পাবলো নেরুদার কবিতা সংগ্রহ

 

পাবলো নেরুদা (১২ জুলাই, ১৯০৪ – ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩) ছিলেন চিলিয়ান কবি ও রাজনীতিবিদ। তার প্রকৃত নাম ছিল নেফতালি রিকার্দো রেয়েস বাসোয়ালতো। পাবলো নেরুদা প্রথমে তার ছদ্মনাম হলেও পরে নামটি আইনি বৈধতা পায়। কৈশোরে তিনি এই ছদ্মনামটি গ্রহণ করেন। ছদ্মনাম গ্রহণের পশ্চাতে দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, ছদ্মনাম গ্রহণ ছিল সে যুগের জনপ্রিয় রীতি; দ্বিতীয়ত, এই নামের আড়ালে তিনি তার কবিতাগুলি নিজের পিতার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতেন। তার পিতা ছিলেন কঠোর মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি। তিনি চাইতেন তার পুত্র কোনো "ব্যবহারিক" পেশা গ্রহণ করুক। নেরুদা নামটির উৎস চেক লেখক জান নেরুদা এবং পাবলো নামটির সম্ভাব্য উৎস হলেন পল ভারলেইন। পাবলো নেরুদাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী লেখক মনে করা হয়। তার রচনা অনূদিত হয়েছে একাধিক ভাষায়।




কার দুঃখ বেশি, যার জীবন কাটে শুধুই অপেক্ষায়, নাকি যার অপেক্ষা করার মত ছিল না কখনো কেউ?

~নেরুদা


আমার কাছ থেকে দূরে থেকো না – পাবলো নেরুদা

আমার কাছ থেকে দূরে থেকো না, দয়া করো

একটা দিন অনেক অনেক দীর্ঘ সময়,

অনেক দূরে ঘুমে থাকা ট্রেনের আশায়

নীরব ইস্টিশানের জন্যে, আমার জন্যে।

একদন্ড আমায় ছেড়ে যেয়ো না, কারণ-

ভয়ের শীতল স্রোত ঘিরে ফেলে আমায়,

অথবা ঘর খোঁজা ধোঁয়া এসে চেপে বসে

বুকের উপরে, গলা টিপে ধরে আমার।

হারিওনা তুমি ছায়া হয়ে সমুদ্র তীরে;

তোমার চোখের পাতায় হারিওনা দূরে।

এক মুহূর্ত আমার ছেড়ে থেকোনা প্রিয়,

এক মুহুর্তে তুমি খুব দূরে চলে যাবে

আমি উদ্ভ্রান্ত ভেবে যাব, তুমি আসবে?

নাকি আমি আমৃত্যু রয়ে যাব একা?

=====================


 

বিদায়-পাবলো নেরুদা

এক.

তোমার অন্তস্হল থেকে, এবং হাটুঁ গেড়ে বসা

এক বিষণ্ণ শিশু, আমার মত, দেখে আমাদের।

সেই জীবনের জন্য যা পুড়িয়ে দেবে তার ধমনীগুলো

আমাদের জীবনের সঙ্গে বাধাঁ পড়তে বাধ্য হবে।

সেই হাতগুলি দিয়ে, তোমার হাতগুলির কন্যারা

আমার হাতগুলিকে হত্যা করতে বাধ্য হবে।

ধরণীতে তাদের উন্মুক্ত চোখগুলির ভেতর দিয়ে

একদিন দেখবে তোমার অশ্রুবিন্দুগুলি।


দুই.

আমি তাকে ভালবাসি না,আমাদা।

যাতে কিছুই আমাদের বন্ধনে না জড়ায়

যেন কোন কিছুই আমাদের নয়।

নেই কোন শব্দ যা তোমার মুখ সুবাসিত করে

নেই কোন কিছু যা বলেছিল শব্দগুলো।

ভালবাসার কোন উৎসব ছিল না আমাদের,

জানালার পাশে ছিল না তোমার দীর্ঘশ্বাস।

তিন.

নবিকদের ভালবাসাকে ভালবাসি

যারা চুম্বন করে এবং চলে যায়।

এক প্রতিজ্ঞা রেখে যায়।

কিন্তু কখনও ফিরে আসে না।

প্রতি দরজায় অপেক্ষা করে এক নারী,

নাবিকেরা চুম্বন করে এএবং চলে যায়।

এক রাত্রিতে তারা ঘুমাতে যায় মৃত্যুর সঙ্গে

সমুদ্র শয্যায়।

ভালবাসি সেই ভালবাসা যা তারা ভাগ করে নেয়

চুম্বনে,শয্যায় এবং রুটিতে।

=====================



বিদায় ২ -পাবলো নেরুদা

এক.

ভালবাসি সেই ভালবাসা যা হতে পারে শাশ্বত

আবার হতে পারে ক্ষণস্হায়ী।

ভালবাসি সেই ভালবাসা যা মুক্তি দিতে চায়

আবার ভালবাসার জন্য।

ভালবাসি সেই স্বর্গীয় ভালবাসা যা নিকটবর্তী হয়

আবার যা দূরে চলে যায়।


দুই.

তোমার চোখে চোখ রেখে আমার চোখ আনন্দ পাবে না,

আর আমার বেদনা তোমার সঙ্গে থেকে মনোরম হবে না।

কিন্তু যেখানেই যাই তোমার দৃষ্টি বহন করি

আর যেখানেই ঘুরে বেড়াও বহন কর আমার দুঃখ।

তুমি আমার ছিলে,আমি তোমার। আর কি চাই? দুজনে গড়েছিলাম

চলার পথে একটা বাঁক,যেখান দিয়ে চলে গিয়েছিল ভালবাসা।

তুমি আমার ছিলে,আমি তোমার।তোমার ফলের বাগানে আমি

যে বীজ পুঁতেছিলাম, তার থেকেই তুমি হবে আমার ভালববাসা।

আমি চলে যাই। বিষন্ন আমি : কিন্তু সর্বদাই বিষন্ন আমি।

তোমার দু’বাহু থেকে আমি আসি। জানি না কোথায় যাই।

…তোমার হৃদয় থেকে আমাকে বিদায় জানায় এক শিশু

এবং আমিও তাকে জানায় বিদায়।

=====================

 

আলোর জন্তুরা – পাবলো নেরুদা

আজ হারিয়ে যাওয়া অরণ্যের গভীরে

সে শুনতে পাচ্ছে শত্রুর আওয়াজ, পালাচ্ছে ছুটে

অন্যদের থেকে নয়, নিজেরই কাছ থেকে

পালাচ্ছে সেইসব সংঘবদ্ধতা জড়িয়ে ছিল আমাদের

জীবনের মানে থেকে

কারণ শ্ধু একবার,শুধুই একবার

একটাই অক্ষর বা নিঃস্তব্ধ খানিকটা বিরতি |

অতৃপ্ত ঢেউয়ের শব্দ

ঠেলে দেয় সত্যের মুখোমুখি আমায়

ব্যাখ্যার কিছু নেই

বলারও কিছু নেই, এই সব

অরণ্যের দরজাগুলি বন্ধ সব

সূর্য পরিক্রমা করে, জাগাতে গাছের পাতা

চাঁদ উঠছে সাদা ফলের মতন

মানুষ নিচু করছে মাথা

ভবিতব্যের কাছে |

=====================


 

মাচো পিচুর উচ্চতা থেকে – পাবলো নেরুদা

আমার জন্মের সঙ্গে জেগে ওঠ ভাই আমার

গভীর থেকে বাড়িয়ে দাও তোমার মলিন হাত ।

এইসব পাথরের দৃঢ় শাসন থেকে ফিরবে না তুমি।

পাতালের সময় থেকে উঠবে না জেগে ।

ফিরে আসবে না তোমার খসখসে কন্ঠস্বর,

কোটর থেকে তোমার বিস্ফারিত চোখ দুটি উঠে আসবে না।

মৃত্তিকার গভীর থেকে এই আমাকে দ্যাখো,

ফসলের মাঠের কর্মি, তাঁতী, মৌন মেষপালক,

টোটেমিয় প্রাণির রক্ষক,

উচুঁ ঝুঁকিপূর্ন ভারার রাজমিস্ত্রি

আন্দেজের কান্নার বরফমানুষ

থেঁতলানো আঙুলের স্বর্ণকার

কচি ফসলের মাঠে উদ্বিগ্ন চাষা

অপচয়ী কাদায় কুমাড়

পাত্রে নতুন এই জীবন আনে

তোমার প্রাচীন সমাহিত দুঃখ।

দেখাও তোমার রক্ত, দেখাও তোমার ক্ষত;

আমাকে বল: এখানে আমি নির্যাতিত হয়েছিলাম

কারণ, নিম্নমানের রত্নপাথর কিংবা পৃথিবী সময়মতো

শষ্য ও রত্নপাথর দিতে পারেনি।

আমাকে দেখাও কোন্ পাথরের ওপর তুমি ছটফট করেছ

কোন অরণ্যের কাঠে তারা তোমায় করেছে ক্রশবিদ্ধ।

পুরনো পাথর ঘষ

জ্বালাও প্রাচীন প্রদীপ, আলোকিত কর চাবুক

শতাব্দী ধরে তোমার ক্ষতে আঠার মতন লেগে আছে

আর আলোকিত কর তোমার রক্তে ভেজা কুঠার ।

আমি তোমার মৃত মুখের ভাষা দিতে এসেছি।

বিশ্বজুড়ে

মৃত ঠোঁট একত্রিত হও,

গভীর থেকে উঠে এসে এই দীর্ঘ রাত্রি আমার সঙ্গে ঘূর্নায়মান হোক

যেন আমি তোমার সঙ্গে নোঙরে বাধা।

আর আমাকে সব বল, স্তর থেকে স্তরে বল

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বল, ধাপে ধাপে বল।

যে ছোরাটি লুকিয়ে রেখেছ সেটিতে ধার দাও

বিদ্ধ কর আমার পাঁজরে, আমার হাতে,

সূর্যবিস্ফোরনের ঝঞ্ছার মতো

সমাহিত জাগুয়ারের আমাজন

এবং আমাকে কাঁদতে দাও, ঘন্টা, দিন ও বছর

অন্ধ সময়, সৌর শতাব্দী।

আর আমায় স্তব্দতা দাও, জল দাও, আশা দাও।

সংগ্রাম দাও, লৌহ, আগ্নেয়গিরি।

শরীরগুলি আমার শরীরে চুম্বুকের মতন আটকে

আমার শিরায় আমার মুখে আসুক দ্রুত

কথা বলুক আমার ভাষায় আমার রক্তে ।

===================== 



যদি আমায় তুমি ভুলে যাও – পাবলো নেরুদা

অনুবাদ:ইমন জুবায়ের


একটি কথা আমি তোমাকে

জানিয়ে দিতে চাই ।

তুমি কি জান

আমি যখন আমার জানালার বাইরে

মন্থর হেমন্তের লাল ডালে

স্ফটিক চাঁদটির দিকে তাকাই,

যদি ছুঁয়ে দিই

আগুনের কাছটিতে

অবোধগম্য কিছু ছাই

কিংবা কাটা গুঁড়ির বৃত্তাকার শরীর-

এসবই তোমার নিকটে আমায় বহন করে নিয়ে যায়,

যেনবা- যা কিছু অস্তিত্বশীল,

সুগন্ধ, আলো, কিংবা ধাতুসমূহ,

যেনবা ছোট্ট নৌকা

যা বইছে

আমার জন্য অপেক্ষমান তোমার দ্বীপ অভিমূখে

ঠিক আছে, এখন,

যদি অল্প অল্প করে আমায় ভালোবাসা কমিয়ে দাও

আমিও অল্প অল্প করে তোমায় ভালোবাসা কমিয়ে দেব।

সহসা

তুমি আমায় ভুলে গিয়ে

আমার দিয়ে চেও না,

কেননা, এরই মধ্যে আমি তোমায় ভুলতে বসেছি।

যদি তুমি অনেকক্ষণ ধরে এসব ভাব আর পাগল হয়ে যাও-

পতাকার বাতাস

যা বয় আমার জীবনের মধ্য দিয়ে,

আর তুমি সিদ্ধান্ত নাও

আমায় ছেড়ে যাবে হৃদয়ের পাড়ে

যেখানে আমার শিকড়,

মনে রেখ যে:

ঐ দিনে,

ঐ মুহূর্তে,

আমি আমার হাত তুলব

আর আমার শিকড় যাত্রা করবে

অন্য কোনও ভূমির সন্ধানে।

কিন্তু,

প্রতি দিনে

প্রতি প্রহরে

তুমি অনুভব করবে আমিই তোমার

নিষ্ঠুর মধুর নিয়তি …

যদি প্রতিদিন একটি ফুল

আমায় খুঁজতে বেড়ে ওঠে তোমার ঠোঁটের দিকে-

আহ্ আমার প্রেম, আহ্ আমার আমি,

আমার ভিতরে সমস্ত আগুন পুর্নবার হয় আবর্তিত

আমার ভিতরে নিভে যায়নি কিছুই, কিংবা হয়নি বিস্মৃত

আমার প্রেম তোমার প্রেম পেয়ে বাঁচে, প্রিয়তম,

আর আমাকে পরিত্যাগ না করে যতদিন বাঁচবে

তোমার আলিঙ্গনে রবে আমার প্রেম।

===================== 



আলোর স্তম্ভ – পাবলো নেরুদা

অনুবাদ: ইমন জুবায়ের


ও আলোর স্তম্ভ, বিষন্ন সুন্দর

ঐ বৃহদায়তন কন্ঠহার আর সমুদ্রের মূর্তি

চুনাপাথর-চোখ, বিপুলা জলধির সম্মান,

শোকার্ত সমুদ্র-পাখির কান্না, সমুদ্রের দাঁত,

প্রশান্ত বাতাসের স্ত্রী, ও অতলের নিষ্পেষিত ঝোপের

দীর্ঘ কান্ড থেকে উত্থিত

পৃথক গোলাপ

রুপান্তরিত দীপপুঞ্জমালা

ও প্রাকৃতিক নক্ষত্র, সবুজাভ উষ্ণীষ

একা তোমার নিঃসঙ্গ সাম্রাজ্যে

এখনও অর্জনশূন্য, পলায়নপর, জনমানবশূন্য

একটি বিন্দুর মতন, একটি আঙ্গুরের মতন, সমুদ্রের মতন।

=====================


 

সাদা মৌমাছি – পাবলো নেরুদা

অনুবাদ: ইমন জুবায়ের


সাদা মৌমাছি, তুমি আমার ভিতরে গুনগুন কর- তুমি মধু পান করে মাতাল

ধোঁওয়ার ধীর কুন্ডলীতে তুমি ঘুরে ঘুরে উড়ছ

আমি দিশেহারা, প্রতিধ্বনিশূন্য শব্দ,

সকলই হারিয়েছে যে- অথচ যার সকলই ছিল।

সর্বশেষ বাঁধন, আমার আকাঙ্খায় তুমি তোল ঝড়

আমার বিরানভূমিতে তুমিই সর্বশেষ গোলাপ।

আহ্, তুমি কী নিশ্চুপ!

তোমার গভীর চোখ বন্ধ কর। রাত্রি নামছে

ওহ্, তোমার শরীর এক সুগন্ধী ভাস্কর্য, নগ্ন।

তোমার গভীর চোখে রাত্রি নামে

ফুলের শীতল হাত আর গোলাপের কোল।

সাদা শামুকের মতন তোমার স্তন

তোমার নাভীর ওপর ছায়ার প্রজাপতিরা ঘুমাতে এসেছে।

আহ্,

তুমি কী নিশ্চুপ!

এই নির্জনতায় তুমি নেই।

বৃষ্টি ঝরছে। সমুদ্রবাতাস শঙ্খচিলদের তাড়িয়ে দিচ্ছে

ভেজা রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটছে জল

গাছের পাতারা বলছে ওদের শরীর খারাপ

সাদা মৌমাছি, যখন তুমি আমার ভিতরে গুনগুন কর

তুমি আবার সময়ে বাঁচ, তন্বি-নীরব।

আহ্ তুমি কী নিশ্চুপ!

===================== 



লেবু – পাবলো নেরুদা

অনুবাদ: ইমন জুবায়ের


লেবু ফুল থেকে

ঢিলেঢালা ভাবে

জ্যোস্নায়, প্রেমের

সুদৃঢ় তৃষ্ণার

সারৎসার,

গন্ধে পরিপূর্ন,

লেবু গাছের হলদে

উত্থান,

লেবুগুলো

গাছের কৃত্রিমভবন থেকে

নিচের দিকে নড়ছে

সংবেদনশীল বানিজ্য!

বন্দর এ নিয়ে বৃহৎ

বাজার

আলোর জন্য ও

বর্বর স্বর্ণের জন্য।

আমরা

অলৌকিকের

অর্ধেকটা খুলি,

আর, নোনা স্তরের কিনারে

জমাট এসিড:

সৃষ্টির

আদি রস,

বিস্ময়কর, অপরিবর্তনীয়,

জীবন্ত:

কাজেই সজীবতা

একটি লেবুর ভিতরে থাকে বেঁচে,

খোলশের মিষ্টিগন্ধী আড়তে

অনুপাত, অবোধ্য আর কটূ।

লেবু কাটতে

চাকু

একটি ছোট গির্জে রেখে যায়:

কুঞ্জকুঠিরগুলি চোখে আন্দাজহীন

যা খোলে নোনতা কাচ

আলোর দিকে: পোখরাজ

ছোট বিন্দুর ওপর উঠছে,

বেদিগুলি,

সুগন্ধী তোরণ।

কাজেই, হাত যখন

কাটা লেবু ধরে,

অর্ধ-পৃথিবী

চামচের ওপর,

ব্রহ্মান্ডের স্বর্ন

উৎসারিত

তোমার স্পর্শে:

এক কাপ হলুদ

অলৌকিকতায়,

একটি স্তন ও স্তনবৃন্ত

পৃথিবীকে সুগন্ধে ভরাচ্ছে;

ফল উৎপাদনের জোয়ার

একটি গ্রহের ছোট আগুন।

===================== 



পিঙ্গলবর্ণের উচ্ছ্বল শিশু – পাবলো নেরুদা

অনুবাদ: ইমন জুবায়ের

 

পিঙ্গলবর্ণের উচ্ছ্বল শিশু, সূর্য -যা সৃজন করে ফল

আর শষ্যকে করে পরিপক্ক, সমুদ্রশ্যাওলাকে করে আন্দোলিত

তোমার সুখি শরীর আর তোমার উজ্জ্বল চোখ করেছে নির্মান

আর তোমার মুখে দিয়েছে জলের হাসি।

কৃষ্ণকায় এক যন্ত্রণাকাতর সূর্য কচি পাতায় জড়ানো

তোমার কালো কেশরে যখন তুমি বাড়িয়ে দাও হাত

তুমি সূর্যালোকে খেলে বেড়াও যেনবা জোয়ারের নদী

আর তা তোমার চোখে কালো দুটি জলাশয় রেখে যায়।

পিঙ্গলবর্ণের উচ্ছ্বল শিশু, তোমার দিকে আমাকে নেয় না কিছুই

এই অপরাহ্নে সবই আমাকে টেনে সরিয়ে দিচ্ছে।

তুমি মৌমাছির উদ্দাম যৌবন,

ঢেউয়ের মাতলামি, তাপের শক্তি।

আমার ঘোর লাগা হৃদয় সবর্দা তোমায় খোঁজে

আমি তোমার সুখি শরীর ভালোবাসি, তোমার ঐশ্বর্যময় নম্র কন্ঠস্বর।

গোধূলির প্রজাপতি, মিষ্টি ও নিশ্চিত

গমক্ষেতের মতো, সূর্য, পপিফুল,আর তোমার জল।

===================== 



কুকুরটি বেঁচে নেই – পাবলো নেরুদা

আমি তাকে বাগানের মাঝামাঝি কবর দিয়েছি

এখন আমাকে ভীষণ শক্তিহীন মনে হচ্ছে।

তার সাথে বহুদিন সঠিক পথেই হেঁটে গেছি

ঢেউখেলা চুলে যে হাঁটবে না আমার সাথে কোনদিন।

আমি বাস্তবাদী, আকাশের শূন্যতাকে বিশ্বাস করি না

জানি আমাদের মতো কারো জন্য কোন স্বর্গ নেই

তবে কুকুরটি স্বর্গবাসি হলে আমিই সুখি হবো বেশি

এবং জানি সে আমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করবে

প্রভূত্ব দেখাবে লেজ নেড়ে একমাত্র বন্ধুর জন্য।

কুকুরটি কখনো দাসত্ব করেনি, জামার ওপর হাঁটেনি

আয়ত্বে নেবার জন্য সে কখনও ছোঁয়ায়নি চুমু

অন্যদের মতো যৌনতায় মাতেনি সে

সে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো বন্ধু হয়ে

যতোটুকু প্রয়োজন, যতোটুকু দরকার

সে আমাকে বুঝতে চাইতো মানুষের প্রয়োজনে

মানুষ পারে না অথচ কুকুরটি পেরেছিল নষ্টপ্রহরে।

স্বপ্নের চেয়েও শুদ্ধ মনে হতো তার দু’চোখ

মিষ্টি এবং পশমি গন্ধময় সুন্দর দিনে

কাছাকাছি প্রশ্নহীন, আমি তার লেজ ছুঁয়ে-

সাগর সৈকতে হেঁটেছি বহুদিন

শীতে যেখানে পাখিরা নির্জন আকাশ ভরে রাখে

সেখানে আমার পশমি কুকুর সাগরে ঢেউয়ে লাফাতো

আশ্চর্য কুকুর মুহুর্তেই তার সোনারং লেজ নিয়ে

আবার দাঁড়াতো সাগরের সব জল নাড়তে।

আনন্দ! কি যে আনন্দ তার!

আমার কুকুর জেনেছিল সুখী হতে হয় কোন পথে

মানুষের লজ্জাহীন দৌরাত্বের শাসন উপেক্ষা করে।

সেই কুকুরের জন্য আজ কোন শোকবার্তা নেই

সে এখন বহুদুরে, আমি তাকে মাটি চাপা দিয়েছি

অথচ তার ভালোবাসা মাটি থেকে বের হয়ে আসছে

যা বহনের ক্ষমতা আজ আমারও নেই।

===================== 


সনেট ৬৯ – পাবলো নেরুদা

অনুবাদ:জি.এম.তানিম


শূন্যতা মানে তোমার না থাকা

দুপুরকে একটা নীল ফুলের মতো চিরে

তোমার না চলা, কুয়াশা ঘেরা বিকেলে

নুড়িমাখা পথে তোমার না চলে যাওয়া,

তোমার হাতে সোনালি সেই আলো

না থাকা, যে আলো চোখে পড়ে না কারো,

যে আলো সবার অগোচরে বেড়ে ওঠে

লাল গোলাপের কুঁড়ির মতন।

সোজা কথায় তোমার না থাকা: ঝরো হাওয়ায়

উড়ে আসা একগুচ্ছ গোলাপের মতন উৎসাহে

উদ্দীপ্ত তোমার আমার পৃথিবী জানতে না আসা,

তাই আমি আছি কেবল তুমি আছ বলে।

তাই তুমি আছ, আমি আছি, আমরা আছি,

এবং ভালোবেসে আমি থাকব, তুমি থাকবে, আমরা থাকব।

(মূল কবিতাঃ Soneto LXIX,

Pablo Neruda,

Cien Sonetos de Amor)

===================== 



নেংটো সুন্দরির বন্দনায় – পাবলো নেরুদা

অনুবাদ:চয়ন খায়রুল হাবিব

খাস কলিজায়

পাক সাফ চোখে

আমি তোমার সৌন্দর্জ উদজাপন করি

অঝরে ঝরা রক্তপাত ধরে রাখি

যাতে তা লাগাম পরাতে পারে

আমার কবিতায় শোয়া

তোমার শরিরের বাকে

জংগল ঘেরা জমিতে

অথবা সমুদ্রে সার্ফিং :

সুগন্ধি ফেনায়

সাগরের বাজনায়।

ও নেংটো সুন্দরিঃ

সমান তালে তালে সুন্দর

তোমার পায়ের পাতা

প্রাচিন বাতাস আর শব্দের

কারুকাজ আঙ্গুলের ভাজেঃ

কানের লতি

আমেরিকান সাগর সেচা

ছোট ছোট শামুকের খোল;

পুরুষ্ঠ বুক জোড়ায়

জ্যন্ত জ্যন্ত আলোর কলরোল

উড়ন্ত

পাপড়িরা

খুলছে

আর ঢাকছে

চোখের দুই গভির মহাদেশ

তোমার ঘাড়ের বাক

যেখানে দু’ভাগে হারিয়েছে

ধুসর পায়ের চামড়ায়

সেখানেই গলেছে

মাঝখানে সমান করে কাটা

আপেলের জমকালো দুটি টুকরো,

তোমার সৌন্দর্জ দু’ভাগে নেমে যায়

সোনায় মোড়ানো দুটি থাম্বায়-

আমরা যাদের বলি রান বা উরু

ধিরে ধিরে ডূবে যায়

আঙ্গুরের থোকায় ঢাকা

পায়ের পাতায়,

ওখানে তোমার জমজ গাছ

আবার পোড়ে এবং আবারো ওড়েঃ

আগুন ঝরায়, ঝাড়বাতি দোলায়,

গাছপাকা ফল

সাগরের সাথে পৃথিবির

মিতালি পাতায়

কি খনিজে, কি ভেষজে

তৈরি তোমার দেহা-

মনকা পাথরে, সোলেমানি আকিকে,

সিলিকা বালুকনায়, গমের একহারা দানায়,

তান্দুরিতে ফুলে ওঠা পাউরুটি

সংকেত পাঠাচ্ছে

রুপালি

পাহাড়কে,

মিষ্টি ফলের ভেতর

নরম মখমল,

ততক্ষন হাশফাশ

যতক্ষন আশ

তুলতুলে আর পেটোয়া

নারির গড়ন?

শুধুমাত্র আলোই

পৃথিবিতে ঝরে না,

তোমার দেহের ভেতর ছড়াচ্ছে

দম আটকানো তুষার

ধরেই নিয়েছে ওরা

ভিতর বাড়িতে তুমি পুড়ে খাক

বাহির বাড়িতে চামড়ার ভাজে ভাজে চাদের সর্বনাশ ।

===================== 



কবিতা – পাবলো নেরুদা

অনুবাদ:চয়ন খায়রুল হাবিব


এবং ঐ বয়সটাতে…কবিতা এসেছিল

আমার খোজে।আমি জানতাম না,

জানতাম না কোথ্যেকে,

শিতকাল না কি নদি থেকে,

কিভাবে কখন জানতে পারি নি,

না, কোনরকম শব্দও শুনিনি,

নিশব্দও না,

কিন্তু রাস্তা থেকে ও আমাকে ডেকেছিল,

পুড়তে পুড়তে,

ভয়ঙ্কর আগুনের হলকায় হুটোপুটি করতে করতে,

রাতের ডালপালারা ডেকেছিল ইশারায়ঃ

ভিড় থেকে দুরে সরে যেতে বলেছিল

আমার তখন কোন চেহারাই ছিলনা

কিন্তু কবিতা ঠিক ঠিক আমার

চেহারাকেই ছুয়েছিল

জানতাম না ঠিক কি বলতে হবে,

আমার মুখে নাম ধাম তেমন আসেনা,

চোখ তখন অন্ধ,

ভেতরে কেমন একটা তোলপাড়,

জ়্বর জ্বর ভাব য্যনো পথ হারানো ডানা-ভাঙ্গা পাখি,

কিন্তু ঠিকই পথ বের করে ফেলেছিলাম

ঐ ভয়ঙ্কর আগুনের গোপন সংকেতের পাঠ শিখে নিয়েছিলাম,

প্রথম অস্পষ্ট লাইনটি হুট করেই চলে এসেছিল,

অস্পষ্ট , বড় কোন অর্থ নেই, কিন্তু খাটি,

আগামাথা নেই, বকুনি,

কিন্তু নির্ভেজাল জ্বান,

অগ্বানের গ্বান আর কি

হঠাত স্বর্গ দেখে ফেলেছিলাম,

স্বর্গের দুয়ার খুলছে

আর বন্ধ হচ্ছে

তারারা পিট পিট করছে

ছায়ারা ছিড়ছে খুড়ছে

ছায়াতে, তারাতে

তির ধনুকে, আগুন এবং ফুলদের ধাধা,

রাত আর পৃথিবি এলানো বিশ্রামে।

এবং আমার অস্তিত্বের শেষ নেই,

মহান তারাদের শুন্যতায়

মাতাল,রহস্যের ছবি ও ছায়ায়

নিখোজ নিজের ভেতরের গোলক ধাধায়

কিন্তু খাটি

বাদলা বাতাসে তারাদের মেলায় ।

===================== 



তোমাকে পছন্দ করি স্থির – পাবলো নেরুদা

অনুবাদ:চয়ন খায়রুল হাবিব


তোমাকে পছন্দ করি এক্কেবারে স্থির

এমনটা য্যনো তুমি আসলে নেই

আমাকে শুনতে পাচ্ছ দুর থেকে,

কিন্তু আমার গলার স্বর তোমাকে ছুচ্ছে না

তোমার চোখগুলো কোথায় য্যনো উড়ে গেছে

তোমার মুখ তালামারা চুমুর সিলগালায়

সবকিছুতেই আমার আত্মা

তুমি আবার আমার সবকিছুতেই

আমার আত্মার স্বপ্নের প্রজাপতি

এবং তুমি “বিশন্নতা” নামক

শব্দটার ধারক ও বাহক

আমি তোমাকে পছন্দ করি এক্কেবারে স্থির

মনে হতে পারে তুমি শোকাহত

প্রজাপতি কাতরাচ্ছে ঘুঘু পাখির মত

দুর থেকে ঠিকই তুমি আমাকে শুনতে পাচ্ছ

কিন্তু আমার গলা তোমার কাছে পৌছোচ্ছে না

আমাকে তোমার নিরবতায় সুস্থির হতে দাও

তোমার নিরবতার সাথে আমাকে কথা বলতে দাও

সে-কথাগুলো পিদিমে জ্বলজ্বলে

আংটিতে সাধারন , তারাদের ভিড়ে তুমি রাত

তোমার নিরবতা অনেক দুরের তারাদের সিথানে কাত

আমি তোমাকে চাই এক্কেবারে স্থির

কিন্তু তুমি নেই, দুরে অনেক দুরে দুঃক্ষিত

আর হবে হয়ত মরেই গিয়েছ

একটু কথা, একটু হাসি-তাই যথেস্ট

তাতেই আমি খুশি,খুশি যে এসবের কোনটাই সত্যি না ।

===================== 



মাতাল ও মাছকন্যা – পাবলো নেরুদা

অনুবাদ:চয়ন খায়রুল হাবিব


এক্কেবারে নেংটো মেয়েটি ঢোকবার সময়

পানাশালাত বেশ ক’জন জোয়ান মর্দ বসে বসে পান করছিল।

পান করতে করতে,ওরা মেয়েটির দিকে

থু থু থু…করে থুতু ছিটাচ্ছিল।

সবে সাগর থেকে উঠে আসা মেয়েটি

এসবের কিছুই বুঝতে পারছিল না।

মেয়েটি পথ হারানো মাছকন্যা ।

টিটকারি থু থুক্কার জ্বলজ্বলে মাংশ ছুয়ে

পিছলে পিছলে খসে পড়ছিল।

খিস্তি খেউড়ে ওর সোনালি দুধের মাই ঝলাসাচ্ছিল।

কাদতে জানেনা বলে মাছকন্যা কাদে নি।

কাপড় চেনেনা বলে মাছকন্যা পোষাক পরেনি।

জ্বলন্ত সিগারেট ওরা মাছকন্যার গায়ে ঠেশে ধরছিল।

শব্দ অপরিচিত বলে ও চিতকার করনি।

দুরের ভালবাশার রঙ্গে ওর চোখ তবূও রঙ্গিন,

ওর হাতগুলো মনকা পাথরে জ্বল জ্বল,

প্রবালের আলোতে ওর ঠোট নড়ছিল,

শেষমেশ মেয়েটি অবশ্য বেরোতে পেরেছিল।

যে-নদি থেকে এসেছিল

সে-নদিতে ফেরা মাত্র মাছকন্যা আবার পরিস্কার,

আবার বৃষ্টি ধোয়া সাদা মার্বেলে টলটলে।

একবারও পিছে না ফিরে ও সাতরে গিয়েছিল

শুন্যতার দিকে, নিজের মরনের দিকে।

===================== 



এঞ্জেলা – পাবলো নেরুদা

অনুবাদ:চয়ন খায়রুল হাবিব


আজকে শুয়েছিলাম এক খাটি তরুনির পাশে

সাদা সাগরের তিরে জ্বলন্ত তারাদের ঠিক মাঝখানে

সব ঘটছিল খুব আস্তে আস্তে

টানা সবুজ চাহনিতে

ঝলসানো আলোতে শুকনো পানির দাগ

টলটলে গভির গোল্লাছুটের তিব্র আর তাজা আবেগ

বুকের বোটায় দুটি দুমুখি মশাল

জ্বলছে খাড়া দুই দুটি অঞ্চলেঃ

জ্বলতে জ্বলতে গলেছিল নদিপথে

পরিস্কার পায়ের পাতায়

মৌসুমি বাতাসে সবে ফলন ধরেছে

শরিরের এক মাথা থেকে আরেক মাথা

নিজেকে ভরে তুলেছে গাছপাকা ফলে

গোপন অনলে ।

===================== 



দুপুরের বুকে ঝুকে – পাবলো নেরুদা

অনুবাদ:চয়ন খায়রুল হাবিব


দুপুরের বুকে ঝুকে পড়ে বিষন্নতার জাল ছুড়েছিলাম

তোমার সাগর-নিল চোখের জলে

ওখানে গনগনে হলকায় আমার একাকিত্ত্ব বাড়ে

ডুবন্তের হাত তড়পায় বানের জলের তোড়ে

তোমার অন্যমনস্ক চোখে আমি লাল সংকেত পাঠিয়েছি

চাহনি দুলেছিল সাগরবেলাতে দাঁড়ানো বাতিঘরে

দুরের নারি তুমি কেবল অন্ধকার ধরো

শঙ্কাপারে আশঙ্কা থরো থরো

দুপুরের বুকে ঝুকে বিশ্ননতার জাল ছুড়েছিলাম

সেই সাগরে আছড়ে পড়ে তোমারই সাগর-নিল চোখ

তোমার সাথে সঙ্গম

অনেকটা রাতচরা পাখিদের দানা খুটে খুটে খাওয়া

রাত সওয়ার এখন ছায়াবতি ঘোড়ার জিনে

রাত মাটিতে বুনেছে রাতের নিল টাসেল।

=====================


সকাল – পাবলো নেরুদা

অনুবাদ:চয়ন খায়রুল হাবিব


একদম উদোম, তুমি তোমার হাতের মতন সাধারন

তুলতুলে, সাদামাটা, ছোট্ট, স্বচ্ছ, গোলগাল,

চাদের আলোতে, আপেল বাগানেঃ

একদম উদোম, গমের দানার মত একহারা

একদম উদোম, তুমি কিউবার রাতের মত নিল

চুলজুড়ে আঙ্গুর আর তারাদের ভিড়

বেশ খোলামেলা আর হলুদাভ

গির্জার সোনালি গম্বুজ য্যমনটা গরমকালের আচ

একদম উদোম, তুমি তোমার নখের মতই ছোট্ট-

বাকানো, সুক্ষ, গোলাপি, দিনের আলোর জন্ম হ’লো মাত্র

আর তুমি নিজেকে সরিয়ে নিলে পাতালে

কাপড় চোপড়ে ঢাকা এক সুড়ংগপথে

তোমার টলটলে আলো পোষাক পরছে-পাতা ঝরছে-

আবার হয়ে উঠছে উদোম একটা সাধারন হাত



সমুদ্রের নীলাভ লবণ

সমুদ্রের নীলাভ লবণ, বিপুল ফেনীল ঢেউ 
আর সূর্যকিরণ, যখন তোমার ওপর ঝাপটে পড়ে 
ইসলানেগ্রায়, তখন আমি চেয়ে দেখি কর্মব্যস্ত বোলতাটিকে, 
স্বকীয় পৃথিবীর মধুর কাছে ওর আত্মসমর্পণ।

দেখি ওর নিয়ত আসা-যাওয়া; নিয়ন্ত্রিত, সোনালী উড়ান।
যেন কোনো অদৃশ্য, সরল তারে ও পিছলে যায়,
দৃপ্ত নাচে, নিপুণ ভঙ্গিমায়। দেখি ওর পিয়াসী কোমর,
একটি একটি করে ওর সূক্ষ্ম সুঁচ নিঃশেষিত হওয়া।

একটি অনচ্ছ কমলা রংধনুর ভেতর 
এক চিলতে বিমানের মত, ঘাসের ওপর শিকার করে ও।
দেখি ওর গজালের সূক্ষ্ম ইঙ্গিত, লহমায় হারিয়ে যাওয়া।

আর এর মধ্যে তুমি সমুদ্র-স্নান শেষে নগ্ন উঠে আসো,
ফিরে যাও লবণাক্ত, সূর্যময় পৃথিবীতে,
যেন অনুনাদী ভাস্কর্য এক, যেন বালিতে ঝলসানো এক শাণিত তরবারি।

--অনুবাদ: আনন্দময়ী মজুমদার 
২০১৪/০৯/২৯


সমালোচনাগাথা

পাঁচটা কবিতা লিখেছিলাম:
একটা ছিল সবুজ
আরেকটা ছিল গোলগাল গমের রুটির টুকরা
তৃতীয়টা ছিল একটা বাড়ি, একটা ইমারত
চার নম্বরটা ছিল একটা আংটি
আর পঞ্চমটা ছিল বিদ্যুতের ঝলকানির মতো অল্প মুহূর্তের
এবং যেহেতু কবিতা লিখেছিলাম
সে নিজেই আমার হেতু-কে ছাপ দিয়ে আমার কথা জানান দিল।

তো, পুরুষ
আর নারী
এল আর গেল
আর সঙ্গে নিয়ে চলল
আমার সহজ সরল সঞ্চয়—
হালকা বাতাস, ঢেউ-খেলানো বাতাস,
বর্ণচ্ছটা, কাদা, কাঠ
আর এই সব সাধারণ জিনিসপত্র দিয়েই
বানাল দেয়াল, মেঝে আর স্বপ্ন।

আমার কবিতার একটি পঙ্ক্তির ওপর
তারা ঝুলিয়ে রাখল সূর্যের আলোতে ভেজা কাপড়।
আমার শব্দগুলো হয়ে উঠল তাদের রাতের খাবার।
আমার শব্দগুলোকে রেখে দিল
তাদের মাথার বালিশের পাশে।
কবিতার সঙ্গে শুরু হলো তাদের বসবাস,
শুরু হলো বসবাস সেই আলোর সঙ্গে
যে আলো আমার পাশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল।

তখন
এল এক নিঃশব্দ সমালোচক।
তারপর এল বাচালের পাল
এবং এল আরও অনেকেই—
কেউ কানা, কেউ নাকি সব দেখে, সর্বদ্রষ্টা,
তাদের মধ্যে কেউ কেউ দারুণ মার্জিত পরিচ্ছন্ন রুচিমান
কেউ কেউ এমনকি লাল জুতার বর্ণচ্ছটার মতো উজ্জ্বল
কেউ কেউ লাশের মতো কাপড়চোপড়ে ভীষণ পরিপূর্ণ।
কেউ কেউ আবার উন্নীত রাজতন্ত্রের
দলবাজি করে,
কেউ কেউ মার্ক্স মহাশয়ের ঘন দীর্ঘ ভুরুতে আটকে গিয়ে আর ঝুলে থেকে
তার দাড়িতে ঠ্যাং দিয়ে লাথি মেরে যাচ্ছিল।
কেউ কেউ ইংরেজ
পুরাদস্তুর ইংরেজ
এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ
দাঁত আর ছুরি নিয়ে
ঢাউস অভিধান আর গুপ্ত অস্ত্র নিয়ে
মাননীয় উদ্ধৃতিসমূহের কুচকাওয়াজ নিয়ে
কবিতা পড়ার যাত্রা শুরু করল।
তারা কবিতা পড়ার যাত্রা শুরু করল,
যে মানুষগুলো আমার কবিতা ভালোবাসত
সেই সহজ-সরল সুন্দর সাধারণ মানুষের কাছ থেকে
আমার কবিতাকে ছিনতাই করার জন্য।

তারা কবিতাকে ফাঁদে ফেলে মশকরায় মেতে থাকল।
তারা কবিতাকে ঠোঙা বানাল,
তারা কবিতার ভিতরে কয়েক শ পিন ঢুকিয়ে তাকে
নিরাপদে রাখতে চাইল তাদের জন্য।
কবিতাকে ঢেকে রাখল কঙ্কালের ঝুরঝুরি দিয়ে
অথবা কবিতাকে কালির মধ্যে চুবাতে থাকল,
বিড়ালের বদান্যতার নামে কবিতার ওপর থুতুও ছিটাল।
কবিতাকে ব্যবহার করল ঘড়ি মোড়াবার কাপড় হিসেবে।
মনে করলো তারা কবিতাকে রক্ষা করে যাচ্ছে এভাবে।
কাঁচা তেলের সঙ্গে কবিতাকেও তারা মজুত করল
আর কবিতাকে উৎসর্গ করে চলল
তাদের স্যাঁতসেঁতে রচনাবলি কিংবা অভিসন্দর্ভ।
তারা মাঝেমাঝে দুধ দিয়ে কবিতা সিদ্ধ করল,
নুড়ি দিয়ে কবিতাকে গোসল করাল।
আর এই প্রক্রিয়ায় কবিতা থেকে মুছে ফেলল
তার জ্বলজ্বলে স্বরবর্ণ, তার শব্দের টুকরো, তার দীর্ঘশ্বাস।
কবিতাকে তারা প্রায় খুন করে বসল।
তারা কবিতাকে দুমড়িয়ে-মুচড়িয়ে হাত-পা বেঁধে রেখে দিল
এক প্যাকেটে।
তারপর কবিতায় থাকা চিলেকোঠা আর গোরস্থানকে
সম্বোধন করল।

তারপর
একের পর এক তারা অবসর নিল—
পাগলের মতো খেপে উঠল আমার ওপর
কারণ আমি তাদের জন্য যথেষ্ট ‘জনপ্রিয়’ নই।
অথবা আমার কবিতায় নিয়মমাফিক ভুতুড়েপনার অভাবের প্রতি
খানিকটা ঘৃণায় কাতর হয়ে
তারা বিদায় নিল।
সকলেই।

এবং তারপর
আরও একবার
নারী আর পুরুষ
এল
আমার কবিতার সঙ্গে
থাকবে বলে।
আরও একবার
তারা জ্বালাল আগুন
গড়ে তুলল ঘরবাড়ি
বানাল রুটি
ভাগাভাগি করে নিল
আলো সূর্য মাটি কাদা কাঠ
এবং ভালোবাসায়
বিদ্যুতের ঝলকানির সঙ্গে
আংটির সঙ্গে
যোগ দিল।

এবং এখন:
ভদ্রমহোদয়গণ!
গোস্তাকি মাফ করবেন
এই গল্প থামানোর জন্য।

কেননা আমি নিজেই চলে যাচ্ছি চিরতরে—
ওই সহজ সরল সুন্দর সাধারণ মানুষের
সঙ্গে চিরকাল থাকার জন্যই।

বইবন্দনা

বই
সুন্দর পেলব
বই
ছোট্ট বন
পাতার
পর পাতা
তোমার কাগজ
মাটি আর বায়ু আর জল আর অগ্নির
গন্ধে মৌ মৌ
বই, তুমি প্রত্যহের
তুমি রাত্রির
তুমি শস্যদানা
তুমি মহাসমুদ্র—

তোমার প্রাচীন পৃষ্ঠায়-পৃষ্ঠায়
থাকে ভালুক শিকারি
উৎসবের নীল দীপাবলি
মিসিসিপি অভিমুখে
দ্বীপগুলোতে
ক্যানু—
পরে আসে রাস্তা
রাস্তার পর রাস্তা
আলোকায়ন—
চিন্তার উন্মীলন
বিদ্রোহে টগবগ করা
শহর সব
ফরাসি কবি র‌্যাঁবো
যেন আহত
যেন রক্তভেজা মাছ
কাদায় পরে হাঁসফাঁস করছে
এবং ভ্রাতৃত্বের সৌন্দর্য
মানুষের প্রাসাদ তোলে
পাথরের ওপর পাথর দিয়ে
জড়িয়ে থাকা কষ্টদুঃখ
অটুট হয়ে—
সংহতি—
চোরা গোপন বই
পকেট থেকে পকেটে
তার যাত্রা জারি রাখে
যেন এক গুপ্ত বাতি
যেন একটা লাল জ্বলজ্বলে তারা।

আমরা
অর্থাৎ ভবঘুরে কবিরা
পৃথিবী চষে বেড়িয়েছি, খুঁজেছি তাকে
জীবন আমাদের স্বাগত জানিয়েছে
প্রতিটি দরজায় দরজায়
মাটি-কাদা-জলের সংগ্রামে
যোগ দিয়েছি আমরা।
কিন্তু কী ছিল আমাদের বিজয়?
একটা বই—
একটা বই
মানুষের স্পর্শে আর যোগাযোগে ঠাসা—
নির্জনতাহীন পিরহানে পিরহানে ঠাসা বই
মানুষ আর তার হাতিয়ারে ভরপুর বই—
বই-ই
আমাদের বিজয়।

বই পরিপক্ব হয়
বই পাকা ফলের মতো পড়ে
আছে তার আলো
আছে তার ছায়া
কিন্তু তার পৃষ্ঠাগুলোও তো ছিঁড়ে ফেলা যায়
অথবা রাস্তায় হারিয়ে যায়
মাটিতে সমাধিস্থ হয়।

কবিতার বই
ভোরের আলোর মতো ফোটে
ফিরে আসে তোমার পৃষ্ঠায়
বরফ কিংবা শেওলা ধারণ করার জন্য
যাতে তোমার পায়ের আওয়াজ
কিংবা তোমার চোখ
তাদের চিহ্ন রেখে যেতে পারে—

আরও একবার
আমাদের জন্য
পৃথিবীটাকে বর্ণনা করো
সতেজ পরিষ্কার জলের পৃথিবী
ঝরনার পৃথিবী
লম্বা লম্বা গাছের ঝাড়
বিপরীতমুখী গ্রহ
আর মানুষের বান
নতুন রাস্তায়।
এগোচ্ছে তারা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে
জলের ওপর এগোচ্ছে তারা
সমুদ্রের নগ্ন নির্জনতায়
মানুষ—মানুষ—মানুষেরা
আবিষ্কার করছে
পরম রহস্য:

মানুষেরা ফিরছে
প্রত্যেকের হাতে হাতে বই

বই
বই
বই
বই

ফিরছে শিকারি বাড়িতে—
তারও হাতে বই।

আর চাষা করছে চাষ
তার লাঙল দিয়ে
যার নাম বই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন