কাজী নজরুল ইসলাম এর কয়েকটি কবিতা

 

হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক
- কাজী নজরুল ইসলাম

হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই 
ভারতের দুই আঁখি তারা 
এক বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদম চারা।। 

যেন গঙ্গা সিন্ধু নদী 
যায় গো বয়ে নিরবধি 
এক হিমালয় হতে আসে, এক সাগরে হয় গো হারা।। 

বুলবুল আর কোকিল পাখী 
এক কাননে যায় গো ডাকি, 
ভাগীরথী যমুনা বয় মায়ের চোখের যুগল ধারা।। 

ঝগড়া করে ভায়ে ভায়ে 
এক জননীর কোল লয়ে 
মধুর যে এ কলহ ভাই পিঠোপিঠী ভায়ের পারা।। 

পেটে ধরা ছেলের চেয়ে চোখে ধরারা মায়া বেশী, 
অতিথী ছিল অতীতে, আজ সে সখা প্রতিবেশী। 
ফুল পাতিয়ে গোলাপ বেলী 
একই মায়ের বুকে খেলি, 
পাগলা তা'রা আল্লা ভগবানে ভাবে ভিন্ন যারা।।



সংকল্প
- কাজী নজরুল ইসলাম

থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,- 
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে। 
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে 
ছুটছে তারা কেমন করে, 
কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে, 
কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণারে।। 

কেমন করে বীর ডুবুরী সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে, 
কেমন করে দুঃসাহসী চলছে উড়ে স্বরগ পানে। 
জাপটে ধরে ঢেউয়ের ঝুঁটি 
যুদ্ধ-জাহাজ চলছে ছুটি, 
কেমন করে আঞ্ছে মানিক বোঝাই করে সিন্ধু-যানে, 
কেমন জোরে টানলেসাগর উথলে ওঠে জোয়ার বানে। 

কেমন করে মথলে পাথার লক্ষী ওঠেন পাতাল ফুঁড়ে, 
কিসের অভিযানে মানুষ চলছে হিমালয় চুড়ে। 
তুহিন মেরু পার হয়ে যায় 
সন্ধানীরা কিসের আশায়; 
হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পুরেঃ 
শুনবো আমি, ইঙ্গিত কোন 'মঙ্গল' হতে আসছে উড়ে।। 

কোন বেদনার টিকিট কেটে চন্ডু-খোর এ চীনের জাতি 
এমন করে উদয়-বেলায় মরণ-খেলায় ওঠল মাতি। 
আয়ার্ল্যান্ড আজ কেমন করে 
স্বাধীন হতে চলছে ওরেঃ 
তুরষ্ক ভাই কেমন করে কাঁটল শিকল রাতারাতি! 
কেমন করে মাঝ গগনে নিবল গ্রীসের সূর্য-বাতি।। 

রইব না কো বদ্ধ খাঁচায়, দেখব এ-সব ভুবন ঘুরে- 
আকাশ বাতাস চন্দ্র-তারায় সাগর-জলে পাহাড়-চুঁড়ে। 
আমার সীমার বাঁধন টুটে 
দশ দিকেতে পড়ব লুটেঃ 
পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়েঃ 
বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।।




মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যম
- কাজী নজরুল ইসলাম

মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যম 
মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল, 
মোরা বিধাতার মত নির্ভয় 
মোরা প্রকৃতির মত স্বচ্ছল।। 
মোরা আকাশের মত বাঁধাহীন 
মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন, 
বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন 
চিত্তমুক্ত শতদল।। 
মোরা সিন্ধু জোঁয়ার কলকল 
মোরা পাগলা জোঁয়ার ঝরঝর। 
কল-কল-কল, ছল-ছল-ছল 
মোরা দিল খোলা খোলা প্রান্তর, 
মোরা শক্তি অটল মহীধর। 
হাসি গান শ্যাম উচ্ছল 
বৃষ্টির জল বনফল খাই- 
শয্যা শ্যামল বনতল।।

কবি-রাণী
- কাজী নজরুল ইসলাম

তুমি আমায় ভালোবাসো তাই তো আমি কবি। 
আমার এ রূপ-সে যে তোমায় ভালোবাসার ছবি।। 
আপন জেনে হাত বাড়ালো- 
আকাশ বাতাস প্রভাত-আলো, 
বিদায়-বেলার সন্ধ্যা-তারা 
পুবের অরুণ রবি,- 
তুমি ভালোবাস ব’লে ভালোবাসে সবি? 

আমার আমি লুকিয়েছিল তোমার ভালোবাসায়, 
তুমিই আমার মাঝে আসি’ 
অসিতে মোর বাজাও বাঁশি, 
আমার পূজার যা আয়োজন 
তোমার প্রাণের হবি। 
আমার বাণী জয়মাল্য, রাণি! তোমার সবি।। 

তুমি আমায় ভালোবাস তাই তো আমি কবি। 
আমার এ রূপ-সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।।



এক আল্লাহ জিন্দাবাদ
- কাজী নজরুল ইসলাম

উহারা প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ; 
আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ। 
উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ, 
আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ। 

উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহীদি দরজা চাই; 
নিত্য মৃত্যু-ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই! 
ওরা মরিবেনা, যুদ্ব বাধিঁলে ওরা লুকাইবে কচুবনে, 
দন্তনখরহীন ওরা তবু কোলাহল করে অঙ্গনে। 

ওরা নির্জীব; জিব নাড়ে তবু শুধূ স্বার্থ ও লোভবশে, 
ওরা জিন, প্রেত, যজ্ঞ, উহারা লালসার পাঁকে মুখ ঘষে। 
মোরা বাংলার নব যৌবন,মৃত্যুর সাথে সন্তরী, 
উহাদের ভাবি মাছি পিপীলিকা, মারি না ক তাই দয়া করি। 

মানুষের অনাগত কল্যাণে উহারা চির অবিশ্বাসী, 
অবিশ্বাসীরাই শয়তানী-চেলা ভ্রান্ত-দ্রষ্টা ভুল-ভাষী। 
ওরা বলে, হবে নাস্তিক সব মানুষ, করিবে হানাহানি। 
মোরা বলি, হবে আস্তিক, হবে আল্লাহ মানুষে জানাজানি। 

উহারা চাহুক অশান্তি; মোরা চাহিব ক্ষমাও প্রেম তাহার, 
ভূতেরা চাহুক গোর ও শ্মশান, আমরা চাহিব গুলবাহার! 
আজি পশ্চিম পৃথিবীতে তাঁর ভীষণ শাস্তি হেরি মানব 
ফিরিবে ভোগের পথ ভয়ে, চাহিবে শান্তি কাম্য সব। 

হুতুম প্যাচারা কহিছে কোটরে, হইবেনা আর সূর্যোদয়, 
কাকে আর তাকে ঠোকরাইবেনা, হোক তার নখ চষ্ণু ক্ষয়। 
বিশ্বাসী কভু বলেনা এ কথা, তারা আলো চায়, চাহে জ্যোতি; 
তারা চাহে না ক এই উৎপীড়ন এই অশান্তি দূর্গতি। 

তারা বলে, যদি প্রার্থনা মোরা করি তাঁর কাছে এক সাথে, 
নিত্য ঈদের আনন্দ তিনি দিবেন ধুলির দুনিয়াতে। 
সাত আসমান হতে তারা সাত-রঙা রামধনু আনিতে চায়, 
আল্লা নিত্য মহাদানী প্রভূ, যে যাহা চায়, সে তাহা পায়। 

যারা অশান্তি দুর্গতি চাহে, তারা তাই পাবে, দেখো রে ভাই, 
উহারা চলুক উহাদের পথে, আমাদের পথে আমরা যাই। 
ওরা চাহে রাক্ষসের রাজ্য, মেরা আল্লার রাজ্য চাই, 
দ্বন্দ্ব-বিহীন আনন্দ-লীলা এই পৃথিবীতে হবে সদাই। 

মোদের অভাব রবে না কিছুই, নিত্যপূর্ণ প্রভূ মোদের, 
শকুন শিবার মত কাড়াকাড়ি করে শবে লয়ে-- শখ ওদের! 
আল্লা রক্ষা করুন মোদেরে, ও পথে যেন না যাই কভূ, 
নিত্য পরম-সুন্দর এক আল্লাহ্ আমাদের প্রভূ। 

পৃথিবীতে যত মন্দ আছে তা ভালো হোক, ভালো হোক ভালো, 
এই বিদ্বেষ-আঁধার দুনিয়া তাঁর প্রেমে আলো হোক, আলো। 
সব মালিন্য দূর হয়ে যাক সব মানুষের মন হতে, 
তাঁহার আলোক প্রতিভাত হোক এই ঘরে ঘরে পথে পথে। 

দাঙ্গা বাঁধায়ে লুট করে যারা, তার লোভী, তারা গুন্ডাদল 
তারা দেখিবেনা আল্লাহর পথ চিরনির্ভয় সুনির্মল। 
ওরা নিশিদিন মন্দ চায়, ওরা নিশিদিন দ্বন্দ চায়, 
ভূতেরা শ্রীহীন ছন্দ চায়, গলিত শবের গন্ধ চায়! 

তাড়াবে এদের দেশ হতে মেরে আল্লার অনাগত সেনা, 
এরাই বৈশ্য, ফসল শৈস্য লুটে খায়, এরা চির চেনা। 
ওরা মাকড়সা, ওদের ঘরের ঘেরোয়াতে কভু যেয়ো না কেউ, 
পর ঘরে থাকে জাল পেতে, ওরা দেখেনি প্রাণের সাগর ঢেউ। 

বিশ্বাস করো এক আল্লাতে প্রতি নিঃশ্বাসে দিনে রাতে, 
হবে দুলদুল - আসওয়ার পাবে আল্লার তলোয়ার হাতে। 
আলস্য আর জড়তায় যারা ঘুমাইতে চাহে রাত্রিদিন, 
তাহারা চাহে না চাঁদ ও সূর্য্য, তারা জড় জীব গ্লানি-মলিন। 

নিত্য সজীব যৌবন যার, এস এস সেই নৌ-জোয়ান 
সর্ব-ক্লৈব্য করিয়াছে দূর তোমাদেরই চির আত্বদান! 
ওরা কাদা ছুড়ে বাঁধা দেবে ভাবে - ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ, 
মোরা ফুল ছড়ে মারিব ওদের, বলিব - "এক আল্লাহ জিন্দাবাদ"।



আনন্দময়ীর আগমনে
কাজী নজরুল ইসলাম

আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল? 
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল। 
দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি, 
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী? 

মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি 
খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি। 
ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা, 
মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা। 

তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে 
রক্ত-তৃষার 'ময়-ভুখা-হু'র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।- 
অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা, 
আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা। 
দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা 
দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।.. 

'ময় ভুখা হুঁ মায়ি' বলে আয় এবার আনন্দময়ী 
কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!



শায়ক-বেঁধা পাখী
- কাজী নজরুল ইসলাম

রে নীড়-হারা, কচি বুকে শায়ক-বেঁধা পাখী!
   কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?
   কোথায় রে তোর কোথায় ব্যথা বাজে?
   চোখের জলে অন্ধ আঁখি কিছুই দেখি না যে?
   ওরে মাণিক! এ অভিমান আমায় নাহি সাজে-
তোর জুড়াই ব্যথা আমার ভাঙা বক্ষপুটে ঢাকি’।
 ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী,
 কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?
 
 বক্ষে বিঁধে বিষ মাখানো শর,
 পথ-ভোলা রে! লুটিয়ে প’লি এ কা’র বুকের’ পর!
 কে চিনালে পথ তোরে হায় এই দুখিনীর ঘর?
তোর ব্যথার শানি- লুকিয়ে আছে আমার ঘরে নাকি?
 ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী!
 কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?
 
 হায়, এ কোথায় শানি- খুঁজিস্‌ তোর?
 ডাক্‌ছে দেয়া. হাঁকছে হাওয়া, কাঁপছে কুটীর মোর!
 ঝঞ্ঝাবাতে নিবেছে দীপ, ভেঙেছে সব দোর,
দুলে দুঃখ রাতের অসীম রোদন বক্ষে থাকি’ থাকি’!
 ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী!
 এমন দিনে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?

 মরণ যে বাপ বরণ করে তারে,
 ‘মা’ ‘মা’ ডেকে যে দাঁড়ায় এই শক্তিহীনার দ্বারে!
 মাণিক আমি পেয়ে শুধু হারাই বারে বারে,
ওরে তাই তো ভয়ে বক্ষ কাঁপে কখন দিবি ফাঁকি!
 ওরে আমার হারামণি! ওরে আমার পাখী!
 কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি?

হারিয়ে পাওয়া ওরে আমার মাণিক!
দেখেই তোরে চিনেছি, আয়, বক্ষে ধরি খানিক!
বাণ-বেঁধা বুক দেখে তোরে কোলে কেহ না নিক,
  ওরে হারার ভয়ে ফেলতে পারে চিরকালের মা কি?
   ওরে আমার কোমল-বুকে-কাঁটা-বেঁধা পাখী!
   কেমন ক’রে কোথায় তোরে আড়াল দিয়ে রাখি।
   এ যে রে তোর চির-চেনা স্নেহ,
   তুই তো আমার ন’সরে অতিথ্‌ অতীত কালের কেহ,
   বারে বারে নাম হারায়ে এসেছিস এই গেহ,
  এই মায়ের বুকে থাক যাদু তোর য’দিন আছে বাকী!
   প্রাণের আড়াল ক’রতে পারে সৃজন দিনের মা কি?
   হারিয়ে যাওয়া? ওরে পাগল, সে তো চোখের ফাঁকি!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন