চিত্তরঞ্জন দাশ
যেই প্রাণ-মহানন্দ ছুটিয়াছে গ্রহ হতে তৃণের তরঙ্গে,
আগ্নেয় পর্বতোদ্গারে, বিহঙ্গে আর শার্দূলে, ভুজঙ্গে,
সূর্যের তূর্যের ছন্দে, উল্বাসিনী কল্লোলিনী-হিল্লোল-লীলায়,
নটিনী সে ঝটিকার উন্মত্ত নর্তনে, তারে তুমি বেঁধেছিলে
তোমার দুর্বল ক্ষীণ মৃণ্ময় দেহের প্রতি স্নায়ুতে শিরায়
ক্ষুদ্র এই আয়ুকুণ্ডে ; রক্তে রক্তে আবর্তিয়া তুমি তুলেছিলে
শক্তি-মুক্তধারা ! তাই শৃঙ্খলের আলিঙ্গন করি উল্লঙ্ঘন
কৃত্রিমেরে চূর্ণ করি’ বাহিরিয়া এলে হে সন্ন্যাসী বিবসন,
জ্বলন্ত জটার তলে গঙ্গার তরঙ্গ নিয়া এসেছিলে, শিব,
সে তরঙ্গ রঙ্গ ভঙ্গে মূর্ছাহত মৃত্তিকার নিষ্প্রভ নির্জীব
যত গুল্ম তৃণ-বত্স স্তন্য পিয়া’ স্কন্ধে তুলি’ প্রাণের পতাকা
করেছিল যাত্রা হায় দুর্ধর্ষ উদ্ধতভরে ; বীজের বলাকা
তব মুক্তি-বীজমন্ত্রে জন্ম লভি’ মৃত্তিকার গর্ভ দীর্ণ করি’
রৌদ্রের প্রসাদ পেল | তোমার দৃষ্টির ত্রাসে উঠিত শিহরি’
হে বব্ধনহীন বাত্যা, হে আদিত্য, যত মিথ্যা দৈত্য—কারাগার,
হে বিভঙ্গ, তবপক্ষ-সঞ্চালনে চূর্ণ যত পিঞ্জরের দ্বার ;—
কে তোমা রাখিবে রুধি ? রুধিরে বারিধি তব উন্মত্ত উধাও !
হে করাল, হে কালবৈশাখী, অবশেষে তাই তুমি ভেঙ্গে যাও
ভঙ্গুর দেহের কারা চিরমুক্তি-তীর্থমুখে, ওগো তীর্থম্ভূত !
মন্দার-সুগন্ধ নিয়া প্রাণানন্দে বন্ধহারা নন্দন-বিচ্যুত
এসেছিলে মর্ত্যভূমে ; হিমালয় হল তব নব পীঠস্থান
হে মহেন্র মানবেন্দ্র | প্রাণের আগুন জ্বালি তপ্ত লেলিহান
খাণ্ডব দাহন করি’ দানবেরে দলিয়াছ তাণ্ডবে তাণ্ডবে
জ্বলজ্জটা হে ধূর্জটি ! হে দুর্জয় শম্ভু, তব শঙ্খ-হাহারবে
জাগালে বাত্যা ও বন্যা | হে উদাত্ত উত্তাল বিশাল অম্বুনিধি,
কে মাপিবে অঙ্ক কষি তব ভাব-উচ্ছ্বসিত প্রাণের পরিধি,
শবের শ্মশানতলে তব নগ্ন তপস্যার কে বোঝে মহিমা ?
তুমি যে সমুদ্র রুদ্র, তাই লঙ্ঘি’ ক্ষুদ্র দিউ বদ্ধ তটনীমা
বিদীর্ণ বিকীর্ণ করি আপনাদের চতুর্দিকে বিচূর্ণ করিয়া
পরিপূর্ণ পান করি প্রাণের মদিরা, এলে তুমি উত্পাটিয়া
মহীদ্র ও মহীরুহ | হে বিদ্রোহী মেঘনাদ, হে নিত্য-জাগ্রত
আবার প্রশান্ত তুমি নিশান্তের স্নিগ্ধজ্যোতি আকাশের মত,
তোমার নয়নে জ্বলে শত সূর্য আর শত শতদল সৌরভ-মাধুর্যে,
বুকে মরুভূর জ্বালা, আর তৃণ-মঞ্জরীর শ্যামল প্রাচুর্যে
নিত্য নিত্য নব নব জন্মের উত্সব | তুমি কৃষ্ণ চক্রধারী
হনি অক্ষৌহিণী সেনা, আমার প্রেমের বেণু হে কবি, ফুকারী’
আনন্দের বৃন্দাবন করিলে সৃজন ; গীতার উদ্গাতা নব,
শিখাল ব্রহ্মণ্যতেজ অকর্মণ্যে, বহ্নিদীপ্ত রুদ্র অস্ত্র তব |
ভুজঙ্গেরা তব অঙ্গস্পর্শ লভি’ হয়েছে যে লবঙ্গ-লতিকা,
শৃঙ্খল হয়েছে স্বর্ণ, ধরা দেয় মায়াবিনী মরু-মরীচিকা
তোমার দৃষ্টির তলে ; ওগো ক্ষিপ্ত দৃপ্তজ্বালা দীপ্ত সর্বভূক,
ধূলায় নামিয়া আসি, হে সন্ন্যাসী, ভিক্ষুশ্রেষ্ঠ, সেজেছ ভিক্ষুক,
কমণ্ডলু ভরিযাছ মুক্তি-তীর্থোদকে, করিয়াছ প্রাণ-ভিক্ষা
বজ্রেতে বোধন যার, কন্টক তপস্যা তীব্র, দুঃখ বহ্নি-দীক্ষা,
যে প্রাণ প্রহ্লাদ সম দূরন্ত আহ্লাদে নাচে উত্তপ্ত কটাহে,
তারে তুমি ডাক দিয়া ফিরিয়াছ পথে পথে অশ্রান্ত উত্সাহে
ভূষাহীন ওগো মুসাফের ! আহর্নিশি ওগো তাই তুমি ঋষি-রাজ,
মুক্তি চেয়েছিলে, তাই সঞ্চিত নিষ্ফল যত ঐশ্বর্য্যের লাজ
নিক্ষেপিয়া ঘৃণ্য আবর্জনা সম সেজেছিলে নগ্ন নিঃসম্বল
মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলি ; তাতেও ছিল না তৃপ্তি, তাই অনর্গল
প্রাণের পবিত্র হবি রূদ্র মুক্তি যজ্ঞাগ্নিতে আহুতি দিয়াছ
দেহের বন্ধন টুটি’ চিরমুক্তিতীর্থ তুমি তাই লভিয়াছ |
এ আয়ুর আয়তনে কে তোমা’করিবে বন্দী, হে দুর্ধর্ষ বীর,
মৃত্যুতেও নাই নাই তোমার সমাপ্তি, কবি, তুমি যে অস্থির
সৃষ্টির যাত্রার ছন্দে মিশাইলে তব মত্ত নৃত্যের কিঙ্কিনী,
মৃত্যু-অমাবস্যা মাঝে বহাইলে বিদ্রোহের প্রাণ-প্রবাহিনী,
অজস্র অশ্রুর সাথে সহস্র আনন্দ ! তুমি বঙ্গের অঙ্গনে
আরম্ভিয়া গেলে যজ্ঞ, সেই অগ্নি উল্লম্ফিয়া উঠিছে গগনে
হেরিতে তোমার মুখে সর্বশেষ বিজয়ের নিঃশব্দ আহ্লাদ !
মৃত্যুতে, হে পুরোহিত, রেখে গেলে এই মন্ত্র, এই আশীর্ব্বাদ !
নারী
এ মোর একা’র গর্ব আজি এ নিখিলে —
তুমি যাহা নও,— তাই, তুমি মোর কাছে ছিলে।
এ মোর একা’র অহঙ্কার।
তুমি ছিলে কায়াহীন নিশ্চল নীরন্ধ্র অন্ধকার-
তারি মাঝে অমর্ত্যলোকের বিভা
খুঁজিয়া করেছে আবিস্কার
একমাত্র আমার প্রতিভা।
তুমি ছিলে কলঙ্কিনী অমা,
হেরিলাম তারি মাঝে আমি শুধু পূর্ণিমার সম্পূর্ণ সুষমা ;-
একমাত্র আমি। – এই গর্ব মোর –
যাহা নও, -তারি স্বপ্নে রেখেছিনু তোমারে বিভোর।
তুমি কভু জানিতে না কি তোমার দাম,
আমার চোখের জলে তাই দেখালাম ।।
বিধাতার সৃষ্টি তুমি, -হে নিরাভরণা নারী, -বাসনার সোনার প্রতিমা,–
কারারুদ্ধা, – চতুর্দিকে বন্ধনের সীমা ;
ক্ষণিকা ও ক্ষীণ-
মোর প্রেম-স্বর্গ হ’তে পরম উত্সর্গ-পত্র লভিলে প্রথম যেই দিন,
লভিলে বিস্তীর্ণ মুক্তি, -আপন আয়ত্তাতীত অপূর্ব মহিমা,
বিরাট সম্মান,
মোর কন্ঠ-মাল্য-দানে তোমারে করেছি মূল্যবান।।
মোর বুকে বেজেছিল তব ক্ষুদ্র ব্যর্থতার ব্যথা,
মণ্ডিত করেছি তোমা’ উদ্বৃত্ত ঐশ্বর্যে মোর- দিয়াছি অনন্ত সম্পূর্ণতা।
বিধাতার সৃষ্টি তুমি, হে লীলাললিতা কান্তা কামাক্ষী কামিনী,
রাশীকৃত চুম্বনের ফেনা ;-
মোর কাছে চিরজন্ম চিরমৃত্যু র’বে তুমি ঋণী,
তুমি যাহা, -মোর কাছে তুমি তা ছিলে না।।
পুরুষের কাম্য তুমি, জীর্ণ কাব্য তুমি বিধাতার,
সেই কাব্য একদিন মোর হস্তে লভেছিল নবীন সংস্কার।
তুমি স্হূল, সুপ্রত্যক্ষ, -সন্ধান করিছে তোমা’ উদগ্র ইন্দ্রিয়,
তুমি প্রয়োজন।
স্পর্শের রোমাঞ্চ-হর্ষে আমি শুধু লভিয়াছি অকূল অমিয়-
মানস-আকাশে তোমা, রাখিয়াছি করি’ চিরন্তন
হে অচিরদ্যুতি,
শুনিয়াছি তোরি মাঝে স্বর্গের কাকুতি।
অনন্ত মৃত্যুর তীরে তব তরে রেখেছিনু স্নেহদীপশিখা,
নিকটে আছিলে যবে, ডেকেছিনু – ওগো সুদূরিকা।
তুমি নারী মানুষের, বিধাতার, শুধু মোর নই,
তবু তোরে দিনু ভিক্ষা, – কবির বিরহ,-
শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।
এ নিখিলে এ গর্ব তোমার।।
ঝটিকা
মুক্ত করে দিনু মোর রুদ্ধ দ্বার বন্ধ বাতায়ন,
এস দৃপ্ত প্রভঞ্জন,
উচ্ছৃঙ্খল দুর্মদ বিদ্রোহী
দুরন্ত আনন্দখানি বহি,
চূর্ণ আজি কর গো আমারে ;
মৃত্যুর ফুত্কারে
নির্বাপিত কর দীপ, ভগ্ন কর ভাণ্ডের ভাণ্ডার |
হে ঝটিকা, অতিথি আমার,
নটবর, হে ভোলা ভৈরব,
শুরু কর ধ্বংসের তাণ্ডব
মোর সুপ্ত জীর্ণ বক্ষতলে,
স্পন্দনে স্পন্দনে তারে
আন্দোলিয়া তোল তুমি ক্রন্দনের আনন্দ-কল্লোলে !
ক্রদ্ধ অহঙ্কারে
বন্ধনেরে পদতলে করি’ নিষ্পেষণ,
এস মোর ক্ষ্যাপা, বিবসন,
দৃঢ়হস্তে কাড়ি যত সঞ্চয়ের মিথ্যা আড়ম্বর
এস হে ঈশ্বর,
চূর্ণ করি’ প্রাচীরের ক্ষুদ্র পরিসীমা
সুন্দর ভীষণ তব উলঙ্গ মহিমা
আমারে দেখাও ;
মোরে তুমি নিঃসম্বল নগ্ন করি’ দাও
বন্ধহীন বিরহী বৈরাগী ;
প্রলয়ের প্রেমে অনুরাগী
এস হে অপরিমিত, অশান্ত, ব্যাকুল,
মোরে কর গৃহহীন পথের বাউল
হে চির-পথিক সহচর !
হে মোর অশেষ,
নিত্য অগ্রসর,
অনির্ণীত, এস নির্নিমেষ,
নেত্র হতে মুছে নিয়া নিদ্রার কুজ্ঝটি
এস হে ধূর্জটি !
ওই যেথা শুরু হল প্রলয়ের আনন্দ-উত্সব,
তোমার তাথৈ-থৈ নৃত্যের তাণ্ডব
সেথা মোরে নিয়ে যাও
নিরুদ্দেশ করি’ ;
হাত ধরি’ ধরি’
নটরাজ, মোরে তুমি নাচিতে শেখাও
তোমারি বাত্যার তাল তালে,
মোর পায়ে বাঁধি দাও ঝঞ্ঝার মঞ্জীর |
এস হে অস্থির,
বিদ্রোহের জয়টীকা পরাইয়া মোর দীপ্ত ভালে
মোরে তুমি নিয়ে যাও,
হে উধাও,
যেথায় বজ্রের নিত্য বিজয়-উল্লাস,
বিদ্যুতের তীক্ষ্ম অট্টহাস,
যেথা পান্থ নিরাশ্রয় মেঘেদের যাত্রা-সমারোহ,
মিশাইব সেথা মোর প্রাণের বিদ্রোহ
প্রতন্ত, প্রচুর |
এস দস্যু দুর্দান্ত, নিষ্ঠুর,
মোরে তুমি ছিন্ন করে’ নিয়ে যাও
তোমার কেতন-তলে ;
সেথা নিত্য রুদ্র কোলাহলে
তব সাথে দিব করতালি |
এস-কাল-বৈশাখী বৈকালী,
শিষ্য করে’ নিয়ে যাও মোরে হে সন্ন্যাসী,
সর্বনাশী
তোমার যাত্রায় ;
আমার পায়ের ছন্দ ধ্বনিয়া উঠুক তব
বন্ধহীন নৃত্যের লীলায় |
চূর্ণ করি’ অচলায়তন,
সজ্জার লজ্জার হ’তে মুক্তি দাও মোরে, বিবসন,
নিয়ে যাও জ্যোতিষ্কে জ্যোতিষ্কে গ্রহে সূর্যে,
নব নব ছন্দের মাধুর্যে !
আমার প্রিয়ার ঘরের অতিথি
আমার প্রিয়ার ঘরের অতিথি, শুধাই তোমরে ভাই,
হেরিছ তেমনি তা’র দুই চোখে বসন্ত- বাসনাই ?
কোন নামে তারে ডাক’ ?
তোমারো আকাশে ফুটিয়াছে তারা তেমনি কি লাখো লাখো ?
তোমরা দুজনে মাঠের কিনারে তেমনি কি থাক’ বসি,
তোমাদের দেশে তেমনি কি আসে চৈতের চৌদশী ?
শয়ন-শিয়রে রজনীগন্ধা ফেলিছে কি নিশ্বাস,
নিরালা জাগিয়া দু’জনে তেমনি ভুঞ্জিব আবকাশ ?
আমারে বলিবে না কি ?
তেমনি কোমল দু’টি করতল, শীতল তেমনি আঁখি ?
তুমি না চাহিতে অধর আনিয়া অধরে কি আর রাখে,
বারেক আধেক ‘ভালবাসি’ বলে’ তেমনি কি থেমে থাকে ?
রঙীন বসন পরি’
তোমারে তুষিতে খোঁপায় গোঁজে কি ধান্যের মঞ্জরী ?
নবনবনীর মত সুকোমল তার দুটি পয়োধরে
সঞ্চিত করি’ রাখিয়াছে সুধা তোমার শিশুর তরে ?
আর কি বেহাগ গায় ?
তোমার চোখে কি আমার চোখের জলের আভাস পায় ?
ছন্নছাড়া
গলির মোড়ে একটা গাছ দাঁড়িয়ে
গাছ না গাছের প্রেতচ্ছায়া —
আঁকাবাঁকা শুকনো কতকগুলি কাঠির কঙ্কাল
শূন্যের দিকে এলোমেলো তুলে দেওয়া,
রুক্ষ রুষ্ট রিক্ত জীর্ণ
লতা নেই পাতা নেই ছায়া নেই ছাল-বাকল নেই
নেই কোথাও এক আঁচড় সবুজের প্রতিশ্রুতি
এক বিন্দু সরসের সম্ভাবনা ।
ওই পথ দিয়ে
জরুরি দরকারে যাচ্ছিলাম ট্যাক্সি ক’রে ।
ড্রাইভার বললে, ওদিকে যাব না ।
দেখছেন না ছন্নছাড়া ক’টা বেকার ছোকরা
রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে–
চোঙা প্যান্ট, চোখা জুতো, রোখা মেজাজ, ঠোকা কপাল–
ওখান দিয়ে গেলেই গাড়ি থামিয়ে লিফট চাইবে,
বলবে, হাওয়া খাওয়ান ।
ওরা কারা ?
চেনেন না ওদের ?
ওরা বিরাট এক নৈরাজ্যের –এক নেই রাজ্যের বাসিন্দে ।
ওদের কিছু নেই
ভিটে নেই ভিত নেই রীতি নেই নীতি নেই
আইন নেই কানুন নেই বিনয় নেই ভদ্রতা নেই
শ্লীলতা-শালীনতা নেই ।
ঘেঁষবেন না ওদের কাছে ।
কেন নেই ?
ওরা যে নেই রাজ্যের বাসিন্দে–
ওদের জন্যে কলেজে সিট নেই
অফিসে চাকরি নেই
কারখানায় কাজ নেই
ট্রামে-বাসে জায়গা নেই
মেলায়-খেলায় টিকিট নেই
হাসপাতালে বেড নেই
বাড়িতে ঘর নেই
খেলবার মাঠ নেই
অনুসরণ করবার নেতা নেই
প্রেরণা-জাগানো প্রেম নেই
ওদের প্রতি সম্ভাষণে কারু দরদ নেই–
ঘরে-বাইরে উদাহরণ যা আছে
তা ক্ষুধাহরণের সুধাক্ষরণের উদাহরণ নয়,
তা সুধাহরণের ক্ষুধাভরণের উদাহরণ–
শুধু নিজের দিকে ঝোল- টানা ।
এক ছিল মধ্যবিত্ত বাড়ির এক চিলতে ফালতু এক রক
তাও দিয়েছে লোপট ক’রে ।
তাই এখন পথে এসে দাঁড়িয়েছে সড়কের মাঝখানে ।
কোথ্বকে আসছে সেই অতীতের স্মৃতি নেই ।
কোথায় দাঁড়িয়ে আছে সেই বর্তমানের গতি নেই
কোথায় চলেছে নেই সেই ভবিষ্যতের ঠিকানা ।
সেচ-হীন ক্ষেত
মণি-হীন চোখ
চোখ-হীন মুখ
একটা স্ফুলিঙ্গ-হীন ভিজে বারুদের স্তুপ ।
আমি বললুম, না ওদিক দিয়েই যাব,
ওখান দিয়েই আমার শর্টকাট ।
ওদের কাছাকাছি হতেই মুখ বাড়িয়ে
জিজ্ঞেস করলুম,
তোমাদের ট্যাক্ সি লাগবে ? লিফট চাই ?
আরে এই তো ট্যাক্ সি, এই তো ট্যাক্ সি, লে হালুয়া
সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল ওরা
সিটি দিয়ে উঠল
পেয়ে গেছি পেয়ে গেছি চল পানসি বেলঘরিয়া ।
তিন-তিনটে ছোকরা উঠে পড়ল ট্যাক্ সীতে,
বললুম কদ্দুর যাবে ।
এই কাছেই । ওই দেখতে পাচ্ছেন না ভিড় ?
সিনেমা না, জলসা না, নয় কোনো ফিল্মি তারকার অভ্যর্থনা ।
একটা নিরীহ লোক গাড়িচাপা পড়েছে,
চাপা দিয়ে গাড়িটা উধাও–
আমাদের দলের কয়েকজন গাড়িটার পিছে ধাওয়া করেছে
আমরা খালি ট্যাক্ সি খুঁজছি ।
কে সে লোক ?
একটা বেওয়ারিশ ভিখিরি ।
রক্তে-মাংসে দলা পাকিয়ে গেছে ।
ওর কেউ নেই কিছু নেই
শোবার জন্য ফুটপাথ আছে তো মাথার উপরে ছাদ নেই,
ভিক্ষার জন্য পাত্র একটা আছে তো
তার মধ্যে প্রকান্ড একটা ফুটো ।
রক্তে মাখামাখি সেই দলা-পাকানো ভিখিরিকে
ওরা পাঁজাকোলা করে ট্যাক্ সির মধ্যে তুলে নিল ।
চেঁচিয়ে উঠল সমস্বরে –আনন্দে ঝংকৃত হয়ে–
প্রাণ আছে, এখনো প্রাণ আছে ।
রক্তের দাগ থেকে আমার ভব্যতা ও শালীনতাকে বাঁচাতে গিয়ে
আমি নেমে পড়লুম তাড়াতাড়ি ।
তারপর সহসা শহরের সমস্ত কর্কশে-কঠিনে
সিমেন্টে-কংক্রিটে ।
ইটে-কাঠে-পিচে-পাথরে দেয়ালে-দেয়ালে
বেজে উঠল এক দুর্বার উচ্চারণ
এক প্রত্যয়ের তপ্ত শঙ্খধ্বনি–
প্রাণ আছে, এখনো প্রাণ আছে
সমস্ত বাধা-নিষেধের বাইরেও
আছে অস্তিত্বের অধিকার ।
ফিরে আসতেই দেখি
গলির মোড়ে গাছের সেই শুকনো বৈরাগ্য বিদীর্ণ ক’রে
বেরিয়ে পড়েছে হাজার-হাজার সোনালি কচি পাতা
মর্মরিত হচ্ছে বাতাসে,
দেখতে দেখতে গুচ্ছে গুচ্ছে উথলে উঠছে ফুল
ঢেলে দিয়েছে বুকের সুগন্ধ,
উড়ে এসেছে রঙ-বেরঙের পাখি
শুরু করেছে কলকন্ঠের কাকলি,
ধীরে ধীরে ঘন পত্রপুঞ্জে ফেলেছে স্নেহার্দ্র দীর্ঘছায়া
যেন কোনো শ্যামল আত্মীয়তা ।
অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে দেখলুম
কঠোরের প্রচ্ছন্নে মাধুর্যের বিস্তীর্ণ আয়োজন ।
প্রাণ আছে, প্রাণ আছে– শুধু প্রাণই আশ্চর্য সম্পদ
এক ক্ষয়হীন আশা
এক মৃত্যুহীন মর্যাদা ।