করোনা আমাকে চুম্বন করেছিল: তসলিমা নাসরিন

 


তসলিমা নাসরিন: করোনা আমাকে চুম্বন করেছিল

করোনা মেয়েটি আমার ঘরে কী করে কী করে যেন একদিন ঢুকে গেল,

এত খিল দিয়ে রাখলাম,
এত আকাশ বাতাস আটকে রাখলাম,
এত শীত-গ্রীষ্মে, এত অন্ধকারে শ্বাস বন্ধ করে বসে রইলাম,
আমার একটি চুলও, চোখের একটি পাপড়িও, পায়ের একটি নখও যেন দেখতে না পায়।
কিন্তু ঠিকই দেখতে পেল।
এসে ঠিকই ঝাঁপিয়ে পড়লো শরীরে, চুম্বন করলো ঠোঁটে।
জিভে জিভ স্পর্শ করে বসে রইলো,
যতই তাকে টেনে নামাতে চাই, ততই সে বিদ্রোহ করে, নিবিড় আলিঙ্গন করে।
সরীসৃপের মতো বুকে হেঁটে হেঁটে যেতে চায় আমার ভেতর-ঘরে, নিভৃতে।

সারারাত যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে সে, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে সারাদিন।
আমাকে ক্লান্ত, অবসন্ন করে, শক্তিহীন করে, অচল অথর্ব করে, অর্ধমৃত করে
এক রত্তি মেয়েটি জয়ী হলো।
বিজয় নিশান উড়িয়ে দিল বাড়ির ছাদে।
আমার ঘর বারান্দা, বিছানা বালিশ, আমার লেখার টেবিল, সব তার দখলে।
আমার চাল ডাল, ফল মূল, ডিম দুধ সব দখলে তার।
বইপত্র তছনছ করে মেয়েটি দখল নিয়ে নিল সংসারের,
আমার যা কিছু ছিল,নিল।
বাড়ির বেড়ালটিকেও ধমকে এক কোণে বসিয়ে রেখেছে,
সব নাকি তার, বেড়ালও।

কেউ জানে না করোনা নামের মেয়েটি আমার শরীরে উন্মাদের মতো লাফাচ্ছে,
যেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধিশ্বরী সে, খুশিতে আত্মহারা মেয়ে, জানে না
অসাবধানে পা পড়ছে আমার কণ্ঠদেশে,
শ্বাসরোধ হচ্ছে আমার।
জানেনা প্রচণ্ড ক্ষিধেয় সে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে,
আমার হৃদপিণ্ড, আমার ফুসফুস।
চোখদুটো খাবলে তুলে আনছে, খাচ্ছে।
মাংসগুলো খাচ্ছে, হাড়গুলো চিবিয়ে চিবিয়ে ফেলছে,
এক চুমুকে খেয়ে নিচ্ছে মস্তিস্ক।

মেয়েটি হাসি-মুখে এসেছিল, চুম্বন করেছিল,
ভালোবেসে এসেছিল।
ভালোবেসে বাস করতে এসেছিল।
বাস করতে এসেছিল আমার সর্বাঙ্গে।
সে জানে না সে বাসের যোগ্য নয়,
করোনা জানে না সে মৃত্যুর আরেক নাম।
কিশোরী ঘুঙ্গুর পরে লোকালয়ে এসেছিল,
মৃত্যু ঘুঙ্গুর পায়ে এসেছিল লোকালয়ে।

কিশোরীর কামড় খেয়ে কিছু লোক কালো পিঁপড়ের মতো আস্তাকুঁড়ে,
ঋজু দাঁড়িয়ে থাকারা খুব নীল,
যেন আকণ্ঠ বিষ পান করে রঙিন হয়েছে।
মনে নেই চুম্বনে তারা শুষে নিয়েছিল কিশোরীর লালা?

করোনা আমার কেউ নয়,
তবু সে আমাকে বার বার কাছে ডাকে।
আমার সর্বনাশ করেছে সে, তারপরও আসে, পা টিপে টিপে আসে,
গভীর রাত্তিরে আসে,
শহর ঘুমিয়ে গেলে আসে,
কতটুকু অবশিষ্ট আছি দেখতে আসে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন