আসফিয়া
সোহেল হাসান গালিব
তোমার নাম উচ্চারিত হলে কাস্পিয়ান হ্রদের কথা মনে পড়ে
মনে পড়ে পাটাতন ভেঙে-পড়া নৌ কিংবা নাবিকের
হতোদ্যম জীবন-সংহিতা;
সুদূর-পরাহত প্রাণের ইচ্ছাজীর্ণ আর্তনাদ
কী প্রবল আকাঙ্খায় প্রতিধ্বনিত জগতে দৃশ্য গন্ধ গান হয়ে ফেরে
আমি চেয়ে দেখি
লুপ্ত জনপদ থেকে জেগে-ওঠা এক ভুবনকল্পনা
ধ্বস্ত পর্বতের মতো সমুদ্রে বিলীন হয়ে
তোমার উদ্দেশে পংক্তি ও সোপান রচনা করেছে।
বিষুব-বলয় থেকে ছুটে গিয়ে মেরুর মাথায় নক্ষত্রকে ছুঁয়ে
দাঁড়িয়েছো তুমি আলেকজান্ডারের লোভাতুর চোখে
সাম্রাজ্যের অপর বিন্দুতে,
অথচ মকর-কর্কট ক্রান্তিতে কোথাও
দূরত্বের ছায়া ফেলে রাখো নি।
আগামী আকাশপটে স্ফুরিত আলোর স্মৃতি মনে রেখে
অন্ধকারের সম্বৃত ইতিহাস আমি লুকিয়ে রেখেছি
আমার প্রতিরোধ ভেঙে-পড়া চেতনার আর্যাবর্তে, ভুলে যেতে চেয়েছি
সুরের করতল মেলে-দেয়া শোকগাথার মতন
চারদিকে যেন নিরুদ্ভিন্ন উল্লাসের অপরিসীম মৃত্যু,
যেন ব্যষ্টিসমষ্টির দোলাচলে
স্বপ্নস্খলিত ঘুমের পতন উজ্জীবন।
তবু এখনও সহসা
তোমার নাম উচ্চারিত হলে কাস্পিয়ান হ্রদের কথা মনে পড়ে
মনে পড়ে পাটাতন ভেঙে-পড়া নৌ আর নাবিকের
স্রোতবিহ্বল জীবন-সংহিতা।
পুরাণে বর্ণিত বহু দেশ ও কালের কীর্তি নাশ হয়ে যাবার উদ্ভাসে
আমার এ বেঁচে থাকা তোমাকে দেখার পর
পৃথিবীর বিস্মরিত কল্পনার মতো
স্রায়ুবিক আয়ুশূন্য।
বৃষ্টি ছুঁয়েছেনে মেঘে হাত বুলাবার অভিজ্ঞতা-ঋণে
দিনযাপনের পালা শেষ। তোমার নৈকট্য
আমাকে প্রত্যক্ষ করে গেছে সকাল ও সন্ধ্যার কাছে
কত কতবার, আজ
শম্বুকের মতো পাঁজরের হাড় খুলে
কিছু দেখাতে আপত্তি নেই আমার।
কথাকাহিনির বাঁকে বাঁকে মুহূর্তের ইতিবৃত্ত হয়ে
পথে পথে পদছাপ রেখে তোমার প্রস্থান
নগর-গ্রামের ভেদাভেদ মুছে ফেলার মতন
অপ্রতিরোধ্য বলে মনে হয়।
তবু একদিন একবার
মৃত্তিকার মর্মমূলে যাবো ভেবে চোখে চোখ রেখে দিগন্তে অপসৃয়মাণ
মাস্তুলের দুলে দুলে কেঁপে কেঁপে ডুবে যাওয়া দেখেছি।
আজ পূর্বান্তিক বেদনার উপত্যকায় দূরবর্তী মেঘযান থেকে
হে ঐতিহ্যবিলাসবিভ্রমসঞ্চালিনী
জীবনের এই রুগণ দিগ্বলয়কোণ কী আশ্চর্য ভালোবেসে হায়
পশ্চিমের মুগ্ধ হাহাকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলে
অপহরণের প্রবোধ-দ্বিধার সান্ত্বনা
আর অনুতাপহীন গ্লানি রেখে তুমি
নিহত দিনের রক্তিম গালিচা বেয়ে
উঠে গেলে সভ্যতার শৃঙ্গে।
আমি শৃঙ্গ-অভিসারী নই, ছিলাম না কোনোদিন
তোমার অহমের বস্তুগ্রাহ্য ছায়ায় লেপ্টে থেকে এখন আমার
কেবল বপ্রকেলি- ঈর্ষাসমাচারহীন।
আমার তুচ্ছ দিনাতিপাতে
জগৎ ও জীবনের ম্লেচ্ছ অনুসূয়া
দিকে দিকে রটনা করে যায়
তোমার প্রতি অস্বীকৃতি যুগের মেদুর আড়ম্বরে।
তবু যতবার শুনি তোমার নাম জনতার মুখে
ততবার টলে উঠে অন্ধকারে আলোর সরলতা, ততবার ভাবি
নির্ঝরিণীর বিপন্ন চঞ্চলতা
আমার তো নয়-
আমি তো জেনেছি তীর ও তরণীর কম্প্র অভিঘাত
এই নদীশাসনের পৃথিবীতে মাটিমানুষের নাব্যতায়
মীমাংসা রেখে গেছে মহাকালের
যেন হংস-ফুল্ল ছায়া, শঙ্খশুভ্র কাশবন
বহু বহু প্রত্যর্পণ-পেরুনো সূর্যের আবর্তনে
বর্ণিল ঔদাস্যমাখা দৃষ্টির
অপ্রমত্ত সীমানায়- সৃজনের ভোরে
নৈর্ঋতে ঈশানে-কৃষাণে কৃষাণে।
তাই বিশুষ্ক একটি তটিনীর মতো
স্রোতের নিমিত্তে আমি একা বসে আছি
ঋতু বদলের মতন নৈঃশব্দ্যে উৎকর্ণ হয়ে-
হয়তোবা শতাব্দীর প্রান্ত ঘেঁষে
অকস্মাৎ ছুটে পালায় একটি নিমেষ
ইঙ্গিতে সংকেতে অস্ফুট ধ্বনির অনিকেত উৎসারণে।