নির্মলেন্দু গুণ এর কবিতা সংগ্রহ

 

আশাগুলি – নির্মলেন্দু গুণ

জ্যা-মুক্ত হয়নি চিত্ত
অধীর মিলনে কোনোদিন ।
পরশে খুলেছে দ্বার, বারবার
কেটেছে অস্থির ঘুমে
শূন্য চিরশয্যা তুমি-হীন ।

অপক্ব মৈথুনে বিবসনা
শ্লীলতা ভাঙেনি শব্দ,
আমাদের অবিমৃষ্য যুগলযৌবন
অথচ জেগেছে কামে
সুপ্তোত্থিতে, প্রিয়তমে
মুখর মৃণালে, প্রিয় নামে ।

তোমাকে বেসেছি ভালো
তীব্রতম বেদনার লাগি ।
মৃত্যুর শিয়রে বসি
সেই প্রিয় মুখে রাত্রি জাগি
একদিন উচ্চরিত প্রার্থনার ভাষা;
করেছিনু আশা, আজ পূর্ণ হবে ।

আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি – নির্মলেন্দু গুণ

সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

শহিদ মিনার থেকে খসে-পড়া একটি রক্তাক্ত ইট গতকাল আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি, ‘সমকাল’
পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

শাহবাগ এ্যভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝরনাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে,
ভালোবাসা আছে_ শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।

এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক,
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্কভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো কান পেতে শুনুক,
আসন্ন সন্ধ্যার এই কালো কোকিলটি জেনে যাক_
আমার পায়ের তলায় পুণ্য মাটি ছুঁয়ে
আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম, আজ সেই পলাশের কথা
রাখলাম, আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম।

আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।

বসন্ত বন্দনা – নির্মলেন্দু গুণ

হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যত আছে,
হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে
বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁখি
তবুও ফুটেছে জবা,—দূরন্ত শিমুল গাছে গাছে,
তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক।

এলিয়ে পড়েছে হাওয়া, ত্বকে কী চঞ্চল শিহরন,
মন যেন দুপুরের ঘূর্ণি-পাওয়া পাতা, ভালোবেসে
অনন্ত সঙ্গীত স্রোতে পাক খেয়ে, মৃত্তিকার বুকে
নিমজ্জিত হতে চায়। হায় কি আনন্দ জাগানিয়া।

এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতই ফেরাই চোখ,
যতই এড়াতে চাই তাকে, দেখি সে অনতিক্রম্য।
বসন্ত কবির মতো রচে তার রম্য কাব্যখানি
নবীন পল্লবে, ফুলে ফুলে। বুঝি আমাকেও শেষে
গিলেছে এ খল-নারী আপাদমস্তক ভালোবেসে।

আমি তাই লঘুচালে বন্দিলাম স্বরূপ তাহার,
সহজ অক্ষরবৃত্তে বাঙলার বসন্ত বাহার।

 গুণ

পদ্ম ফোটানোর জন্যে একটা পুকুর কেটেছিলাম ।
ঝর্নার মতো জল উঠবে তার পাতাল থেকে ।
ভালোবেসে নিজের হাতে কেটেছি হাজার কোয়া মাটি ।
কিন্তু পাতাল চিরে উঠে আসেনি স্বচ্ছতোয়া নদী,
দু’কূল ছাপিয়ে উঠেনি স্বর্গীয় মদে ফেনা ।

দিন শেষে দেখি পদ্মের মৃণালে শুধু মৃত্যু ফুটে আছে ।




ফুলদানি – নির্মলেন্দু গুণ

যেকোনো বাগান থেকে যেটা ইচ্ছে সেই ফুল,
যেকোনো সময় আমি তুলে নিয়ে যদি কভু
তোমার খোঁপায়, আহা, অজগর তোমার খোঁপায়
সাজাবার সুজোগ পেতাম–; তাহলে দেখতে লীলা,
তোমার শরীর ছুঁয়ে লাবণ্যের লোভন ফুলেরা
উদ্বেল হৃদয়ে নিত্য বিপর্যস্ত হতো, মত্ত মমতায়
বলতো আশ্চর্য হয়ে, হতো বলতেইঃ
‘খোঁপার মতন কোনো ফুলদানি নেই৷’


