাঙানো খাটে, দরজায়, জানালায়, নীল আয়নায়
অতিথিশালার মতো যখন-তখন এসে ঘুমোবার, হেঁটে বেড়াবার
সুখটুকু, স্বাধীনতাটুকু
সোনার চাবির মতো হাতে তুলে দিয়েছে স্বেচ্ছায়।
এটোঁ কলাপাতা ঘেঁটে অকস্মাৎ জাফরাণের ঘ্রাণ পেয়ে গেলে
ভিখারীরা যে রকম পরিতৃপ্ত হয়,
সে রকমই সুখ পেয়ে হাঁসের মতন ডুবে আছি
হিমে-রোদে, জলে স্থলে, জয়ে পরাজয়ে।
মনে হয় নিমন্ত্রণ পেয়ে গেছি নক্ষত্রলোকের।
কখন অজ্ঞাতসারে পকেটে কে পুরে দিয়ে গেছে ভিসা পাসপোর্ট
সব উড়োজাহাজের এয়ারপোর্টের
সমুদ্রের কিনারের সব কটি উচু মিনারের।
রেশমের, পশমের, মখমলের মতো শান্তি সঙ্গী হয়ে আছে।

একটি ময়ূর তার হৃদয়ের অপর্যাপ্ত অভ্র ও আবীরে
আমার গায়ের আঁশ, ক্ষয়, ক্ষতি, ক্ষত, অক্ষমতা
সব কিছু রাঙিয়ে দিয়েছে।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন