প্রথম পর্ব
হ্যারি পটার সিরিজের থেকে
#হ্যারি_পটার_এন্ড_দি_ফিলসফারস স্টোন - জে. কে. রাওলিং
🔴 প্রকাশকের কথা
এক বিস্ময়কর সৃষ্টির নাম হ্যারি পটার। যে শিশু আজ ভুবন বিখ্যাত, যে শিশু মাতিয়ে তুলেছে পৃখিবীর তাবৎ শিশু-কিশোরকে তার নাম হ্যারি পটার। বাবা মা হারা ১০ বছরের এই অনাথ শিশুটিই ব্রিটিশ লেখিকা জে. কে. রাওলিংয়ের কলমে হয়ে ওঠে অনন্য সাধারণ। হ্যারি পটার সিরিজে জে কে রাওলিং এ পর্যন্ত ৭টি বই লিখেছেন। হ্যারি পটার এন্ড দি ফিলসফারস স্টোন এই সিরিজের প্রথম বই।
বইয়ের কাহিনী শুরু এক ভাগ্যবিড়ম্বিত শিশুকে নিয়ে। নাম হ্যারি পটার। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর হ্যাগ্রিড নামে এক জাদুকর তাকে দিয়ে যান, ৪ নাম্বার প্রিভেট ড্রাইভে। সেটা ছিল তার আঙ্কল ও আন্টের বাসা। অদ্ভুত স্বভাবের এই দম্পতি হ্যারিকে গ্রহণ করলেও আদর যত্ন করতেন না। হ্যারির ঘুমানোর জন্য কোন ঘর ছিল না। সে থাকতো সিঁড়ির নিচে একটা কাবার্ডে। তাকে নতুন কোন পোশাক দেয়া হতো না। ডাডলির পরিত্যক্ত, পুরনো কাপড় পরেই তাকে থাকতে হতো। তদুপরি সুযোগ পেলেই খালাত ভাই ডাডলি তাকে মারধর করত। সেখানে হ্যারির জীবন ছিল দুর্বিষহ। কিন্তু কিছুই করার নেই। এরই মধ্যে হোগার্টস নামের এক জাদুবিদ্যার স্কুল থেকে চিঠি আসতে থাকে। কিন্তু তার আঙ্কল ও আন্ট কেউই তাকে সেসব চিঠি দেন না। এরপর একদিন হ্যাগ্রিড সত্যি সত্যিই তাকে স্কুলে নিয়ে যান এবং তার কাছে তার বাবা-মার মৃত্যুর ঘটনা এবং ডার্সলি দম্পতির অপকীর্তি ফাঁস করে দেন।
এরপর হোগার্টস জাদুর স্কুলে গিয়ে হ্যারি মজার সব কাণ্ড করতে থাকে। প্রতিপক্ষ কোন খেলায়ই তাকে হারাতে পারে না, ষড়যন্ত্র করলেও সফল হয় না। এই স্কুলেই হ্যারি পেয়ে যায় তার বন্ধু রন ও হারমিওনকে। এই দুই সাথীকে নিয়ে হ্যারি প্রতিটি খেলায় জয়ী হয়। সর্বত্র তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
এ বইয়ে রাওলিং শিশু-কিশোরদের অন্তর্জগতে যে সব অসম্ভব ও অবাস্তব কল্পনার সৃষ্টি হয় তার কথা যেমন বলেছেন তেমনি সেই কল্পনার ওপর ভর করে তাদের নিয়ে গেছেন জাদু বাস্তবতার আশ্চর্য জগতে। শিশু-কিশোররা রূপকথা শুনতে ভালবাসে। রাওলিং তাদের সেই রূপকথা শুনিয়েছেন। তার এ রূপকথার মধ্যে জীবন বাস্তবতার নির্মম নিষ্ঠুর চিত্র আছে, আছে মাতৃহৃদয়ের চিরন্তন স্নেহশীলতা ও মমত্ববোধ।
জে. কে. রাওলিং নিজের বই সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন: সত্যিই আমি ভাগ্যবান মানুষ নই। আমার প্রথম জীবনটা কেটেছে নানা ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে। রাওলিংয়ের আক্ষেপ, তার পরম আনন্দের খবরটি তার মা শুনে যেতে পারলেন না। ১৯৯৩ সালে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মেয়ের লেখালেখি সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। তবে রাওলিংয়ের মা ছিলেন একজন সত্যিকার বই প্রেমিক। তিনি যদি দেখে যেতেন তার মেয়ের লেখা বই মাত্র তিন কপি বিক্রি হয়েছে তাহলেও খুশি হতেন। না, রাওলিংয়ের বই তিন কপি চলেনি, চলেছে ২০ কোটি কপিরও বেশি।
হ্যারি পটার নিয়ে বিশ্বজুড়ে মাতামাতি হলেও বাংলা ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ এটাই প্রথম। এর আগে কলকাতা থেকে নকল হ্যারি পটার প্রকাশের উদ্যোগ নিলেও আইনবলে তা বন্ধ হয়ে গেছে। লেখক জে. কে. রাওলিংয়ের লিটারারি এজেন্ট-এর সঙ্গে দীর্ঘ দুবছর যোগাযোগ করে আমরা এ গ্রন্থ বাংলায় ভাষান্তর করার অনুমতি পেয়েছি। বিদেশে বাংলাদেশের দুর্নাম আছে, এখানকার প্রকাশকরা বিনা অনুমতিতে বিদেশী বই প্রকাশ করছে। আমরা এই দুর্নাম ঘুচাতে চাই। আমরা চাই প্রয়োজনীয় অনুমোদন নিয়েই বিদেশী বইয়ের ভাষান্তর এখানে প্রকাশিত হোক। আবার বাংলাদেশের বইও আইনানুগভাবে বিদেশে ভাষান্তর হোক। এ ব্যাপারে দেশের সহযোগী প্রকাশক ও লেখকদেরও সহযোগিতা কাম্য।
এই বইটি অনুবাদ করেছেন সোহরাব হাসান ও শেহাবউদ্দিন আহমদ। অনুবাদ কাজে সার্বিকভাবে সহায়তা করেছেন গ্রন্থ বিশেষজ্ঞ মোশাররফ হোসেন। তাদের সবার প্রতি জানাই কৃতজ্ঞ।
মেসবাহউদ্দীন আহমেদ
পরিচিতি
হ্যারি পটার : এই বইয়ের প্রধান চরিত্র। জাদুকর লিলি ও জেমস পটারের ছেলে।
ডাডলি : হ্যারি পটারের খালাতো ভাই।
ডার্সলি : ভার্নন ডার্সলি, হ্যারি পটারের খালা পেতুনিয়ার স্বামী ও ডাডলির বাবা। বইতে হ্যারির আঙ্কল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
পেতুনিয়া : পেতুনিয়া ডার্সলি, হ্যারি পটারের খালা। ডাডলির মা। বইতে আন্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভোলডেমর্ট : হ্যারির বাবা-মার হত্যাকারী। ইউ নো হু নামে পরিচিত।
আলবাস ডাম্বলডোর : হোগার্টসের জাদু বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ।
ম্যাকগোনাগল : হোগার্টসের জাদু বিদ্যালয়ের উপ-অধ্যক্ষ।
হ্যাগ্রিড : হোগার্টসের চাবির রক্ষক ও গেমকিপার, হ্যারির সুহৃদ।
মাগল : জাদুবিদ্যায় অবিশ্বাসী সাধারণ মানুষ।
কিডিচ : ফুটবলের মত এক প্রকার জাদুনির্ভর খেলা।
স্নেইপ : হোগার্টসের জাদু বিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
কুইরেল : হোগার্টসের জাদু বিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
স্প্রাউট : জাদু বিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যা বিষয়ক অধ্যাপক।
হেডউইগ : হ্যারির পেঁচা, চিঠিপত্রের বাহক।
গ্রিফিল্ডর : হোগার্টস জাদু বিদ্যালয়ের গ্রিফিল্ডর হাউজ। ছাত্রাবাস।
স্ক্যাবাস : রনের ইঁদুর।
রন উইসলি : হ্যারির বন্ধু হোগার্টসের ছাত্র।
হারমিওন গ্রেঞ্জার : হ্যারির বান্ধবী হোগার্টসের ছাত্র।
নেভিল লংবটম : হ্যারির বন্ধু হোগার্টসের ছাত্র।
ম্যালফয় : হ্যারির সহপাঠী, প্রথম বর্ষের ছাত্র স্লিদারিন হাউজের আবাসিক ছাত্র ও হ্যারির প্রতিদ্বন্দ্বী।
ক্রেব : ম্যালফয়ের বন্ধু।
গ্রিংগটস : জাদুকরদের ব্যাংক।
ইউ-নো–হু : ভোলডেমর্ট, হ্যারির মা–বাবার হত্যাকারী।
ফ্লাফি : পরশমণির পাহারাদার তিনমাথা বিশিষ্ট কুকুর
ফ্লামেল, নিকোলাস : পরশমণির স্রষ্টা।
পিভস : জাদু বিদ্যালয় পালিত ভূত।
ফিলচ : হোগার্টসের কেয়ারটেকার।
ডেইলী প্রফেট : জাদুকরদের সংবাদপত্র।
ডায়াগন এলি : জাদুকরদের বিশেষ বাজার, যেখানে জাদুর উপকরণ পাওয়া যায়।
নিষিদ্ধ বন : হোগার্টের চারপাশের বন। ইউনিকর্ন ও রহস্যময় জন্তুদের বাস। হোগার্টের সীমার বাইরে।
গ্যালিওন্স : জাদুকরদের টাকা। পটার তার অভিভাবকদের কাছ থেকে এক পাত্র গ্যালিওনস পেয়েছিল।
গ্রিফিল্ডর, হাফলপাফ, র্যাভেন ক্ল, স্লিদারিন : হোগার্টের চারটি ছাত্রাবাস। যা, চার প্রতিষ্ঠাতার নামে নামকরণ করা হয়েছে।
হোগার্ট স্কুল অফ উইচক্রাফট এন্ড উইজারি : জাদুবিদ্যার আবাসিক স্কুল, যেখানে হ্যারি ও তার বন্ধুরা বিভিন্ন জাদু শিখেছে। স্কুলের মূলমন্ত্র হলো, কখনও ঘুমন্ত ড্রাগনকে কাতুকুতু দিও না।
অদৃশ্য পোশাক : রূপালী ছাই রঙের পোশাক, যা পড়লে অদৃশ্য হওয়া যায়।
জাদু মন্ত্রণালয় : জাদুকরদের বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জাদুকর আর জাদুকরীদের বিষয় গোপন রাখার দায়িত্ব এই মন্ত্রণালয়ের।
এরিসেডের আয়না : এই আয়নায় মানুষের সব চাইতে বড় ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়।
নিম্বাস ২০০০ : জোরে উড়ে যাওয়া এবং সাংঘাতিক জাদুর ঝাড়ু, যা হ্যারিকে কিডিচে সোনার বল খোঁজায় দারুন পারদর্শী করেছিল।
প্লাটফর্ম পৌনে-দশ : লন্ডনের কিংস ক্রস জাদুর প্লাটফর্ম (যা, সাধারণের কাছে অদৃশ্য), যেখান থেকে হোগার্টের ছাত্রছাত্রীরা হোগার্ট এক্সপ্রেসে চড়ে।
বাছাই টুপি : জাদুকরদের লম্বা-চ্যাপ্টা টুপি। যা, ছাত্ররা কোন্ ছাত্রাবাসে থাকবে তা চিহ্নিত করে। টুপিগুলো গান করতে পারে আর তাদের অনুভূতিও আছে।
০১. প্রথম অধ্যায় : সেই ছেলেটি
জায়গার নাম প্রিভেট ড্রাইভ। বাড়ি নম্বর চার। সেখানে বসবাস করেন ডার্সলি দম্পতি। এ দম্পতি গর্ব করে বলেন যে তারা খুবই স্বাভাবিক মানুষ। তারা কোনো অলৌকিক ঘটনা বা ভূত–প্রেত জাতীয় কিছুতে বিশ্বাস করেন না। এগুলো তাদের কাছে অর্থহীন। মি. ডার্সলি হলেন গ্রুনিংস নামের একটি ড্রিল কোম্পানির পরিচালক। তিনি দেখতে বেশ লম্বা এবং মোটা। তার বিশাল গোঁফ। তবে তার ঘাড় নেই বললেই চলে। অপরদিকে তার স্ত্রী মিসেস ডার্সলি একটু হালকা–পাতলা। চুল বাদামি। তাঁর ঘাড়টা অস্বাভাবিক লম্বা। এটি তার খুব কাজে লাগে। তিনি লম্বা ঘাড় বাঁকিয়ে বাগানের খোঁজ–খবর করেন। পাড়া প্রতিবেশীরা কে কী করছে তা জানতে গোয়েন্দাগিরি করেন। ডার্সলি দম্পতির একমাত্র ছেলে। নাম ডাডলি। তাঁরা বলেন-এমন ছেলে হাজারে একটা মেলে।
ডার্সলি পরিবার যা চান তার সবই পান। কি তাদের একটি গোপন বিষয় আছে। তারা চান না এই বিষয়টা কেউ জানুক। তারা প্রতি মুহূর্তেই ভয়ে ভয়ে থাকেন তাদের ওই গোপন বিষয়টা বুঝি কেউ জেনে ফেলল।
পটার পরিবারের ব্যাপারে তারা বরাবরই অত্যন্ত স্পর্শকাতর। মিসেস পটার হচ্ছেন মিসেস ডার্সলির বোন। তবে দীর্ঘদিন তাদের দেখা–সাক্ষাৎ ছিল না। মিসেস ডার্সলি এমন ভাব দেখাতেন যেন তার কোন বোনই নেই। কারণ তাঁর বোন এবং তার নিষ্কর্মা স্বামীর সাথে মিসেস ডার্সলি বা তার স্বামীর বিন্দুমাত্র মিল ছিল না। পটার পরিবারের কেউ যদি তাদের বাড়িতে এসে পড়ে তাহলে পাড়া–প্রতিবেশী কী বলবে-এ নিয়ে মিসেস ডার্সলি ভয়ে ভয়েই থাকতেন।
ডার্সলি পরিবার জানতেন যে পটার দম্পতির একটা ছোট্ট ছেলে আছে। তারা কখনোই এই ছেলেটাকে দেখেননি। এই ছোট ছেলেটির কারণে ডার্সলি পরিবার নিজেদেরকে পটার পরিবার থেকে দূরে রাখতেন। তারা চান নি যে তাঁদের ছেলে ডাডলি পটার পরিবারের ছেলেটির সাথে মেলামেশা করে।
আমাদের গল্পের সূচনা মঙ্গলবারে। দিনটি ছিল মেঘলা। এই মেঘলা দিনে কখনোই মনে হয়নি ওইদিনই কিছুক্ষণ পর দেশে অদ্ভুত বা রহস্যজনক কিছু ঘটবে। মি. ডার্সলি গুন গুন করছিলেন এবং কাজে যাওয়ার জন্য তাঁর বিরক্তিকর কাজ টাইটা বাঁধছিলেন। তাঁদের পুত্র ডাডলি ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করছিল। মিসেস ডার্সলি গল্প থামিয়ে বেশ কসরৎ করে চিৎকাররত ডাডলিকে একটি উঁচু চেয়ারে বসালেন।
সে সময় তারা কেউই লক্ষ্য করেননি যে একটি বাদামী রঙের পেঁচা তার পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে তাদের ঘরের জানালায় এসে বসেছে।
সকাল সাড়ে আটটায় মিস্টার ডার্সলি অফিসে যাওয়ার আগে তাঁর ব্রিফকেস হাতে নিয়ে মিসেস ডার্সলির চিবুকে চুমো দিলেন। একই সঙ্গে পুত্র ডাডলিকে তিনি বিদায়ী চুমো দিতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। ডাডলি তখন খাচ্ছিল আর এদিক সেদিকে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে মারছিল। পুত্রকে হাই বলেই মি. ডার্সলি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। এরপর গাড়িতে চড়ে সোজা অফিসের দিকে রওনা হলেন।
মি. ডার্সলির কাছে আজ সব কিছু যেন অদ্ভুত মনে হচ্ছে। তিনি গাড়ি থেকে দেখতে পেলেন রাস্তায় একটি বিড়াল মানচিত্র পড়ছে। ডার্সলি বুঝতে পারলেন না তিনি সত্যিই কী দেখছেন। তিনি তার মাথা বাঁকালেন; কিন্তু একই দৃশ্য। প্রিভেট ড্রাইভের কোণায় আরও একটি বিড়াল দাঁড়িয়ে আছে। এবার কোন মানচিত্র নেই। ডার্সলি বুঝতে পারলেন না, ঠিক কী ঘটছে।
এটা কী ভোজবাজি। ডার্সলি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি চোখ কচলিয়ে বিড়ালটার দিকে তাকালেন। বিড়ালটাও তার দিকে তাকাল। ডার্সলির গাড়ি তখন সামনে এগুচ্ছে। তিনি যখনই গাড়ির আয়নায় চোখ রাখছেন তখনই বিড়ালটাকে দেখছেন। বিড়ালটা রাস্তার ফলক দেখছে, প্রিভেট ড্রাইভ নং–। কিন্তু বিড়ালের তো পড়ার কথা নয়, মানচিত্র দেখার ও কথা নয়। কোন ঘোরের মধ্যে আছেন কিনা তা বোঝার জন্য মি. ডার্সলি শরীরকে ঝাঁকুনি দিয়ে বিড়াল বিষয়টাকে মাথা থেকে তাড়ালেন। তার মাথায় এখন একটাই চিন্তা। ড্রিলের বড় অর্ডাটা আজ আর পাওয়ার কথা।
মি. ডার্সলির মগজ থেকে আবার ড্রিলের চিন্তুা উধাও। তিনি গাড়ি থেকে রাস্তায় দেখলেন লোকজন অদ্ভুত ঢোলা পোশাক পরে পায়চারি করছে। চারদিকে সকালের যানজট। কাউকে অদ্ভুত পোশাক পরতে দেখলে ডার্সলি খুব বিরক্ত হন। গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে তিনি বাইরে অদ্ভুত পোশাক পরা লোকজনদের দেখতে লাগলেন। লক্ষ্য করলেন, তাদের মধ্যে কেউই বয়সে তরুণ নয়। এতে তিনি আরও ক্ষেপে গেলেন। কিছুক্ষণ পর সড়ক যানজট মুক্ত হল। অবশেষে অফিসে পৌঁছলেন, অফিসে পৌঁছা মাত্রই তার মাথায় ড্রিলের চিন্তা ফিরে এল।
মি. ডার্সলি সব সময় জানালার দিকে পেছন ফিরে বসেন। তার অফিস দশ তলায়। যদি তিনি সেখানে না বসতেন তাহলে ড্রিলের প্রতি মনোযোগ দেয়া আরও কঠিন হতো। তিনি যদিও কোন পেঁচা দেখতে পেলেন না; কিন্তু পথের লোকজন দিনের আলোয় পেঁচা দেখছিল। তারা হা করে উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের অনেকেই হয়তো জীবনে কখনো রাতের বেলায়ও পেঁচা দেখেনি। অথচ ডার্সলি নিজে খাঁটি পেঁচামুক্ত একটি সকাল কাটালেন। অফিসে একে একে পাঁচজনকে বকা–ঝকা করলেন।
এরপর ডার্সলি কয়েকটা জরুরি ফোন করলেন। আরও খানিকক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করলেন। মধ্যাহ্নভোজের আগ পর্যন্ত তার মনমেজাজ খুবই ফুরফুরে ছিল। তিনি ভাবলেন, হাত–পা ছড়াবার জন্য একটু হেঁটে আসা দরকার। তিনি বেকারি থেকে মিষ্টি রুটি কেনার জন্য পথে নামলেন। অদ্ভুত পোশাকের লোকদের কথা তিনি তখন ভুলে গেলেন। বেকারির সামনে কয়েকজনকে অদ্ভুত পোশাকে দেখে তার আবার তাদের কথা মনে পড়ল। তিনি কড়া দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকালেন। তাঁর রাগের কারণ তিনি বুঝতে পারলেন না, তবে তাদের দেখে বিরক্ত হলেন। লোকগুলো উত্তেজিত স্বরে কানাকানি করছিল। মনে হল তারা পটারের কথা বলছে।
মিস্টার ডার্সলির কানে ভেসে এলো–পটাররা, হ্যাঁ ঠিক…, এটাই আমি শুনেছি।
হ্যাঁ, তাদের ছেলে, হ্যারি–
এসব কথা শুনে মিস্টার ডার্সলি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ভয় তাকে গ্রাস করল। যারা ফিস ফিস করছিল তিনি তাদের দিকে তাকালেন। একবার ভাবলেন কিছু জিজ্ঞেস করবেন। পরে ভাবলেন, জিজ্ঞেস না করাই ভাল।
মিস্টার ডার্সলি রাস্তা পার হলেন এবং দ্রুতবেগে অফিসের দিকে ছুটলেন। অফিসে ঢুকেই সচিবকে বললেন তাকে কেউ যেন বিরক্ত না করে।
তিনি টেলিফোন হাতে নিয়ে বাসায় ফোন করার জন্য ডায়াল ঘোরালেন। পরমুহূর্তেই মত পালটে রিসিভার রেখে দিলেন। এরপর গোঁফে তা দিতে দিতে ভাবলেন এসব চিন্তা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। পটার তো বিশেষ কোন নাম নয়। অনেক লোকের নামই পার হতে পারে এবং হ্যারি নামে তাদের ছেলে থাকতে পারে। তার নাম পটার না হয়ে হার্ভে বা হ্যারল্ডও হতে পারত। কিন্তু ছেলেটিকে তিনি এখন পর্যন্ত দেখেননি। এসব কথা জানিয়ে মিসেস ডার্সলিকে ভয় পাইয়ে দেবার কোন কারণ নেই। তার বোনের নাম উচ্চারণ করলেই মিসেস ডার্সলি ঘাবড়ে যান। এজন্য তিনি স্ত্রীকে দোষ দিচ্ছেন না, তার জায়গায় হলে হয়তো তিনিও তাই করতেন।
বিকেলে তিনি কাজে আর মনোযোগ দিতে পারলেন না। পাঁচটায় যখন অফিস থেকে বের হলেন তখনও চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। অফিস থেকে বেরোবার সময় দরজার বাইরে একটা লোকের সঙ্গে তার ধাক্কা লাগল। লোকটা প্রায় মাটিতেই পড়ে যাচ্ছিল। তার দিকে তাকিয়ে মিস্টার ডার্সলি বললেন—দুঃখিত।
কয়েক সেকেন্ড পর মিস্টার ডার্সলি খেয়াল করলেন যে লোকটা বেগুনি রঙের আলখেল্লা পরেছে। মাটিতে প্রায় পড়ে গেলেও লোকটাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত মনে হলো না। বরং তার মুখে স্মিত হাসির রেখা। বলল–স্যার, দুঃখিত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। কোন কিছুই আজ আমাকে বিচলিত করতে পারবে না। আনন্দ করুন। ফুর্তি করুন। অবশেষে ইউ-নো-হু বিদায় নিয়েছে। আপনার মতো জাদুতে অবিশ্বাসী মাগলদেরও আজ আনন্দ করা উচিত, এই শুভদিনে। শুভদিন।
বৃদ্ধ লোকটা রাস্তার মাঝখানে মিস্টার ডার্সলিকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। পরে ছেড়ে দিয়ে আবার হাঁটতে থাকল।
মিস্টার ডার্সলি অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। এক অদ্ভুত লোক তাঁকে রাস্তায় বুকে জড়িয়ে ধরেছে। লোকটা তাকে আবার মাগলও বলেছে। সবকিছু তার কাছে ধাঁধার মতো মনে হচ্ছে। তিনি দ্রুতবেগে গাড়িতে উঠে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। ভাবলেন হয়তো এই সবকিছুই কল্পনা। তবে তাই বা হয় কি করে! তিনি তো এসব আজগুবি কল্পনায় বিশ্বাস করেন না। গাড়ি নিয়ে চার নম্বর বাড়িতে প্রবেশ করতে প্রথমেই বিড়ালটা তার নজরে পড়ল। বিড়ালটা ছিল বাগানের দেয়ালের ওপর বসা। ডার্সলি নিশ্চিত যে এটাকেই তিনি সকালে দেখেছিলেন। এর চোখের চারদিকে একই চিহ্ন। বিড়ালটা দেখেও তার কোন ভাবান্তর হলো না।
হিস–বিড়ালটার উদ্দেশে তিনি জোরে শব্দ করলেন। নড়ল না।
বরং তার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল। তিনি ভাবলেন এটা তো বিড়ালের স্বাভাবিক আচরণ নয়। আবার ব্যাপারটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলেন। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার সময়ও ডার্সলি ভাবলেন এতক্ষণ যা কিছু ঘটেছে তার কিছুই স্ত্রীকে বলবেন না।
সুন্দর স্বাভাবিকভাবেই মিসেস ডার্সলির দিনটা কাটল। রাতে খাবার সময় তিনি স্বামীকে প্রতিবেশিনী ও তার কন্যার ঝগড়ার আদ্যপান্ত বললেন। ডার্সলি যে একটা নতুন শব্দ শিখেছে তাও তিনি উল্লেখ করলেন। মিস্টার ডার্সলি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেন। ডাডলি যখন ঘুমিয়ে পড়ল সন্ধ্যার শেষ খবর শোনার জন্য তখন তিনি বসার ঘরে গেলেন।
খবরে শোনা গেল–পাখি বিশারদগণ লক্ষ্য করেছেন যে পেঁচা আজ অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। পেঁচা রাতের পাখি। দিনের আলোয় একে খুব কমই দেখা যায়। কিন্তু আজ সকালেই অনেক পেঁচা উড়তে দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা পেঁচার আচরণের আকস্মিক পরিবর্তনের কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি। সংবাদ পাঠক হাসতে হাসতে পেঁচককূলের এ আচরণকে গভীর রহস্যময় বলে উল্লেখ করলেন–আবহাওয়াবিদরা জানালেন, আমরা এ সম্পর্কে কিছু জানি না। কিন্তু আজ পেঁচা এখানেই শুধু অস্বাভাবিক আচরণ করেছে তাই নয়, কেন্ট, ইয়র্কশায়ার ও ডান্ডি থেকেও দর্শকরা ফোন করে একই খবর জানিয়েছেন।
আবহাওয়ার খবরে বলা হলো–আজ অনেক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। দূরদূরান্ত থেকে ফোনে শ্রোতারা আমাদের জানিয়েছেন যে, গতকাল বৃষ্টির পরিবর্তে তারকা গোলাবর্ষণের শব্দ শোনা গেছে। লোকজন আতশবাজি পুড়িয়ে আনন্দ করেছে। অবশ্য আজকের রাতেও বৃষ্টি হবে। মিস্টার ডার্সলি তার আরাম কেদারায় শক্ত হয়ে বসলেন এবং ভাবলেন সারা ব্রিটেনেই তারকা গোলা বর্ষিত হচ্ছে। রাতের পেঁচা কেন দিনে উড়ে বেড়াচ্ছে? সর্বত্রই কি অদ্ভুত আলখেল্লা পরা রহস্যময় লোক? পটারকে নিয়ে ফিসফিসানি…?