আমার কিছু স্বপ্ন ছিল – নির্মলেন্দু গুণ

আমার কিছু স্বপ্ন ছিল, আমার কিছু প্রাপ্য ছিল,
একখানা ঘর সবার মতো আপন করে পাবার,
একখানা ঘর বিবাহিত, স্বপ্ন ছিল রোজ সকালে
একমুঠো ভাত লঙ্কা মেখে খাবার।

সামনে বাগান, উঠোন চাইনি, চেয়েছিলাম
একজোড়া হাঁস, একজোড়া চোখ অপেক্ষমাণ
এই তো আমি চেয়েছিলাম।

স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার, আর কিছু নয়,
তোমায় শুধু অনঙ্গ বউ ডাকার।
চেয়েছিলাম একখানি মুখ আলিঙ্গনে রাখার।

অনঙ্গ বউ, অনঙ্গ বউ, এক জোড়া হাঁস,
এক জোড়া চোখ, কোথায়? তুমি কোথায়?

আকাশ সিরিজ – নির্মলেন্দু গুণ

শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
ঐ আনন্দে কেটে যাবে সহস্র জীবন।

শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
অহংকারে মুছে যাবে সকল দীনতা।

শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
স্পর্শসুখে লিখা হবে অজস্র কবিতা।

শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
শুধু একবার পেতে চাই অমৃত আস্বাদ।

শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
অমরত্ব বন্দী হবে হাতের মুঠোয়।

শুধু তোমাকে একবার ছোঁব,
তারপর হব ইতিহাস।

আবার যখনই দেখা হবে – নির্মলেন্দু গুণ

আবার যখনই দেখা হবে, আমি প্রথম সুযোগেই
বলে দেব স্ট্রেটকাটঃ ‘ভালোবাসি’।
এরকম সত্য-ভাষণে যদি কেঁপে ওঠে,
অথবা ঠোঁটের কাছে উচ্চারিত শব্দ থেমে যায়,
আমি নখাগ্রে দেখাবো প্রেম, ভালোবাসা, বক্ষ চিরে
তোমার প্রতিমা। দেয়ালে টাঙ্গানো কোন প্রথাসিদ্ধ
দেবীচিত্র নয়, রক্তের ফ্রেমে বাঁধা হৃদয়ের কাচে
দেখবে নিজের মুখে ভালোবাসা ছায়া ফেলিয়াছে।

এরকম উন্মোচনে যদি তুমি আনুরাগে মুর্ছা যেতে চাও
মূর্ছা যাবে,জাগাবো না,নিজের শরীর দিয়ে কফিন বানাবো।

‘ভালোবাসি’ বলে দেব স্ট্রেটকাট, আবার যখনই দেখা হবে।

আগ্নেয়াস্ত্র – নির্মলেন্দু গুণ

পুলিশ স্টেশনে ভিড়,আগ্নেয়াস্ত্র জমা নিচ্ছে শহরের
সন্দিগ্ধ সৈনিক।সামরিক নির্দেশে ভীত মানুষের
শটগান,রাইফেল,পিস্তল এবং কার্তুজ,যেন দরগার
স্বীকৃত মানত,টেবিলে ফুলের মতো মস্তানের হাত।

আমি শুধু সামরিক আদেশ অমান্য করে হয়ে গেছি
কোমল বিদ্রোহী,প্রকাশ্যে ফিরছি ঘরে
অথচ আমার সঙ্গে হৃদয়ের মতো মারাত্তক
একটি আগ্নেয়াস্ত্র,আমি জমা দেইনি।

উপেক্ষা – নির্মলেন্দু গুণ

অনন্ত বিরহ চাই, ভালোবেসে কার্পণ্য শিখিনি৷
তোমার উপেক্ষা পেলে অনায়াসে ভুলে যেতে পারি
সমস্ত বোধের উত্স গ্রাস করা প্রেম; যদি চাও
ভুলে যাবো, তুমি শুধু কাছে এসে উপেক্ষা দেখাও৷

আমি কি ডরাই সখি, ভালোবাসা ভিখারি বিরহে?


তোমার পায়ের নিচে পৃথিবীর ঘাস – নির্মলেন্দু গুণ

যখন তোমাকে বলি : ‘ভালবাসি’।
তার মানে এই নয়, আমি তুমি ছাড়া
আর কিছু ভালই বাসি না।
যখন তোমাকে বলি : ‘ভালবাসি।’
পাশাপাশি আমি কি তখন দেখি না
আকাশে মেঘ? পাতার আড়ালে ফুল?
ফুলের আড়ালে পাখি? তোমাকে দেখার আগে
আমি আড়চোখে পৃথিবীর পৃথিবীকে দেখি?

তোমার শাড়ির পাড়ে লেগে থাকে ভোরের শিশির।
তোমার পায়ের রাঙা গোড়ালিকে ঘিরে
বনের সবুজ ঘাসে মনের গোধূলি খেলা করে।
তখন হঠাৎ ভাবি তোমাকে বেসেছি ভালো,
তোমার পায়ের নিচে পৃথিবীর ঘাস আছে বলে।



স্ববিরোধী – নির্মলেন্দু গুণ

আমি জন্মেছিলাম এক বিষণ্ন বর্ষায়,
কিন্তু আমার প্রিয় ঋতু বসন্ত ।

আমি জন্মেছিলাম এক আষাঢ় সকালে,
কিন্তু ভালোবাসি চৈত্রের বিকেল ।

আমি জন্মেছিলাম দিনের শুরুতে,
কিন্তু ভালোবাসি নিঃশব্দ নির্জন নিশি ।

আমি জন্মেছিলাম ছায়াসুনিবিড় গ্রামে,
ভালোবাসি বৃক্ষহীন রৌদ্রদগ্ধ ঢাকা ।

জন্মের সময় আমি খুব কেঁদেছিলাম,
এখন আমার সবকিছুতেই হাসি পায় ।

আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম,
এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি ।




করতল ভরা এই ম্লান রেখাগুলো তোমাদের জন্য
রেখে গেলাম। হাড়গুলো থেকে সার হবে,
সার থেকে জন্ম নেবে হাড়ের গোলাপ।
আমার যে ছেলেটির জম্ন হয় নি, তাকে দিও
এই দুর্বিনিত শীসের কলম।

যে শব্ দটি আমি উচ্চারণ করতে পারলুম না—
তোমাদের প্রচণ্ড ঘৃণায়, সন্দেহে, তার আত্মা
রক্তাপ্লুত হয়েছে বারবার।
যে গান গাইতে পারি নি, তার সুর বেজেছে চৈতন্যে।
যে কবিতা লেখা হল না সে-ও ছিল
সংগঠিত সীসার ভিতরে।

এই কবরগুলো সাক্ষ দেবে, ভালবেসেছিলাম।

গতকাল একদিন – নির্মলেন্দু 

গতকাল বড়ো ছেলেবেলা ছিল
আমাদের চারিধারে,
দেয়ালের মতো অনুভূতিমাখা মোম
জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে আমারা দেখেছি
শিখার ভিতরে মুখ ।
গতকাল ছিল জীবনের কিছু
মরণের মতো সুখ ।

গতকাল বড়ো যৌবন ছিল
শরীরে শরীর ঢালা,
ফুলের বাগান ঢেকে রেখেছিল
উদাসীন গাছপালা ।

আমরা দু’জনে মাটি খুঁড়ে-খুঁড়ে
লুকিয়েছিলাম প্রেম,
গতকাল বড় ছেলেবেলা ছিল
বুঝিনি কী হারালাম !

গতকাল বড়ো এলোমেলো চুলে
বাতাস তুলেছে গ্রিবা,

এবারই প্রথম তুমি – নির্মলেন্দু গুণ


ভুলে যাও তুমি পূর্বেও ছিলে
মনে করো এই বিশ্ব নিখিলে
এবারই প্রথম তুমি।

এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না
ছিলে না আকাশে, নদী জলে ঘাসে
ছিলে না পাথরে ঝর্ণার পাশে।
এবারই প্রথম তুমি।

এর আগে তুমি কিছুতে ছিলে না।
ফুলেও ছিলে না, ফলেও ছিলে না
নাকে মুখে চোখে চুলেও ছিলে না।
এবারই প্রথম তুমি।

এর আগে তুমি এখানে ছিলে না
এর আগে তুমি সেখানে ছিলে না
এর আগে তুমি কোথাও ছিলে না।
এবারই প্রথম তুমি।

রাতের পুণ্য লগনে ছিলে না
নীল নবঘন গগনে ছিলে না।
এবারই প্রথম তুমি।

এর আগে তুমি তুমিও ছিলে না।
এবারই প্রথম তুমি।


চির অনাবৃতা হে নগ্নতমা – নির্মলেন্দু গুণ


গুণের চির অনাবৃতা হে নগ্নতমা
নদীর জল তোমাকে যেভাবে পেয়েছে
আমি সেভাবে পাই নি!

লাক্স সাবান যেভাবে তোমাকে ছুঁয়েছে
আমি সেভাবে ছুঁইনি।
মেডলিন লিপস্টিক যেভাবে তোমাকে চুমু খেয়েছে
আমি সে সুযোগ পাই নি।

প্রসাধন ঘরের চারদেয়াল তোমাকে যেভাবে দেখেছে
আমি সেভাবে তোমাকে দেখিনি।
গাঢ় অন্ধকার যেভাবে তোমাকে আলিঙ্গন করেছে
আমি তো তা পারি নি।

দিনের আলো যেভাবে তোমাকে দূরে সরিয়েছে
আমি সে প্রশ্রয় পাই নি
বেসিনের জল যেভাবে তোমার হাত ধরেছে
আমি সে সুযোগও পাই নি

তোমার হাতের বই বুক পর্যন্ত যেভাবে গড়িয়েছে
দেখে তো আমার ঈর্ষাই হয়েছে
এভাবে স্পর্শকাতর কবি ঈর্ষাকাতর হয়েছে
করেছে ভ্রমণ স্বপ্নের ভিতর
ঘুরেছে ঘোরে ঘোর ঘোরতর।

ম্যাক্সির ভিতর যেভাবে তুমি ঢুকেছো
আমার আলিঙ্গনে সেভাবে তুমি আসো নি
রাতের আকাশ যেভাবে তোমাকে দেখেছে
বৃষ্টির জল যেভাবে তোমাকে জড়িয়েছে
দিনের সূর্য যে উত্তাপ তোমাকে দিয়েছে
তোমার শরীরে পৃথিবীর পরে
আমি সে সুযোগ পাই নি।

ভোরের বায়ু তোমার এলায়িত চুলে

যেভাবে হাত বুলিয়েছে
এই কবি কি সে সুযোগ পেয়েছে?
ভিনদেশী পারফিউম তোমার গাঁয়ে যেভাবে গন্ধ মেখেছে
এই কবি কি তা পেরেছে?

ভালোবাসা, ভারসাম্যহীন – নির্মলেন্দু গুণ

বাঁশির কাছে যে-সুরের প্রত্যাশা
সে-প্রত্যাশা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত
আমি আমার বাঁশিটি বাজাতে চাই।
যে-পর্যন্ত স্থলিত হয়না বীর্য
সে-পর্যন্ত জীবের সঙ্গম।
জয়ী না-হওয়া পর্যন্ত
আমি পরাভাবকে স্বীকার করি না।

ভালো না-বেসেই যদি ভালোবাসা পাই।
ভাবি, কী লাভ তাহলে পণ্ডশ্রমে?
যে-প্রেম ফাঁকি দিতে জানে
তার বাকি শোধ হয় না জীবনে।
যে-প্রেমে ঘাটতি নেই
সে-তো বুদ্ধিমান গৃহীর প্রণয়-
সে আমার নয়।

আমার ভালোবাসা ভারসাম্যহীন,
উঁচু-নিচু, ভাঙা-চোরা, খানাখন্দময়।


হুলিয়া – নির্মলেন্দু গুণ (এক কথায় অসাধারণ)

আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,
শোঁ শোঁ করছে হাওয়া।
আমার শরীরের ছায়া ঘুরতে ঘুরতে ছায়াহীন
একটি রেখায় এসে দাঁড়িয়েছে৷

কেউ চিনতে পারেনি আমাকে,
ট্রেনে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে একজনের কাছ থেকে
আগুন চেয়ে নিয়েছিলুম, একজন মহকুমা স্টেশনে উঠেই
আমাকে জাপটে ধরতে চেয়েছিল, একজন পেছন থেকে
কাঁধে হাত রেখে চিত্কার করে উঠেছিল;- আমি সবাইকে
মানুষের সমিল চেহারার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি৷
কেউ চিনতে পারেনি আমাকে, একজন রাজনৈতিক নেতা
তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন, মুখোমুখি বসে দূর থেকে
বারবার চেয়ে দেখলেন-, কিন্তু চিনতে পারলেন না৷

বারহাট্টায় নেমেই রফিজের স্টলে চা খেয়েছি,
অথচ কী আশ্চর্য, পুনর্বার চিনি দিতে এসেও
রফিজ আমাকে চিনলো না৷
দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পরিবর্তনহীন গ্রামে ফিরছি আমি৷
সেই একই ভাঙাপথ, একই কালোমাটির আল ধরে
গ্রামে ফেরা, আমি কতদিন পর গ্রামে ফিরছি৷

আমি যখন গ্রামে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,
শোঁ-শোঁ করছে হাওয়া৷
অনেক বদলে গেছে বাড়িটা,
টিনের চাল থেকে শুরু করে পুকুরের জল,
ফুলের বাগান থেকে শুরু করে গরুর গোয়াল;
চিহ্নমাত্র শৈশবের স্মৃতি যেন নেই কোনখানে৷

পড়ার ঘরের বারান্দায় নুয়ে-পড়া বেলিফুলের গাছ থেকে
একটি লাউডুগী উত্তপ্ত দুপুরকে তার লক্লকে জিভ দেখালো৷
স্বতঃস্ফূর্ত মুখের দাড়ির মতো বাড়িটির চতুর্দিকে ঘাস, জঙ্গল,
গর্ত, আগাছার গাঢ় বন গড়ে উঠেছে অনায়াসে; যেন সবখানেই
সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করে এখানে শাসন করছে গোঁয়ার প্রকৃতি৷
একটি শেয়াল একটি কুকুরের পাশে শুয়েছিল প্রায়,
আমাকে দেখেই পালালো একজন, একজন গন্ধ শুঁকে নিয়ে
আমাকে চিনতে চেষ্টা করলো- যেন পুলিশ-সমেত চেকার
তেজগাঁয় আমাকে চিনতে চেষ্টা করেছিল৷
হাঁটতে- হাঁটতে একটি গাছ দেখে থমকে দাঁড়ালাম,
অশোক গাছ, বাষট্টির ঝড়ে ভেঙ্গে যাওয়া অশোক,
একসময়ে কী ভীষন ছায়া দিতো এই গাছটা;
অনায়াসে দু’জন মানুষ মিশে থাকতে পারতো এর ছায়ায়৷
আমরা ভালোবাসার নামে একদিন সারারাত
এ-গাছের ছায়ায় লুকিয়ে ছিলুম৷
সেই বাসন্তী, আহা, সেই বাসন্তী এখন বিহারে,
ডাকাত স্বামীর ঘরে চার- সন্তানের জননী হয়েছে৷

পুকুরের জলে শব্দ উঠলো মাছের, আবার জিভ দেখালো সাপ,
শান্ত-স্থির-বোকা গ্রামকে কাঁপিয়ে দিয়ে
একটি এরোপ্লেন তখন উড়ে গেলো পশ্চিমে – -৷
আমি বাড়ির পেছন থেকে দরোজায় টোকা দিয়ে
ডাকলুম,— “মা’৷
বহুদিন যে-দরোজা খোলেনি,
বহুদিন যে দরোজায় কোন কন্ঠস্বর ছিল না,
মরচে-পরা সেই দরোজা মুহূর্তেই ক্যাচ্ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেলো৷
বহুদিন চেষ্টা করেও যে গোয়েন্দা-বিভাগ আমাকে ধরতে পারেনি,
চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে, অফুরন্ত হাওয়ার ভিতরে সেই আমি
কত সহজেই একটি আলিঙ্গনের কাছে বন্দী হয়ে গেলুম;
সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে
একটি অবুঝ সন্তান হয়ে গেলুম৷

মা আমাকে ক্রন্দনসিক্ত একটি চুম্বনের মধ্যে
লুকিয়ে রেখে অনেক জঙ্গলের পথ অতিক্রম করে
পুকুরের জলে চাল ধুতে গেলেন; আমি ঘরের ভিতরে তাকালুম,
দেখলুম দু’ঘরের মাঝামাঝি যেখানে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি ছিল,
সেখানে লেনিন, বাবার জমা- খরচের পাশে কার্ল মার্কস;
আলমিরার একটি ভাঙ্গা- কাচের অভাব পূরণ করছে
ক্রুপস্কায়ার ছেঁড়া ছবি৷

মা পুকুর থেকে ফিরছেন, সন্ধ্যায় মহকুমা শহর থেকে
ফিরবেন বাবা, তাঁর পিঠে সংসারের ব্যাগ ঝুলবে তেমনি৷
সেনবাড়ি থেকে খবর পেয়ে বৌদি আসবেন,
পুনর্বার বিয়ে করতে অনুরোধ করবেন আমাকে৷
খবর পেয়ে যশমাধব থেকে আসবে ন্যাপকর্মী ইয়াসিন,
তিন মাইল বিষ্টির পথ হেঁটে রসুলপুর থেকে আসবে আদিত্য৷
রাত্রে মারাত্মক অস্ত্র হাতে নিয়ে আমতলা থেকে আসবে আব্বাস৷
ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর:
– আমাদের ভবিষ্যত্ কী?
– আইয়ুব খান এখন কোথায়?
– শেখ মুজিব কি ভুল করেছেন?
– আমার নামে কতদিন আর এরকম হুলিয়া ঝুলবে?

আমি কিছুই বলবো না৷
আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকা সারি সারি চোখের ভিতরে
বাংলার বিভিন্ন ভবিষ্য়্ত্কে চেয়ে চেয়ে দেখবো৷
উত্কন্ঠিত চোখে চোখে নামবে কালো অন্ধকার, আমি চিত্কার করে
কন্ঠ থেকে অক্ষম বাসনার জ্বালা মুছে নিয়ে বলবো:
‘আমি এসবের কিছুই জানি না,
আমি এসবের কিছুই বুঝি না৷’


টেলিফোনে প্রস্তাব – নির্মলেন্দু গুণ

আমি জানি, আমাদের কথার ভিতরে এমন কিছুই নেই,
অনর্থ করলেও যার সাহায্যে পরস্পরের প্রতি আমাদের
দুর্বলতা প্রমাণ করা সম্ভব। আমিও তো তোমার মতোই
অসম্পর্কিত-জ্ঞানে এতদিন উপস্থাপন করেছি আমাকে।
তুমি যখন টেলিফোন হয়ে প্রবেশ করেছো আমার কর্ণে-
আমার অপেক্ষাকাতর হৃৎপিণ্ডের সামান্য কম্পনও আমি
তোমাকে বুঝতে দিই নি। দুর্বলতা ধরা পড়ে যায় পাছে।

তুমিও নিষ্ঠুর কম নও, তুমি বুঝতে দাওনা কিছু। জানি,
আমার কাছেই তুমি শিখেছিলে এই লুকোচুরি করা খেলা।
কিন্তু এখন, যখন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে আমাদের বেলা,
তখন ভেতরের চঞ্চলতাকে আমরা আর কতটা লুকাবো?
অস্ত যাবার আগে প্রবল সূর্যও চুম্বন করে পর্বত শিখর,
আর আমরা তো দুর্বল মানুষ, মিলনে বিশ্বাসী নর-নারী।
কার ভয়ে, কী প্রয়োজনে আমরা তাহলে শামুকের মতো
স্পর্শমাত্র ভিতরে লুকাই আমাদের পল্লবিত বাসনার শূঁড়।

তার চেয়ে চল এক কাজ করি, তুমি কান পেতে শোনো,
তুমি শুধু শোনো, আর আমি শুধু বলি, বলি, ভালবাসি।

আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও – নির্মলেন্দু গুণ

তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব,
আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।

এই নাও আমার যৌতুক, এক-বুক রক্তের প্রতিজ্ঞা।
ধুয়েছি অস্থির আত্মা শ্রাবণের জলে, আমিও প্লাবন হব,
শুধু চন্দনচর্চিত হাত একবার বোলাও কপালে।
আমি জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে উড়াব গাণ্ডীব,
তোমার পায়ের কাছে নামাব পাহাড়।
আমিও অমর হব, আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।

পায়ের আঙুল হয়ে সারাক্ষণ লেগে আছি পায়ে,
চন্দনের ঘ্রাণ হয়ে বেঁচে আছি কাঠের ভিতরে।
আমার কিসের ভয় ?

কবরের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই কবর,
শহীদের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই শহীদ,
আমার আঙুল যেন শহীদের অজস্র মিনার হয়ে
জনতার হাতে হাতে গিয়েছে ছড়িয়ে।
আমার কিসের ভয় ?

তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হব,
আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও
এই দেখো অন্তরাত্মা মৃত্যুর গর্বে ভরপুর,
ভোরের শেফালি হয়ে পড়ে আছে ঘাসে।
আকন্দ-ধুন্দুল নয়, রফিক-সালাম-বরকত-আমি;
আমারই আত্মার প্রতিভাসে এই দেখ আগ্নেয়াস্ত্র,
কোমরে কার্তুজ, অস্থি ও মজ্জার মধ্যে আমার বিদ্রোহ,
উদ্ধত কপাল জুড়ে যুদ্ধের এ-রক্তজয়টিকা।

আমার কিসের ভয় ?
তোমার পায়ের নিচে আমিও কবর হব,
আমাকে কী মাল্য দেবে, দাও।


তোমার চোখ এতো লাল কেন – নির্মলেন্দু গুন

আমি বলছি না ভালবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভিতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য।
বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত।

আমি বলছি না ভালবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক। আমি হাতপাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,
আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী-সেবার দায় থেকে।

আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুক;
আমার জল লাগবে কি না, নুন লাগবে কি না,
পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা
তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না।
এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি

আমি বলছি না ভালবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক। কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক : ‘তোমার চোখ এতো লাল কেন?’


তুলনামূলক হাত – নির্মলেন্দু গুণ


তুমি যেখানেই স্পর্শ রাখো সেখানেই আমার শরীর৷
তোমার চুলের ধোয়া জল তুমি যেখানেই
খোঁপা ভেঙ্গে বিলাও মাটিকে;
আমি এসে পাতি হাত, জলভারে নতদেহ আর
চোখের সামগ্রী নিয়ে ফিরি ঘরে, অথবা ফিরি না ঘরে,
তোমার চতুর্দিকে শূন্যতাকে ভরে থেকে যাই৷

তুমি যেখানেই হাত রাখো, যেখানেই কান থেকে
খুলে রাখো দুল, কন্ঠ থেকে খুলে রাখো হার,
সেখানেই শরীর আমার হয়ে ওঠে রক্তজবা ফুল৷

তুমি যেখানেই ঠোঁট রাখো সেখানেই আমার চুম্বন
তোমার শরীর থেকে প্রবল অযত্নে ঝরে যায়৷
আমি পোকা হয়ে পিচুটির মতো
তোমার ঐ চোখের ছায়ায় প্রতিদিন খেলা করে যাই,
ভালোবেসে নিজেকে কাঁদাই৷

তুমি শাড়ির আঁচল দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিলে
আমি রথ রেখে পথে এসে তোমারই দ্বৈরথে বসে থাকি
তোমার আশায়৷ তুমি যেখানেই হাত রাখো
আমার উদগ্রীব চিত্র থাকে সেখানেই৷ আমি যেখানেই
হাত পাতি সেখানেই অসীম শূন্যতা, তুমি নেই৷

যাত্রা-ভঙ্গ – নির্মলেন্দু গুণ

হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই৷

হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন করে যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি৷

তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই৷

তখন আমি একটু ছোঁব,
হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর
বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার নায়ে,
আমার বৈতরনী নায়ে৷

নায়ের মাঝে বসব বটে,
না-এর মাঝে শোব৷
হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ,
দু:খ দিয়ে ছোঁব৷

তুই কেমন করে যাবি?

দু’জনের ভাত – নির্মলেন্দু গুণ

গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে

মনে কি পড়ে না? পড়ে ।
ভালো কি বাসি না? বাসি ।
শ্লথ টেপ থেকে সারা দিন জল ঝরে,
সেই বেনোজলে এঁটো মুখ ধুয়ে আসি ।

গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে
প্রেম কি জাগে না? জাগে ।
কিছু কি বলি না? বলি ।
তিতাস শিখায় যতটুকু তাপ লাগে,
অনুতাপে আমি তার চেয়ে বেশি গলি ।

গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে খেতে
আমি কি কাঁদি না? কাঁদি ।
কাঁচা কাকরুল ভাজার কবিতা লেখি,
বড়-ডেকচিতে দু’জনের ভাত রাঁধি ।

গত রাত্রির বাসী ভাত খেতে-খেতে
কিছু কি ভাবি না? ভাবি ।
ভেবে কি পাই না? পাই ।
তবু কি ফুরায় তুমি-তৃষ্ণার দাবী?
ভাত বলে দেয়, তুমি নাই, তুমি নাই ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন