আল মাহমুদ এর সেরা কবিতা সংগ্রহ



কাঁপুনি
        আল মাহমুদ

শেষ হয়নি কি, আমাদের দেয়া-নেয়া?  
 হাত তুলে আছে, পাড়ানি মেয়েটি  
 বিদায়ের শেষ খেয়া,  
 ডাকছে আমাকে হাঁকছে আমাকে  
 আমিই শেষের লোক।  
 শ্লোক শেষ হলো, অন্ত-মিলেরও শেষ।  
 কাঁপছে নায়ের পাটাতন বুঝি  
 ছেড়ে যেতে উৎসুক।  
  
 আমি চলে গেলে এ পারে আঁধারে কেউ থাকবে না আর  
 সব ভেসে গেছে এবার তবে কি ভাসাবো অন্ধকার?  
 আলো-আঁধারির এই খেলা তবে আমাকে নিয়েই শেষ  
 আমার শরীর কাঁপছে যেমন কাঁপছে বাংলাদেশ। 


   কবিতা এমন
       আল মাহমুদ

কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান  
 আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি  
 পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন  
 আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি–রাবেয়া রাবেয়া–  
 আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!  
  
 কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী  
 কুয়াশায়-ঢাকা-পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন  
 পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ  
 মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠানে ছড়ানো জাল আর  
 বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর।  
  
 কবিতা তো ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর  
 ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান  
 চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে  
 নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা।  
  
 কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস  
 ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর  
 গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর  
 কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার। 


   পাখির মতো
         আল মাহমুদ

আম্মা বলেন, পড়রে সোনা  
 আব্বা বলেন, মন দে;  
 পাঠে আমার মন বসে না  
 কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।  
  
 আমার কেবল ইচ্ছে জাগে  
 নদীর কাছে থাকতে,  
 বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে  
 পাখির মতো ডাকতে।  
  
 সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে  
 কর্ণফুলীর কূলটায়,  
 দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি  
 ফেরেস্তারা উল্টায়।  
  
 তখন কেবল ভাবতে থাকি  
 কেমন করে উড়বো,  
 কেমন করে শহর ছেড়ে  
 সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো!  
  
 তোমরা যখন শিখছো পড়া  
 মানুষ হওয়ার জন্য,  
 আমি না হয় পাখিই হবো,  
 পাখির মতো বন্য। 

৪.    না ঘুমানোর দল
         আল মাহমুদ

নারকেলের ঐ লম্বা মাথায়  
 হঠাৎ দেখি কাল  
 ডাবের মতো চাদঁ উঠেছে  
 ঠান্ডা ও গোলগাল।  
  
 ছিটকিনিটা আস্তে খুলে  
 পেরিয়ে এলেম ঘর  
 ঘুমন্ত এই মস্ত শহর  
 করছিলো থরথর।  
  
 মিনারটাকে দেখছি যেন  
 দাড়িয়ে আছেন কেউ,  
 পাথরঘাটার গির্জেটা কি  
 লাল পাথরের ঢেউ?  
  
 চৌকিদারের হাক শুনে যেই  
 মোড় ফিরেছি বায়–  
 কোত্থেকে এক উটকো পাহাড়  
 ডাক দিল আয় আয়।  
  
 পাহাড়টাকে হাত বুলিয়ে  
 লাল দিঘীটার পাড়  
 এগিয়ে দেখি জোনাকিদের  
 বসেছে দরবার।  
  
 আমায় দেখে কলকলিয়ে  
 দীঘির কালো জল  
 বললো, এসো, আমরা সবাই  
 না ঘুমানোর দল-  
  
 পকেট থেকে খুলো তোমার  
 পদ্য লেখার ভাজঁ  
 রক্তজবার ঝোপের কাছে  
 কাব্য হবে আজ ।  
  
 দীঘির কথায় উঠলো হেসে  
 ফুল পাখিদের সব  
 কাব্য হবে, কাব্য হবে-  
 জুড়লো কলরব।  
  
 কী আর করি পকেট থেকে  
 খুলে ছড়ার বই  
 পাখির কাছে, ফুলের কাছে  
 মনের কথা কই। 

৫.     ভর দুপুরে
        আল মাহমুদ

মেঘনা নদীর শান্ত মেয়ে তিতাসে  
 মেঘের মত পাল উড়িয়ে কী ভাসে!  
 মাছের মত দেখতে এ কোন পাটুনি  
 ভর দুপুরে খাটছে সখের খাটুনি।  
  
 ওমা এ-যে কাজল বিলের বোয়ালে  
 পালের দড়ি আটকে আছে চোয়ালে  
 আসছে ধেয়ে লম্বা দাড়ি নাড়িয়ে,  
 ঢেউয়ের বাড়ি নাওয়ের সারি ছাড়িয়ে।  
  
 কোথায় যাবে কোন উজানে ও-মাঝি  
 আমার কোলে খোকন নামের যে-পাজি  
 হাসেছ, তারে নাও না তোমার নায়েতে  
 গাঙ-শুশুকের স্বপ্নভরা গাঁয়েতে;  
  
 সেথায় নাকি শালুক পাতার চাদরে  
 জলপিপিরা ঘুমায় মহা আদরে,  
 শাপলা ফুলের শীতল সবুজ পালিশে  
 থাকবে খোকন ঘুমিয়ে ফুলের বালিশে।

 ৬.     নোলক
      আল মাহমুদ

আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে  
 হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।  
 নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?  
 -হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।  
 বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে  
 শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।  
  
 জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক  
 সবুজ বনের হরিণ টিয়ে করে রে ঝিকমিক।  
 বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই,  
 আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই।  
  
 কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন  
 আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ।  
 সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি নাতো!  
 ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো  
 বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক  
 হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।  
 এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা  
 আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না। 

৭.    হায়রে মানুষ
        আল মাহমুদ

একটু ছিল বয়েস যখন ছোট্ট ছিলাম আমি  
  
 আমার কাছে খেলাই ছিল কাজের চেয়ে দামি।  
 উঠোন জুড়ে ফুল ফুটেছে আকাশ ভরা তারা  
 তারার দেশে উড়তো আমার পরাণ আত্মহারা।  
  
 জোছনা রাতে বুড়িগঙ্গা তুলতো যখন ঢেউ  
 আমার পিঠে পরীর ডানা পরিয়ে দিতো কেউ।  
 দেহ থাকতো এই শহরে উড়াল দিতো মন  
 মেঘের ছিটার ঝিলিক পেয়ে হাসতো দু’নয়ন।  
  
 তারায় তারায় হাঁটতো আমার ব্যাকুল দু’টি পা  
 নীল চাঁদোয়ার দেশে হঠাৎ রাত ফুরাতো না।  
 খেলার সাথী ছিল তখন প্রজাপতির ঝাঁক  
 বনভাদালির গন্ধে কত কুটকুটোতো নাক;  
 কেওড়া ফুলের ঝোল খেয়ে যে কোল ছেড়েছে মা’র  
 তার কি থাকে ঘরবাড়ি না তার থাকে সংসার?  
  
 তারপরে যে কী হলো, এক দৈত্য এসে কবে  
 পাখনা দুটো ভেঙে বলে মানুষ হতে হবে।  
 মানুষ হওয়ার জন্য কত পার হয়েছি সিঁড়ি  
 গাধার মত বই গিলেছি স্বাদ যে কি বিচ্ছিরি।  
  
 জ্ঞানের গেলাস পান করে আজ চুল হয়েছে শণ  
 কেশের বাহার বিরল হয়ে উজাড় হলো বন।  
 মানুষ মানুষ করে যারা মানুষ তারা কে?  
 অফিস বাড়ির মধ্যে রোবোট কলম ধরেছে।  
  
 নরম গদি কোশন আসন চশমা পরা চোখ  
 লোক ঠকানো হিসেব লেখে, কম্প্যুটারে শ্লোক।  
 বাংলাদেশের কপাল পোড়ে ঘূর্ণিঝড়ে চর  
 মানুষ গড়ার শাসন দেখে বুক কাঁপে থরথর।  
 ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’- গান শোননি ভাই?  
 মানুষ হবার ইচ্ছে আমার এক্কেবারে নাই। 