দু কাপ চা নিয়ে মিসেস ডার্সলি বসার ঘরে প্রবেশ করলেন। চায়ে মোটেই স্বাদ হয়নি। মিস্টার ডার্সলি ভাবলেন স্ত্রীকে কিছু বলা দরকার।
তিনি তার গলা পরিষ্কার করে সংকোচের সাথে শুরু করলেন—
পেতুনিয়া–প্রিয়তমা–তুমি কি ইদানিং তোমার বোনের কোন খবর টবর পেয়েছে।
তিনি যেমনটা ভেবেছিলেন ঠিক তেমনি তার স্ত্রী ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ চোখে তাকালেন। ডার্সলি দম্পতি বোঝাতে চাইতেন, মিসেস ডার্সলির কোন বোন নেই। তারা কখনো এ বিষয়ে আলোচনা করতেন না।
না, হঠাৎ এ কথা কেন? মিসেস ডার্সলি রাগতস্বরে প্রশ্ন করলেন।
মিস্টার ডার্সলি আমতা আমতা করে বললেন–আজকাল খুব আজগুবি খবর শোনা যাচ্ছে।–পেঁচা–তারকা–গোলাগুলি এবং আজ শহরে অদ্ভুত পোশাক পরা লোককে দেখলাম।
কথার মাঝখানে থামিয়ে মিসেস ডার্সলি বললেন, তা-ই!
মিসেস ডার্সলি নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। মিস্টার ডার্সলি ভাবলেন, পটার সম্পর্কে যেসব কথা আজকে শুনেছেন তা স্ত্রীকে বলবেন কিনা, তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এ ব্যাপারে কথা না বলাই ভালো। তারপর খুবই হালকাভাবে বললেন তাদের ছেলেটা ডাডলির বয়সি হবে না?
মিসেস ডার্সলি শুকনো কণ্ঠে জবাব দিলেন, আমার মনে হয় তা-ই।
তার নাম কি? হাওয়ার্ড না কি যেন?
তুমি যদি আমাকে জিজ্ঞেস কর, তাহলে বলব নাম, হ্যারি। অনেকেই এ নাম রাখে।
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। মিস্টার ডার্সলি উত্তর দিলেন। তার বুক কাঁপছিলো, এই নামটিই তো তিনি শুনেছেন। আমি তোমার সাথে একমত।
ওপরের তলায় ওঠার সময় মিস্টার ডার্সলি এ বিষয়ে আর কোন কথা বললেন না। মিসেস ডার্সলি যখন স্নানের ঘরে, মিস্টার ডার্সলি তখন শোবার ঘরের জানালা দিয়ে বাড়ির সামনের বাগানের দিকে তাকালেন। বিড়ালটা তখনও সেখানে আছে। বিড়ালটা প্রিভেট ড্রাইভের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যে মনে হচ্ছে বিড়ালটা কোন কিছুর প্রতীক্ষা করছে। এসব কি তার কল্পনা? নাকি এর সাথে পটারদের কোন যোগসূত্র আছে?
সত্যি যদি যোগসূত্র থাকে তার ঝামেলাটা কিভাবে মোকাবিলা করবে সে কথা তিনি ভাবতেও পারছেন না।
ডার্সলি দম্পতি ঘুমুতে গেলেন। মিসেস ডার্সলি শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লেন। কিন্তু মিস্টার ডার্সলির সহজে ঘুম এলো না। না ঘুমিয়ে তিনি আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলেন। তিনি নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন এবং ভাবলেন যে, আজকের অদ্ভুত ঘটনাগুলোর সঙ্গে পটারদের যদি কোন যোগসূত্র থেকেও থাকে তাহলেও তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের কিছুতেই তাঁর কাছে বা তার স্ত্রীর কাছে আসার কোন কারণ নেই। তিনি এবং তার স্ত্রী পটারদের সম্পর্কে কী ধারণা রাখেন তা তাদের জানা আছে। পটাররা তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
কিন্তু তার ধারণা সঠিক ছিল না।
মিস্টার ডার্সলি ক্রমশঃ অস্বস্তিকর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেও বাইরে দেয়ালের ওপর বিড়ালটার চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম ছিল না। বিড়ালটা মূর্তির মত বসেছিল। তার নিষ্পলক দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল প্রিভেট ড্রাইভের কোণায়। পরের রাস্তায় গাড়ির দরজায় সজোরে শব্দ হওয়া কিংবা দুটো পেঁচা এসে না বসা পর্যন্ত সে নড়ল না। প্রকৃতপক্ষে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত বিড়ালটা দেয়ালের ওপর বসেছিল।
বিড়ালটা যেখানে বসেছিল তার কাছাকাছি হঠাৎ একজন লোককে দেখা গেল। লোকটা এমনভাবে উদয় হলো যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। বিড়ালটা লেজ নাড়াল এবং তার চোখ ছোট হয়ে এল।
প্রিভেট ড্রাইভে এ ধরনের লোক এর আগে কখনো দেখা যায়নি। লোকটা দেখতে লম্বা ও পাতলা। রূপোলি চুল ও দাঁড়ি দেখে সহজেই অনুমান করা যায় যে লোকটা বৃদ্ধ। তার লম্বা চুল ও দাঁড়ি তার কোমর পর্যন্ত ঠেকেছে। লোকটা লম্বা ও ঢোলা পোশাক পরেছেন। তার গোলাপি রঙের পোশাক এত লম্বা যে মাটি স্পর্শ করছিল। তার চোখ ছিল হালকা ও উজ্জ্বল। চশমার ভেতর দিয়ে আলো ঠিকরে পড়ছে। তার নাক বেশ লম্বা, আর একটু খাদা ধরনের। তার নাক দেখে মনে হয় এটা অন্তুতঃ দুবার ভেঙেছে। এই লোকটির নাম আলবাস ডাম্বলডোর। তিনি তার আলখেল্লার বিভিন্ন পকেটে আতিপাতি করে কি যেন খুঁজছিলেন।
মনে হয় ডাম্বলডোর বুঝতে পারেন নি, তিনি যে সড়কে এসেছেন সেখানে তার নাম থেকে শুরু করে জুতা পর্যন্ত প্রতিটা জিনিসই অবাঞ্ছিত।
তিনি বুঝতে পারলেন যে কেউ তাকে লক্ষ্য করছে। হঠাৎ বিড়ালটার দিকে তার দৃষ্টি পড়ে, বিড়ালটা সড়কের অপরদিক থেকে তাঁর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বিড়ালটাকে দেখে তিনি খুব মজা পেলেন। তিনি মনে মনে হাসলেনও, বিড়বিড় করে বললেন–আমার জানা উচিত ছিল।
ডাম্বলডোর তার জামার পকেটে যা খুঁজছিলেন এবার হাত দিয়ে তা পেলেন, একটা রূপোর সিগারেট লাইটার। তিনি লাইটারে মৃদু চাপ দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার কাছের বাতিটা নিভে গেল। এভাবে তিনি মোট বারো বার লাইটারে চাপ দিলেন। রাস্তার সব বাতি নিভে গেল। অবশিষ্ট আলো বলতে ছিল বিড়ালটার দুটি চোখ। গোল কুতকুতে চোখের মিসেস ডার্সলি বা অন্য কেউ যদি তখন বাইরে তাকাতেন তাহলেও নিচের ফুটপাথে অন্ধকারে কি ঘটছে তা তারা দেখতে পেতেন না। লাইটারটা পকেটে ভরে এরপর ডাম্বলডোর রাস্তার শেষপ্রান্তে চার নম্বরে এসে বিড়ালটার পাশে দেয়ালের ওপর বসলেন।
বিড়ালটার দিকে না তাকিয়ে ডাম্বলডোর বললেন–অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল, অবাক কাণ্ড আপনি এখানে?
এরপর তিনি বিড়ালটার দিকে স্মিত হাস্যে তাকালেন। কিন্তু এ কি? বিড়ালের কোন নাম নিশানা নেই। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন রাশভারি এক মহিলা। তার চোখে চারকোণা চশমা। এমন চৌকো চারকোণা চিহ্ন বিড়ালের চোখের চারপাশেও ছিল। তার গায়ে সবুজ পান্না রঙের আলখেল্লা। তার কালো চুল ঝুটি বাঁধা। চেহারায় একটু বিধ্বস্ত ভাব।
মহিলা প্রশ্ন করলেন–আমি এখানে আছি-এটা আপনি কী করে জানলেন?
ডিয়ার প্রফেসর, আমি কখনো কোন বিড়ালকে এত শক্তভাবে বসে থাকতে দেখিনি।
ম্যাকগোনাগল বললেন, আপনিও যদি সারাদিন ইটের দেয়ালের ওপরে বসে থাকতেন তাহলে আপনাকেও এতটা শক্ত থাকতে হত।
সারাদিন? তাহলে আপনি কখন আনন্দ করলেন? আমি এখানে আসার পথে এক ডজন ভোজ ও পার্টি দেখে এসেছি।
প্রফেসর ম্যাকগোনাগল ঘৃণাসূচক নাক সিঁটকালেন। হ্যাঁ, সবাই উৎসবই তো করবে। অধৈর্য কণ্ঠে তিনি বললেন। আপনি বলেছিলেন তাদের আরও সতর্ক থাকা উচিত। কিন্তু তারা সতর্ক হলো না। হ্যাঁ, এমন কিছু যে ঘটছে মাগলরাও তা বুঝতে পেরেছে। এটা তাদের নজরে এসেছে।
অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল ডার্সলি পরিবারের অন্ধকার শোবার ঘরের জানালার দিকে তাকালেন। তারপর তিনি মন্তব্য করলেন–পেঁচার ঝাঁক, তারকা গোলা… এগুলো আমি শুনেছি। তারা একেবারে বোকা নয়, তাদের চোখে কিছু না কিছু ধরা পড়বেই। তারকা গোলা গিয়ে পড়ল কেন্টে। আমি বাজি ধরতে পারি এগুলি ডিডালুস ডিগলের কাজ। কখনো তার বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল না।
তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ডাম্বলডোর নম্রস্বরে বললেন গত এগারো বছরে উৎসব করার মতো কোন সুযোগ আমরা পাইনি।
আমি সেটা জানি। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল খানিকটা রেগেই জবাব দিলেন। তবে এটা মাথা গরম করার কোন বিষয় নয়। সবাই একেবারেই অসতর্ক ছিল, এমনকি প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায় বের হওয়া, তাও মাগলদের পোশাক না পরে, গুজব ছড়ানো।
তিনি ডাম্বলডোরের দিকে তীব্র তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালেন। তার ধারণা ছিল ডাম্বলডোর তাকে কিছু বলবেন, কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। তাই ম্যাকগোনাগল বলে চললেন–খুবই ভালো হত যদি ওইদিন ইউ-নো-হু অদৃশ্য হয়ে যেত। মাগলরা আমাদের সম্পর্কে সব জেনে গেছে। আমার মনে হয় ডাম্বলডোর, সে সত্যি সত্যিই চলে গেছে।
আমারও তা-ই মনে হয় সে চলে গেছে– ডাম্বলডোর জবাব দিলেন। সে জন্য তাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। তারপর একটু থেমে বললেন আপনাকে কি শরবতি লেবু দেব?
কী? ম্যাকগোনাগল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
শরবতি লেবু। এটা মাগলদের প্রিয়। আমিও খুব পছন্দ করি।
না, ধন্যবাদ–ম্যাকগোনাগল শীতল কণ্ঠে জবাব দিলেন। তিনি মনে করেন না এটা শরবতি লেবু খাওয়ার সময়। একটু থেমে বললেন–আমি যেমন বলি, যদি ইউ-নো-হু চলে গিয়েও থাকে।
প্রিয় অধ্যাপক, আপনার মত বিচক্ষণ ব্যক্তির উচিত তাকে নাম ধরে ডাকা। ইউ-নো-হু কি কোন নাম হলো। আমি গত এগারো বছর ধরে সবাইকে এটা বোঝাবার চেষ্টা করেছি যে তাকে তার আসল নাম ধরেই ডাকা উচিত। তার আসল নাম ভোলডেমর্ট। ডাম্বলডোর বললেন।
অধ্যাপক, ম্যাকগোনাগল কুণ্ঠিত হলেন। ডাম্বলডোর দুটি শরবতি লেবুর খোসা ছাড়িয়ে খেলেও ম্যাকগোনাগল সে দিকে তাকালেন না। আপনি যদি ইউ–নো–হু বলতে থাকেন তাহলে সবকিছুতে বিভ্রান্তি দেখা দেবে। আমি ভলডেমর্ট-এর নাম বলতে ভয় পাওয়ার কোন কারণ দেখি না।
কিন্তু এতে কোন কাজ হয়নি। অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন কিছুটা ক্লান্তি আর কিছুটা বিস্ময় নিয়ে আপনি অন্যদের থেকে ভিন্ন। সবাই জানে একমাত্র আপনিই জানেন। ইউ–নো–সরি–ভলডেমর্ট ভয় পেয়েছিলেন।
আপনি আমার সম্পর্কে বাড়িয়ে বলছেন। ডাম্বলডোর শান্তভাবে জবাব দিলেন ভলডেমর্টের এমন ক্ষমতা ছিল যা আমার কোনদিনই হবে না।
কারণ আপনি খুব ভাল… এত মহৎ যে সে ক্ষমতা আপনি ব্যবহার করেন না।
এটা ভাগ্যের কথা যে-এখন সব অন্ধকার। খুবই লজ্জা পাচ্ছি আপনার কথায়, মাদাম পমফ্রে আমার কান ঢাকা টুপির প্রশংসা করার পর এত লজ্জা আমি আর কখনো পাইনি।
ম্যাকগোনাগল ডাম্বলডোরের দিকে শানিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন গুজব যেভাবে ছড়াচ্ছে তার সামনে পেঁচারা কিছুই নয়। আপনি কি জানেন–সবাই কী বলাবলি করছে? তারা বলছে–সে কোথায় গেছে? গেছে কোথায়?
মনে হল অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল এখন ডাম্বলডোরকে বলতে চান কেন তিনি সারাদিন বিড়ালের ছদ্মবেশে কনকনে শীতের মধ্যে দেয়ালের ওপর বসেছিলেন। সবাই যা বলাবলি করছিল তিনি তা বিশ্বাস করবেন না। যতক্ষণ না ডাম্বলডোর সেটাকে সত্য বলেন। ডাম্বলডোর কিন্তু কোন কথা না বলে আরেকটা শরবতি লেবু মুখে তুললেন।
তারা বলছিল অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন, গতরাতে ভোলডেমর্ট গডরিকস হলোতে গিয়েছিলেন পটারদের সন্ধানে। গুজব ছড়ানো হয়েছে যে লিলি এবং জেমস পটার মৃত।
ডাম্বলডোর তার মাথা নত করলেন এবং অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
লিলি আর জেমস মারা গেছে-একথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি এটা বিশ্বাস করতে চাই না …ওহ! আলবাস
ডাম্বলডোর কাছে গিয়ে তাঁর কাঁধ মৃদু স্পর্শ করে ভারি কণ্ঠে বললেন আমি জানি, আমি জানি। আপনার কাছে খবরটা কত বেদনাদায়ক।
কম্পিত কণ্ঠে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন-এটাই শেষ নয়। তারা বলছিল যে, সে পটারের ছেলে হ্যারি পটারকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার সে চেষ্টা সফল হয়নি। কেন হয়নি তা কেউ বলতে পারছে না। যখন হ্যারি পটারকে হত্যা করা গেল না তখনই ভোলডেমর্টের ক্ষমতা কিছুটা হলেও হ্রাস পেল। এই কারণেই সে চলে গেছে।
ডাম্বলডোর গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন।
এটা-এটা কি সত্য? ম্যাকগোনাগল দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বললেন। সে তো সবাইকে হত্যা করেছে। কেবল এই ছোট্ট ছেলেটাকে হত্যা করতে পারেনি? এটা সত্যিই বিস্ময়কর। হ্যারি যে বেঁচে গেল-এটা সত্যিই অভাবনীয়।
আমরা কেবল অনুমান করতে পারি। ম্যাকগোনাগল বললেন হয়তো সত্যটা কখনোই জানতে পারবো না।
অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল একটা রুমাল বের করে তার চশমার ভেতর দিয়ে চোখ মুছলেন। ডাম্বলডোর পকেট থেকে সোনালী ঘড়ি বের করে মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। ঘড়িটা আবার পকেটে রেখে বললেন–হ্যাগ্রিড দেরি করছে। সে নিশ্চয়ই আপনাকে বলেছিল যে আমি এখানে থাকব।
হ্যাঁ ম্যাকগোনাল জবাব দিলেন–আমি জানি, আপনি আমাকে বলবেন না–আপনি এখানে কেন এসেছেন।
আমি হ্যারিকে তার আঙ্কল ও আন্টের কাছে দিয়ে যাবার জন্য এখানে এসেছি। হ্যারির আত্নীয়ের মধ্যে এখন তো মাত্র তারাই আছেন।
যারা এখানে থাকে আপনি নিশ্চয়ই তাদের কথা বলছেন না? চার নাম্বার বাড়ি দেখিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন–ডাম্বলডোর, আপনি যা ভাবছেন তা করা ঠিক হবে না। আমি সারাদিন ধরে তাদের লক্ষ্য করছি। ওরা দুজন আমাদের মত নয়। ওদের একটা ছেলে আছে। সে তো আজকে সারা পথ ওর মাকে লাথি মেরেছে আর চিৎকার করেছে মিষ্টির জন্য। হ্যারি পটার এখানে আসবে এবং থাকবে ভাবাও যায় না।
এটাই তার জন্য উপযুক্ত স্থান। ডাম্বলডোর বললেন যখন হ্যারি বড় হবে তখন তার আঙ্কল–আন্ট তাকে সব ব্যাখ্যা করে বলতে পারবেন। আমি তাদেরকে একটা চিঠি দিয়েছি।
চিঠি? ম্যাকগোনাগল অবাক হয়ে জানতে চাইলেন আপনি কি সত্যিই মনে করেন একটা চিঠিই সবকিছু ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট? এই লোকগুলো কোনদিনই হ্যারি পটারকে বুঝতে পারবে না। তবে একদিন সে কিংবদন্তী হবেই।
আজকের দিনটাকেই যদি হ্যারি পটারের দিন বলে ঘোষণা করা হয় আমি বিন্দুমাত্র অবাক হব না। ভবিষ্যতে হ্যারিকে নিয়ে যে বই লেখা হবে তা পৃথিবীর প্রতিটি শিশু পড়বে।
আপনি ঠিকই বলেছেন অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল। ডাম্বলডোর বললেন। একটা ছেলে হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে না, কিন্তু বিখ্যাত হয়েছে-একটা ছোট ছেলেকে মাথা খারাপ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন–হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু ছেলেটাকে এখানে কীভাবে আনবেন? তারপর তিনি ডাম্বলডোরের আলখেল্লার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে, মনে হল তিনি হ্যারিকে তার পোশাকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছেন।
হ্যাগ্রিড তাকে নিয়ে আসছে। ডাম্বলডোর জবাব দিলেন।
এমন একটা কঠিন বিষয়ে হ্যাগ্রিডের ওপর আস্থা রাখা কি ঠিক হবে? অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল জানতে চাইলেন।
হ্যাগ্রিডের ওপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। ডাম্বলডোর জবাব দিলেন।
আমি তাকে অবিশ্বাস করি না– অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল বললেন। তবে সে তো ভুলও করতে পারে।
কিছু সময় নীরবে কাটল। তারপর বাইরে মোটর বাইকের শব্দ শোনা গেল। মোটর বাইক থেকে হ্যাগ্রিড নামলেন। মোটর বাইকটা অনেক বড় হলেও হ্যাগ্রিডের জন্য এটা নস্যি মাত্র। হ্যাগ্রিড এমনিতে যথেষ্ট লম্বা। সাধারণ লোকের তুলনায় পাঁচগুণ মোটা। কালো ঝাকড়া চুল। দাঁড়িতে তার সারা মুখ ঢেকে গেছে। তার হাত ডাস্টবিনের ঢাকনির মত চওড়া। বুটপরা অবস্থায় তার পা দেখলে মনে হবে শিশু ডলফিন। তার বাহু দেখলে মনে হবে কয়েকটা কম্বলের বাণ্ডিল।
অবশেষে তুমি এসেছো! আশ্বস্ত হয়ে ডাম্বলডোর হ্যাগ্রিডের কাছে জানতে চাইলেন–যাক! তুমি এই মোটর বাইক কোথায় পেলে?
অধ্যাপক ডাম্বলডোর, আমি এটা ধার করেছি। হ্যাগ্রিড বাইক থেকে নামতে নামতে জবাব দিলেন–ইয়াং সিরিয়াস ব্ল্যাক এটা আমাকে ধার দিয়েছে।
কোন অসুবিধে হয়নি তো? ডাম্বলডোর জানতে চাইলেন।
না, কোন অসুবিধে হয়নি। হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন–বাড়িটা ধ্বংস হয়ে গেছে। মাগলদের কিছু করার সুযোগ না দিয়েই আমি ছেলেটাকে বের করে নিয়ে এসেছি। ব্রিস্টলে এসে সে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ডাম্বলডোর এবং অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল কাছে এসে ঝুঁকে কম্বলের পুঁটলিটাকে দেখলেন। কম্বলটা সরাতেই দেখা গেল–ভেতরে একটা শিশু ঘুমিয়ে আছে। কালো চুল। কপালের ওপর বিদ্যুৎ চমকানোর মতো আঁকাবাঁকা একটা কাটা দাগ।
এটাই কি সেই দাগ?–ম্যাকগোনাগল প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ–ডাম্বলডোর জবাব দিলেন। সারাজীবন তাকে এই দাগ বয়ে বেড়াতে হবে।
এ ব্যাপারে আপনি কি কিছু করতে পারেন না ডাম্বলডোর? অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল জানতে চাইলেন।
পারলেও আমি কিছু করব না–ডাম্বলডোর জবাব দিলেন। কারণ এই দাগগুলো ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে। আমারও বাঁ পায়ের হাঁটুতে কাটা দাগ আছে, যা দেখতে অবিকল লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ডের ম্যাপের মতো। হ্যাগ্রিড, বাচ্চাটাকে দাও। এখন আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো।
হ্যারিকে কোলে নিয়ে ডাম্বলডোর ডার্সলিদের বাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন।
আমি কি এখন বিদায় নিতে পারি? হ্যাগ্রিড জানতে চাইলেন।
হ্যাগ্রিড তার দাঁড়িভরা মুখ নিয়ে হ্যারিকে চুমো খেলেন। তারপর বিকট শব্দ করে আহত কুকুরের মত দ্রুতগতিতে সরে গেলেন।
ম্যাকগোনাগল তাকে হুঁশিয়ার করলেন—শ্শ্। চুপ। মাগলরা জেগে যাবে।
হ্যাগ্রিড একটা বড় রুমাল বের করে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন–লিলি আর জেমস জীবিত নেই, এ সত্যটাই আমি মানতে পারছি না। হ্যারি মাগলদের সাথে কিভাবে থাকবে–সেটা ভেবেই আমি চিন্তিত।
আসলেই এটা খুব দুঃখজনক। ম্যাকগোনাগল বললেন–হ্যাগ্রিড আপনি শক্ত হোন। নতুবা অন্যরা আমাদের দেখে ফেলবে।
ডাম্বলডোর বাগানের দেয়াল টপকে বাড়ির সামনের দরোজার দিকে অগ্রসর হলেন। নিজের আলখেল্লার ভেতর থেকে একটি চিঠি বের করে তিনি হ্যারির গায়ে জড়ানো কম্বলের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন। হ্যারিকে কম্বলসহ দরোজার সামনে রেখে ডাম্বলডোর ফিরে এলেন আগের জায়গায়, সঙ্গী দুজনের কাছে।
পুরো এক মিনিট তারা তিনজন দাঁড়িয়ে কম্বলের পুটলির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হ্যাগ্রিডের কাধ নড়ে উঠল, অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল তার চোখের পাতা পিট পিট করলেন আর ডাম্বলডোরের চোখে যে জ্যোতি সব সময় দেখা যেত, তা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।
ডাম্বলডোর বললেন-এখানে দাঁড়িয়ে থাকার তো কোন মানে হয় না। আমরা ফিরে গিয়ে উৎসবে যোগ দিতে পারি।
ঠিক বলেছেন, হ্যাগ্রিভ কুণ্ঠিত কণ্ঠে বললেন আমি বরং বাইক নিয়ে বিদায় হই। শুভরাত্রি অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল, শুভ রাত্রি অধ্যাপক ডাম্বলডোর।
চোখ মুছতে মুছতে হ্যাগ্রিড তার মোটরবাইকে উঠলেন। আর বিকট আওয়াজ করে বাইক ছুটে চলল।
অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল, আবার দেখা হবে আশা করি–ডাম্বলডোর বললেন।
জবাবে অধ্যাপক ম্যাকগোনাগল নাক দিয়ে লম্বা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন। ডাম্বলডোর রাস্তার দিকে রওনা হলেন। লাইটারের সাহায্যে রাস্তার আলোগুলো আবার জ্বেলে দিলেন। বারটা বাতিই জ্বলে উঠলো, কমলা রঙের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো সড়ক, এমন পরিস্কার সব কিছু দেখা যাচ্ছিল যে কোন বিড়ালের বাচ্চাও যদি সড়কের শেষপ্রান্তে দৌড়ে যেত পরিষ্কার তা দেখা যেত। দূর থেকে তারা দেখতে পেল চার নাম্বার বাড়ির সিঁড়িতে কম্বলের পুটলিটা। তারপর গুডলাক হ্যারি বলে কোথায় যেন মিলিয়ে গেলেন।
প্রিভেট ড্রাইভের ঝোঁপঝাড়ু তখন বাতাসে দুলছে। আকাশের দিকে তাকালে মনে হচ্ছিল শিগগিরই আশ্চর্যজনক কিছু ঘটনা ঘটবে।
কম্বলের ভেতর হ্যারি পটার নড়ছে, কিন্তু তার ঘুম ভাঙেনি।
হ্যারির একটা হাত সেই চিঠির ওপর ছিল, যেটা ডাম্বলডোর তার কম্বলের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। হ্যারি জানতেও পারল না যে, সে অসাধারণ, সে বিখ্যাত এবং কিছুক্ষণ পর মিসেস ডার্সলি তাকে ঘুম থেকে জাগাবেন।
ভোরবেলা দরোজা খুলেই মিসেস ডার্সলি চিৎকার করে উঠলেন। দুধের বোতল নেয়ার জন্য তিনি দরোজা খুলেছিলেন। কম্বল জড়ানো শিশুটাকে তিনি দুহাতে কোলে তুলে নিলেন। তার পুত্র ডাডলির সাথে হ্যারি আশ্রয় পেল। তিনি জানতেও পারলেন না দেশের সর্বত্র লোকজন মিলিত হয়ে গোপন সভায় হাতের গ্লাস উঁচু করে ফিসফিসে গলায় বলছে হ্যারি পটারের উদ্দেশ্যে, যে ছেলেটা বেঁচে আছে।
🔴 কাঁচের খাঁচার অন্তর্ধান
হ্যারি পটারকে যেদিন ডার্সলিরা কোলে তুলে নিয়েছিলেন, সেদিন থেকে দেখতে দেখতে দশটা বছর কেটে গেছে। তবে প্রিভেট ড্রাইভে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।
সূর্য আগের মতোই পূর্বদিকে উঠছে আর পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে। আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে যেদিন মিসেস ডার্সলি তার দরোজার সামনে থেকে হ্যারি পটারকে কুড়িয়ে কোলে তুলে নিয়েছিলেন, যে রাতে মি. ডার্সলি পেঁচা সম্পর্কে দুঃখজনক খবর শুনেছিলেন। সবই আগের মত চলছে, শুধু দেয়ালে ঝুলানো তাদের ছবিগুলো দেখে বোঝা যায় কত বছর পার হয়ে গেছে।
ডাডলিও আর এখন শিশু নয়। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি ছেলে সাইকেল চালাচ্ছে। মেলা দেখতে যাচ্ছে। বাবার সাথে কম্পিউটারে গেমস খেলছে। ঘরে ঢুকে কিছুতেই বোঝা যাবে না এখানে ডাডলির কোন এক সঙ্গী আছে বা আর কেউ এখানে থাকে! হ্যারি পটার তখনও ঘুমোচ্ছে। কিন্তু বেশিক্ষণ সে ঘুমোতে পারল না। আন্ট পেতুনিয়ার কর্কশ কণ্ঠ তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল। তার উচ্চ কণ্ঠ দিনের নীরবতা ভঙ্গ করল
এখনি উঠে পড়। এখুনি।
হ্যারি উঠে পড়ল।
তার আন্ট দরোজা ধাক্কাচ্ছেন।
হ্যারি, ওঠো বলে আন্ট পেতুনিয়া চিৎকার করছেন।
হ্যারি বুঝতে পারল তার আন্ট রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছেন। চুলার ওপর কড়াই বসানো হচ্ছে।
পাশ ফিরে হ্যারি স্বপ্নের কথা ভাবছিল। একটু আগেই সে একটা মজার স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্নে দেখছিল যে একটা উড়ন্ত মোটর বাইকে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আন্ট পেতুনিয়া দরোজার কাছে এসে আবার জিজ্ঞেস করলেন–হ্যারি তুমি কি উঠেছ?
উঠেছি। হ্যারি জবাব দিল।
তাড়াতাড়ি এদিকে এসো। আন্ট হ্যারিকে নির্দেশ দিলেন–তুমি শূকরের মাংসের দিকে খেয়াল রেখো। দেখো সবকিছু যেন পুড়ে না যায়। আমি চাই আজ ডাডলির জন্মদিনে সব কিছু নিখুঁত হোক।
হ্যারি বিড় বিড় করে কী যেন বলল।
আন্ট তাকে প্রশ্ন করলেন–হ্যারি, তুমি কি কিছু বলছিলে?
হ্যারি জবাব দিল–না, কিছু নাতো।
ডাডলির জন্মদিনের কথা তো সে ভুলে যেতে পারে না। হ্যারি বিছানা থেকে উঠে মোজা খুঁজতে লাগল। বিছানার নিচেই সে এক জোড়া মোজা পেল। মোজার ওপর থেকে একটি মাকড়সাকে তাড়িয়ে দিয়ে হ্যারি মোজা দুটি পরল। হ্যারি মাকড়সাকে ভয় পায় না কারণ কাবার্ডে অনেক মাকড়সা। আর সিঁড়ির নিচের ঘুপচির এই কাবার্ডেই হ্যারিকে ঘুমোতে হয়।
জামা পরে হ্যারি নিচে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো। ডাডলির জন্মদিনের উপহারগুলোর জন্য টেবিলটাই দেখা যাচ্ছে না। জন্মদিনে ডাডলি তার পছন্দের সব জিনিসই পেয়েছে বলে মনে হলো। সে নতুন কম্পিউটার পেয়েছে, আরেকটা টেলিভিশন পেয়েছে, রেসের বাইক পেয়েছে।
ডাডলি কেন রেসের বাইক চেয়েছে এটা হ্যারির কাছে রহস্যই রয়ে গেল। কাউকে সাইকেল দিয়ে ধাক্কা মারার জন্য হলে ঠিক আছে। ডাডলি খুব মোটা এবং ব্যায়াম সে একেবারেই পছন্দ করে না। অবশ্য কাউকে ঘুষি মারা সেটা অন্য কথা–বিশেষ করে হ্যারিকে। এই ব্যায়ামটাই সে সব সময় করে থাকে। তবে হ্যারিকে বাগে পাওয়া সহজ ছিল না।
হ্যারি কিন্তু গায়ে–গতরে তেমন বড় হয়ে ওঠেনি। তার শরীর রোগা পাতলা। ডাডলির বড় জামা–কাপড়ে তাকে আরো বেশি রোগা দেখায়। আকারে–আয়তনে ডাডলি ছিল তার চার গুণ। হ্যারির মুখ পাতলা, হাঁটু গোল, চুল কালো আর চোখ উজ্জ্বল সবুজ। চোখে গোল কাঁচের চশমা। চশমায় অনেক সেলোটেপের টুকরো, কারণ ডাডলি প্রায়ই তার নাকে ঘুসি মেরে চশমা ভাঙতো। নিজের চেহারার যে জিনিসটা হ্যারির ভালো লাগে তা হলো তার কপালের চিকন দাগ। ঝিলিক মারা বিদ্যুতের মতো আঁকাবাঁকা।
তার কপালে এই দাগ কেন-এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে আন্ট পেতুনিয়া জবাব দেন–যখন মোটর দুর্ঘটনায় তোমার বাবা–মা দুজনই মারা যান তখন থেকেই তোমার কপালে এই দাগ। এর বাইরে তুমি আমাকে আর কোন প্রশ্ন করো না।
হ্যারি জানে, ডার্সলি পরিবারের সাথে থাকতে হলে-এ ব্যাপারে দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করা যাবে না।
হ্যারি যখন কড়াই-এ শূকরের মাংস উল্টাচ্ছিলো ঠিক তখনই আঙ্কল ভার্নন রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন।
চুল আঁচড়াওনি কেন? তিনি হ্যারির কাছে যেন কৈফিয়ত চাইলেন।
আঙ্কল ভার্নন সপ্তাহে একদিন পত্রিকার শিরোনামের ওপর চোখ বোলান এবং উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করেন–হ্যারির এখনই চুল কাটা দরকার। কিন্তু এতে কিছু যায় আসে না। হ্যারির চুল যথারীতি বাড়তেই থাকে।
হ্যারি যখন ডিম ভাজছিল ঠিক তখনই ডাডলি এবং তার মা রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন। ডাডলির চেহারার সাথে আঙ্কল ভার্ননের অনেক মিল আছে। ডাডলির মা বলেন, ডাডলির চেহারা শিশু এ্যাঞ্জেলদের মতো। আর হ্যারির কাছে মনে হয় ডাডলি পরচুলা পরা একটা শূকর।
টেবিলের ওপর ডিম ও শূকরের মাংস রাখতে হ্যারিকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। কারণ টেবিলে তেমন জায়গা নেই। আর ডাডলি তখন তার উপহারগুলো গুনছে।
উপহার গুনতে গুনতে ডাডলির মন একটু দমে গেল।
ডাডলি মন্তব্য করল–ছত্রিশটা, তার মানে গতবারের জন্মদিনের তুলনায় দুটি কম।
আন্ট বললেন-এর সাথে মার্জ আন্ট আর আমার উপহার যোগ কর। এবার গুণে দেখো কত হয়?
ঠিক আছে। তাহলে সাইত্রিশটা হলো –ডাডলির জবাবের মধ্যে ভীষণ ক্রোধের গন্ধ পেয়ে আন্ট পেতুনিয়া বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তিনি বললেন–ঠিক আছে, আমরা আজ যখন বাইরে যাবো তখন তোমাকে আরো দুটা উপহার কিনে দেব।
ডাডলি মুহূর্তের জন্য কী যেন ভাবল। তারপর বলল–ঠিক আছে। তাহলে আমার উপহারের সংখ্যা হবে ত্রিশ।
আন্ট পেতুনিয়া কথা শেষ করলেন–লক্ষ্মীসোনা, সংখ্যা হবে ত্রিশ নয়, বেশি। ঊনচল্লিশ। আহ ডাডলি চেয়ারে বসে সবচে কাছের প্যাকেটটা হাতে তুলে বললো, তাহলে ঠিক আছে।
আঙ্কল ভার্নন মৃদু হাসলেন।
বাবার মতোই ডাডলি তার প্রাপ্যটা চাচ্ছে। এই বলে আঙ্কল ভার্নন ডাডলির চুলে আদরের হাত বুলিয়ে দিলেন। ঠিক এই সময় ফোন বেজে উঠল। আন্ট পেতুনিয়া ফোন ধরতে চলে গেলেন। হ্যারি আর আঙ্কল ভার্নন দেখলেন ডাডলি তার উপহার সামগ্রীর মোড়ক খুলছে। ডাডলি একটা রেসিং বাইক পেয়েছে। পেয়েছে একটা সিনে–ক্যামেরা। কম্পিউটারের ১৬টা নতুন খেলা, একটা ভিডিও রেকর্ডার। ডাডলি মোড়ক খুলে সোনালি হাতঘড়িটা বের করল। এই সময় আন্ট পেতুনিয়া হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন। তাকে ক্রুদ্ধ ও চিন্তিত মনে হল।
তিনি বললেন–দুঃসংবাদ, ভার্নন। মিসেস ফিগের পা ভেঙে গেছে। তিনি ওকে নিতে পারবেন না। এই বলে তিনি হ্যারির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন।
ডাডলির চেহারায় অপ্রত্যাশিত আতঙ্ক দেখা গেল। হ্যারি অবশ্য হাফ ছেড়ে বাঁচল। প্রতি বছর ডাডলির জন্মদিনে তার বাবা–মা তাকে এবং এক বন্ধুকে নিয়ে সারাদিনের জন্য বাইরে যান। এ্যাডভেঞ্চার পার্ক, হামবার্গার বার বা সিনেমায়। প্রতি বছরই হ্যারিকে ফিগের কাছে রেখে যেতেন তাঁরা। ফিগ হচ্ছেন একজন উন্মাদ বৃদ্ধা, তিনি দুটো রাস্তার পরেই থাকেন। হ্যারি মিসেস ফিগকে একদমই পছন্দ করে না।
তাহলে এখন কি হবে? আন্ট পেতুনিয়া কথাগুলো বলে হ্যারির দিকে এমনভাবে তাকালেন যে মনে হল মিসেস ফিগের পা ভাঙার জন্য হ্যারিই দায়ী। ভার্নন বললেন–মার্জকে ফোন করা যেতে পারে।
বোকার মতো কথা বলো না ভার্নন। সে হ্যারিকে একেবারেই পছন্দ করে না–মিসেস ডার্সলির জবাব।
হ্যারির সামনেই ডার্সলি পরিবারে তাকে নিয়ে প্রায়ই এ ধরনের কথাবার্তা হতো। যেন হ্যারি ধারে–কাছেও নেই বা তারা যখন হ্যারি সম্পর্কে এমন অবজ্ঞার সুরে কথা বলতেন যে মনে হতো, তার এখানে কোন উপস্থিতিই নেই।
হ্যারি মনে মনে আশা করছিল একা থাকলে সে টেলিভিশনে তার খুশিমতো অনুষ্ঠান দেখতে এবং ডাডলির কম্পিউটার রুমেও যেতে পারবে।
তাদের কথাবার্তার মাঝখানে হ্যারি বলল–আমাকে তোমরা বাড়িতে রেখে যেতে পারো। আমি টিভি দেখে সময় কাটাব।
আন্ট পেতুনিয়া হ্যারির দিকে এমনভাবে তাকালেন যে মনে হলো যেন এইমাত্র তিনি তেতো কিছু মুখে দিয়েছেন।
তিনি মন্তব্য করলেন–ঘরে ফিরে দেখা যাবে সব তছনছ হয়ে গেছে।
আমি বাড়ির কোন কিছুর ক্ষতি করব না। হ্যারি বলল। কিন্তু কেউই তার কথা কানে তুললেন না।
আন্ট পেতুনিয়া বললেন–চলো চিড়িয়াখানায় যাই। এক গাড়িতে বসিয়ে রাখা যাবে।
গাড়িটা নতুন। নতুন গাড়িতে ও একা থাকতে পারবে না।
ডাডলি কাঁদতে শুরু করল। আসলে কাঁদা নয়। কাঁদার অভিনয়। ডাডলি জানে কাঁদলেই সে যা চায় তাই পায়।
দুষ্ট ছেলে এভাবে কাঁদে না। তার মা বললেন, তোমার মা কখনোই চাইবে না যে সে তোমার জীবনের এই দিনটা নষ্ট করে দিক।
আমি চাই না, একদম চাই না সে আমাদের সঙ্গে যাক। ডাডলি বলল–সে সবকিছু নষ্ট করে দেয়। এই বলে সে হ্যারির দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাল।
ঠিক তখনই দরোজায় বেল বেজে উল। আন্ট পেতুনিয়া উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠলেন, ওহ ঈশ্বর, তারা এসেছে। কিছুক্ষণ পর মাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল ডাডলির ঘনিষ্টতম বন্ধু পায়ার্স পলকিস। ডাডলির কান্না থেমে গেল। পায়ার্সের চেহারাটা যেন অনেকটা ইঁদুরের মতো। পায়ার্স পলকিস ডাডলির মজার বন্ধু। ডাডলি যখন লোকজনকে আঘাত করে তখন সে তাদের হাত পেছনে আধমোড়া করে বেঁধে ফেলে।
আধঘণ্টা পরেই হ্যারি গিয়ে বসল ডার্সলিদের গাড়িতে। হ্যারি ভাবতেও পারেনি তার এমন সৌভাগ্য হবে। গাড়িতে ডাডলি এবং পায়ার্সও আছে। তারা সকলেই যাবে চিড়িয়াখানায়।
আঙ্কল ভার্নন তারিকে সতর্ক করে দিলেন–সাবধান। কোনপ্রকার গগুগোল করবে না। গণ্ডগোল করলেই বড়দিন পর্যন্ত তোমাকে কাবার্ডে কাটাতে হবে।
সত্যি বলছি। আমি কোন রকম গণ্ডগোল করব না। হ্যারি আশ্বাস দিল।
আঙ্কল ভার্ননের মতো কেউই হ্যারির কথা বিশ্বাস করল না।
হ্যারিকে নিয়ে প্রায়ই অঘটন ঘটে। এর আগেও হ্যারি তাদের বিরক্ত করেছে।
সমস্যা হলো হ্যারিকে নিয়ে প্রায়ই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। তাকে নিয়ে ডার্সলি পরিবার মোটেই খুশি নন।
একবার সেলুন থেকে চুল কেটে হ্যারি বাড়িতে ফিরে আসতে আসতেই তার চুল আগের মত হয়ে যায়। আন্ট পেতুনিয়া দেখতে পান তার মাথার চুল আগের মতোই। যেন চুল কাটাই হয়নি। এতে তিনি বিরক্ত হলেন এবং রান্নাঘর থেকে কাঁচি এনে হ্যারির মাখা মুড়িয়ে দিলেন। কেবল কপালের দাগ ঢেকে রাখার জন্য সামনের দিকে কিছু রেখে দেয়া হলো। ডাডলি তাকে দেখে হাসছিল। সারারাত তার ঘুম হলো না। সে স্কুলের কথা ভাবছিল। সকালে উঠে দেখে হ্যারির মাথাভর্তি চুল, আন্ট কেটে দেয়ার আগে যে অবস্থা ছিল। এ কারণে আন্ট তাকে সাত দিন কার্ডের মধ্যে আটকে রাখলেন। যদিও হ্যারি বোঝাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে যে সে এর কারণ জানে না।
আরেকদিন আন্ট পেতুনিয়া ডাডলির একটা পুরনো ঢোলা জাম্পারের ভেতর হ্যারিকে ঢুকানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু যতই তিনি হ্যারির মাথা ঢুকাতে চান ততই জাম্পারের মুখটা ছোট হয়ে আসে। আন্ট পেতুনিয়া ভাবলেন, হয়তো ধোয়ার পর ছোট হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত জাম্পারে হ্যারির মাথা ঢুকে এবং হ্যারি শাস্তি থেকে রেহাই পায়।
আরেকবার হ্যারি ভীষণ বিপদে পড়েছিল। তাকে একদিন স্কুল ভবনের ছাদে পাওয়া গেল। আসলে ছাদে সে স্বেচ্ছায় ওঠেনি। ডাডলির দুষ্টু বন্ধুরাই হ্যারিকে তাড়া করে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্ৰী ডার্সলি দম্পতিকে একটা চিঠি লিখে জানান যে, হ্যারি স্কুলের ছাদে উঠেছে। হ্যারি রান্নাঘরের বাইরে বড় শিম গাছের পেছনে লাফ দেয়ার চেষ্টা করেছিল। হ্যারির ধারণা বাতাস তাকে উড়িয়ে এত ওপরে তুলেছে।
কিন্তু আজ কোন গোলমাল হলো না। তার স্কুল, কাপ বোর্ড অথবা মিসেস ফিগ-এর বাঁধাকপির গন্ধভরা রুম থেকে ডাডলি ও পায়ার্স-এর সঙ্গে দিন কাটানো ভাল।
গাড়ি চালাতে চালাতে আঙ্কল ভার্নন আন্ট পেতুনিয়ার কাছে অভিযোগ করছিলেন। তিনি অভিযোগ করতে পছন্দ করেন। সচরাচর তার অভিযোগ হলো : কর্মরত লোকজন, হ্যারি, ব্যাংক, এরপর কাউন্সিল আবার হ্যারি বিষয়ক। আজ সকালে অভিযোগ হলো মোটরবাইক বিষয়ক।
…মোটরবাইক ক্ষেপাটে ও তরুণ মস্তানের মতো গর্জন করে চলে। একথা তিনি বললেন, যখন পাশ দিয়ে একটা মোটরবাইক অতিক্রম কর চলে গেল।
আমি মোটরবাইক নিয়ে একটি স্বপ্ন দেখছিলাম। হ্যারির হঠাৎ মনে পড়ল। সে বলল, মোটরবাইকটি উড়ছিল।
আরেকটু হলেই ভার্ননের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ত। তিনি ডানদিকে ঘুরে হ্যারির দিকে বিরক্তির সঙ্গে তাকালেন। তার মুখ তখন বৃহদাকার মূলার মত। বললেন মোটরবাইক উড়তে পারে না!
ডাডলি ও পায়ার্স হাসছিল।
আমি জানি এটি উড়তে পারে না। হ্যারি বলল, আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম।
এরপরই হ্যারি ভাবল, কিছু না বললেই ভাল হতো। সে কথা বলুক এটা ডার্সলি পরিবারের কেউ চায় না। তারা তাকে ঘৃণা করে। স্বপ্ন হোক বা কার্টুন হোক তাতে কিছু আসে যায় না। তারা মনে করবে এটা নিশ্চয়ই হ্যারির ভয়ঙ্কর কোন ব্যাপার।
দিনটি ছিল রোদ ঝলমলে শনিবার, ছুটির দিন। চিড়িয়াখানায় প্রচণ্ড ভিড়। ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেক পরিবার এসেছে। ডার্সলি দম্পতি ডাডলি ও পায়ার্সের জন্য বড় সাইজের চকোলেট আইসক্রিম কিনে দিলেন। হ্যারিকে আড়াল করার আগেই যখন ভ্যানে বসা লাস্যময়ী মহিলা হ্যারির জন্য কি কেনা হবে জানতে চান, তখন একটি সস্তা লেমন আইস কিনে দেন। হ্যারি মনে মনে ভাবল, তাও মন্দ নয়।
দীর্ঘদিন পর হ্যারির একটা সুন্দর সকাল কাটল। ডাডলি এবং পিয়ার্স থেকে একটু ব্যবধান রেখেই হ্যারি হাঁটাহাঁটি করল। চিড়িয়াখানার রেস্তোরাঁয় তারা খাওয়া–দাওয়া সারল। দুপুরে খাবারের পর তারা সাপজাতীয় প্রাণীদের ঘর দেখতে গেল। ঘরটা ছিল খুব ঠান্ডা ও অন্ধকার। তবে দেয়ালের পাশের জানালাগুলোতে আলো জ্বালানো ছিল। ঘরে ছিল টিকটিকি, সাপ ও অনান্য সরীসৃপ। বিশাল আকারের বিষধর কোবরা, এমনকি মানুষকে পিষে মেরে ফেলতে পারে এমন মোটা একটি অজগর।
একটা বিশাল সাপ ঘুমিয়ে ছিল। ডাডলি ওর বাবাকে ফিস ফিস করে বলল–ওটাকে জাগাও।
আঙ্কল ভার্নন কাঁচে টোকা দিলেন, কিন্তু কোন কাজ হলো না। সাপটা একটুও নড়ল না। কিছুক্ষণ পর সাপটা মাথা তুলল। মনে হলো সাপটা হ্যারির দিকে তাকিয়ে আছে। হ্যারি সাপটাকে লক্ষ্য করল এবং আর কেউ সাপটাকে লক্ষ্য করছে কিনা এটাও দেখে নিল। না আর কেউ লক্ষ্য করছে
সাপটা তার মাখা আঙ্কল ভার্নন ও ডাডলির দিকে বাড়াল। চোখ তুলে ওপরের দিকে তাকাল। তারপর হ্যারির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলতে চাইল আমি তো সব সময় এরকমই ব্যবহার পেয়ে থাকি।
আমি তা জানি। হ্যারি বিড় বিড় করে বলল।
সাপটি জোরে জোরে মাথা নাড়াচ্ছে।
তুমি কোথা থেকে এসেছো?–হ্যারি জানতে চাইল।
সাপ লেজ দিয়ে কাঁচের গায়ের লেখা দেখাল–বোয়া কনসট্রিকটর, ব্রাজিল।
জায়গাটা কি বেশ ভালো? হ্যারি প্রশ্ন করল। সাপটা লেজ দিয়ে আবার গ্লাসের ওপর লেখা দেখাল। হ্যারি পড়তে পারল। এই সাপটাকে এই চিড়িয়াখানায় বড় করা হয়েছে।
হ্যারি বলল–তাহলে তুমি কখনও ব্রাজিল দেখনি? সাপ মাথা নেড়ে জানাল। সঙ্গে সঙ্গে হ্যারি সজোরে চিৎকার করে উঠল ডাডলি। মিস্টার ডার্সলি। শিগগির এদিকে এসো। অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা দেখে যাও।
সবাই দৌড়ে এলো। ডাডলি সুযোগ পেয়ে হ্যারির পাঁজরে একটি ঘুষি বসিয়ে দিল।
হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে কংক্রিটের মেঝেতে পড়ে গেল। এরপর যা ঘটল তা আরো আশ্চর্যজনক। ডাডলি এবং পায়ার্স যখন কাঁচের দিকে তাকাল তখন তারা উডয়ে ওরে বাপরে বলে মাটিতে ছিটকে পড়ল।
হ্যারি বসে হাপাতে লাগল। একটু পর হ্যারি তাকিয়ে দেখে কাঁচের খাঁচাটা নেই। সাপটা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সরীসৃপ ভবনে হৈচৈ ও শোরগোল পড়ে গেল। যে যেদিকে পারে ছুটতে লাগল। সাপটা যখন হ্যারির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন হ্যারি সাপের কণ্ঠে শুনল–আমি ব্রাজিল থেকে এসেছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
সরীসৃপ ভবনের কীপার স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
চিড়িয়াখানার পরিচালক আন্ট পেতুনিয়াকে এক কাপ মিষ্টি চা তৈরি করে খাওয়ালেন। তিনি বারবার তার কাছে মাফ চাইলেন।
সরীসৃপ ভবন থেকে পায়ার্সের বের হয়ে না আসা পর্যন্ত আঙ্কল ভের্নন অপেক্ষা করলেন।
সাপটা কারো কোন ক্ষতি করেনি। হ্যারির পায়ের পাশ দিয়ে সামনের দিকে চলে গেছে। কোন অঘটন ঘটেনি। তারা সবাই ভার্নন আঙ্কলের গাড়িতে উঠে পড়ল।
ডাডলি বলল–আরেকটু হলে সাপটা আমার পায়ে কামড় বসিয়ে দিত।
পায়ার্স বলল–আমাকে তো পাকে পাকে সাপটা জড়িয়ে ধরেছিল। আর সাপটা হ্যারির সাথে কথা বলেছিল। তাইনা হ্যারি?
আঙ্কল ভার্নন বারবার হ্যারির দিকে তাকালেন। তিনি হ্যারির ওপর খুবই অসন্তুষ্ট। রাগে আঙ্কল ভার্ননের মুখ থেকে কথা বেরুচ্ছিল না। তারপরও আদেশ দিলেন, যাও কাবার্ডে যাও… তোমার জন্য কোন খাবার নেই।
বাড়িতে ফিরে আঙ্কল ভার্নন একটি চেয়ারে এলিয়ে পড়লেন। আন্ট পেতুনিয়া ব্রান্ডি আনতে ছুটলেন।
হ্যারির ঠাঁই হলো অন্ধকার কাবার্ডে। সে ভাবছিল, তার যদি একটা ঘড়ি থাকত। ঘড়ি না থাকায় সে সময় জানতে পারল না। ডার্সলি পরিবারের সদস্যরা ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা এটা তো সে বুঝতে পারছিল না। তারা না ঘুমোলে সে রান্নাঘরে যাবার কথা ভাবতেও পারে না।
প্রায় দশ বছর হ্যারি ডার্সলি পরিবারের সাথে কাটিয়ে দিয়েছে। দশটা বছর খুব বিরক্তিকর ও কষ্টকর সময়। ছোটবেলার কথা, তার যতদূর মনে পড়ে, তার বাবা–মা যখন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তখনকার কথা। যে গাড়িতে ওর বাবা–মা দুর্ঘটনায় মারা যান, সেখানে সেও ছিল কিন্তু সে সময়ের কোন কথাই তার স্মরণ নেই।
কাবার্ডে যখন সে দীর্ঘক্ষণ তার অতীত স্মরণ করার চেষ্টা করছে, তখন এক আশ্চর্যজনক দৃশ্য দেখল। এক তীব্র সবুজ আলোক রশ্মি দেখে সে কপালের কাটা দাগে ব্যথা অনুভব করে। কপালের ব্যথা থেকে সে দুর্ঘটনার কথা মনে করতে পারে। কিন্তু সবুজ আলো? ওটা কোথা থেকে আসে? বাবা–মার কথা একেবারেই তার স্মরণে নেই। তার বাবা–মা সম্পর্কে কোন কথা হ্যারির আঙ্কল বা আন্ট তার সাথে বলতেন না। এসব ব্যাপারে প্রশ্ন করাও হ্যারির জন্য বারণ ছিল। এই বাসায় তার বাবা–মার কোন ছবিও নেই।
হ্যারির বয়স যখন আরো কম ছিল তখন সে প্রায়ই স্বপ্ন দেখত, একজন অচেনা আত্নীয় এসে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি। তার একমাত্র পরিচিত বলতে এই ডার্সলি পরিবার।
একবার আন্টের সাথে দোকানে কেনাকাটার সময় একজন লোক এসে হ্যারিকে জিজ্ঞেস করেছিল, সে তাকে চেনে কিনা। এ প্রশ্ন শুনে কোন কিছু না কিনেই আন্ট পেতুনিয়া দোকান থেকে বাইরে চলে এলেন।
একবার এক অচেনা মহিলা চলন্ত বাস থেকে হ্যারিকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিলো। মহিলার গায়ে সবুজ পোশাক। চেহারাটা একটু বুনো ধরনের। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো–হ্যারি যখনই তাদের সাথে কথা বলতে চাইতো তারা অদৃশ্য হয়ে যেত। স্কুলে হ্যারির কোন বন্ধু ছিল না। সবাই জানতো এই ঢোলা জামা ও ভাঙা চমশা–পরা হ্যারি পটারকে ডাডলি এবং তার দুষ্টু বন্ধুরা কেউই পছন্দ করে না।
কেউ হ্যারির সাথে মিশতো না, কারণ ডাডলিকে চটাবার মতো সাহস কারোরই ছিল না।
🔴 যে চিঠি কেউই লেখেনি
ব্রাজিলিয়ান বোয়া সাপটা বের হয়ে যাওয়ার কারণে হ্যারিকে দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে।
শাস্তিভোগের পর যখন সে কাবার্ড থেকে মুক্তি পেল তখন গরমের ছুটি চলছে। এরই মধ্যে ডাডলি তার নতুন সিনেমা ক্যামেরাটা ভেঙে ফেলেছে। নষ্ট করেছে রিমোট কন্ট্রোল এরোপ্লেন। তাছাড়া মিসেস ফিগ যখন ক্রাচে ভর করে প্রিভেট ড্রাইভের রাস্তা পার হচ্ছিলেন তখন ডাডলি তার রেইসিং সাইকেলে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দেয়।
স্কুল ছুটি থাকায় হ্যারির বেশ ভালো লাগছে। তবে ডাডলির সাঙ্গপাঙ্গদের অত্যাচার থেকে কোন মুক্তি নেই। তারা প্রতিদিন এই বাসায় বেড়াতে আসে। পায়ার্স, ডেনিস, ম্যালকম এবং গর্ডন এরা সবাই নির্বোধ। ডাডলি ছিল এই নির্বোধদের দলপতি। তাদের প্রধান খেলা ছিল হ্যারির ওপর নির্যাতন চালানো।
এই কারণে হ্যারি ইচ্ছে করেই বেশির ভাগ সময় বাসার বাইরে কাটাতো। এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াত। শিগগিরই ছুটি শেষ হয়ে যাবে। সেপ্টেম্বর মাসে হ্যারি সেকেন্ডারি স্কুলে যাবে। তখনই সে প্রথমবারের মতো ডাডলির হাত থেকে ছাড়া পাবে। ডাডলি ভর্তি হবে আঙ্কল ভার্ননের পুরনো স্কুলে। পায়ার্সও সেখানে ভর্তি হবে। হ্যারি ভর্তি হবে স্টোনওয়াল হাই-এ।
ডাডলি হ্যারিকে বললো–স্টোনওয়ালে কি হয় জানিস? প্রথমদিনই তোদের মাথা টয়লেটে ঢুকিয়ে রাখবে। একবার ওপর তলায় গিয়ে প্র্যাকটিস করে দেখ কেমন লাগে?
না, ধন্যবাদ। হ্যারি জবাব দিল। এই খারাপ টয়লেটে মাথা ঢোকাবার মতো নোংরা আর কিছু হতে পারে না। এই বলে হ্যারি দৌড়ে পালিয়ে গেল যাতে ডাডলি তাকে দিয়ে এ ধরনের প্র্যাকটিস না করাতে পারে।
জুলাই মাস। স্কুলের ইউনিফর্ম কেনার জন্য আন্ট পেতুনিয়া ডাডলিকে নিয়ে লন্ডন গেলেন। হ্যারিকে রেখে গেলেন মিসেস ফিগের কাছে। তার অবস্থা তখন এত খারাপ ছিল না। জানা গেল তিনি তার পোষা বিড়ালের একটাকে ডিঙোতে গিয়ে পড়ে গিয়ে এক পা ভেঙে ফেলেছেন। এর পর থেকে বিড়ালের প্রতি তার ভালোবাসার ঘাটতি পড়েছে। তিনি হ্যারিকে টিভি দেখতে দিলেন এবং বছরের পর বছর রেখে দেয়া কিছু বাসি চকোলেট কেকও খেতে দিলেন।
ওইদিন সন্ধ্যায় বসার ঘরে ডাডলি তার নতুন ইউনিফর্ম পরে হেঁটে দেখালো সবাইকে। স্মেলটিং স্কুলের মেরুন রঙের নিকার বোকার ইউনিফর্ম। হাতে একটা লাঠি। অপরকে পেটাবার জন্য। অবশ্যই শিক্ষকের দৃষ্টি এড়িয়ে। এটা পরবর্তী জীবনের জন্য ভাল ট্রেনিং বলে মনে করা হয়।
আঙ্কল ভার্নন ডাডলিকে নতুন ইউনিফর্মে দেখে খুব খুশি। তিনি খুশি হয়ে বললেন–আজ আমার জীবনে একটি পরম গর্বের দিন।
ডাডলিকে দেখে আন্টের চোখে আনন্দাশ্রু। তিনি বললেন–আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, ডাডলি এত বড় হয়ে গেছে। এসব কথায় হ্যারির হাসি পাচ্ছিল। সে বহুকষ্টে হাসি চেপে রাখলো।
পরদিন সকালে হ্যারি নাশতার জন্য রান্নাঘরে গেলে একটা বিশ্রী গন্ধ পেল। রান্নাঘরটা ছিল বড়সড়। সেখানেই খাবার টেবিল। মনে হচ্ছে ওখানে রাখা একটা বড় গামলা থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। হ্যারি উঁকি দিয়ে দেখল যে বড় গামলায় ময়লা কাপড় পানিতে ভেজানো।
সে আন্ট পেতুনিয়াকে জিজ্ঞেস করল-এগুলো কি?
আন্ট ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিরেট কণ্ঠে বললেন-এগুলো তোমার স্কুলের ইউনিফর্ম।
হ্যারি মন্তব্য করল–আমি বুঝতে পারিনি যে এগুলো এত ভেজা হবে।
আন্ট বললেন–বোকার মতো কথা বলো না। আমি তোমার জন্য ডাডলির কিছু পুরনো কাপড় রঙ করে দিয়েছি। শেষ হলে দেখবে তোমাকে ঠিকই মানাচ্ছে।
হ্যারির মনে সন্দেহ দেখা দিলেও সে কোন প্রশ্ন করল না। ওই পোশাকে স্টোনওয়াল স্কুলে তাকে প্রথম দিন কেমন দেখাবে। তাকে দেখে মনে হবে সে হাতির চামড়ার পোশাক পরেছে।
ডাডলি এবং আঙ্কল ভার্নন ঘরে ঢুকে নাক কুঁচকালেন–কারণ হ্যারির ইউনিফর্ম থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। আঙ্কল ভার্নন পত্রিকার পাতা খুললেন আর ডাডলি লাঠি দিয়ে টেবিল পেটাতে লাগল।
বাইরে ডাকবাক্সে পড়ার শব্দ শোনা গেল।
আঙ্কল ভার্নন বললেন–ডাডলি যাও তো, চিঠিগুলো নিয়ে এসো।
হ্যারি যাক না। ডাডলি বলল।
হ্যারি, যাও তো চিঠিগুলো নিয়ে এসো আঙ্কল ভার্নন বললেন।
ডাডলি, ওকে লাঠি দিয়ে খোঁচা মারো তো। আঙ্কল ভার্নন বললেন।
লাঠি তোলার আগেই হ্যারি উঠে ডাক বাক্সের দিকে রওনা দিলো।
হ্যারি গিয়ে দেখল পাপোসের ওপর তিনটা চিঠি পড়ে আছে। একটা পোস্টকার্ড এসেছে আঙ্কল ভার্ননের বোন মার্জের কাছ থেকে। তিনি আইলসঅউইটে ছুটি কাটাচ্ছেন। দ্বিতীয় চিঠি একটি বাদামী খামের ভেতর। কোন বিল থাকতে পারে এতে। তৃতীয় চিঠিতে লেখা–হ্যারির জন্য চিঠি, নিজের চিঠিটি হ্যারি হাতে তুলে নিল। তার বুক ধড়পড় করতে লাগল। তাকে তো এ পর্যন্ত কেউ চিঠি লেখেনি। তার কোন বন্ধু–বান্ধব বা আত্নীয়স্বজনও নেই। তাহলে কে লিখতে পারে? চিঠির খামে হ্যারির নাম লেখা। চিঠি যে হ্যারিকে লেখা এ ব্যাপারে তো কোন সন্দেহ নেই।
মি. এইচ. পটার
সিঁড়ির নিচের কাবার্ড
৪, প্রিভেট ড্রাইভ
লিটল হুইংগিং
সারে
চামড়ার মতো শক্ত হলুদ খামে সবুজ অক্ষরে লেখা ঠিকানাটা। ওপরে কোন ডাকটিকেট নেই। হ্যারি খামটা উল্টেপাল্টে দেখল। তার বুক কাঁপছিল। হ্যারি দেখল, খামের ওপর কতগুলো রঙিন ছাপ–সিংহ, ঈগল আর সাপের। চারদিকে বড় অক্ষরে ইংরেজি এইচ লেখা আছে।
রান্নাঘর থেকে আঙ্কল ভার্নন চিৎকার করলেন হ্যারি, জলদি এসো। ওখানে তুমি কী করছ। তুমি কি পত্ৰবোমা পরীক্ষা করছ?
নিজের রসিকতায় আঙ্কল ভার্নন নিজেই হাসলেন।
হ্যারি রান্নাঘরে আঙ্কল ভার্ননের হাতে দুটো চিঠি দিল। তারপর তার নিজের চিঠি খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আঙ্কল ভার্নন চিঠিটা খুলে দেখলেন এবং বিরক্তির সাথে পোস্টকার্ডটি দেখলেন। আন্ট পেতুনিয়াকে বললেন, শুনছ, মার্জ নাকি অসুস্থ। কী এক ঝামেলা।
ঠিক এই সময় ডাডলি দৌড়ে এসে বলল–বাবা, হ্যারি যেন কিছু পেয়েছে।
হ্যারি চিঠিটার ভাঁজ খুলতে যাচ্ছিল। এই চিঠিটার কাগজটিও খামের মত শক্ত। চিঠি খোলার আগেই আঙ্কল ভার্নন এসে হ্যারির হাত থেকে চিঠিটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন।
এ চিঠি তো আমার। এই বলে হ্যারি চিঠি ফেরত নেয়ার চেষ্টা করল।
তোমাকে আবার কে চিঠি লিখবে। আঙ্কল ভার্নন ঠাট্টা করে বললেন। হাতে ধরা চিঠিটা তিনি বার বার পরখ করে দেখলেন। তারপর পড়তে শুরু করলেন। তার মুখের রঙ ট্রাফিক লাইটের মতো বদলাতে লাগল। লাল থেকে সবুজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুখের রঙ হয়ে গেল ধূসর শাদা। অনেকটা পুরনো পরিজের মতো।
তিনি চিৎকার করে উঠলেন–পে–পে–পে–তুনিয়া।
ডাডলি চিঠিটা পড়ার জন্য হাতে নেয়ার চেষ্টা করল। নাগালের বাইরে থাকায় সে ধরতে পারল না। আন্ট পেতুনিয়া চিঠিটা পড়লেন। প্রথম লাইন পড়েই তার ভিরমি খাবার জোগাড়। তিনি চিৎকার করে উঠলেন–ভার্নন, ওহ মাই গুডনেস, ভার্নন?
আঙ্কল ভার্নন ও আন্ট পেতুনিয়া পরস্পরের দিকে তাকালেন। ঘরে যে ডাডলি আছে তা তারা ভুলেই গেলেন। তবে ডাডলি এ পরিবারে কখনোই অবহেলিত নয়। সে তার লাঠি দিয়ে তাঁর বাবার মাথায় মৃদু টোকা দিল। তারপর চিৎকার করে বলল–আমি চিঠিটা পড়তে চাই।
হ্যারি বলল–আমি চিঠিটা পড়তে চাই। কারণ আমাকে লেখা।
তোমরা দুজনই ঘর থেকে বেরোও। আঙ্কল ভার্নন ডাডলি ও হ্যারিকে ধমক দিলেন। অবশেষে হ্যারি আর ডাডলিকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়ার পর তিনি নিজেই দড়াম করে রান্নাঘরের দরোজাটা বন্ধ করে দিলেন।
আন্ট পেতুনিয়া বললেন–ভার্নন দেখো তো, চিঠিতে কি ঠিকানা লেখা আছে। হ্যারি কোথায় ঘুমায় এটা তারা জানল কী করে? তোমার কি মনে হয় না, তারা আমাদের বাসার ওপর নজরদারি করছে?
নজরদারি?…তার মানে গোয়েন্দাগিরি। তুমি বলতে চাইছ কেউ আমাদের অনুসরণ করছে।
তাহলে আমরা কী করব ভার্নন? আমরা কী লিখে দেব–আমরা এ ধরনের কিছু আশা করিনা।
আঙ্কল ভার্নন বললেন–আমরা বিষয়টা আমলে আনব না। ওরা যাতে কোন উত্তর না পায়, সেটাই ভালো হবে।
কিন্তু….
আমি ঘরে এসব ঘটতে দেব না, পেতুনিয়া। আঙ্কল ভার্নন বললেন আমরা যখন ওকে ঘরে এনেছিলাম তখনই কি আমরা সিদ্ধান্ত নিইনি–তার মগজে যা কিছু খারাপ আছে সব ঝেটিয়ে বিদেয় করব!
ওইদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে আঙ্কল ভার্নন এমন এক কাজ করলেন যা তিনি জীবনেও করেননি। তিনি কাবার্ডে হ্যারিকে দেখতে গেলেন।
হ্যারি তাকে প্রশ্ন করল, আমার চিঠি কোথায়? কে আমাকে চিঠি লিখেছে?
আঙ্কল ভার্নন বললেন–ভুল করে খামে তোমার ঠিকানা লেখা হয়েছিল। আমি সেই চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলেছি।
খামে ভুল ঠিকানা লেখা হয়নি। হ্যারি দৃঢ়তার সাথে বলল-এমনকি ওখানে আমার কাবার্ডের ঠিকানাও ছিল।
চুপ। আর কোন কথা নয়। আঙ্কল ভার্নন ভীষণ জোরে ধমক দিলেন। তার ধমকের শব্দে সিলিং থেকে কয়েকটি মাকড়সা নিচে পড়ে গেল।
ধমকের পর পরিবেশ সহজ করার জন্য তিনি হাসার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার চেহারার কাঠিন্য কিছুতেই দূর হলো না।
হ্যাঁ, হ্যারি। আঙ্কল ভার্নন বললেন–আমি আর তোমার আন্ট ভাবছিলাম–যেহেতু তুমি বড় হয়েছে সেহেতু তোমাকে আর কাবার্ডে রাখা হবে না। তুমি ডাডলির দ্বিতীয় শোবার ঘরে চলে যাও।
কেন? হ্যারি প্রশ্ন করে বসল।
কোন প্রশ্ন করা যাবে না। আঙ্কল কড়া ভাষায় বললেন–তোমার মালামাল ওপরে নিয়ে যাও।
ডার্সলি পরিবার যে বাড়িতে থাকে সেখানে চারটা কক্ষ। একটায় থাকেন আঙ্কল আর আন্ট, দ্বিতীয় কক্ষটি অতিথিদের জন্য পৃথক করে রাখা হয়েছে, আরেকটাতে থাকে ডাডলি। সর্বশেষ ঘরটা সব থেকে ছোট, এখানে ডাডলির সব খেলনার জিনিসে ভরা। ডাডলির শয়নকক্ষে এগুলোর স্থান সংকুলান হয় না।
অন্যদিকে হ্যারির জিনিসপত্র এত কম যে কাবার্ড থেকে মালামাল নিয়ে সে একবারেই উপরে উঠে গেল।
হ্যারি বিছানায় বসে চারদিকে তাকাল। ঘরের প্রায় সব জিনিসই ভাঙা।
মাত্র এক মাসের পুরনো সিনেমা ক্যামেরাটি ভাঙা, ভাঙা টেলিভিশনও, এছাড়া আছে পাখির একটি বড় খাঁচা, যেটায় কাকাতুয়া থাকত। এছাড়াও আছে ভাঙা এয়ারগান। র্যাকগুলোতে অসংখ্য বই। বই গুলো দেখেই বোঝা যায় যে এখনও কেউ স্পর্শ করেনি। নিচ থেকে ডাডলির বিরক্তির কথা শোনা যাচ্ছিল মা, আমি চাই না সে ওই ঘরে থাকুক। সে এখানে থাকতে পারবে না। ঘরটা আমার, ঘরটা আমার লাগবে।
হ্যারি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আর ভাবতে লাগল, গতকাল হলেও ওপরতলার ঘরে আসার জন্য হ্যারি সম্ভব সব ধরনের চেষ্টাই চালাত। আর আজ তার কাছে কাবার্ডই বেশি গ্রহণযোগ্য। কারণ কাবার্ডের ঠিকানাতেই তার চিঠিটা এসেছে।
***
পরদিন সকালে সবাইকে শান্ত দেখা গেল। কিন্তু ডাডলির রাগ আর ছটফটানি দেখে কে? সে বাবাকে লাঠি দিয়ে বাড়ি দিল। মাকে লাথি মারল। তার ছোট খরগোশটা ছুঁড়ে ফেলল। হ্যারি ঘর ছাড়েনি। আঙ্কল আর আন্ট গম্ভীর মুখে পরস্পরের দিকে তাকালেন।
পরদিন যখন ডাকপিয়ন এলো তখন আঙ্কল ভার্নন হ্যারিকে নয়, নরম স্বরে ডাডলিকে বললেন–বাবা যাও তো! চিঠিগুলো নিয়ে এসো। ডাডলি তার লৌহদণ্ডে দুম দাম শব্দ করতে করতে হল ঘর পার হয়ে চিঠি আনতে দরোজার দিকে গেল।
সেখান থেকেই ডাডলি চিৎকার করে উঠল, আবার একটা চিঠি এসেছে। ঠিকানা লেখা আছে–
মি, এইচ পটার
স্মলেস্ট বেডরুম
৪ প্রিভেট ড্রাইভ
আর্তনাদ করে উঠলেন আঙ্কল ভার্নন এবং চেয়ার থেকে উঠে হল রুমের দিকে ছুটলেন। হ্যারি তার পেছনে পেছনে ছুটলো। চিঠিটা হাতে নেয়ার জন্য ডাডলিকে মাটিতে ফেলে দিলেন ভার্নন। এদিকে হ্যারি পেছন থেকে তার গলা ধরে ঝুলে পড়ার কারণে চিঠিগুলো ডাডলির কাছ থেকে কেড়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছিল। প্রত্যেকের গায়েই লোহার রডটা আঘাত করেছে। একটা বিভ্রান্তিকর এলোমেলো পরিস্থিতির পর পর–আঙ্কল ভার্নন সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, দীর্ঘশ্বাস নিলেন এবং হ্যারিকে লেখা চিঠিখানা খামচে ধরলেন।
আঙ্কল ভার্নন নির্দেশ দিলেন–হ্যারি তোমার কাবার্ডে… মানে তোমার শোবার ঘরে যাও…. আর ডাডলি তুমিও এখান থেকে ভাগো।
হ্যারি তার নতুন শোবার ঘরের বাইরে পায়চারি করতে লাগল। হ্যারি নিশ্চিত হল–তাকে যিনি চিঠি দিয়েছেন তিনি জেনেছেন হ্যারির ঘর বদল হয়েছে এবং হ্যারি আগের চিঠিটা পায়নি। তিনি নিশ্চয়ই আবার চিঠি লিখবেন। এবার তাকে চিঠিটা পেতেই হবে। হ্যারি একটা পরিকল্পনার কথা ভাবতে লাগল। সে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখল।
পরদিন সকাল ৬টায় ভাঙা ঘড়িতে অ্যালার্ম বেজে উঠল। ভোরের আলো তখনও ঘরে প্রবেশ করেনি। হ্যারি অ্যালার্ম বন্ধ করে চুপি চুপি জামা পরে নিল। ডার্সলি পরিবারের কাউকেই সে জাগাবে না। কোন বাতি না জ্বালিয়ে অন্ধকারে সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল। হল ঘর পার হয়ে সে দরোজার কাছে গেল। তার ইচ্ছে ছিল প্রিভেট ড্রাইভের কোনায় দাঁড়ানো যাতে ডাক পিয়ন আসা মাত্রই সে চিঠি তার হাতে নিতে পারে! দরোজার কাছাকাছি পা দিতেই…
হঠাৎ আ–র–র–র—
হ্যারি লাফ দিয়ে উঠল। আরে পাপোসের ওপরে কি যেন! আরে এ যে জীবন্ত প্রাণী।
হ্যারির মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেল। এ কী, এ যে আঙ্কল ভার্নন। তিনি দরোজার গোড়ায় একটি স্লিপিং ব্যাগে ঘুমিয়ে আছেন। হ্যারি এমন কিছু একটা করবে তার মনে আগেই সন্দেহ হয়েছিল। আঙ্কল ভার্নন স্লিপিং ব্যাগ থেকে বের হয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা হ্যারিকে বকাঝকা করলেন। তারপর হুকুম দিলেন চা বানাবার জন্য। হ্যারিকে রান্নাঘরে ঢুকতে হল। চা নিয়ে এসেই হ্যারি দেখে যে ডাকপিয়ন এসে গেছে এবং চিঠিগুলো আঙ্কল ভার্ননের কোলে। হ্যারি লক্ষ্য করল তিনটা চিঠিই সবুজ কালি দিয়ে লেখা।
হ্যারি বলল–আমার চিঠি কোথায়?
এর মধ্যে আঙ্কল ভার্নন সব চিঠির খাম খুলে ফেলেছেন।
তোমাকে আবার কে চিঠি লিখবে? আঙ্কল ভার্নন প্রশ্ন করলেন। তোমাকে কেউই চিঠি লিখবে না। আঙ্কল ভার্নন আবার বললেন–ওই চিঠিতে ভুল করে তোমার নাম লেখা হয়েছিল।
আমার চিঠি কোথায়? হ্যারি প্রশ্ন করল। প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আঙ্কল ভার্নন হ্যারির সামনেই সবগুলো চিঠি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললেন।
তিনি সেদিন আর অফিসে গেলেন না। সারাদিন বাসায় কাটালেন। ডাকবাক্সটাতে এমনভাবে পেরেক ঠুকে দিলেন যাতে এখানে কেউ চিঠি ফেলতে না পারে।
ভালোই হলো। আন্ট পেতুনিয়া মন্তব্য করলেন-এখন তারা আর চিঠি দিতে পারবে না। চিঠি দিতে হলে তাদেরকে ওপরে উঠতে হবে।
আঙ্কল ভার্নন ততটা আশ্বস্ত হতে পারলেন না। তিনি বললেন-এসব লোক আমাদের মত নয়। সব সময়ই এরা নতুন নতুন ফন্দি–ফিকির বের করতে জানে।
***
শুক্রবারে হ্যারির নামে কম করে হলেও বারোটা চিঠি এলো।
ডাকবাক্সে ফেলা সম্ভব হয়নি বলে চিঠিগুলি এবার দরোজার নিচের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু কিছু চিঠি বাথরুমের জানালা দিয়েও ভেতরে ফেলা হয়েছে। আঙ্কল ভার্নন এদিনও অফিসে গেলেন না। বাসাতেই কাটালেন। তিনি হাতুড়ি, পেরেক আর ছোট ছোট কাঠের টুকরো দিয়ে দরোজা ও জানালার সবগুলো ফাঁক বন্ধ করলেন।
শনিবারে আরো বড়ো অঘটন ঘটল। হ্যারির নামে চব্বিশটা চিঠি এলো। চিঠিগুলো দুডজন ডিমের বাক্সের ভেতর পাঠানো হয়েছিল। ডেইরির লোকেরা কিছু বুঝতে না পেরেই শয়নকক্ষের জানালা দিয়ে ডিমগুলোর সাথে চিঠিগুলো আন্ট পেতুনিয়ার কাছে দিয়েছিল। ক্ষিপ্ত হয়ে আঙ্কল ভার্নন ডাকঘর আর ডেইরিতে বার বার ফোন করলেন। আর আন্ট পেতুনিয়া চিঠিগুলো টুকরো টুকরো করে ফুড মিক্সচারে দিয়ে নষ্ট করে ফেললেন।
ডাডলি বিস্ময়ের সাথে হ্যারিকে প্রশ্ন করল–তোমার সাথে কথা বলার জন্য কে এমন উতলা হল?
***
রোববার সকালে আঙ্কল ভার্নন নাশতার টেবিলে বসলেন। তিনি পরিশ্রান্ত। তবে তাকে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছিল।
তিনি বললেন–আজ রোববার, ছুটির দিন। আজ আর কোন চিঠি আসবে না।
কিন্তু হঠাৎ রান্নাঘরের চিমনিতে শব্দ শোনা গেল। কিছু যেন গড় গড় করে চিমনি বেয়ে নিচে পড়ছে। তিনি যা দেখলেন তাতে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। উনুনের চিমনি দিয়ে তিরিশ চল্লিশটা চিঠি বুলেটের মত বেরিয়ে এল। ডার্সলি পরিবারের সবাই অবাক। আর চিঠিগুলো ধরার জন্য হ্যারি লাফ দিল।
বের হও! এখান থেকে বের হও!
আঙ্কল ভার্নন হ্যারির কোমর জড়িয়ে ধরে উঁচু করে তাকে রান্নাঘর থেকে হল ঘরে ছুঁড়ে ফেললেন। আন্ট পেতুনিয়া আর ডাডলি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বাইরে চলে গেল। আঙ্কল ভার্নন দড়াম করে দরোজা বন্ধ করে দিলেন। চিঠিগুলো দেয়াল এবং মেঝেতে এসে পড়েছে-এ শব্দ তাদের কানে আসছিল। রাগে ক্ষোভে টান দিয়ে গোঁফ ছিঁড়তে ছিঁড়তে আঙ্কল ভার্নন বললেন–তোমাদেরকে পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে তোমরা তোমাদের গুটি কয়েক জামা–কাপড় নিয়ে নিচে নেমে আসবে। আমরা এখান থেকে চলে যাব। এই বিষয়ে আর কোন কথা নয়।
আঙ্কল ভার্ননের অর্ধেক গোঁফ উড়ে যাওয়ায় তাকে খুবই ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। তাই কেউ তাকে কোন প্রশ্ন করতে সাহস করল না। সবাই গিয়ে গাড়িতে বসল। ডাডলি পেছনে বসে ফুঁসছিলো। কারণ সে তার টেলিভিশন, ভিডিও আর কম্পিউটার সাথে নেয়ার জন্য প্যাক করছিলো। আঙ্কল ভার্নন তার মাথার চারদিক চেপে তাকে জোর করে উঠিয়ে দেন।
গাড়ি চলছে তো চলছেই। আন্ট পেতুনিয়ারও সাহস হলো না প্রশ্ন করে, গাড়ি কোথায় যাচ্ছে। আঙ্কল ভার্নন একটু পর পরই ডানদিকে বামদিকে কঠিন মোড় নিয়ে গাড়ি চালাতে লাগলেন।
খাওয়া–দাওয়ার জন্যও গাড়ি কোথাও থামল না। সন্ধ্যা হতেই ডাডলির বিলাপ শোনা যেতে লাগল। তার জীবনে কোন দিন এত খারাপ যায়নি। সে খুবই ক্ষুধার্ত। সে টেলিভিশনের পাঁচটা প্রোগ্রাম মিস করেছে যা সে দেখতে চেয়েছিল। তাকে এত খেসারত দিতে হবে জানলে সে গাড়িতেই উঠত না। অবশেষে আঙ্কল ভার্নন এক শহরতলীতে এসে একটা হোটেলের সামনে তার গাড়ি থামালেন। একটা ঘরে দুটো নোংরা বিছানায় হ্যারি আর ডাডলিকে খাকতে হল। ডাডলি বিছানায় পড়েই নাক ডাকা শুরু করল। হ্যারির চোখে কোন ঘুম নেই। হ্যারি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চলন্ত গাড়িগুলোর আলোর দিকে তাকিয়ে রইল।
পরদিন সকালের নাশতায় তারা খেলো বাসি কর্নফ্লেক ও টোস্টের সাথে টিনের টমেটো। নাশতা খাবার পর পরই হোটেলের মালিক তাদের টেবিলে এলেন।
তিনি বললেন-এক্সকিউস মি, আপনাদের মধ্যে হ্যারি পটার কে? তাঁর নামে ফ্রন্ট ডেসকে একশ চিঠি এসেছে।
হোটেলের মালিক ভদ্রমহিলা একটা চিঠি তাদের সামনে তুলে ধরলেন। সবুজ কালিতে লেখা–
মি. এইচ. পটার
কক্ষ নং–১৭
রেইলভিউ হোটেল
ককওয়ার্থ
চিঠিটা নেবার জন্য হ্যারি হাত বাড়াল। হ্যারির হাতটি আঙ্কল ভার্নন সরিয়ে দিলেন। হোটেলের মালিক ভদ্রমহিলা বিস্মিত হলেন। আঙ্কল ভার্নন উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলাকে বললেন–চলুন। আমি চিঠিগুলো নেব।
***
কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চলার পর আন্ট পেতুনিয়া ভয়ে ভয়ে বললেন–ঘরে ফিরে গেলে কি ভালো হত না?
কিন্তু আঙ্কল ভার্নন তার কথায় কান দিলেন না। তিনি যে ঠিক কী চাইছেন তা অন্য কেউ জানে না। তিনি গাড়ি চালিয়ে একটি গভীর বনে প্রবেশ করলেন। গাড়ি থেকে নামলেন। চারদিকে তাকালেন। মাথা নাড়লেন। আবার গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলেন। এ রকম ঘটনা আরো একাধিকবার ঘটল।
ডাডলি বলে উঠল–বাবার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
সমুদ্র উপকূলের কাছে এসে আঙ্কল ভার্নন গাড়ি পার্ক করলেন। সবাইকে গাড়ির ভেতর বসিয়ে রেখে কোথায় যেন গেলেন। বাইরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। গাড়ির ছাদেও বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল।
ডাডলি তার মাকে বলল–আজ সোমবার। আজ রাতে টিভিতে দ্য গ্রেট হামবেটেসি আছে। আমি যদি টিভি আছে এমন স্থানে থাকতে পারতাম।
সোমবার হ্যারিকে কষ্ট করে মনে করতে হয় না, আজকে কি বার। কোনদিন সোমবার তা জানার জন্য ডাডলির ওপর নির্ভর করা যায়, কারণ সোমবারের টিভির প্রিয় এই প্রোগ্রামের জন্য দিন গুনতে থাকে সে। আগামীকাল মঙ্গলবার। আগামীকাল হ্যারির একাদশ জন্মদিন। অবশ্য এ বাড়িতে হ্যারির জন্মদিনের কোন গুরুত্ত্ব নেই। গত জন্মদিনে সে ডার্সলি পরিবার থেকে পেয়েছিল একটি কোট হ্যাঙার এবং আঙ্কল ভার্ননের এক জোড়া পুরনো মোজা। প্রতিদিনই তো বয়স এগারো থাকে না।
আঙ্কল ভার্নন ফিরে এলেন। মুখে ঈষৎ হাসি। হাতে লম্বা ও সরু একটা প্যাকেট।
কী কিনেছো? আন্ট পেতুনিয়া জানতে চাইলেন। তিনি এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন–চমৎকার একটা জায়গা পেয়েছি। সবাই গাড়ি থেকে নামো।
গাড়ির বাইরে খুব ঠাণ্ডা। আঙ্কল ভার্নন যে জায়গাটা দেখালেন সেটা একটা শিলাময় ছোট দ্বীপ। এর মাঝখানে পুরনো একটা ছোট বাড়ি। এ বাড়িতে যে কোন টেলিভিশন নেই–তা হলফ করেই বলা যায়।
আঙ্কল ভার্নন বললেন–আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে যে আজ রাতে ঝড় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। দ্বীপটাতে যাবার জন্য এই ভদ্রলোক আমাদেরকে তার নৌকাটা ধার দিয়েছেন।
ফোকলা মুখের এক বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে একটা নৌকা দেখিয়ে তাদের সেদিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তার মুখে কপট হাসি।
আমার কাছে এখনো কিছু খাবার আছে। সবাই নৌকায় ওঠো। আঙ্কল ভার্ননের নির্দেশ।
নৌকাতে হিমেল হাওয়া। সাথে বৃষ্টি। সবাই ঠাণ্ডায় অস্থির। মনে হলো কয়েক ঘণ্টা যাত্রার পর তারা দ্বীপে পৌঁছল। আঙ্কল ভার্নন তাদেরকে একটি ভাঙা বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
বাড়ির ভেতরটা ছিল আরো ভয়ঙ্কর। ঘরের ভেতরে সামুদ্রিক আগাছার গন্ধ। ফায়ার প্রেস স্যাঁতসেঁতে, কাঠের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে সমুদ্রের বাতাসের শো শো শব্দ। বাড়িতে মাত্র দুটো কক্ষ।
আঙ্কল ভার্ননের খাবার ভাণ্ডারে যা ছিল তা হল মাত্র এক প্যাকেট মচমচে বিস্কুট ও এক হালি কলা।
তিনি ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেখানে কোন কাঠ নেই, একেবারেই খালি।
আঙ্কল ভার্নন আনন্দের সাথে মন্তব্য করলেন–যাক, এখানে কোন চিঠি আসবে না। তিনি নিশ্চিত যে এই ঝড়ের রাতে কেউ তাদের কাছে আসতে পারবে না। রাত নামলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস মোতাবেক ঝড় শুরু হলো। সমুদ্রের তরঙ্গ দেয়ালে ছিটকে পড়ছে। বাইরের ঝড়ো বাতাস জরাজীর্ণ ও নোংরা জানালায় আঘাত করছে।
আন্ট পেতুনিয়া একটা পোকায়–কাটা সোফার ওপর কম্বল বিছিয়ে ডাডলির শোয়ার ব্যবস্থা করলেন। আঙ্কল ভার্নন ও আন্ট পেতুনিয়া পাশের কক্ষে চলে গেলেন। হ্যারি মেঝের ওপর একটা ছেঁড়া পাতলা কম্বল বিছিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। রাত বাড়ার সাথে সাথে ঝড়ের বেগও বাড়তে লাগল। হ্যারি ঘুমোতে পারল না। একটু আরাম পাবার জন্য এপিঠ–ওপিঠ করছে। পেট খিদেয় চো চো করছে। অপরদিকে ডাডলি নিশ্চিন্তে নাক ডাকছে। তার হাতঘড়ির আলো একটু পর পর ঠিকরে পড়ছে। অন্ধকারে ঘড়ির আলো থেকে হ্যারি বুঝতে পারল আর দশ মিনিটের ভেতর তার বয়স এগারো পূর্ণ হবে। ডাডলি ভাবছিল পত্রলেখক এখন কোথায়।
পাঁচ মিনিট পর হ্যারি বাইরে যেন কিসের আওয়াজ শুনল। তার ভয় হচ্ছিল–ছাদ মাথার ওপর ভেঙে পড়বে না তো? ছাদ ভেঙে পড়লে সে অবশ্য আরো বেশি উষ্ণতা উপভোগ করতে পারত।
আর চার মিনিট বাকি–হয়তো বা প্রিভেট ড্রাইভে এত চিঠি আসবে যে সারা বাড়ি চিঠিতে ভরে যাবে। সেখান থেকে যেভাবেই হোক অন্ততঃ একটা চিঠি চুরি করতে হবে। তিন মিনিট বাকি।
সমুদ্রের ঢেউ কি এ বাড়ির ওপর আছড়ে পড়ছে।
এখনও দু মিনিট বাকি।
অদ্ভুত শব্দ। সাগরে শিলাখণ্ড টুকরো টুকরো হয়ে সাগরে মিলিয়ে যাচ্ছে?
আর একটা মিনিট।… তিরিশ সেকেন্ড… কুড়ি সেকেন্ড…. দশ,.. নয়… বিরক্ত করার জন্য হলেও ডাডলিকে জাগাবে কি?
তিন… দুই… এক… বুম। বুম।
হঠাৎ বিকট আওয়াজ।
গোটা দ্বীপটা কেঁপে উঠল, হ্যারির দরোজায় কে যেন খুব জোরে জোরে কড়া নাড়ছে। কে যেন ভেতরে আসতে চায়।
দ্বিতীয় পর্ব
হ্যারি পটার সিরিজের থেকে
#হ্যারি_পটার_এন্ড_দি_ফিলসফারস স্টোন - জে. কে. রাওলিং
🔴 চাবির রক্ষক
বুম। বুম। দরোজায় আবার ধাক্কার শব্দ। ডাডলি লাফ দিয়ে জেগে উঠল।
কামানের শব্দ? সে বোকার মত প্রশ্ন করল।
তাদের পেছনে একটি বিকট শব্দ শোনা গেল। আঙ্কল ভার্নন ভয়ে বিবর্ণ হয়ে ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে একটি রাইফেল। এখন তারা বুঝতে পারল তিনি সরু লম্বা প্যাকেটে কি এনেছিলেন।
কে ওখানে? আঙ্কল ভার্নন চিৎকার করে উঠলেন–সাবধান, আমার হাতে অস্ত্র আছে
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর আবার…
ধ পা স
দরোজায় এমন জোরে ধাক্কা লাগল যে কান–ফাটানো আওয়াজে দরোজার সব পাল্লা মাটিতে পড়ে গেল। দরোজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে এক অতিকায় মানুষ–দৈত্য বললেও ভুল হবে না। চুল–দাঁড়িতে মুখ প্রায় ঢাকা। জ্বলজ্বলে চোখ। তার মাথা গিয়ে ঠেকেছে ঘরের ছাদ পর্যন্ত। মাথা নত করে পিঠ বাঁকিয়ে কুঁজো হয়ে দৈত্যটা ঘরে ঢুকে গেলেন। সে মাথা নিচু করে দরোজাটি হাতে তুলে নিলেন এবং জায়গামতো বসিয়ে দিল। বাইরে ঝড়ের গর্জন কিছুটা কমল। দৈত্যটা সবার দিকে তাকাল।
আমাকে কি এক কাপ চা বানিয়ে দেয়া যায়? পথে যা ধকল সহ্য করেছি।
তারপর সে সোফার দিকে এগিয়ে গেল যেখানে ডাডলি ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে।
দৈত্য বলল-এই মটু উঠে দাঁড়া।
ডাডলি ভয়ে জড়সড় হয়ে মাকে আড়াল করে লুকোবার জন্য ছুটল। আঙ্কল ভার্ননের পেছনে তিনিও ভয়ে কাঁপছিলেন।
আরে এইতো হ্যারি। দৈত্য হ্যারিকে দেখে বলল। হ্যারি দৈত্যাকার লোকটার দিকে তাকাল। লোকটার মুখে স্মিত হাসি।
দৈত্যাকার লোকটা হ্যারিকে বলল–আমি তোমাকে প্রথম যখন দেখি তখন তুমি মাত্র একটি ছোট্ট শিশু। তোমাকে ঠিক তোমার বাবার মত দেখাচ্ছে। অবশ্য তোমার চোখ দুটো তোমার মায়ের মতো।
আঙ্কল ভার্ননের গলায় ঘাড় ঘ্যাঙ শব্দ।
তিনি বললেন–তুমি এক্ষুণি এখান থেকে চলে যাও। এটা আমার হুকুম। তুমি দরোজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছো।
চুপ করো, নির্বোধ–দৈত্য দাপটের সাথে ধমক দিল। সে সোফার পেছনে গিয়ে আঙ্কল ভার্ননের হাত থেকে রাইফেলটি নিয়ে নিল। রাইফেলটাকে বাঁকিয়ে ঘরের এক কোণে ছুঁড়ে ফেলল। এত সহজে যেন রাবারের তৈরি কোন জিনিস দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিল। আঙ্কল ভার্নন মৃদুকণ্ঠে কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু অদ্ভুত কিছু শব্দ করা ছাড়া তার গলা দিয়ে কথা বেরুল না।
দৈত্য হ্যারিকে উদ্দেশ্য করে বলল–হ্যারি, যাহোক, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।
এর পর দৈত্যটা তার জামার পকেট থেকে একটা বাক্স বের করে হ্যারিকে দিল। হ্যারি কাঁপা কাঁপা হাতে বাক্সটা খুলল। একটা বড়ো চকোলেট কেক। কেকের ওপর সবুজ রঙের আইসক্রিম দিয়ে লেখা হ্যাপি বার্থ–ডে হ্যারি।
হ্যারি দৈত্যের দিকে তাকিয়ে বলতে চাইছিল–তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু তার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো–কে তুমি?
দৈত্যটা প্রথম একটু আমতা আমতা করল। তারপর বলল–আমারই ভুল হয়ে গেছে। প্রথমেই আমার পরিচয় দেয়া উচিত ছিল। আমার নাম রুবিয়াস হ্যাগ্রিড। আমি হোগার্টসে থাকি। সেখানকার দরোজার চাবি আমার হেফাজতে আর মাঠের দেখাশোনা করি।
হ্যারির সাথে করমর্দন করার জন্য দৈত্যটি বিশাল হাত বাড়িয়ে দিল। করমর্দনের সময় হ্যারির মনে হলো তার হাতটা বুঝি খসে পড়ছে।
চা পাওয়া যাবে? হ্যাগ্রিড মনে করিয়ে দিলেন। চা যদি একটু কড়াও হয় তাতেও আমার আপত্তি নেই।
এবার হ্যাগ্রিডের দৃষ্টি গেল ঘর গরম করার ফায়ার প্লেস-এর দিকে। তিনি ঘরের ফায়ার প্লেস-এর কাছে একটু কুঁজো হলেন। মুহূর্তের মধ্যে সেখানে গনগনে আগুন জ্বলে উঠল। ঘর এত গরম হলো যে হ্যারির মনে হল, সে যেন একটা হট বাথ নিচ্ছে। আগুনে গোসল করে নিচ্ছে।
হ্যাগ্রিড এবার সোফায় বসে পড়লেন। মনে হল গদিটি বুঝি ডুবে যাবে। এবার হ্যাগ্রিডের জামার পকেট থেকে হরেক রকমের জিনিস বেরুল–তামার কেতলি, এক প্যাকেট শূকরের মাংসের সসেজ, লম্বা মগ, বোতল, চা ইত্যাদি। হ্যাগ্রি তার কাজ শুরু করে দিলেন। সসেজের আগুনে ঝলসানোর শব্দ ও পোড়া মাংসের গন্ধে ঘর ভরে গেল। তিনি যখন ছয়টি মোটা, রসে ভরা এবং কিছুটা পুড়ে যাওয়া সসেজ লোহার শিকের কড়াই থেকে বের করল ডাডলি লোভাতুর দৃষ্টিতে সেইদিকে তাকাল। আঙ্কল ভার্নন কড়াভাবে বললেন–ডাডলি, ওর দেয়া কোন জিনিস স্পর্শ করবে না।
হ্যাগ্রিড মুচকি হেসে রসিকতা করে বললেন–তোমার ছেলে ডাডলি তো একটি আস্ত থলথলে পুডিং, ওর জন্য চর্বির প্রয়োজন হবে না। তোমার কোন চিন্তার কারণ নেই।
হ্যাগ্রিড হ্যারির দিকে সসেজ বাড়িয়ে দিলেন। হ্যারি এত ক্ষুধার্ত ছিল যে খেয়ে মনে হলো এর আগে কখনো সে এত সুস্বাদু খাবার খায়নি। যদিও সে ভয়ের চোখে হ্যাগ্রিডের দিকে তাকিয়ে ছিল।
হ্যারি হ্যাগ্রিডের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। তারপর নিজ থেকেই বলল–আমি এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি আপনি কে?
হ্যাগ্রিড এক ঢোক চা গিললেন। হাতের তালু দিয়ে মুখ মুছলেন।
বললেন–সবাই যেমন ডাকে–তুমিও আমাকে হ্যাগ্রিড বলে ডাকবে। তোমাকে একটু আগেই বলেছি, আমি হোগার্টসের চাবির রক্ষক। ধীরে ধীরে তুমি হোগার্টস সম্পর্কে সব জানতে পারবে।
না। হ্যারি বলল।
হ্যাগ্রিড একটু ধাক্কা খেলেন মনে হলো; তিনি হ্যারির এই উত্তর আশা করেনি।
আমি দুঃখিত। হ্যারি দুঃখ প্রকাশ করল।
এবার হ্যাগ্রিড ডার্সলি পরিবারের অন্য সবার দিকে তাকাল। হ্যারি, তোমার দুঃখিত হবার কোন কারণ নেই। দুঃখিত হবার কারণ তো ওদেরই। আমি জানি–তোমাকে লেখা একটি চিঠিও ওরা তোমাকে দেয়নি। হোগার্টসের ব্যাপারেও তারা তোমাকে কিছু জানায়নি। তোমার বাবা–মার ব্যাপারেও ওরা তোমাকে কিছু বলেনি।
আমার বাবা–মার সম্পর্কে কী? হ্যারি আগ্রহ ভরে জানতে চাইল।
তুমি কিছুই জানো না! হ্যাগ্রিড বিস্ময় প্রকাশ করল। বলল–ঠিক আছে, এক সেকেন্ড অপেক্ষা করো।
হ্যাগ্রিড এত ক্ষেপে গেলেন যে মনে হল মুহূর্তেই বাড়িটা লন্ডভণ্ড করে ফেলবেন। ডার্সলি ভয়ে পেছনে হটে দেয়ালে পিঠ ঠেকালেন।
হ্যাগ্রিড হুংকার দিয়ে বললেন–তোমরা আমাকে বল, ছেলে-এই ছেলেটা–মানে হ্যারি কি কিছুই জানে না?
হ্যারির মনে হলো–হ্যাগ্রিড একটু বাড়াবাড়ি করছেন। সে তো স্কুলে পড়ছে। লেখাপড়ায় সে খুব একটা খারাপ নয়।
হ্যারি বলল–আমি পড়াশোনা করি। আমি অঙ্কে ভালো।
হ্যাগ্রিড হ্যারির কথায় কান না দিয়েই ডার্সলি পরিবারের সদস্যদের কাছে প্রশ্ন করলেন আপনারা কি ওকে ওর পরিবার, ওর বাবা–মার ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানাননি?
হ্যাগ্রিড যেন উত্তেজনায় ফেটে পড়ছিলেন।
আঙ্কল ভার্নন ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে পড়লেন। হ্যাগ্রিড হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন–তোমার বাবা–মা সম্পর্কে তোমার জানা উচিত। তারা খ্যাতিমান ব্যক্তি ছিলেন। তুমিও সেই হিসেবে খ্যাতিমান।
কী বললেন? আমার বাবা–মা খ্যাতিমান ছিলেন? হ্যারি বিস্ময়ে হ্যাগ্রিডকে জিজ্ঞেস করল।
তুমি একেবারে কিছুই জানো না? হ্যাগ্রিড বিস্ময়ে হ্যারির দিকে তাকালেন।
অনেকক্ষণ পর আঙ্কল ভার্নন কিছু বলার সাহস পেলেন। তিনি বললেন–হ্যারির বাবা–মা সম্পর্কে কিছু না বলার জন্য তোমাকে অনুরোধ করছি।
এতে হ্যাগ্রিডের রাগ কমল না। হ্যাগ্রিড রাগের সাথেই বললেন আপনি তো কখনো তাকে বলেননি চিঠিগুলোতে কী লেখা ছিল? ডাম্বলডোর হ্যারিকে এই চিঠিগুলো পাঠিয়েছিলেন আমার সামনেই। আপনি এতগুলো বছর হ্যারির কাছ থেকে সবকিছু গোপন রেখেছেন। তাই না?
কী লুকিয়ে রেখেছেন? হ্যারি কৌতূহলী হয়ে উঠলো।
চুপ কর, এসব কথা বলতে আমি কি তোমাকে নিষেধ করিনি? আঙ্কল ভার্নন বিরক্তি প্রকাশ করলেন।
আন্ট পেতুনিয়ার চেহারায়ও আতঙ্কের ছাপ দেখা গেল।
আপনারা দুজন মাথা গরম করলেও কিছু হবে না। হ্যারি তুমি একজন জাদুকর। হ্যাগ্রিড বলল।
ঘরের মধ্যে পিনপতন নীরবতা। শুধু কেবল সাগরের গর্জন আর বাতাসের শির শির আওয়াজ ভেসে আসছে।
আমি একজন কী? হ্যারি আরো কৌতূহলী হলো।
তুমি একজন জাদুকর। হ্যাগ্রিড বললেন–তোমার কাছে পাঠানো চিঠিগুলো তোমার পড়া উচিত ছিল। এই বলে হ্যাগ্রিড একটি হলুদাভ খাম হ্যারির হাতে দিলেন।
হ্যারি খামটি হাতে নিল। খামের ওপর হালকা সবুজ কালিতে লেখা ছিল
মি, এইচ পটার
দি ফ্লোর, হার্ট অন দি রক
সমুদ্র
হ্যারি চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলো–
হোগার্টসের জাদু বিদ্যালয়
প্রধান শিক্ষক : আলবুস ডাম্বলডোর
প্রিয় মি. পটার,
আমরা আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, আমাদের জাদু বিদ্যালয়ে তোমার জন্য একটি আসন রাখা আছে। চিঠির সাথে প্রয়োজনীয় বইপত্র ও সরঞ্জামাদির তালিকা দেয়া হলো।
আগামী ১লা সেপ্টেম্বর থেকে কোর্স শুরু হবে। ৩১শে জুলাইয়ের ভেতর তোমার কাছে পেঁচা প্রত্যাশা করছি।
ইতি
মিনার্ভা ম্যাকগোনাগল
উপ–প্রধান শিক্ষক
হ্যারির মাথায় একগাদা প্রশ্ন কিলবিল করছিল। সে ভেবে পাচ্ছিল না, কোন প্রশ্নটা আগে করবে। কয়েক মিনিট পর অস্ফুটস্বরে বলল, তারা আমার পেঁচার জন্য অপেক্ষা করবে, এর অর্থ কী? একহাতে নিজের কপাল চেপে হ্যাগ্রিড বলল, এতক্ষণে মনে পড়েছে তার অপর হাতটি ওভারকোটের পকেটে ঢুকিয়ে একটি জীবন্ত পেঁচা, একটি লম্বা পালকের কলম ও মোটা কাগজের রোল বের করলেন। হ্যাগ্রিড তার দাঁতে পাখির পালক চেপে কাগজে কিছু লিখলেন যা বুঝতে হ্যারির একটুও অসুবিধে হলো না।
হ্যাগ্রিড লিখলেন :
প্রিয় মি, ডাম্বলডোর,
হ্যারিকে তার চিঠি দেয়া হয়েছে। তার জিনিসপত্র কেনার জনা আমি আগামীকাল বেরুব। আবহাওয়া দুর্যোগময়। আশা করি আপনি ভালো আছেন।
ইতি
হ্যাগ্রিড
লেখাটা ভাঁজ করে হ্যাগ্রিড পেঁচাকে দিলেন। পেঁচা এটা ঠোঁটে চেপে ধরল। এবার পেঁচাটিকে জানালা দিয়ে হ্যাগ্রিড আকাশে উড়িয়ে দিলেন। এমন স্বাভাবিকভাবে হ্যাগ্রিড ফিরে এসে বসলেন, যেন এইমাত্র ফোনে কথা বলে এলেন। এরপর আঙ্কল ভার্নন হুংকার দিয়ে উঠলেন–হ্যারি তুমি কোথাও যাবে না। হ্যাগ্রিড রেগেমেগে আগুনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। এবং বললেন–আমি দেখতে চাই তোমার মতো একটা মাগল তাকে কীভাবে আটকায়।
মাগল। মাগল কী? হ্যারি জানতে চাইল।
হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন–মাগল হলো যে সব লোক জাদুর মর্ম বোঝে না। তোমার দুর্ভাগ্য এরকম একটি মাগল পরিবারে তুমি বড় হয়েছে।
এবার আঙ্কল ভার্নন এগিয়ে এসে বললেন–আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমরা তাকে এ ধরনের ভোজবাজি থেকে দূরে রাখব। তার ওই ধরনের জাদু–টাদু শেখার ইচ্ছা চিরকালের জন্য আমরা শেষ করে দেব।
হ্যারি বলল–তোমরাও কি জানো যে আমি একজন–জাদুকর।
অবশ্যই জানি। পেতুনিয়া জবাব দিলেন-এটা কী করে হয় যে আমি আমার বোন সম্পর্কে কিছু জানবো না। সেও সেই স্কুল থেকে এরকম চিঠি পেয়েছিল এবং একদিন উধাও হয়ে গিয়েছিল। ছুটির সময় সে বাড়িতে আসতো–তার পকেটে থাকতে ব্যাঙের পা, চায়ের কাপকে সে ইঁদুর বানাতো। একমাত্র আমিই জানতাম, সে একটি ভণ্ড! কিন্তু আমার মা–বাবার কাছে সে ছিল প্রিয়–সবকিছুতেই তারা লিলিকে নিয়ে গর্ব করতো। সবসময় বলতে লিলি এটা… লিলি ওটা…। তারপর তোমার বাবার সাথে স্কুলে তার পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে ঘনিষ্টতা এবং বিয়ে। ওরা দুজনেই পাগল, অদ্ভুত, অস্বাভাবিক। তারপর তোমার জন্ম হয়। আমি জানতাম তুমি তাদের মত হবে। তারা একদিন বিস্ফোরণে শেষ হয়ে গেল। তারপর থেকে তুমি আমাদের কাছে।
কথাগুলো শুনে হ্যারির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একটু পর হ্যারি মুখ খুলল–বিস্ফোরণ! তোমরা না বলেছিলে, আমার বাবা–মা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছে?
গাড়ি দুর্ঘটনায়! হ্যাগ্রিড গর্জন করে উঠলেন। ডার্সলি পরিবারের সদস্যদের প্রতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হ্যাগ্রিড প্রশ্ন করলেন-এটা কি বিশ্বাস করা যায় যে লিলি আর জেম্স্ গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এটা অসম্ভব। এটা নিছক গুজব। বানোয়াট গল্প। এটা বদনাম। আমাদের জগতের প্রতিটা শিশুই হ্যারি পটারের নাম জানে। এটা কি করে হয় যে সে নিজেই তার সম্পর্কে জানে না। কিন্তু কেন এই দুর্ঘটনা ঘটলো। হ্যাগ্রিড কঠিন ভাষায় প্রশ্ন করলেন।
হ্যাগ্রিডের ক্রোধ খুব দ্রুতই উদ্বেগে পরিণত হলো। উদ্বিগ্ন স্বরে হ্যাগ্রিড বললেন–আমি এটা কখনোই আশা করিনি। আমি তখন বুঝতে পারিনি ডাম্বলভোর কেন আমাকে বলেছিলেন তোমাকে নিতে অনেক বাধা–বিপত্তি পেরুতে হবে। তুমি যে অনেক কিছু জানো না-এটাও আমার জন্য কম বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। তোমাকে আমার অনেক কিছুই বলার আছে। তবে সবটুকু এখন বলা যাবে না। আমি ততটুকুই বলব যতটুকু আমার পক্ষে বলা সম্ভব।
ডার্সলি পরিবারের সদস্যদের প্রতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হ্যাগ্রিড হ্যারিকে বলতে লাগলেন–বিষয়টি এই, আমার মনে হয় একটা লোক, নাম–কিন্তু আশ্চর্য তুমি তার নাম জানো না! পৃথিবীর সকলে তার নাম জানে।
লোকটা কে? হ্যারি প্রশ্ন করে বসে।
তার নাম …বলতে গিয়ে হ্যাগ্রিড থেমে গেলেন। হ্যাগ্রিডের মুখ থেকে নামটি বেরুল না।
আমি তার নাম বলতে পারব না। কেউই তার নাম উচ্চারণ করে না হ্যাগ্রিড বললেন।
কিন্তু কেন? হ্যারি জানতে চাইল।
হ্যাগ্রিড বললেন–ঘটনার সাথে আরেকজন জড়িত। তার নাম গালপিন গারগোয়েলেস। সে একজন ভেলকিবাজ ও বদমায়েশ। খুবই জঘন্য, জঘন্যের চেয়েও জঘন্য। তার নাম বলা… আচ্ছা ঠিক আছে, তার নাম ভোলডেমর্ট। দ্বিতীয়বার তার নাম নিতে বলবে না। তার জগতটাই ছিল জাদুলীলা, ডাইনি আর ভেলকিবাজদের নিয়ে। প্রায় বিশ বছর আগে সে তার অনুসারী বানাবার জন্যে লোকজন খুঁজতো। সে বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটাতে। সে কয়েকজনকে খুন করেছে। বিশেষ করে তার বিরোধী মতের লোকদেরকে। একমাত্র ডাম্বলডোরকেই সে ভয় পেতো। তার স্কুলটাকে সে নিতে সাহস পায়নি।
হ্যাগ্রিড বলে চললেন–তোমার বাবা মা খুব ভাল জাদুকর ছিলেন। তাদের তুলনা হয় না। ছাত্রাবস্থায় হোগার্টস স্কুলে তারা হেড বয় ও হেড গার্ল ছিলেন। তবে এটা অজানাই থেকে গেল যে কেন ভোলডেমর্ট তাদেরকে পক্ষে নেয়ার চেষ্টা কখনো করেনি। এর কারণ হতে পারে যে তোমার বাবা–মা ডাম্বলডোরের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তখন তোমার বয়স মাত্র এক বছর। ভোলডেমর্ট তোমাদের বাড়ি যায়। তোমার বাবা–মাকে হত্যা করে। এ সময় ইউ–নো–হু তোমাকেও হত্যা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সফল হয়নি। তাই তোমার কপালের এই দাগ দেখে আমি বিস্মিত হইনি। এটাও তো কম কষ্ট নয়। এটা একটি শক্তিশালী অভিশাপের পরিণাম। শাপটা তোমার ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। এজন্যই তুমি খ্যাতিমান হ্যারি। কারণ সে যাকে মারতে চাইতো তার বাঁচার কোন উপায় থাকত না। একমাত্র তুমিই তার ব্যতিক্রম।
গ্রিডের কথা শুনে হ্যারির মন বিষাদে ভরে গেল।
করুণ দৃষ্টিতে হ্যাগ্রিড হ্যারির দিকে তাকালেন।
হ্যাগ্রিড বলনেল–ডাম্বলডোরের নির্দেশেই আমি তোমাকে সেই ভাঙা বাড়ি থেকে উদ্ধার করি। তবে শেষ পর্যন্ত তুমি যেখানে আছ–অর্থাৎ ডার্সলিদের পরিবারে–সেটাও তো তোমার জন্য ভালো হয়নি। এটা তো তোমার জন্য একটি নরক।
ইতোমধ্যে আঙ্কল ভার্নন তার সাহস কিছুটা ফিরে পেয়েছেন। তিনি বললেন–আমি স্বীকার করি হ্যারির ভেতর অদ্ভুত কিছু জিনিস আছে। সে ডাইনি জগতের লোক। হয়ত শাসন করে তাকে বশে আনা যাবে অথবা যাবে না। তবে আমি চাই না সে ওই জগতের সাথে কোন সম্পর্ক রাখুক।
আঙ্কল ভার্ননের কথা শুনে হ্যাগ্রিড সোফা থেকে লাফ দিয়ে উঠলেন। তার প্যান্ট থেকে একটা ভাঙা ছাতা বের করে সেটাকে তরবারির মতো করে আঙ্কল ভের্ননের সামনে উঁচিয়ে ধরলেন। তারপর বললেন–ডার্সলি, আমি তোমাকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি, তুমি আর একটি কথাও বলবে না।
ছাতার খোঁচা খাবার ভয়ে আঙ্কল ভার্নন একেবারে চুপসে গেলেন।
হ্যাগ্রিড পুনরায় সোফায় বসলেন।
ভোলডেমর্টের কী হলো? হ্যারি জানতে চাইল।
হ্যাগ্রিড বললেন–সে সেদিন পালিয়ে গেল। পরের রাতে সে তোমাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তবে ওর ব্যাপারটাও রহস্য রয়ে গেছে। কেউ বলে ও মারা গেছে। কেউ বলে ও এখনও জীবিত।
আন্তরিকতা ও উষ্ণতার সাথে হ্যাগ্রিড হ্যারির দিকে তাকালেন। ওঁর কথায় হ্যারি খুশি ও গর্বিত হওয়ার পরিবর্তে বরং মনে করলো কোথাও বড় ধরনের ভুল হচ্ছে। সে জাদুকর! সে কীভাবে জাদুকর হয়? সে তো ডার্সলি পরিবারে আঙ্কল ভার্নন এবং আন্ট পেতুনিয়ার কাছেই প্রতিপালিত হয়েছে। সে যদি জাদুকরই হবে তাহলে তাকে কেন যাযাবরের জীবন কাটাতে হচ্ছে? কেন কাবার্ডের ওপর ঘুমোতে হয়। সে যদি খ্যাতিমানই হবে তাহলে ডাডলি কেন সব সময় তাকে ফুটবলের মতো লাথি মারে।
হ্যারি হ্যাগ্রিডকে বলল–আপনি বোধহয় ভুল করছেন। আমার মনে হয় না, আমি একজন জাদুকর।
হ্যারির কথায় হ্যাগ্রিড মৃদু হাসলেন।
তুমি জাদুকর হবে না কেন? জাদুবিদ্যাকে কি তুমি ভয় পাও?
হ্যারি আগুনের দিকে তাকাল। এখন সে ভাবতে লাগল ভার আঙ্কল আন্ট তার সাথে কেন দীর্ঘদিন এমন ওলট–পালট ও অস্বাভাবিক ব্যবহার করেছেন।
হ্যারি হাসিমুখে হ্যাগ্রিডের দিকে তাকিয়ে দেখল, হ্যাগ্রিডের মুখে তখনও স্মিত হাসি। আঙ্কল ভার্ননের উদ্দেশ্যে হ্যাগ্রিড বললেন–তুমি কি দেখতে চাও হ্যারি জাদু জানে কিনা।
আঙ্কল ভার্নন বলল–আমি তোমাকে বলেছি হ্যারি কোথাও যাবে না। ও স্টোনওয়াল হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে। তোমাদের ফালতু চিঠি আমি পড়েছি।
হ্যারি হোগার্টসে যদি যেতে চায়। তোমার মত একজন বড় মাগলও কিছুতেই তাকে রুখতে পারবে না–হ্যাগ্রিড বললেন। তুমি কি পাগল, ভাবছো, লিলি ও জেমস-এর ছেলের হোগার্টস যাওয়া বন্ধ করতে পারবে। জন্মের পরেই ওর নাম এ স্কুলে লেখা হয়ে গেছে। সে সেখানে হোগার্টসের ইতিহাসে যার মত বড় শিক্ষক হননি সেই আলবাস ডাম্বলডোরের অধীনে পড়াশোনা করবে।
তাকে ম্যাজিকের কারসাজি শেখানোর জন্য কোন মাথা খারাপ বৃদ্ধকে আমি এক কানা কড়িও দিচ্ছি না। আঙ্কল ভার্ননের কণ্ঠে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
শেষ পর্যন্ত তিনি খানিকটা বেশিই বলে ফেললেন। হ্যাগ্রিড আবার ছাতাটি তরবারির মতো করে আঙ্কল ভার্ননের সামনে তার মাথার ওপর শূন্যে ঘুরালেন। আর বলল–হুঁশিয়ার আলবাস ডাম্বলডোরের বিরুদ্ধে তুমি একটা কথা বলবে না।
হিশ… শব্দ করে ছাতাটি যখন ডাডলির সামনে চলে এল, বেগুনি রঙের আলোর ঝলকানি, আতশবাজির মত একটা শব্দ, এক তীব্র চিৎকার এবং পরমুহূর্তেই ডাডলি তার নিতম্বে দু হাত চেপে তীব্র ব্যথায় বিকট শব্দ করে উঠল। হ্যারি দেখলো একটি শূকরের লেজ ডাডলির ট্রাউজার খুঁড়ে বের হচ্ছে। আঙ্কল ভার্নন আর্তনাদ করে উঠলেন। তিনি এত ভয় পেলেন যে তৎক্ষণাৎ আন্ট পেতুনিয়া আর ডাডলিকে দ্রুত টেনে অন্য ঘরে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় যখন দরোজা বন্ধ করছিলেন তখন তার চেহারায় ভীষণ আতঙ্কের ছাপ। হ্যাগ্রিড তার দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে ছাতার দিকে তাকিয়ে বললেন, মাথা গরম করা ঠিক নয়, কিন্তু অনেক সময় এটা কাজ করে। মানে… ওকে শূকর বানানো, তবে সে এমনিতেই দেখতে শূকরের মতো।
হ্যারি হ্যাগ্রিডকে জিজ্ঞেস করল–আপনি জাদু দেখান না কেন?
একথার কোন জবাব না দিয়ে হ্যাগ্রিড তাঁর কোটটা হ্যারির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, তুমি আমার কোটটি পরে নাও। খেয়াল রেখো। এর ভেতরে আরো কিছু জিনিস আছে।
🔴 ডায়াগন এলি
পরদিন খুব সকালেই হ্যারির ঘুম ভাঙল। যদিও সে জানে চারদিক ফরসা হয়ে গেছে। তবুও চোখ বন্ধ করে রইল।
তার মনে হলো রাতে সে স্বপ্ন দেখেছে যে হ্যাগ্রিড নামে এক দৈত্য এসে তাকে জাদুবিদ্যার স্কুলে ভর্তি হতে বলেছে। হ্যারি মনে মনে বলল, এখন আমি চোখ খুললেই দেখবো বাড়িতে আমি আমার কাবার্ডের ওপর শুয়ে আছি।
ঠিক এই সময় দরোজায় ঠক–ঠক আওয়াজ। মনে হচ্ছে আন্ট পেতুনিয়া দরোজায় শব্দ করছেন। তবুও সে চোখ বন্ধ করে থাকল। কারণ গত রাতে সে একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখেছে।
আবার দরোজায় ঠক–ঠক আওয়াজ।
হ্যারি বলল–আমি আসছি।
হ্যারি উঠতেই তার গা থেকে হ্যাগ্রিডের দেয়া কোটটা নিচে পড়ল।
চারদিকে সুর্যের আলো। ঝড় থেমে গেছে। হ্যাগ্রিড তখনও সোফায় ঘুমোচ্ছেন। একটা পেঁচা জানালায় ডানা ঝাপটাচ্ছে। ঠোঁটে একটা খবরের কাগজ। হ্যারি উঠে গিয়ে জানালা খুলে দিল। পেঁচাটা ঘরে ঢুকে হ্যাগ্রিডের গায়ের ওপর খবরের কাগজটা ফেলে দিয়ে হ্যাগ্রিডের কোটে আক্রমণ করল। হ্যারি পেঁচাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল। হ্যাগ্রিড চোখ না খুলেই হ্যারিকে বললেন–ওকে কিছু পয়সা দিয়ে দাও।
–কত দেব? হ্যারি জানতে চাইল।
–দেখ, আমার পকেটে কী আছে।
হ্যাগ্রিডের কোটের পকেটে চাবির গোছা, ব্রোঞ্জ মুদ্রা, টি–ব্যাগসহ নানা কিসিমের জিনিস পাওয়া গেল।
অবশেষে হ্যারি অদ্ভুত ধরনের কিছু মুদ্রা বের করল।
তাকে পাঁচটি নাট দিয়ে দাও। হ্যাগ্রিড হ্যারিকে বললেন।
নাট! অবাক হয়ে হ্যারি প্রশ্ন করল।
হ্যাগ্রিড বললেন–হ্যাঁ, ব্রোঞ্জের ছোট ছোট মুদ্রাগুলো। হ্যারি গুণে গুণে ব্রোঞ্জের পাঁচটি মুদ্রা বের করল। পেঁচা পা বাড়িয়ে দিতেই হ্যারি একটি পুটুলিতে মুদ্রাগুলো রেখে পুটুলিটি পেঁচার পায়ের সাথে বেঁধে দিল। পেঁচা জানালা দিয়ে বেরিয়ে আকাশে উড়াল দিল।
হ্যাগ্রিড ঘুম থেকে উঠে বসলেন। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে আজকে অনেক কিছু করতে হবে। বললেন–লন্ডন যেতে হবে। লন্ডন যাবার আগে জাদুবিদ্যার স্কুলের দরকারি সব জিনিসপত্র কিনতে হবে।
হ্যারি হ্যাগ্রিডের উদ্দেশ্য বলল–আমার কোন টাকা পয়সা নেই। আর আপনিও শুনলেন জাদুবিদ্যার স্কুলে ভর্তি হবার জন্য আমার আঙ্কল আমাকে কোন টাকা দেবেন না।
এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। হ্যাগ্রিড বললেন–তুমি কি মনে করেছো যে, তোমার বাবা তোমার জন্য কিছুই রেখে যাননি? তোমার বাবা তোমার জন্য প্রচুর ধন–সম্পদ রেখে গেছেন।
কিন্তু তাদের বাড়ি তো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল–হ্যারি বলল।
তারা তাদের সোনা–দানা বাসায় রাখেননি। আমাদের কাজ হবে প্রথমে গ্রিংগটস উইজার্ড ব্যাংকে যাওয়া। নাও সসেজ খাও। খুব বেশি ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি। তোমার জন্মদিনের কেকও খেতে পার… তোমার যা ইচ্ছে। হ্যাগ্রিড বললেন।
জাদুকরদের কি ব্যাংক থাকে? হ্যারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ, তাদের একটাই ব্যাংক আছে। গ্রিংগটস উইজার্ড ব্যাংক।
বিকেলে হ্যাগ্রিড পাহাড়ে গেলেন। সাথে হ্যারিও গেল। আকাশ নির্মেঘ, পরিষ্কার, সমুদ্রে সূর্যাস্তের প্রতিফলন। ভাড়ার একটি নৌকা ঘাটে বাঁধা আছে। নৌকার তলায় বৃষ্টির পানি জমেছে।
অন্য একটি নৌকার সন্ধান করে হ্যারি হ্যাগ্রিডকে প্রশ্ন করল–আপনি এখানে এলেন কী করে?
উড়ে এসেছি। হ্যাগ্রিড বলল।
উড়ে এসেছেন–মানে? হ্যারি অবাক হলো।
হ্যাঁ–আমরা এটাতেই ফিরে যাব। হ্যাগ্রিড় বলল–আমি যখন এটা পেয়েছি এখন আর জাদুবিদ্যার সাহায্য দরকার নেই।
তারা দুজন নৌকায় উঠলেন। হ্যারি তখনও হ্যাগ্রিডের দিকে তাকিয়েছিল এবং কল্পনা করছিল কিভাবে হ্যাগ্রিড উড়ছেন।
হ্যাগ্রিড বলেছেন নৌকা বাওয়াটা লজ্জার ব্যাপার। তাহলে কি নৌকাটা উড়বে–হ্যারি ভাবছিল।
হ্যাগ্রিড বললেন–আমি যেখানেই থাকি সেখানে সবকিছুর গতি বেড়ে যায়। তুমি কি হোগার্টসে গিয়ে এসব বিষয়ে গল্প করবে? হ্যাগ্রিড হ্যারির দিকে তাকালেন।
অবশ্যই না। হ্যারি জবাব দিল।
হ্যাগ্রিড তার গোলাপী ছাতাটা বের করে দুভাগ করলেন। নৌকার পাশে ধরতেই নৌকাটা দ্রুতবেগে পাড়ের দিকে রওনা হলো।
আপনি গ্রিংগটস থেকে টাকা আনার জন্য এত ব্যস্ত হলেন কেন? হ্যারি জানতে চাইল।
জাদুবিদ্যা কাজে লাগিয়েছি। পত্রিকার ভাঁজ খুলতে খুলতে হ্যাগ্রিড বললেন–বলা হয় ড্রাগন নাকি ব্যাংকের ভল্টগুলো পাহারা দিচ্ছে। গ্রিংগটস লন্ডন থেকে শত শত মাইল দূরে। সমুদ্রের নিচ দিয়ে যেতে হবে। ওখানে যেতে হলে তুমি খিদেয় মারা যাবে। হ্যারি বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবছিল। ডেইলি প্রফেটের পাতা ওল্টাতে ওল্টাভে হ্যাগ্রিড মন্তব্য করলেন জাদু মন্ত্রণালয় সব সময় গোল পাকায়।
জাদুর জন্য কি আবার একটি মন্ত্রণালয় আছে নাকি? হ্যারি বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
অবশ্যই আছে। হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন–সরকার চাচ্ছিলেন ডাম্বলডোর ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিক। কিন্তু ডাম্বলডোর হোগার্টসের জাদুবিদ্যার স্কুল ছেড়ে মন্ত্রী হতে আগ্রহী নন।
জাদুবিদ্যা মন্ত্রণালয়ের কাজ কী? হ্যারি জানতে চাইল।
হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন–মাগলদের হাত থেকে জাদুবিদ্যা শাস্ত্রকে রক্ষা করা।
নৌকা ঘাটে ভিড়ল। তারা নৌকা থেকে নেমে সড়কপথে হাঁটতে লাগল। পথচারীরা অবাক দৃষ্টিতে হ্যাগ্রিডের দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের দোষ দেওয়া যায় না। হ্যাগ্রিড এত লম্বা যে, তিনি সহজেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন।
লন্ডন যাওয়ার জন্য তারা স্টেশনে পৌঁছল। পাঁচ মিনিটের ভেতরই লন্ডনের জন্য ট্রেন পাওয়া যাবে। মাগলদের টাকার ব্যাপারে হ্যাগ্রিডের কোন ধারণা ছিল না। সে টাকাকে মাগল টাকা বলে থাকে। তাই টিকিট করার জন্য হ্যারিকে টাকা দিলেন। ট্রেনের দিকে না তাকিয়ে সবাই শুধু হ্যাগ্রিডের দিকে তাকায়। হ্যাগ্রিড দুটো আসন নিয়ে বসলেন।
তোমার চিঠি কি তোমার সাথে আছে? হ্যাগ্রিড হ্যারিকে জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যারি হলুদ খামের চিঠিটা পকেট থেকে বের করলো।
ঠিক আছে। হ্যাগ্রিড বললেন, তোমার কী কী লাগবে তার একটা বিস্তারিত তালিকা চিঠিতে লেখা আছে।
হ্যারি কাগজের দ্বিতীয় অংশটার ভাঁজ খুলল। রাতে সে কাগজটা লক্ষ্যও করেনি এবং পড়েওনি। হ্যারি পড়তে শুরু করল–
হোগার্লস স্কুল অফ উইচক্রাফট এবং উইজারডি
ইউনিফর্ম
প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আবশ্যক
১। তিন সেট স্বাভাবিক কাজের পোশাক (কালো)
২। দিনে পরার জন্য একটা সাধারণ চোখা হ্যাট (কালো)
৩। একজোড়া দস্তানা (ড্রাগন ও অনুরূপ প্রাণীর চামড়ার তৈরি)
৪। শীতের একটা পোশাক (কালো–রূপালী এবং টিলা)
লক্ষ্য করুন–প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর পোশাকে নেইম–ট্যাগ থাকতে হবে।
নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক
প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে তালিকাভুক্ত প্রত্যেকটা বইয়ের একটা করে কপি রাখতে হবে
(ক) The Standard Book of Spells (Grade–1) by Miranda Goshawk
(খ) History of Magic by Bathilda Bagshot
(গ) Magical Theory by Adalbert Wafting
(ঘ) A Beginners Guide to Transfiguration by Emeric Switch
(ঙ) One Thousand Magical Herbs and Fungi by Phyllida Spore
(চ) Magical Drafts and Potions by Arsenius Jigger
(ছ) Fantastic Beasts and Where to Find Them by Newt Scamander
(জ) The Dark Forces–A Guide to Self–Protection by Quentin Trimble
অন্যান্য যন্ত্রপাতি
একটা জাদুর কাঠি
একটা কলড্রন (পিউটার স্ট্যান্ডার্ড সাইজ–২)
এক সেট গ্লাস অথবা স্কটিক ফিঅল
একটি দূরবীন
এক সেট তামার স্কেল
ছাত্রছাত্রীরা একটা পেঁচা বা একটা বিড়াল অথবা একটা ব্যাঙ আনতে পারবে।
অভিভাবকদের জানানো যাচ্ছে যে প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদেরকে তাদের নিজস্ব ঝাড়ুলাঠি ব্যবহার করতে দেয়া হয় না।
এগুলো সবই লন্ডনে কিনতে পাওয়া যাবে? হ্যারি প্রশ্ন করল।
কোথায় পাওয়া যাবে সেটা তোমার জানা থাকলে অবশ্যই পাওয়া যাবে–হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন।
হ্যারি এর আগে কখনও লন্ডন যায়নি। সে যে কোথায় যাচ্ছে-এটাও তার জানা ছিল না। তবে যাওয়ার পথ ও পদ্ধতি খুব বিচিত্র। ট্রেনের আসনগুলো ছোট, গতি খুবই কম। জাদুবিদ্যার সাহায্যে এরা এসকেলেটর দিয়ে উঠল। এই তো রাস্তা। এই তো সারি সারি দোকান।
হ্যাগ্রিড এত বিশালদেহী যে ভিড় ঠেলে যেতে কোন অসুবিধেই হলো না। আর হ্যারির কাজ হলো পেছনে থেকে তাকে কেবল অনুসরণ করা। তারা বইয়ের দোকান, মিউজিকের দোকান, ফাস্টফুডের দোকান এবং সিনেমা হল পার হয়ে গেল, কিন্তু কোথাও তারা জাদুর কাঠি বিক্রি হতে দেখল না। রাস্তায় লোকজনের ভিড়। এখানে মাটির তলায় কোন জাদুকরের গুপ্তধন কি লুকিয়ে থাকতে পারে? জাদুবিদ্যার বইপত্র, জাদু ঝাড়ু কোথায় বিক্রি হয়? এটা নিশ্চয়ই ডার্সলিদের তৈরি বড় রকমের কৌতুক নয়? হ্যারি যদি জানত যে ডার্সলিদের কোন রসবোধ নেই, তাহলে হয়তো সে রকম কিছু একটা ভাবত। যদিও হ্যাগ্রিড তাকে যা যা বলেছেন তার অনেক কিছুই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। হ্যারি তাকেও খুব একটা বিশ্বাস করতে পারছিলো না।
এক জায়গায় এসে হ্যাগ্রিড বললেন–আমরা এসে গেছি, এ জায়গার নাম লিকি কলড্রন এটা খুব বিখ্যাত স্থান।
এটা দেখতে অনাকর্ষণীয় ছোট পাব। হ্যাগ্রিড যদি তাকে না দেখাতেন তাহলে হ্যারি বুঝতেই পারত না যে এটা পাব।
এটা বিখ্যাত কোনও স্থানের মত নয়, অন্ধকার ও অপরিষ্কার। কয়েকজন বয়স্কা মহিলা এক কোণায় বসে ছোট গ্লাসে শেরি পান করছিলো। তাদের মধ্যে একজন লম্বা পাইপে ধূমপান করছিলো। একজন ছোট খাটো লোক টাকমাথা বৃদ্ধ বার–ম্যানের সাথে কথা বলছিলো। তারা ভেতরে ঢুকতেই কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল। সবাই হ্যাগ্রিডকে দেখে হাসলো ও হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানালো। মনে হলো হ্যাগ্রিডকে সবাই এখানে চেনে। বার-ম্যান গ্লাস বের করে বলল, তোমার সেটাই দেবো?
একজন লোক বেরিয়ে এল, হ্যাগ্রিডের পূর্ব পরিচিত। হ্যারির সাথেও তার আলাপ হলো! আরও বেশ কয়েকজনের সাথে হ্যারির পরিচয় হলো। তারা বেশ একটু ঘুরে দেখল। এখানে হ্যাগ্রিডকে সবাই চেনে।
হ্যারির কাঁধে হাত রেখে হ্যাগ্রিড বললেন–না টম, আমি হোগার্টসের কাজে এখানে এসেছি।
গুড লর্ড ভদ্রলোক বললেন-এ কি সে?–তা কি করে হয়? লিকি কলড্রনের দোকানপাট মুহূর্তের মধ্যেই সম্পূর্ণ নীরব হয়ে গেল।
আমার আত্নাকে আশীর্বাদ করুন। বারের বৃদ্ধ লোকটা বললেন আমার কী সৌভাগ্য যে হ্যারি পটার আপনার সাথে দেখা হলো। কি সম্মানের বিষয়.. !
বৃদ্ধ বার-ম্যান বারের পেছন থেকে বের হয়ে হ্যারির দিকে ছুটে আসলেন। তিনি হ্যারির হাত ধরলেন–তার চোখে জল।
মি. পটার, তোমাকে পুনরায় স্বাগতম, মি. পটার তোমাকে পুনরায় স্বাগতম। কী বলবে হ্যারি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। হ্যারি অবাক হয়ে দেখল–সবাই তার দিকে তাকাচ্ছে। হ্যাগ্রিডের মুখে স্মিত হাসি। বৃদ্ধা মহিলাটির তামাক শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু তিনি পাইপ টেনেই চলছেন সেদিকে খেয়াল না করে।
তারপর চেয়ার টানাটানির শব্দ শোনা গেল। পরক্ষণেই হ্যারি দেখল যে লিকি কলড্রনের প্রত্যেকেই তার সাথে করমর্দন করছেন।
আমি ডরিস ক্রকফোর্ড, কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না, তোমার সাথে দেখা হবে, মি. হ্যারি পটার।
তোমার সাথে দেখা হওয়ায় আমি নিজেকে খুব গর্বিত মনে করছি, মি. পটার।
তোমার সাথে করমর্দন করার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। আজ আমার আনন্দের দিন।
তোমার সাথে দেখা হওয়াতে আমি যে কত আনন্দিত হয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না–মি. পটার’ ডিডালুস ডিগল বললেন।
জবাবে হ্যারি বলল–আমি আপনাকে আগে দেখেছি। একটা দোকানে আপনি আমাকে বো করেছিলেন।
ডিডালুস সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন–তোমরা কি দেখেছ–সে আমাকে এখনও মনে রেখেছে এখনও।
হ্যারি সবার সাথে করমর্দন করল। ডরিস ক্রকফোর্ড প্রায় সময়ই হ্যারির কাছাকাছি থাকলেন।
একজন তরুণ উদ্বিগ্নভাবে হ্যারির দিকে এগিয়ে এলেন। হ্যাগ্রিড বললেন–হ্যারি, ইনি অধ্যাপক কুইরেল। হোগার্টসের জাদুবিদ্যা স্কুলে তিনি তোমার একজন শিক্ষক।
প-প-পটার তোতলাতে তোতলাতে অধ্যাপক কুইরেল বললেন হ্যা…রি। তোমার সাথে দেখা… হওয়াতে আমি যে ক–কত খুশি হয়েছি ভা-ভা-ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
আপনি কী ধরনের জাদু শেখান, অধ্যাপক কুইরেল।
কালো জাদুর বিরুদ্ধে আত্নরক্ষার জাদু–অধ্যাপক কুইরেল জবাব দিলেন।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে হ্যারির–প্রায় দশ মিনিট লেগে গেল।
হাতে আর সময় নেই। হ্যারি, তাড়াতাড়ি কর। হ্যাগ্রিড তাগিদ দিলেন।
ডরিস ক্রকফোর্ড হ্যারিকে বিদায়ী করমর্দন করলেন। এরপর ওরা দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন।
আমি কি তোমাকে বলিনি তুমি খ্যাতিমান? হ্যারির উদেশ্যে হ্যাগ্রিড বললেন। তোমার সাথে দেখা করে অধ্যাপক কুইরেল প্রায় কাঁপছিলেন।
তিনি কি সব সময় এরূপ নার্ভাস থাকেন? হ্যারি জানতে চাইল।
অবশ্যই। হ্যাগ্রিড বললেন–তিনি অত্যন্ত মেধাবী, যখন তিনি পড়াশোনা করতেন তখন সবই ঠিক ছিল। যখন তিনি অভিজ্ঞতার জন্য এক বছর হাতে–কলমে কাজ করতে গেলেন তখনই গোল বাঁধল। কেউ কেউ বলেন, যখন থেকে তিনি রক্তচোষাদের সাক্ষাৎ শুরু করলেন তখন থেকেই তার এই অবস্থা। ছাত্রদের দেখলেও তিনি ভয় পেয়ে যান। যাক সে কথা। আমার ছাতা কোথায়? হ্যাগ্রিড জানতে চাইলেন।
হ্যারি রক্তচোষাদের কথা ভাবছিল।
হ্যারি, সোজা হয়ে দাঁড়াও। হ্যাগ্রিড হ্যারিকে নির্দেশ দিলেন।
হ্যাগ্রিড ছাতার মাথা দিয়ে দেয়ালে তিনবার আঘাত করলেন। দেয়াল নড়ে উঠল। দেয়ালের মাঝখানে একটি গর্ত দেখা গেল। গর্তটি ধীরে ধীরে বড় হলো ও সিংহদ্বারে পরিণত হলো। গর্তের ভেতর দিয়ে হ্যাগ্রিডের মত বিশাল দেহের ব্যক্তিও প্রবেশ করতে পারে। ডায়াগন এলিতে স্বাগতম হ্যাগ্রিড বললেন।
হ্যারির বিস্মিত সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তিনি মুচকি হাসলেন। হ্যারিও গর্তের ভেতর প্রবেশ করল। হ্যারি ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো সিংহদ্বারটা ছোট হতে হতে দেয়ালে মিলিয়ে গেল। বাইরে দোকানগুলোর কলড্রনের সারির ওপর সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে। জল গরম করার কলড্রনগুলোর ওপর একটা সাইনবোর্ডও ঝুলছিল। কলড্রনস–অল সাইজেস–রূপা, পিতল, পিউটের, তামা সেলফ–স্টিয়ারিং–কলাপসিবল।
হ্যাগ্রিড হ্যারিকে বললেন–তোমারও পানি গরম করার একটা কলড্রন লাগবে। তার আগে চলো তোমার টাকা উঠিয়ে নিই।
হ্যারি ভাবছিল তার যদি আরো আটটা চোখ থাকত। হাঁটতে হাঁটতে তার চোখ চারদিকে ঘুরতে লাগলো। দোকানপাট, লোকজন সবকিছু সে দেখার চেষ্টা করল। হ্যারি দেখল তার বয়সের কিছু ছেলে ঝাড়ুর দোকানের জানালার গ্লাসের ওপর তাদের নাক ঘষে দাঁড়িয়ে আছে। হ্যারি তাদের একজনকে বলতে শুনল–দেখো, নিউ নিম্বাস টু থাউজেন্ড। এটাই সবচে দ্রুতগামী। বিভিন্ন দোকানে পোশাক, দূরবীন ও রূপার অদ্ভুত যন্ত্রপাতি বিক্রি হচ্ছিল। যা হ্যারি এর আগে কখনোই দেখেনি। তারা হাঁটছেন। এক সময় হ্যাগ্রিড বললেন–আমরা গ্রিংগটসে এসে পড়েছি।
তারা একটা তুষার শুভ্র ভবনের সামনে এলো যা অন্যান্য ছোট দোকানগুলোর অনেক উঁচুতে। এক ব্যক্তি তাদের স্বাগতম জানাল। এই তো গবলিন, হ্যাগ্রিড বললেন। লোকটা উচ্চতায় হ্যারির চেয়েও খাটো। তার চেহারায় একটা ধূর্ত ভাব আছে। খাড়া খাড়া কুঁচলো দাঁড়ি। হ্যারি লক্ষ্য করল যে লোকটির আঙুল ও পা অনেক লম্বা। এবার তার দরোজার দ্বিতীয় অংশে এল দরোজার ওপর একটি কবিতা ঝোলানো ছিল।
আগন্তুক, তুমি মন দিয়ে শোনো
লোভের পাপের কি শাস্তি হয় জানো?
যারা শুধু নেয়, অর্জন করে না কিছুই
তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে, মানো।
আমাদের মেঝের নিচে যে গুপ্তধন
সেগুলো তোমার নয়, তবুও বলি
যদি তুমি হুঁশিয়ার না হও, করো চুরি
তাহলে দেখবে সেখানে
গুপ্তধন ছাড়াও আছে ‘অন্য কিছু’।
আমি বলেছি না, তোমারও এ ধরনের একটি পোশাক নিতে হবে। হ্যাগ্রিড বললেন।
দুজন গবলিন তাদের বো করল। তারা তখন মর্মরের তৈরি বিশাল হল রুমে। আরো প্রায় একশ গবলিন উঁচু চেয়ারে বসেছিল। তারা বড় বড় লেজারে লিখছিল, তামার দাঁড়িপাল্লায় মুদ্রার ওজন নিচ্ছিল এবং চোখে লাগানো ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে মূল্যবান পাথর পরীক্ষা করছিল।
সুপ্রভাত হ্যাগ্রিড বললেন–হ্যারি পটারের সিন্দুক থেকে কিছু টাকা ওঠাবার জন্য আমরা এখানে এসেছি।
আপনাদের কাছে কি চাবি আছে?
হ্যাঁ, আছে হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন। তারপর তিনি তার পকেট খালি করে সমস্ত জিনিসপত্র কাউন্টারের ওপর রাখতে শুরু করলেন। হ্যারি ডানদিকে লক্ষ্য করে দেখল যে গবলিনটা একটা মুক্তার স্তূপ ওজন করছে।
পেয়েছি সোনালী চাবিটা হাতে পেয়ে হ্যাগ্রিড বললেন।
গবলিন চাবি পরখ করে বলল–ঠিক আছে।
হ্যাগ্রিড বেশ গুরুত্বের সাথে বললেন–আমি ডাম্বলডোরের কাছ থেকে একটি চিঠিও নিয়ে এসেছি। চিঠিটা ইউ–নো–হোয়াট, সাতশত তের ভল্টের বিষয়ে। গবলিন মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা পড়ল। ঠিক আছে। গবলিন হ্যাগ্রিডকে চিঠিটা ফেরত দিয়ে বলল–ভলটে যাবার জন্য আমি এই বলে গবলিন গ্রিপহুককে ডাকলো।
গ্রিপহুকও একজন গবলিন। হ্যাগ্রিড সব ডগ–বিস্কুট পকেটে ভরার পর তারা দুজন গ্রিপন্থককে অনুসরণ করল।
৭১৩ নং ভলটে ইউ–নো–কী করে? হ্যারি জানতে চাইল। হ্যাগ্রিড জবাব দিলেন–আমি তোমাকে তা বলতে পারব না। এগুলো হোগার্টসের গোপনীয় জিনিস। ডাম্বলডোর বিশ্বাস করে আমাকে যতটুকু কাজ দিয়েছেন-এর বাইরে আমার কিছু করার নেই।
গ্রিপহুক তাদের জন্য দরোজা খুলে দাঁড়ালো। ভেতরে ঢুকেই হ্যারি বিস্মিত। ঘরে মশাল জ্বলছে। যাওয়ার রাস্তাটা সরু এবং নিচের দিকে ঢালু হয়ে চলে গেছে। মেঝেতে বেশকিছু রেল লাইন। গ্রিপহুক বাঁশি বাজাতেই একটা ছোট বাহন তাদের সামনে এল। তারা চড়ে বসলো। অবশ্য হ্যাগ্রিডের বিরাট শরীর নিয়ে একটু কষ্ট হল উঠতে। বাহনটা ছুটতে শুরু করল। খুব দ্রুত ছুটছে। আঁকা–বাঁকা পথ দিয়ে। হ্যারি ডাইনে বায়ে উডয়দিকে তাকাল। কিছুই দেখতে পেল না শুধু বাহনটার চলার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। বাহনটা সবুজ আলোকিত এক স্থানে থামলো। হ্যাগ্রিডের পা ঝিম ঝিম করছিল, সে দাঁড়াতে পারছিলো না, পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। সরু পথের দেয়ালে একটা দরজা। গ্রিপহুক দরজার তালা খুললো।
ঘরের ভেতর রাশি রাশি স্বর্ণমুদ্রা। রূপোর স্তম্ভ। পাহাড়প্রমাণ ছোট ছোট ব্রোঞ্জের টুকরো। এবার স্মিত হেসে হ্যাগ্রিড হ্যারির উদ্দেশ্যে বললেন-এসবই তোমার। স্বর্ণগুলো হলো গ্যালিওন আর রূপোগুলো হলো সিকেল।
সব আমার, বলেন কী? অবিশ্বাস্য। হ্যারির কণ্ঠে বিরাট বিস্ময়।
মুদ্রাগুলো ব্যাগে ভরার ব্যাপারে হ্যাগ্রিড হ্যারিকে সাহায্য করলেন, হ্যাগ্রিড বললেন–সিন্দুক আর ভল্টে আরো আছে।
গ্রিপহুক বলল–ধীরে ধীরে সেগুলোও পাবে।
তারা আগে বাড়তে লাগল। তারা যতই আগে বাড়ল ততই তারা শীত অনুভব করতে লাগল।
মাটির নিচে একটা ছোট নদী। ওরা নদী অতিক্রম করল। তাদের সামনে সাতশ তের নাম্বার ভল্ট, কিন্তু চাবি ঢোকাবার ছিদ্র নেই। গ্রিপহুক বলল–সরে দাঁড়াও। বলেই তার লম্বা আঙুল ভল্টের গায়ে লাগিয়ে দিল। ভল্টের দেয়াল সরে গেল। গ্রিপহুক বলল–গ্রীংগট গবলিন ছাড়া অন্য কেউ হলে দরোজা ওদের শুষে নিত এবং ওরা এর ভেতর আটকে যেত।
হ্যারি জিজ্ঞেস করল–কেউ ঢুকেছে কিনা তা দেখার জন্য তুমি কতদিন পর পর পরীক্ষা কর।
গ্রিপহুক জবাব দিল–দশ বছরে অন্তত একবার। গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা নির্ভর ভল্টে কিছু অসাধারণ ঘটনা ঘটে থাকে। হ্যারি নিশ্চিত ছিল, এখানে অসাধারণ কিছু সে দেখবে। ঘর ভর্তি অলংকার। হঠাৎ একটা ছোট প্যাকেটের ওপর তার দৃষ্টি পড়ল। হ্যাগ্রিড মাটি থেকে প্যাকেটটা তুলে তার কোটের ভেতর রাখল। হ্যারি জানতে চাইল, ভেতরে কী!
চলে এসো। এই মাটির তলার বাহনে। হ্যাগ্রিড কললেন–আমার সাথে এখন কোন কথা বলবে না।
আমার এখন কোন কথা না বলাই ভাল। হ্যারি ভাবছে এত ভারী বস্তা ভর্তি টাকা পয়সা নিয়ে তারা কোথায় এবং কিভাবে যাবে।
একটা বাহনে করে ঝড়ের গতিতে তারা গ্রীংগটসের বাইরে চলে এলো। বাইরে তারা সূর্যের আলোর রেখা দেখতে পেল।
তার এখন জানার দরকার নেই কত গ্যালিওনে এক পাউন্ড হয়। এত অর্থ নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে যা সারা জীবনেও সে দেখেনি–সারা জীবনে ডাডলিও দেখেনি।
এখনও হ্যারির ইউনিফর্ম কেনা বাকি। মাদাম মালকিনের দোকানে কি ইউনিফর্ম পাওয়া যাবে?
মাদাম মালকিনের সঙ্গেও আলাপ হলো।
অবশ্যই পাওয়া যাবে। তিনি বললেন–হোগার্টস থেকেও একটি ছেলে এসেছে, তাকেও ইউনিফর্ম দিয়েছি।
সেই ছেলেটার সাথেও হ্যারি আলাপ করল। তাদের মধ্যে বেশ কিছু কথাবার্তা হলো। স্কুল সম্পর্কেও তাদের মধ্যে কথা হলো। তার কাছ থেকে একটা নাম শোনা গেল–কিডিচ। কিডিচ কী? কিডিচ এক ধরনের খেলা। খেলাটা অনেকটা ফুটবল খেলার মতো। এ খেলায় কিছু ঝাড়ু লাগে।
ফ্লারিশ ব্লট নামে এক বইয়ের দোকান থেকে হ্যারির জন্য স্কুলের বই কেনা হলো। এই দোকানে বইয়ের স্ট্যাকগুলো সিলিং পর্যন্ত পৌঁছেছে।
চামড়া বাঁধাই বিরাট বিরাট বই, সিল্ক কাপড়ের বাঁধাই ডাকটিকেটের মতো ক্ষুদ্র বই, বিচিত্র রকমের প্রতীক চিহ্নের বই আবার কিছু বই আছে যেখানে কিছুই ছাপা নেই। এমনকি ডাডলির মতো ছেলে–যে মোটেও বই পড়ে না, এসব বই পাওয়ার জন্য সেও নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যেত।
বই দেখতে দেখতে এক জায়গায় হ্যারি থেমে গেল, বইটা ছিল শাপ ও প্রতিশাপ… কারসেস এন্ড কাউন্টার কারসেস। বন্ধুদের কিভাবে বোকা বানানো যায় বা শত্রুদের কিভাবে ক্ষতি করা যায়। লেখক অধ্যাপক ভিনডিকটাস ভিরিডিয়ান।
হ্যাগ্রিড এখান থেকে হ্যারিকে প্রায় ঠেলেই সরালেন। আমি দেখছিলাম, ডাডলিকে অভিশাপ দেয়ার কিছু পাওয়া যায় কিনা।
মন্দ নয়, আমি বলবো না যে আইডিয়াটা খারাপ হ্যাগ্রিড বললেন, কিন্তু তুমি তো বিশেষ কোন কারণ ছাড়া মাগলদের ওপর শাপ দিতে পারবে না। এটা নিষিদ্ধ। তাছাড়া তুমি এ কাজ পারবেও না। এর জন্য তোমাকে যথেষ্ট পড়াশোনা করতে হবে।
হ্যাগ্রিড হ্যারিকে স্বর্ণের তৈরি কলড্রন কিনতে দেননি। তবে জাদুপানীয় তৈরির উপাদান মাপার নিক্তি ও ভাঁজ করা যায় এমন একটি স্কেল কিনে দিলেন। এরপর ওরা গেল ওষুধের দোকানে–ফার্মেসিতে। পচা ডিম ও পচা পাতাকপির বিশ্রী গন্ধ এক ধরনের ভিন্ন পরিবেশের সৃষ্টি করেছে সেখানে। মেঝেতে পিপা ভর্তি কিছু সরু জিনিস, জারভর্তি ভেষজ, শুকনো শিকড় ও চকচকে উজ্জ্বল গুড়ো পদার্থ দেয়ালে লাইন করে সাজানো।
পাখার বান্ডেল, ছাদ থেকে নিচে পর্যন্ত ঝোলানো সুতোয় বিষধর সাপের দাঁত, পাখির হাড়ের তৈরি অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি। হ্যারি নিজে একুশ গ্যালিওন দিয়ে ইউনিকর্নের দুটো রূপার শিং কিনলো।
দোকান থেকে বের হয়ে হ্যাগ্রিড হ্যারির জন্য ক্রয় তালিকা বের করলেন। ও, তোমার জন্মদিনের উপহার তো কেনা হয়নি। হ্যারি লজ্জা পেয়ে বলল, না এর কোন প্রয়োজন নেই।
না, এ কথাটা তোমাকে আমার বলার দরকার ছিল না। তোমার জন্য ব্যাঙ কিনবো না। এটা কেউ এখন পছন্দ করে না। বিড়ালও না। বিড়াল থাকলে আমার হাঁচি হয়। তোমার জন্য কিনবো পেঁচা। এটা এখনকার ছোটরা খুব পছন্দ করে। খুবই প্রয়োজনীয়। চিঠিপত্রও নিয়ে যায়। তোমার অন্য জিনিসপত্রও নিয়ে যেতে পারবে।
আউল এমপোরিয়ামটা ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকার। পেঁচার ঝটপটানির শব্দ। একটা সাদা পেঁচাকে একটা সুন্দর বড় খাঁচায় ভরে হ্যারি অগ্রসর হতে লাগল।
কুড়ি মিনিট পরে ওরা আউল এমপোরিয়াম অতিক্রম করে শেষ দোকানে পৌঁছল। সরু এবং নোংরা রাস্তা। দরোজায় লেখা আছে অলিভ্যান্ডার্স–সুন্দর জাদুদণ্ড প্রস্তুতকারক, স্থাপিত খ্রি. পূ. ৩৮২।
তারা দোকানের ভেতর প্রবেশ করার সাথে সাথেই দোকানের বেশ ভেতর থেকে টুং করে ঘণ্টা বাজল। কেউ আসলেই এটা বাজে। ভেতরটা খুবই ছোট, বসার জন্য একটা মাত্র চেয়ার। সেখানে হ্যাগ্রিড বসলেন। সেখানকার নিস্তব্ধতা হ্যারির কাছে মনে হলো যেন কোন পাঠাগারে তারা প্রবেশ করছে। ছোট ছোট বাক্সে সিলিং পর্যন্ত বই। ধুলো জমেছে। পিন পতন নিস্তব্ধতা। গুড আফটারনুন শব্দ কানে ভেসে আসায় হ্যারি চমকে উঠল। হ্যাগ্রিডও চমকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। এক বৃদ্ধ লোক তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখ দুটো চাঁদের আলোর মত জ্বল জ্বল করছে।
***
আহ্ হা, দোকানে বৃদ্ধ লোকটি হ্যারিকে বললেন–হ্যাঁ, হ্যারি আমি ভাবছিলাম–তোমার সাথে শিগগিরই আমার দেখা হবে। তোমার চোখ ঠিক তোমার মায়ের মতো। মনে হচ্ছে যেন গতকালই তিনি এখানে এসেছিলেন। তার জাদুদণ্ড কিনছেন। জাদুকাঠির দৈর্ঘ্য ছিল সোয়া দশ ইঞ্চি।
তোমার বাবা মেহগনি কাঠের জাদুকাঠি পছন্দ করতেন। তার কাঠির দৈর্ঘ্য ছিল ১১ ইঞ্চি।
মি. অলিভাল্ডার হ্যারির কপালের বিদ্যুৎ চমকানোর সাদৃশ্য কাটা দাগে তার লম্বা ও সাদা আঙ্গুল স্পর্শ করলেন। তারপর বললেন, আমি দুঃখিত, যে জাদুর কাঠি এই ঘটনা ঘটিয়েছে তা আমিই বিক্রি করেছি। সাড়ে তের ইঞ্চি লম্বা খুবই শক্তিশালী এই কাঠি ভুল মানুষের হাতে পড়েছিল। আমি যদি জানতাম এই জাদুকাঠিটা পৃথিবীতে কি করতে যাচ্ছে…।
তিনি সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য হ্যারির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তার চোখ পড়লো হ্যাগ্রিডের দিকে, রুবিয়াস। রুবিয়াস হ্যাগ্রিড! কি ভাল লাগছে তোমাকে দেখে… ওফ, ষোল ইঞ্চি, একটু বাঁকা, তাই না?
জী স্যার, ওটা তা-ই ছিল, হ্যাগ্রিড বললেন।
ওটা খুবই ভাল জাদুকাঠি ছিল। তুমি যখন বহিষ্কৃত হলে তখন ওরা ওটাকে দুটুকরো করে দিয়েছিল, ঠিক তাই না। মি. অলিভান্ডার পেছন ফিরে বললেন।
হ্যাঁ, তারা দু টুকরো করেছিল। পদচারণা করতে করতে হ্যাগ্রিড বললেন খণ্ডগুলো অবশ্য আমার কাছেই আছে। কথাটা বলে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
কিন্তু তুমি তো ওগুলো এখন ব্যবহার করো না?
মি. অলিভান্ডার বেশ জোর দিয়ে বললেন।
না স্যার—হ্যাগ্রিড দ্রুত উত্তর দিলেন।
হ্যারি লক্ষ্য করলো হ্যাগ্রিড যখন কথা বলছেন, তখন তিনি খুব শক্ত করে তার গোলাপী ছাতা আঁকড়ে ধরেছিলেন।
তারপর মি. অলিভান্ডার হ্যারির দিকে ফিরে বললেন। এখন কি ধরনের জাদুর কাঠি চাই তোমার? তিনি মাপ নেওয়ার জন্য তার পকেট থেকে রূপোর দাগ দেওয়া লম্বা মাপের ফিতা বের করলেন। তিনি হ্যারিকে মাপলেন, কাঁধ থেকে আঙ্গুল, তারপর কব্জি থেকে কনুই, কাঁধ থেকে ভূমি, কনুই থেকে বগল ও মাথা চক্রাকারে। তিনি যখন মাপ নিচ্ছিলেন তখন বলে চলছিলেন, প্রত্যেকটি অলিভান্ডার জাদুর কাঠিতে শক্তিশালী জাদুর পদার্থ থাকে মি. পটার। আমরা ইউনিকর্নের চুল, ফিনিক্সের লেজ ও ড্রাগনের হার্টস্ট্রিং ব্যবহার করি। তবে সব জাদুকাঠি এক হয় না। যেমন সব ইউনিকর্ন, ড্রাগন বা ফিনিক্স সমান হয় না। এটা নিশ্চিত যে তুমি এর চেয়ে ভাল জাদুকাঠি আর কোথাও পাবে না। এক সময় হঠাৎ করে হ্যারি দেখলো মাপার ফিতাটি নিজে নিজেই তার মাপ নিচ্ছে। মি. অলিভান্ডার তখন বিভিন্ন তাক খুঁজে বাক্স নামাচ্ছিলেন। এটাই তোমার জন্য ভাল হবে। মি. অলিভান্ডার বললেন, পরীক্ষা করে দেখ। বীচ কাঠ এবং ড্রাগন হার্টস্ট্রিং-এর তৈরি। নয় ইঞ্চি লম্বা। সুন্দর এবং বাঁকানো যায়। এটা নিয়ে ঢেউয়ের মত নাড়াও।
হ্যারি কাঠিটি নিয়ে যেই একটু ঢেউ খেলালো এবং কোন কিছু অনুভব করার আগেই মি, অলিভান্ডার দ্রুত তার হাত থেকে কাঠিটি কেড়ে নিলেন। না-এটা দেখ! এবনি গাছের কালো কাঠের এবং ইউনিকর্ন চুলের, সাড়ে আট ইঞ্চি। দেখ, চেষ্টা কর।
হ্যারি চেষ্টা করে। একের পর এক কাঠি দিয়েই যাচ্ছেন মি. অলিভান্ডার। হ্যারি বুঝতেই পারে না, ঠিক কোনটার জন্য মি. অলিভাণ্ডার অপেক্ষা করছেন। উঁচু টুলটিতে একের পর এক জাদুকাঠি জমে এক বড় স্তূপে পরিণত হলো। মি. অলিভান্ডারের যেন কোন কষ্টই হচ্ছে না, আনন্দেই একের পর এক জাদুরকাঠি তাক থেকে নামাচ্ছেন আর হ্যারিকে দিয়ে চেষ্টা করছেন।
আমরা ঠিক কাঠিটাই পেয়ে যাব।
তিনি স্বগতোক্তি করলেন। হ্যাঁ বোধহয় এটাই–বেরি গাছের কাঠ মাঝখানে ফাঁপা এবং ফনিক্স পাখির পাখা, এগার ইঞ্চি, সুন্দর ও বাঁকানো। যায়।
হ্যারি জাদুর কাঠিটা হাতে নিল। সে তার আঙ্গুলে হঠাৎ করে তাপ অনুভব করলো। কাঠিটা সে তার মাথারও উঁচুতে উঠালো এবং শো শো করে নিচে নামালো, কাঠিটির প্রান্ত থেকে তারা বাতির মতো লাল ও সোনালী আলো বিভূতির মতো বিচ্ছুরিত হলো, ঘরের দেয়াল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। হ্যাগ্রিড তালি দিয়ে উঠলেন। মি. অলিভান্ডার চিৎকার করে উঠলেন, ওহ, ব্রাভো, খুব ভালো, ঠিক… ঠিক… কি আশ্চর্য… তিনি হ্যারির জাদুর কাঠিটি বাক্সে ভরলেন, এবং বাদামী কাগজে মোড়াতে মোড়াতে বিড় বিড় করে বললেন, কি অদ্ভুত… কি অদ্ভুত…
আপনি আশ্চর্য হলেন কেন? হ্যারি জিজ্ঞেস করলো। মি. অলিভান্ডার হ্যারির দিকে বিষণ্ণভাবে তাকালেন আমার স্মরণ আছে, প্রত্যেকটি জাদুকাঠি যা এ পর্যন্ত আমি বিক্রি করেছি, মি. পটার। প্রত্যেকটি জাদুকাঠিই। তোমার জাদুকাঠিতে যে ফিনিক্স পাখিটার লেজের পালক দেওয়া হয়েছে সেই পাখিরই আর একটা পালক–শুধু আর একটাই মাত্র। আশ্চর্যজনক, তোমার ভাগ্য নির্ধারিত ছিল এই জাদুদন্ডটাতেই এই জোড়ার অপরটা তোমার কপালের এই দাগের কারণ।
হ্যাঁ–সেটাই, সাড়ে তের ইঞ্চি। সত্যিই কি আশ্চর্যভাবে এটা হলো। আমার স্পষ্ট স্মরণ আছে এর অপরটি কোন জাদুকর কিনেছিলেন। আমি তোমার কাছে অনেক বড় কিছু আশা করি মি. পটার… বড় কিছু… যিনি অপরটি কিনেছিলেন নিশ্চয়ই তিনি বড় মহান কিছু করেননি। তিনি বড় ধরনের সাংঘাতিক খারাপ কাজ করেছিলেন।
হ্যারি কেঁপে উঠলো। মি. অলিভান্ডারকে তার খুব একটা পছন্দ হয়নি। জাদুর কাঠিটার জন্য সে স্বর্ণের সাত গ্যালিওন দিল এবং মি. অলিভান্ডার মাথা নিচু করে অভিবাদন জানিয়ে তাদের বিদায় দিলেন।
বিকেলে আকাশে সূর্য যেন নিচু হয়ে ঝুলছিল। ওরা ডায়াগন এলি থেকে বেরিয়ে এল সেই লিকি কলড্রন অতিক্রম করে। পথে হ্যারি কোন কথা বলল না। আশপাশের লোকজনের দিকেও তাকায়নি।
ব্যাগ কাঁধে তুলে হ্যাগ্রিড বললেন–ট্রেন ধরার আগে খাবার জন্য কিছু সময় আছে।
হ্যাগ্রিড হ্যারির জন্য একটি হ্যামবার্গার কিনলেন। তারা প্লাস্টিকের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। হ্যারি চারদিকে তাকাচ্ছে। সবকিছু তার কাছে অদ্ভুত মনে হচ্ছে।
হ্যারি সব কিছু ঠিক আছে তো? হ্যাগ্রিড জানতে চাইলেন। হ্যারি নিজকে ঠিক প্রকাশ করার ভাষা পাচ্ছিল না। এই প্রথম সে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ জন্মদিন পালন করেছে। সে হ্যাম্বারগারে কামড় দিল।
একটু থেমে হ্যারি বলল–আমার কাছে সবকিছু অপূর্ব লাগছে। লোকজন, লিকি কলড্রন, অধ্যাপক কুইরেল, অলিভান্ডার সবই অপূর্ব। কিন্তু আমি তো জাদুবিদ্যার কিছুই জানি না। কীভাবে তারা আমার কাছে থেকে বড় কিছু আশা করেন। আমি বিখ্যাত, কিন্তু আমি জানি না–কেন আমি বিখ্যাত–আমার বাবা মা যে রাতে মারা যান সে রাতে কি ঘটেছিল। টেবিলের অপর প্রান্তে হ্যাগ্রিডের ভ্রূ ও দাঁড়ি ভেদ করে একটি সদয় স্মিত হাসির রেখা দেখা দিল।
হ্যাগ্রিড তাকে অভয় দিয়ে বললেন–হ্যারি, তুমি চিন্তা করো না। তুমি দ্রুতই সব জানতে পারবে। সবাইকে হোগার্টসে প্রথম থেকেই শুরু করতে হয়, তুমি সেখানে ভালোই করবে। আমি জানি এটা কঠিন। তবে, তোমাকে সেখানে ভিন্নভাবে দেখা হবে, তোমার কাছে বেশি… আশা করা হবে, এটা সব সময় কঠিন। তবে হোগার্টসে তোমার সময় ভালোই কাটবে।
হ্যাগ্রিড হ্যারিকে ট্রেনে উঠতে সাহায্য করলেন। এই ট্রেনে করেই হ্যারি ডার্সলিদের পরিবারে ফিরে যাবে। বিদায় নেয়ার আগে হ্যাগ্রিড হ্যারিকে একটা খাম দিয়ে বললেন, হোগার্টসে যাবার জন্য তোমার টিকিট, পহেলা সেপ্টেম্বর–কিংস ক্রস, এটা ওয়ানওয়ে টিকেট। ডার্সলি পরিবারে যদি তোমার কোন সমস্যা হয় পেঁচার মাধ্যমে তুমি আমাকে চিঠি দিও।
তোমার সাথে শিগগিরই দেখা হবে।
ট্রেন স্টেশন ত্যাগ করল। যতক্ষণ দেখা গেল ততক্ষণ হ্যারি হ্যাগ্রিডের দিকে তাকিয়ে রইল।