মতিউর রহমান মল্লিক এর সেরা কবিতা সংগ্রহ



 একটি হৃদয় 

একটি হৃদয় কলির মতো, ওলির মতো, 

মেঘনা নদীর পলির মতো। 


পাখ-পাখালীর উধাও উধাও ক্লান্ত প্রহর, 

উথাল পাথাল ধানসিঁড়ি ঢেউ নিটোল নহর, 

সবুজ খামার হাওয়ার খেলায় সুরের বহর; 

একটি হৃদয় লতার মতো, লজ্জাবতীর পাতার মতো 

অনেক কথকতার মতো। 


ঝুমুর ঝুমুর ঝাউয়ের নূপুর দুপুর বেলা 

সুদূর প্রদেশ আলোর ঝালর সাগর বেলা 

ঝোপঝাড় ও ঝিল জোনাক জোনাক তারার মেলা; 

একটি হৃদয় ফুলের মতো, সুরমা নদীর কূলের মতো 

বট-পাকুড়ের মূলের মতো। 


রাঙামাটির স্বপন সজীব সুখদ পাহাড়, 

মন মাতানো নাফ নদীটির এপার ওপার, 

তেতুলিয়ার একটানা পথ নানান খামার; 

একটি হৃদয় মাঠের মতো, পল্লীগাঁয়ের বাটের মতো, 

নৌকা বাঁধা ঘাটের মতো 

একটি হৃদয় কলির মতো, ওলির মতো, 

মেঘনা নদীর পলির মতো। 





এই সময় 

এই সময় আকাশ খুব বেশি সংক্ষিপ্ত 

দেয়াল টপকাতে গেলেই বিঘ্নিত দৃষ্টিরা অন্তরমুখী 

গারদের দিকে 

অন্তত পাখি দেখলেতো ঐ রকমই। 


অথচ কথোপকথন ভালোবাসে সে সব বৃক্ষ 

দিনানুদিন অপেক্ষমাণ সমস্ত নীল প্রজাপতির জন্যে 

কেবল সেই সব ছায়ায় গেলেই 

প্রসারিত ও প্রশস্ত খামার এবং ফসলিত সমতল। 


দুঃখ এবং যন্ত্রণা উপদেষ্টা হয়ে গেলে যে রকম 

ভেসে আসে- 

নিসর্গের নিমজ্জন থাকলে পাখা খোলার আগ্রহ জন্মে 

বিস্তার ও বিন্যাসের জন্যে জলাশয়কে 

নদীর দিকে নিয়ে যাও। 


এখন আমার নির্ণিত জলাশয় 

এবং নিমগ্নতা সীমান্ত ছিঁড়েছে 

আর অন্তরীণতা থেকে উপলব্ধি- এই জলস্রোত 

ঢেউ ঢেউ বেজে যেতে লাগলো 


তুমুল প্রপাত যার উপমা। 



কবি ও কবিতা 

কবিতার শব্দ কি সব 

অঙ্গ কি তার অমোঘ বিষয় 

কবিতার সংজ্ঞা কেবল সন্নিহিত 

শরীরের শিল্পকলাই 


কবিতার দেহের জন্য 

কবি কি দীপ্র মেধার 

এতোকাল সবকিছু কি বাইরে থাকে? 


কবি কি অলংকারের স্বর্ণঈগল 

উপমার জালের ভেতর পালক ঝরায় 

এবং সে তার ইচ্ছে মতো দেয় না উড়াল দিগন্তরে 


কবি কি ডুব দেবে না 

ভাবের স্বচ্ছ্ব সম্ভাবনায় 

শিকড়পন্থী মহান মানুষ 

তৃপ্ত রবেই ডালপালাতেই? 


নারী কি শুধুই নারী কবির নিকট 

নদী কি শুধুই নদী 

কবিতার স্বভাব কি তার অঙ্গে বিভোর 

নাকি এক হৃদয় আছে 

কবিতার গহীন ভেতর। 



একজন ফুটবলের কথা

সময়ের লাথি খেতে খেতে 

সে এক নিষ্পেষিত ফুটবল 

ঢুকে গেলো সকালের অফিসে 

নির্দিষ্ট ভেতরে 

তারপর নির্বাচিত খেলোয়াড়েরা 

নির্ঘাত খেলে গেলো সর্বান্ত অবধি 

প্রর্তেকের পাও ঘুরে ঘুরে 

সেই যে ফুটবল নিয়মিত প্রেসে যায় 

কোথায় প্রুফ 

পরকীয়া শব্দ নিয়ে জপছে এক 

রুদ্ধদ্বার সাধক। 


পথে নামতেই খেলে তাকে অনিয়ম 

খেলে তাকে ক্ষুধার্ত রেলপথ পাথরের সুঁই 

নিষ্পিষ্ট স্মৃতি অনিশ্চিত যাত্রা 

খেলে তাকে দুপুরের অতন্দ্র অন্ধকার 

আর কূটগূঢ় বৈঠকের লাথি 

তারে ফেলে দেয় গিফারির মাঠে 

তারপর খেলে তাকে শৃগালের লেজ 

গোখরার ফণা। 


সে এক জর্জরিত ফুটবল 

বাজারের লাথি খেয়ে খেয়ে 

থলে ভরে দুঃখ নিয়ে ফিরে যায় ‘ভাড়ায়’ 

ফিরে যায় চুক্তিবদ্ধ চতুর্থ তলায় 

তারপর খেলে তাকে 

চারকোটি অভিযোগ 

খেল তাকে দুর্বিনীত মাসের খরচ 

খেলে তাকে দীর্ঘরাত্রির 

এক জেগে থাকা। 


এই যে নিগৃহীত ফুটবল 

সেও একদা মানুষ ছিলো 

কিংবা অপরাজিত মানুষের অনুপ্রেরণার মতোন। 



বৃক্ষের নামতা

তুমি কেবলই না না করো 

অথচ বিষয়ের প্রতিটি প্রান্তেই কী 

‘না না’-র মতো পতাকা উড়ছে? 


তোমাকে আমি বহুবার বলেছি 

একটি মরুভূমি দেখলেই 

বলে ফেলো না যে- 

এখানে আদিগন্ত শূন্যতা 


মরুভূমির নিচের পরিপূর্ণতার কথা নাইবা বললাম 

আসলে তুমি যেখানে শূন্যতাকে 

দেখে নিয়েছো বলে শেষাবধি মুখ ফিরাতে পারলে 

ঠিক সেখানে গতকালও উদিত হয়েছিলো 

নরম নক্ষত্রের অফুরন্ত নীল আকাশ 


তুমি কেবলি না না করো 

অথচ তোমার ব্যক্তিগত ‘না না’-র দিকে 

ফিরে তাকাও না একবারও 


একটা বৃক্ষের সমস্ত শরীর জুড়েই হাঁ হাঁ 

মূলত এখন তোমার বারবারই 

বৃক্ষের নামতা পড়া দরকার। 



সন্নিহিত নাতের পঙক্তি বিশেষ 

হাসসান বিন সাবিতের অলৌকিক স্বর্ণালংকার 

আমি দেখেছি এবং 

আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহার অশ্বারোহণও। 

তারপর কোনো সন্নিহিত গতি উদ্ধার করার 

সমস্ত কলাকৌশলই অনাবিষ্কৃত থাকতে 

থাকতে একটি উদিত সূর্য অনুবাদ করতে গিয়ে 

দেখি- 

সমবেত সূর্যমন্ডলী তাঁকে অতিক্রম করতে পারলো না। 


কে সেই সূর্যমন্ডলীরও অপ্রতিদ্বন্দ্বী সভাপতি? 

তাঁকে আর তাঁর নিদর্শনাবলীও 

সমর্থন করলেন বলে 

পৌত্তলিকতার সমস্ত জৌলুসই কবি লবিদ 

গলিত বর্জ্যরে মতো কবরস্থ করতে লাগলেন। 


হায়! আমি যদি তাঁর একটি নগণ্য এবং 

উৎকীর্ণ সূর্যমুখীও হতে পারতাম! 



বৃষ্টিঃ নিষন্ণ পাখির নীড়ের ওপর

মেঘমালার দিকে 

তাকাতে-না-তাকাতেই 

উড়ে এলো প্রথম প্রভাত 

উড়ে এলো আকাশের 

অবশিষ্ট 

সজল 

প্রলেপনিচয় 


এবং তাকাতে-না-তাকাতেই 

হালকা-পাতলা নেকাব 

নেমে এলো- 

নেমে এলো 

অবগুণ্ঠনের তৃপ্তি 

নিষণ্ন পাখির নীড়ের ওপর- 

দূরের বাঁশরীর কোমল আগ্রহের সুর 

ক্রমাগত যেমন কাছে আসে 

এবং পত্রপল্লবের ঠোঁটেরা 

এখন 

ভেজা মুখমন্ডলের জন্য 

উন্মুুখরতার অন্তরাল 

খুঁজে বেড়াচ্ছে 


আজ সারাদিন 

সমুদ্রের শুভ্র-শুভ্র 

অনিশেষ মৌমাছিরা 

আমাকে কবি না-বানিয়ে 

ছাড়লো না। 




একটি ধ্রুব বিজয়ের জন্য 

একটি ধ্রুপদ বিজয় আমার ভেতরে আগুনের মতো উস্কে দিয়েছে 

অনেক অনেক ধ্রুব বিজয়ের নেশাগ্রস্ততা 

অথবা নেশারও অধিক এক উদগ্র অতৃপ্তি 

তাছাড়া আমার কেবলই মনে হয় যে 

একটি ধ্রুপদ বিজয়ই প্রথম বিজয় নয় কিংবা শেষ বিজয়ও হতে পারে না 


প্রভাত কি একবারই হয়? 

সূর্য কি একবারই ওঠে? 

জেয়ার কি একবারই আসে? 

মূলত একটি অকাট্য বিজয় মানে হচ্ছে অসংখ্য বিজয়ের নাম-ভূমিকা 

না হয় তারও আগের শুদ্ধতম পরিকল্পনাসমূহের একেকটি অবিশ্রান্ত খসড়া 

যেমন কোথাও যেতে হলে মানচিত্রের খুবই দরকার হয়ে পড়ে 

তার মানে এই নয় যে ইতিহাসের একেবারেই কোনো প্রয়োজন নেই 


বিভীষণ কিংবা মীর জাফরের কথা সম্পূর্ণ আলাদা 

অর্থাৎ তারাও তাদের সাঙ্গাতদের নিয়ে 

একদা উপদ্রুত উৎসবে মেতে উঠেছিলো 


বস্তুত একটি ধ্রুব বিজয়ের জন্যে এখন আমি 

এক সিরাজুদ্দৌলা ছাড়া আর কাউকেই সহ্য করতে পারছি না। 




অনেক বিজয়

অনেক বিজয় এসেছে আবার 

অনেক বিজয় আসেনি যে- 

অনেক বিহান হেসেছে আবার 

অনেক বিহান হাসেনি যে! 


পেরিয়ে এসেছি অনেক অনেক পথ 

ছিঁড়েছি অনেক গোলামীর দাসখত্ 

ভেঙেছি অনেক লৌহকপাট-কারা 

অনেক ঝরেছে তপ্ত-রক্ত-ধারা 

অনেক হয়েছে মহাজীবনের ক্ষয় 

অনেক হয়েছে বেদনার সঞ্চয়- 

তবুও পূর্ণ জয়ের সূর্য 

এখনো আকাশে ভাসেনি যে; 

অনেক বিজয় এসেছে আবার 

অনেক বিজয় আসেনি যে! 


অনেক স্বপ্ন দু’হাতে পেয়েছি 

পাইনি অনেক আবার 

অনেক চাওয়ার তবু বাকি আছে 

এখনো অনেক পাওয়ার! 


ঈমানের ঘর ক্রমাগত শুধু নড়ে 

স্বদেশ-প্রেমের জিজ্ঞাসা কেঁদে মরে 

গণতন্ত্রের বেড়ে চলে ঝন্ঝাট্ 

অর্থনীতির থামে যে-নান্দীপাঠ 

জনতার দাবি অপূর্ণ রয়ে যায় 

ধৈর্যের বাঁধ ক্রমাগত ক্ষয়ে যায়- 

তাইতো নতুন যুদ্ধের নেশা 

বিজয়ের দিন নাশেনি যে; 

অনেক বিজয় এসেছে আবার 

অনেক বিজয় আসেনি যে! 


বিজয়ের অরি চিনেছি অনেক 

চিনেছি যে-বিভীষণ 

তবুও অনেক আঁধারে পড়েনি 

দৃষ্টির বিকিরণ! 


নদীর শত্রু যাচাই হলো না আজো! 

দেশের শত্রু বাছাই হলো না আজো! 

জাতির শত্রু এখনো অনেক ভিড়ে 

কলিজা চিবায় বক্ষ দু’হাতে চিরে- 

ন্যায়ের শত্রু হয়নি অনেক চেনা 

অনেক মুক্তি হয়নি এখনো কেনা 

এখনো স্বদেশ অনেক জমিনে 

আজাদির চাষ চাষেনি যে; 

অনেক বিজয় এসেছে আবার 

অনেক বিজয় আসেনি যে 

অনেক বিহান হেসেছে আবার 

অনেক বিহান হাসেনি যে! 



ইউরোপ

দেহের দো’ভাঁজে ওরা খুঁজে ফেরে সুখ, 

বোতলের ছিপি ছাড়া বোঝে না কিছুই, 

তত্ত্বের নাভিমূলে বানরের হাড়; 

নগ্ন ভূ-ভাগে তবে পশু কে? মানুষ! 


পৃথিবীর সবদিকে মেলে শ্যান চোখ 

ওরা গড়ে তোলে লাল- শ্বেত-ভল্লুক; 

বিবিধ তন্ত্র বুলডগ হাতিয়ার। 

মূলত ওরাই আনে যুদ্ধ ভয়াল। 


মাতালের মহাদেশে বুড়োরা আকাল- 

অচল মুদ্রা বড় অহেতুক বোঝা! 

মানুষের চেয়ে প্রিয় ওখানে কুকুর, 

হৃদয়বাদের সব আলোক নিখোঁজ। 


এশিয়াই পূরয়িতা রদরু ছায়ায় 

ইউরোপ তলে তলে বারুদের ঘ্রাণ। 















2 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন