লাইভ
ইমতিয়াজ মাহমুদ
❑
রাজাকে একটা পাইথন পেঁচিয়ে ধরেছে। রাজার গোসলখানায়। আজ ভোরে। ভেতর থেকে দরজা দেয়া। আমরা টিভির পর্দায় সরাসরি ঘটনাটা দেখছি। রাজার প্রাসাদের সামনে মানুষের ভিড়। মানুষমাত্রই
সাংবাদিক। মানুষমাত্রই উদ্ধারকর্মী। আমরা টিভির দিকে হা করে তাকিয়ে আছি।
‘মনোজ! মনোজ!
আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?
মনোজ!’
“হ্যাঁ তামান্না। আমরা এখনো রাজার বাড়ির গেইটে দাঁড়িয়ে আছি। নিরাপত্তাকর্মীরা আমাদের ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না।
তাদের ব্যবহার খারাপ। এখানে অসংখ্য মানুষ। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ রাজার বাড়ির সামনে চলে এসেছে। একটা উৎসবমুখর পরিবেশ লক্ষ করা যাচ্ছে। সবার মুখে উত্তেজনা।
সবার একটাই প্রার্থনা। পাইথনটাকে মেরে ফেলতে হবে। রাজাকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু আমাদের ভেতরে
ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। আপনি দেখতে পাচ্ছেন আমাদের একজন ক্যামেরাম্যানকে আমরা গেইটের সামনের গাছে উঠিয়ে
দিয়েছি। তিনি বলেছেন সেখান থেকে তিনি গোসলখানা খুঁজে পাচ্ছেন না। তালগাছটা তার সাথে সহযোগিতা করছে না।”
‘মনোজ!
রাজাকে উদ্ধারের কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?’
“তামান্না গেইটের ভেতরে আমরা অনেক উদ্ধারকর্মীকে দেখতে পেয়েছি। তাদের হাতে করাত আছে।
তারা বলছেন দরজা কেটে ভেতরে ঢোকার জন্য তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা করাতে ধার দিচ্ছেন।
তাদের কর্মতৎপরতায় জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। তারা বলছে করাতে কেন আগে ধার দেয়া হয় নাই?
তামান্না আমরা লক্ষ করছি ফায়ার ব্রিগেডের তিনটা পানি ভর্তি গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করছে।”
‘মনোজ! মনোজ!
পানি দিয়ে তারা কী করবেন?’
“তামান্না এই বিষয়ে আমরা একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে কথা বলেছি। তিনি আমাদের জানিয়েছেন,
দরজা কাটার সময় ঘর্ষণে আগুন লেগে যেতে পারে। সতর্কতা হিসেবে তারা পানি এনেছেন।
দর্শক আপনারা দেখছেন উদ্ধার কাজে যোগ দেয়ার জন্য এইমাত্র একটি অত্যাধুনিক বাহিনী গেইট দিয়ে প্রবেশ করল।
তাদের গায়ে বিশেষ ধরনের পোশাক। পায়ে উন্নত জুতা এবং তাদের প্রত্যেকের হাতে করাত।”
‘মনোজ! রাজার বাড়ির সামনে তো আমরা হাজার হাজার মানুষ দেখতে পাচ্ছি। ওখানে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কি কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?'
“হ্যাঁ তামান্না, আমরা পুলিশের সাথে এবিষয়ে কথা বলেছি। তারা বলেছেন পুলিশ এখানে জিরো টলারেন্স অবস্থানে আছেন। এখানে নিয়মিত সদস্য ছাড়াও সাদা পোশাকের অনেক পুলিশ মোতায়েন করা আছে। পুলিশ ইতোমধ্যে একজন আমড়া বিক্রেতাকে আটক করেছে।”
‘দর্শক পাইথনের হাতে ইতোপূর্বে অনেক সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হলেও কোন রাজার উপর পাইথনের হামলার ঘটনা ইতিহাসে এই প্রথমবারের
মতো ঘটলো। এর আগে ১৯৮৭ সালে আদ্দিস আবাবায় এক কয়লা শ্রমিক এগার ঘন্টা পাইথনের হাতে বন্দী থাকার পর তাকে জীবিত উদ্ধার
করা হয়। এধরনের আরেকটা ঘটনা ঘটে কারাকাসে। এক চিত্রকরের বাড়িতে। তিনি একুশ ঘন্টা পাইথনের হাতে বন্দী ছিলেন। তাকে আর জীবিত পাওয়া যায়নি।
মনোজ! মনোজ! দরজা কতটুকু কাটা হয়েছে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন?’
“তামান্না আমাদেরকে এখানে ঠিকমতো কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগে কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল লোক আমাদের ক্যামেরাম্যানকে
লাঞ্ছিত করেছে।”
‘লাঞ্ছিত করেছে মানে কী?’
“তামান্না আমি বলতে চাচ্ছি কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল লোক আমাদের ক্যামেরাম্যানের গায়ে হাত তুলেছে।”
‘হাত তুলেছে-- তারা কি ক্যামেরাম্যানকে মেরেছে?’
“জ্বি তামান্না তারা ক্যামেরাম্যানকে মেরেছে। এবং আপনি শুনলে অবাক হবেন তারা ক্যামেরার গায়েও হাত তুলেছে।”
‘দর্শক এই বর্বরোচিত ঘটনার বিষয়ে কথা বলার জন্য আমাদের সাথে স্টুডিওতে হাজির হয়েছেন সাংবাদিক পরিষদের একাংশের নেতা জনাব মোতাহার আলী।
মোতাহার কি বলবেন?’
“কী বলব! আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কতটা অমানবিক নির্দয় হলে মানুষ ক্যামেরার গায়ে হাত তুলতে পারে। আমি ক্যামেরার গায়ে হাত তোলার এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আমার আকুল আবেদন থাকবে যেন অবিলম্বে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়।”
‘দর্শক আমরা আবার ফিরে যাচ্ছি রাজার বাড়িতে।
মনোজ! মনোজ!’
“হ্যাঁ, তামান্না আমরা এইমাত্র জানতে পেরেছি পাইথন রাজাকে নয়, রাজার বাবুর্চিকে পেঁচিয়ে ধরেছে এবং ঘটনাটা কাল রাতে ঘটেছে।
রাজার কিচেনে।”
‘মনোজ! কিচেনের দরজা কি খোলা আছে?’
“না তামান্না কিচেনের দরজাও ভেতর থেকে লাগানো।”
‘কিন্তু কিচেনের দরজা কেন লাগানো থাকবে?’
“তামান্না ঘটনাটা রহস্যজনক। আমরা এবিষয়ে একজন দরজা বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলেছিলাম। তিনি বলেছেন এরকম হতে পারে।
তিনি বলেছেন এরকম হয় যে, দরজা অনেক সময় এমনি এমনিও লেগে যায়।
দর্শক আমরা এখন লক্ষ করছি উদ্ধারকর্মীদের মধ্যে একটা ঢিলেঢালা ভাব দেখা যাচ্ছে। তারা এতক্ষণ করাতে ধার দিচ্ছিলেন। কিন্তু বাবুর্চির কথা শুনে ধার দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের এই অবহেলায় মানুষ সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।”
‘মনোজ! আমরা পরে আবার আপনার সাথে যোগাযোগ করবো। আমাদের সাথে এখন কথা বলার জন্য স্টুডিওতে উপস্থিত আছেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার তৌফিকা খাতুন।
সব তো শুনলেন?’
“হ্যাঁ, শুনলাম। অবাক হলাম। আমরা কোন দেশে বাস করছি? বাবুর্চিকে তারা কি মানুষ মনে করে না? না হলে কেন এমন হবে? সেও তো মানুষ, নয় কি? বাবুর্চির কথা শুনে কেন করাতে ধার দেয়া বন্ধ হয়ে যাবে? আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো তিনি যেন বাবুর্চিকে মানুষ গণ্য করেন। আর আমাকে অনুরোধ করতে হবে কেন, আশ্চর্য! বাবুর্চিটা তো এমনিতেও মানুষ।”
‘দর্শক আমরা আবার চলে যাচ্ছি রাজার কিচেনে। সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য।
মনোজ! মনোজ!’
“হ্যাঁ তামান্না আমরা এই মাত্র শুনতে পেয়েছি পাইথন রাজার বাবুচির্কে পেঁচিয়ে ধরেনি। পেঁচিয়ে ধরেছে বাবুর্চির রাজহাঁসটিকে। এবং সেটা পাইথন ছিলো না। একটা সাধারণ সাপ ছিলো। ওঝারা এসে সাপটিকে ধরে নিয়ে গেছে। যদিও আমরা লক্ষ করেছি উদ্ধার করতে আসা বাহিনী নিরাপত্তার অজুহাতে ওঝাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি। তবে অদম্য ওঝারা তাতে হাল ছেড়ে দেয়নি। তারা বাইরে থেকে বীণ বাজিয়ে সাপটাকে ধরে ফেলেছে।”
‘মনোজ! রাজহাঁসটি কেমন আছে? ওটা বেঁচে আছে তো?’
“তামান্না হাঁসটিকে মুমূর্ষু অবস্থায় পশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”
‘দশর্ক আমরা এখন সরাসরি চলে যাচ্ছি জাতীয় পশু হাসপাতালে। সেখানে আছেন আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি শাহাদাত রাজিব।
রাজিব! রাজিব! আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?’
“জ্বি, তামান্না। মুমূর্ষু হাঁসটিকে কিছুক্ষণ আগেই হাসপাতালে আনা হয়েছে। ডাক্তাররা বলছেন তাকে বাঁচানো যাবে না।”
‘রাজিব সিঙ্গাপুর নিয়ে চিকিৎসা দিলে কি হাঁসটাকে বাঁচানো সম্ভব?’
“তামান্না আমরা ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে কি না? ডাক্তার বলেছেন হাঁসটা অতক্ষণ টিকবে না। তার মধ্যে দায়সারা ভাব দেখা গেছে।”
‘কার মধ্যে দায়সারা ভাব দেখা গেছে, রাজহাঁস না ডাক্তার?’
“জি, ডাক্তার।
দর্শক আপনারা দেখতে পাচ্ছেন হাঁসটা এখন মারা যাচ্ছে। আমরা তার মরবার দৃশ্যটা সরাসরি দেখানোর চেষ্টা করছি। আপনারা মরণ দেখছেন, কদুর তেলের সৌজন্যে।
আপনারা দেখতে পাচ্ছেন হাঁসটার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে।
আপনারা ক্যামেরায় দেখছেন হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালের সামনে। মানুষ কাঁদছে। হাজার হাজার মানুষ টিভি পর্দার সামনে। মানুষ কাঁদছে। হাঁসটার জন্য মানুষ কাঁদছে ঢাকায়, সিলেটে, বগুড়ায়। এ এক বিরল দৃশ্য। তার জন্য মানুষ কাঁদছে লন্ডনে, প্যারিসে, নিউইয়র্কে তেহরানে এবং আরো যেসব জায়গায় আমাদের সম্প্রচার রয়েছে।
দর্শক আপনারা দেখুন হাঁসটার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেখুন সে আর শ্বাস নিতে পারছে না। তার চোখ এখন বন্ধ হয়ে গেল।
দেখুন
হাঁসটা মারা গেল।
ছয়টা তেপ্পান্ন মিনিটে।
আমরা রিপ্লেতে আবার তার মৃত্যুটা দেখাচ্ছি। দর্শক আবার দেখতে থাকুন। তারপর আবার। তারপর আবারও। যারা এখন দেখতে পাচ্ছেন না তারা এটি দেখতে পাবেন রাত এগারটার পর আমাদের বিশেষ আয়োজন, ‘একটি হাঁসের মৃত্যু এবং আমরা কোথায়?’
এই অনুষ্ঠানে। আপনারা চোখ রাখুন।”
‘রাজিব! রাজিব! শুনতে পাচ্ছেন?’
“জ্বি, তামান্না শুনতে পাচ্ছি।”
‘বাবুর্চির কোন প্রতিক্রিয়া নেয়া কি সম্ভব হয়েছে?’
“তামান্না বাবুর্চিটা খুব শোকাহত আছে। আমরা তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু উনি আমাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে দেননি।”
‘রাজিব! বাবুর্চির কি আর কোন হাঁস আছে?’
“তামান্না বাবুর্চি আমাদের কিছু বলেনি তবে আমরা বিশেষ সূত্র থেকে জানতে পেরেছি, তার আর কোন হাঁস নাই।
তামান্না এই মাত্র আমরা লক্ষ করলাম মরা হাঁসটি আবার চোখ মেলেছে। সে সবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। একটু আগেই ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষনা করেছিলেন।
অলৌকিক!
অবিশ্বাস্য!
হাঁসটা আবার উঠে দাঁড়িয়েছে।
সে এই একটু হাঁটল। আবার পড়ে যাচ্ছে। আবার উঠে দাঁড়াল।
এখন উড়তে শুরু করেছে। দেখুন হাঁসটা উড়ছে।
মরা হাঁসটা ঐ উড়ে যাচ্ছে…
.
[কালো কৌতুক/২০১৭]