৮.   রবীন্দ্রনাথ 
      আল মাহমুদ

এ কেমন অন্ধকার বঙ্গদেশ উত্থান রহিত  
 নৈশব্দের মন্ত্রে যেন ডালে আর পাখিও বসে না।  
 নদীগুলো দুঃখময়, নির্পতগ মাটিতে জন্মায়  
 কেবল ব্যাঙের ছাতা, অন্যকোন শ্যামলতা নেই।  
  
 বুঝি না, রবীন্দ্রনাথ কী ভেবে যে বাংলাদেশে ফের  
 বৃক্ষ হয়ে জন্মাবার অসম্ভব বাসনা রাখতেন।  
 গাছ নেই নদী নেই অপুষ্পক সময় বইছে  
 পুনর্জন্ম নেই আর, জন্মের বিরুদ্ধে সবাই  
  
 শুনুন, রবীন্দ্রনাথ আপনার সমস্ত কবিতা  
 আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতে থাকি  
 নিশ্চিত বিশ্বাস এই, একটিও উদ্ভিদ হবে না  
 আপনার বাংলাদেশ এ রকম নিষ্ফলা, ঠাকুর!  
  
 অবিশ্বস্ত হাওয়া আছে, নেই কোন শব্দের দ্যোতনা,  
 দু’একটা পাখি শুধু অশত্থের ডালে বসে আজও  
 সঙ্গীতের ধ্বনি নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাক্যালাপ করে;  
 বৃষ্টিহীন বোশেখের নিঃশব্দ পঁচিশ তারিখে। 

৯.   অবুঝের সমীকরণ
          আল মাহমুদ

কবিতা বোঝে না এই বাংলার কেউ আর  
 দেশের অগণ্য চাষী, চাপরাশী  
 ডাক্তার উকিল মোক্তার  
 পুলিস দারোগা ছাত্র অধ্যাপক সব  
 কাব্যের ব্যাপারে নীরব!  
  
 স্মাগলার আলোচক সম্পাদক তরুণীর দল  
 কবিতা বোঝে না কোনো সঙ  
 অভিনেত্রী নটী নারী নাটের মহল  
 কার মনে কাতোটুকু রঙ?  
 ও পাড়ার সুন্দরী রোজেনা  
 সারা অঙ্গে ঢেউ তার, তবু মেয়ে  
 কবিতা বোঝে না!  
  
 কবিতা বোঝে না আর বাংলার বাঘ  
 কুকুর বিড়াল কালো ছাগ,  
 খরগোস গিরগিটি চতুর বানর  
 চক্রদার যত অজগর!  
  
 কবিতা বোঝে না এই বাঙলার বনের হরিণী  
 জঙ্গলের পশু-পাশবিনী।  
 শকুনী গৃধিনী কাক শালিক চড়ুই  
 ঘরে ঘরে ছুঁচো আর উই;  
 বাংলার আকাশের যতেক খেচর  
 কবিতা বোঝে না তারা। কবিতা বোঝে না অই  
 বঙ্গোপসাগরের কতেক হাঙর! 

১০. জেলগেটে দেখা
       আল মাহমুদ


সেলের তালা খোলা মাত্রই এক টুকরো রোদ এসে পড়লো ঘরের মধ্যে  
 আজ তুমি আসবে।  
 সারা ঘরে আনন্দের শিহরণ খেলছে। যদিও উত্তরের বাতাস  
 হাড়েঁ কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে বইছে, তবু আমি ঠান্ডা পানিতে  
 হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। পাহারাদার সেন্ট্রিকে ডেকে বললাম,  
 আজ তুমি আসবে। সেন্ট্রি হাসতে হাসতে আমার সিগ্রেটে  
 আগুন ধরিয়ে দিল। বলল, বারান্দায় হেটেঁ ভুক বাড়িয়ে নিন  
 দেখবেন, বাড়ী থেকে মজাদার খাবার আসবে।  
  
 দেখো, সবাই প্রথমে খাবারের কথা ভাবে।  
 আমি জানি বাইরে এখন আকাল চলছে। ক্ষুধার্ত মানুষ  
 হন্যে হয়ে শহরের দিকে ছুটে আসছে। সংবাদপত্রগুলোও  
 না বলে পারছে না যে এ অকল্পনীয়।  
 রাস্তায় রাস্তায় অনাহারী শিশুদের মৃতদেহের ছবি দেখে  
 আমি কতদিন আমার কারাকক্ষের লোহার জালি  
 চেপে ধরেছি।  
 হায় স্বাধীনতা, অভুক্তদের রাজত্ব কায়েম করতেই কি আমরা  
 সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলাম।  
  
 আর আমাকে ওরা রেখেছে বন্দুক আর বিচারালয়ের মাঝামাঝি  
 যেখানে মানুষের আত্মা শুকিয়ে যায়। যাতে  
 আমি আমরা উৎস খুঁজে না পাই।  
 কিন্তু তুমি তো জানো কবিদের উৎস কি? আমি পাষাণ কারার  
 চৌহদ্দিতে আমার ফোয়ারাকে ফিরিয়ে আনি।  
 শত দুর্দৈবের মধ্যেও আমরা যেমন আমাদের উৎসকে  
 জাগিয়ে রাখতাম।  
  
 চড়ুই পাখির চিৎকারে বন্দীদের ঘুম ভাঙছে।  
 আমি বারান্দা ছেড়ে বাগানে নামলাম।  
 এক চিলতে বাগান  
 ভেজা পাতার পানিতে আমার চটি আর পাজামা ভিজিয়ে  
 চন্দ্রমল্লিকার ঝোপ থেকে একগোছা শাদা আর হলুদ ফুল তুললাম।  
 বাতাসে মাথা নাড়িয়ে লাল ডালিয়া গাছ আমাকে ডাকলো।  
 তারপর গেলাম গোলাপের কাছে।  
 জেলখানার গোলাপ, তবু কি সুন্দর গন্ধ!  
 আমার সহবন্দীরা কেউ ফুল ছিড়েঁ না, ছিঁড়তেও দেয় না  
 কিন্তু আমি তোমার জন্য তোড়া বাঁধলাম।  
  
 আজ আর সময় কাটতে চায়না। দাড়ি কাটলাম। বই নিয়ে  
 নাড়াচাড়া করলাম। ওদিকে দেয়ালের ওপাশে শহর জেগে উঠছে।  
 গাড়ীর ভেঁপু রিক্সার ঘন্টাধ্বনি কানে আসছে।  
 চকের হোটেলগুলোতে নিশ্চয়ই এখন মাংসের কড়াই ফুটছে।  
 আর মজাদার ঝোল ঢেলে দেওয়া হচ্ছে  
 গরীব খদ্দেরদের পাতে পাতে।  
  
 না বাইরে এখন আকাল। মানুষ কি খেতে পায়?  
 দিনমজুরদের পাত কি এখন আর নেহারির ঝোলে ভরে ওঠে?  
 অথচ একটা অতিকায় দেয়াল কত ব্যবধানই না আনতে পারে।  
 আ , পাখিরা কত স্বাধীন। কেমন অবলীলায় দেয়াল পেরিয়ে যাচ্ছে  
 জীবনে এই প্রথম আমি চড়ুই পাখির সৌভাগ্যে কাতর হলাম।  
  
 আমাদের শহর নিশ্চয়ই এখন ভিখিরিতে ভরে গেছে।  
 সারাদিন ভিক্ষুকের স্রোত সামাল দিতে হয়।  
 আমি কতবার তোমাকে বলেছি, দেখো  
 মুষ্টি ভিক্ষায় দারিদ্র্য দূর হয় না।  
 এর অন্য ব্যবস্হা দরকার, দরকার সামাজিক ন্যায়ের।  
 দুঃখের শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে।  
 আ , যদি আমার কথা বুঝতে।  
  
 প্রিয়তমা আমার,  
 তোমার পবিত্র নাম নিয়ে আজ সূর্য উদিত হয়েছে। আর  
 উষ্ণ অধীর রশ্মির ফলা গারদের শিকের ওপর পিছলে যাচ্ছে।  
 দেয়ালের ওপাশ থেকে ঘুমভাঙ্গা মানুষের কোলাহল।  
 যারা অধিক রাতে ঘুমোয় আর জাগে সকলের আগে।  
          যারা ঠেলে।  
            চালায়।  
              হানে।  
             ঘোরায়।  
              ওড়ায়।  
                পেড়ায়।  
 আর হাত মুঠো করে এগিয়ে যায়।  
 সভ্যতার তলদেশে যাদের ঘামের অমোঘ নদী।  
 কোনদিন শুকোয় না। শোনো, তাদের কলরব।  
  
 বন্দীরা জেগে উঠছে। পাশের সেলে কাশির শব্দ  
 আমি ঘরে ঘরে তোমার না ঘোষণা করলাম  
 বললাম, আজ বারোটায় আমার দেখা।  
 খুশীতে সকলেই বিছানায় উঠে বসলো।  
 সকলেরই আশা তুমি কোন না কোন সংবাদ নিয়ে আসবে।  
 যেন তুমি সংবাদপত্র! যেন তুমি  
 আজ সকালের কাড়জের প্রধান শিরোনামশিরা!  
  
 সূর্য যখন অদৃশ্য রশ্মিমালায় আমাকে দোলাতে দোলাতে  
 মাঝ আকাশে টেনে আনলো  
 ঠিক তখুনি তুমি এলে।  
 জেলগেটে পৌছেঁ দেখলাম, তুমি টিফিন কেরিয়ার সামনে নিয়ে  
 চুপচাপ বসে আছো।  
 হাসলে, ম্লান, সচ্ছল।  
 কোনো কুশল প্রশ্ন হলো না।  
  
 সাক্ষাৎকারের চেয়ারে বসা মাত্রই তুমি খাবার দিতে শুরু করলে।  
 মাছের কিমার একটা বল গড়িয়ে দিয়ে জানালে,  
 আবরা ধরপাকড় শুরু হয়েছে।  
 আমি মাথা নাড়লাম।  
  
 মাগুর মাছের ঝোল ছড়িয়ে দিতে দিতে কানের কাছে মুখ আনলে,  
 অমুক বিপ্লবী আর নেই  
 আমি মাথা নামালাম। বললে, ভেবোনা,  
 আমরা সইতে পারবো। আল্লাহ, আমাদের শক্তি দিন।  
 তারপর আমরা পরস্পরকে দেখতে লাগলাম।  
  
 যতক্ষণ না পাহারাদারদের বুটের শব্দ এসে আমাদের  মাঝখানে থামলো। 

১১.   একুশের কবিতা
          আল মাহমুদ

ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ  
 দুপুর বেলার অক্ত  
 বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?  
 বরকতের রক্ত।  
  
 হাজার যুগের সূর্যতাপে  
 জ্বলবে এমন লাল যে,  
 সেই লোহিতেই লাল হয়েছে  
 কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে!  
  
 প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে  
 ছড়াও ফুলের বন্যা  
 বিষাদগীতি গাইছে পথে  
 তিতুমীরের কন্যা।  
  
 চিনতে না কি সোনার ছেলে  
 ক্ষুদিরামকে চিনতে?  
 রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে  
 মুক্ত বাতাস কিনতে?  
  
 পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়  
 ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,  
 ফেব্রুয়ারির শোকের বসন  
 পরলো তারই ভগ্নী।  
  
 প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী  
 আমায় নেবে সঙ্গে,  
 বাংলা আমার বচন, আমি  
 জন্মেছি এই বঙ্গে। 

১২. এক নদী
      আল মাহমুদ


তোমার মুখ ভাবলে, এক নদী  
 বুকে আমার জলের ধারা তোলে;  
 সামনে দেখি ভরা ভাতের থালা  
 ঝালের বাটি উপচে পড়ে ঝোলে।  
  
 পিঠার মতো হলুদ মাখা চাঁদ  
 যেনো নরম কলাপাতায় মোড়া;  
 পোড়া মাটির টুকরো পাত্রকে  
 স্মৃতি কি ফের লাগাতে পারে জোড়া!  
 নীল বইচা মাছের মতো চোখ  
 স্বপ্নে আমায় কুশল পুছে রোজ।  
  
 ‘ভালো কি আছো?’ হায়রে ভালো থাকা!  
 নগরবাসী কে রাখে কার খোঁজ!  
  
 ফিরতে চাই, পাবো কি সেই পথ?  
 তরমুজের ক্ষেতের পাশে ঘর,  
 লজ্জাহীনা ফাজিল ছুঁড়ি এক  
 ভীষণ কালো, হাসতো থর থর!  
  
 মহাকালের কালোর চেয়ে কালো  
 রাত-বরণী রূপসী সেই পরী,  
 কাঁপিয়ে কাঁখে ঠিল্লা ভরা পানি  
 দেহের ভাঁজে ভেজা নীলাম্বরী।  
  
 উঠতো হেঁটে জলের ধার বেয়ে;  
 কালো-বাউশী যেনো কলমী বনে  
 অঙ্গ নেড়ে অস্ত গোলা জলে  
 দেখেছিলাম একদা কুক্ষণে  
  
 ফিরলে আজো পাবো কি সেই নদী  
 স্রোতের তোড়ে ভাঙা সে এক গ্রাম?  
 হায়রে নদী খেয়েছে সব কিছু  
 জলের ঢেউ ঢেকেছে নাম-ধাম। 

১৩. ঊনসত্তের ছড়া-১
         আল মাহমুদ

ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!  
 শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে  
 দুয়োর বেঁধে রাখ।  
 কেন বাঁধবো দোর জানালা  
 তুলবো কেন খিল?  
 আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে  
 ফিরবে সে মিছিল।  
 ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!  
 ট্রাকের মুখে আগুন দিতে  
 মতিয়ুরকে ডাক।  
 কোথায় পাবো মতিয়ুরকে  
 ঘুমিয়ে আছে সে!  
 তোরাই তবে সোনামানিক  
 আগুন জ্বেলে দে। 

১৪.    গৃহলতা
       আল মাহমুদ

ঈদের দিনে জিদ ধরি না আর  
 কানে আমার বাজে না সেই  
 মায়ের অলঙ্কার।  
 কেউ বলে না খাও  
 পাতের ভেতর ঠাণ্ডা হলো  
 কোর্মা ও পোলাও।  
 কোথায় যেন মন চলে যায়  
 মেঘের ওপর ভেসে  
 দুয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে  
 মাতৃছায়া এসে।  
 ছায়া কেবল ছায়া  
 ছায়ার ভেতর বসত করে  
 চিরকালের মায়া।  
 মায়ার মোহে মুগ্ধ আমি  
 মায়ায় ডুবে থাকি  
 মায়ার ঘোরে বন্দী আমি  
 নিজকে বেঁধে রাখি॥ 

১৫. হারানো ছেলের গীত
       আল মাহমুদ

কথা বলি আমি ঝরে যায় ঝরাপাতা  
 হাওয়ায় উড়ছে তোমাদের হালখাতা।  
 তোমাদের সাথে ব্যবধান চিরদিন  
 হিসেব নিকেশ মেলে না তো কোনো দিন।  
 সামনে কেবল খোলা আছে এক পথ  
 এই পথে কবে চলে গেছে সেই রথ।  
 রথের মেলায় এসেছিল এক ছেলে  
 বিস্ময়ভরা চোখের পাপড়ি মেলে।  
 ওই সেই ছেলে হারিয়ে গিয়েছে মাঠে  
 তাকে খুঁজে ফিরি হাটেবাটে ঘাটেঘাটে।  
 তার চোখে জ্বলে আগামী দিনের রোদ  
 পোশাকে তো তার ছিল সম্ভ্রম বোধ  
 সাহসের কথা বলতো সে আগেভাগে  
 এখন সে নেই বলো তো কেমন লাগে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন