মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতা সংগ্রহ

 


মেয়েদের অ আ ক খ – মল্লিকা সেনগুপ্ত

অনেক তো হল মানবিকতার ভাষ্য
পৃথিবীটা তবু একচুলও এগোল না
এবার তাহলে মানবিকতাই হোক
একুশ শতকে স্বপ্ন দেখার চোখ

স্বরবর্ণ

অয় অজগর আসছে তেড়ে
ছোট্ট মেয়ের স্বপ্ন ঘেরে

আমার তোমার সবার চোখে
ময়াল সাপের মতন ও কে ?

ইঁদুর ছানা ভয়েই মরে
ধর্ষিত সে ভীষণ ঝড়ে

ঈগল পাখি দ্বিতীয় ভয়
থানা পুলিশ কোর্টে রয়

উট চলেছে উল্টোপুরাণ
মধ্যযুগে সে অভিযান

ঊনো জমির দুনো ফসল
বঙ্গদিশি মেয়ের দল

ঋতুবেলায় অশুচি নারী
অন্য সময় ঠেলবে হাঁড়ি

৯-কার কেমন ডিগবাজি খায়
লুপ্ত হওয়ার লাজ শঙ্কায়

একুশ থেকে ইচ্ছা-পোশাক
যে দেখে তার চক্ষু টাটাক

ঐ দেখো ওর ঘোমটা খোলা
বোরখা খোলা আপন ভোলা

ওল খেও না ধরবে গলা
ময়ালকে তা মিছে বলা

ঔষধে যে ময়াল মরে
সে ঔষধ কি আছে ঘরে

**********************
ব্যঞ্জনবর্ণ

কন্যাশিশুর বিপদ বাড়ছে
যৌতুক যত সীমানা ছাড়াছে

খনার জিভ বাতাসে নড়ে
মুখ ফোটে না সাতাশ চড়ে

গণিকালয় কারা বানায়
ভিয়েতনামে হাড়কাটায়

ঘর তোমার রাজ তোমার
আমি পুতুলখেলা তোমার

ঙ নৌকা মাঝি ব্যাঙ
পুরুষতন্ত্র ড্যাডাং ড্যাং

চৌকাঠের ভাঙন ওরা
লাবণ্য সীতা ইলেকট্রা নোরা

ছবির মতো না, ওরা স্বয়ং
ছবি বানায় রং-বেরং

জরায়ু যার বাচ্চা তার
আধাফসল থাক পিতার

ঝগড়াঝাঁটি ঝিঁঝির ডাক
মেয়ে পুরুষ জড়িয়ে থাক

ঞিহার পূজা প্রণাম বন্ধ
“পরমেশ্বরে” মানুষ গন্ধ !

টাকার গরম ওঠা নামায়
দাদু একাই টাকা কামায়

ঠাকুরমার জীবনভর
পরিশ্রমের দাম তো ধর

ডিম আগে না মুরগি আগে
ইভ জাগে কি আদম জাগে !

ঢিসুম ঢিসুম পেশির জোর
আসমুদ্দুর পৃথিবী তোর

মূর্ধণ্য নাকের পরে
ইভ এখনও পচছে ঘরে

ত্র্যহস্পর্শে গেরস্থালি
মা হওয়া আর রূপের ডালি

থ হবেন না বাবুমশাই
ভালবেসেই এ চড় কষাই

দেরিদা জানে পাতায় পাতা
বিনির্মাণের খেরোর খাতা

ধর্মের কল পুরুষ নাড়ে
ধর্ম ছুড়ে ভীষণ মারে

নারীবাদের একুশ শতক
মেয়েরা চায় নিজস্ব হোক

পুরুষ তোমার এক ভাগ জল
তিনভাগ তুমি জলঅচল

ফেনার ভেনাস তোমার স্বপ্নে
আমি তবু বলি, “আমার সব নে”

বিবাহ মানে সারা জীবন
ভাঙাগড়ার অবগাহন

ভালবাসার গুপ্তধন
এক জীবন অন্বেষণ

মানবী সম্পদের দল
আমরা সব জলঅচল

যোনি আমার উপনিবেশ
শিবঠাকুরের আপন দেশ

ব়্যাডিক্যালিস্ট রাগিণী মেয়ে
পুরুষ তাকে পাবে না চেয়ে

লেসবিয়ান লেসবিয়ান
যৌনতার বিনির্মাণ

বিবাহ তবু শেষ আশ্রয় !
হতেও পারে প্রণয়ময়

শাখা সিঁদুর শাক ঢাকা মাছ
শয্যা শরীর শেকল গাছ

ষোড়শী কিছু আন্তিগোনে
বিদ্রোহের প্রহর গোনে

সাফো ছিলেন প্রথমা শ্লোক
সরস্বতী আশিরনখ

হিংসা যখন ঘরের ভেতর
প্রিয়তমই মৃত্যু যে তোর

“ড়” যন্ত্রের সামনে ষ
লিঙ্গ রাজনীতির দ

ঢ়-এর মাথা কামড়ে খায়
মেয়েপুঁথির সরলরেখা

ৎ-এ ক্রান্তিকাল
“পারসোনাল ইজ পলিটিকাল”

য় ছিল খুব নির্ভরশীল
সংসারে তার চেরনোবিল

ং টি ক্লোনিং শাবক
জনকহীনের জন্মছক

ঃ এর বাবার নাম
ভিয়েতনাম লাল সেলাম


চোখ


কিছুতেই বোঝে না সে ভালবাসা শিয়রে এসেছে
বিছানার পাশে রাখা ছোট্ট সাদা আলো
ভালবাসা সন্তর্পণে সেখানে এসেছে |
আঁচল উড়তে দেখে যুবকটি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে উড়ে আসা ঘোড়া দেখে—
গবেষণাগারে ফেলে এসেছে সে আতস চশমা

আকুলতা স্পর্শ করে তাকে
তবু সে চেনে না চোখ, যে নয়নে তার জন্য রহস্য জমেছে ।



শুভম তোমাকে 

শুভম তোমাকে অনেকদিন পরে
হটাত দেখেছি বইমেলার মাঠে
গতজন্মের স্মৃতির মতন
ভুলে যাওয়া গানের মতন
ঠিক সেই মুখ, ঠিক সেই ভুরু
শুধুই ঈষৎ পাক ধরা চুল
চোখ মুখ নাক অল্প ফুলেছে
ঠোঁটের কোনায় দামি সিগারেট
শুভম, তুমি কি সত্যি শুভম!
মনে পড়ে সেই কলেজ মাঠে
দিনের পর দিন কাটত
কীভাবে সবুজ ঘাসের মধ্যে
অন্তবিহীন সোহাগ ঝগড়া!
ক্রমশই যেন রাগ বাড়ছিল
তুমি চাইতে ছায়ার মতন
তোমার সঙ্গে উঠব বসব
আমি ভাবতাম এতদিন ধরে
যা কিছু শিখেছি, সবই ফেলনা!
সব মুছে দেব তোমার জন্য?
তুমি উত্তম-ফ্যান তাই আমি
সৌমিত্রের ভক্ত হব না!
তোমার গোষ্ঠী ইস্টবেঙ্গল
আমি ভুলে যাব মোহনবাগান!
তুমি সুচিত্রা, আমি কণিকার
তোমার কপিল, আমার তো সানি!
তোমার স্বপ্নে বিপ্লব তাই
আমি ভোট দিতে যেতে পারব না!
এমন তরজা চলত দুজনে
তবুও তোমার ঘাম গন্ধ
সস্তা তামাক স্বপ্নের চোখ
আমাকে টানত অবুঝ মায়ায়
আমার মতো জেদি মেয়েটিও
তোমাকে টানতো প্রতি সন্ধ্যায়
ফাঁকা ট্রাম আর গঙ্গার ঘাটে
তারপর তুমি কম্পিউটার
শেখার জন্য জাপান চললে
আমিও পুণের ফিলমি কোর্সে
প্রথম প্রথম খুব চিঠি লেখা
সাত দিনে লেখা সাতটা চিঠি
ক্রমশ কমল চিঠির সংখ্যা
সপ্তাহে এক, মাসে একটা
ন মাসে ছ মাসে, একটা বছরে
একটাও না… একটাও না…
ডাক বাক্সের বুক খাঁ খাঁ করে
ভুলেই গেছি কতদিন হল,
তুমিও ভুলেছ ঠিক ততদিন
তারপর সেই পৌষের মাঠে
হটাত সেদিন বইমেলাতে
দূরে ফেলে আসা গ্রামের মতো
তোমার মুখটা দেখতে পেলাম
শুভম, তুমি কি সত্যি শুভম!

আপনি বলুন, মার্কস………

ছড়া যে বানিয়েছিল, কাঁথা বুনেছিল
দ্রাবিড় যে মেয়ে এসে গমবোনা শুরু
করেছিল
আর্যপুরুষের ক্ষেতে, যে লালন
করেছিল শিশু
সে যদি শ্রমিক নয়, শ্রম কাকে বলে ?
আপনি বলুন মার্কস, কে শ্রমিক,
কে শ্রমিক নয়
নতুনযন্ত্রের যারা মাসমাইনের
কারিগর
শুধু তারা শ্রম করে !
শিল্পযুগ যাকে বস্তি উপহার দিল
সেই শ্রমিকগৃহিণী
প্রতিদিন জল তোলে, ঘর মোছে,
খাবার বানায়
হাড়ভাঙ্গা খাটুনির শেষে রাত হলে
ছেলেকে পিট্টি দিয়ে বসে বসে কাঁদে
সেও কি শ্রমিক নয় !
আপনি বলুন মার্কস, শ্রম কাকে বলে !
গৃহশ্রমে মজুরী হয়না বলে মেয়েগুলি শুধু
ঘরে বসে বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে
আর কমরেড শুধু যার
হাতে কাস্তে হাতুড়ি !
আপনাকে মানায় না এই অবিচার
কখনো বিপ্লব হলে
পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য হবে
শ্রেণীহীন রাস্ট্রহীন আলোপৃথিবীর
সেই দেশে
আপনি বলুন মার্কস,
মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী
হবে ?


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন