নির্মলেন্দু গুণ এর কবিতা — হুলিয়া

নির্মলেন্দু গুণ


হুলিয়া

আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলুম তখন দুপুর,  

 আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,  

 শোঁ শোঁ করছে হাওয়া।  

 আমার শরীরের ছায়া ঘুরতে ঘুরতে ছায়াহীন  

 একটি রেখায় এসে দাঁড়িয়েছে৷   

 

 কেউ চিনতে পারেনি আমাকে,  

 ট্রেনে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে একজনের কাছ থেকে  

 আগুন চেয়ে নিয়েছিলুম,একজন মহকুমা স্টেশনে উঠেই  

 আমাকে জাপটে ধরতে চেয়েছিল, একজন পেছন থেকে  

 কাঁধে হাত রেখে চিত্কার করে উঠেছিল;-আমি সবাইকে  

 মানুষের সমিল চেহারার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি৷  

 কেউ চিনতে পারেনি আমাকে,একজন রাজনৈতিক নেতা  

 তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন,মুখোমুখি বসে দূর থেকে  

 বারবার চেয়ে দেখলেন-,কিন্তু চিনতে পারলেন না৷   

  

 বারহাট্টায় নেমেই রফিজের স্টলে চা খেয়েছি,  

 অথচ কী আশ্চর্য,পুনর্বার চিনি দিতে এসেও  

 রফিজ আমাকে চিনলো না৷  

 দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পরিবর্তনহীন গ্রামে ফিরছি আমি৷  

 সেই একই ভাঙাপথ,একই কালোমাটির আল ধরে  

 গ্রামে ফেরা,আমি কতদিন পর গ্রামে ফিরছি৷   

  

 আমি যখন গ্রামে পৌঁছলুম তখন দুপুর,  

 আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,  

 শোঁ-শোঁ করছে হাওয়া৷  

 অনেক বদলে গেছে বাড়িটা,  

 টিনের চাল থেকে শুরু করে পুকুরের জল,  

 ফুলের বাগান থেকে শুরু করে গরুর গোয়াল;  

 চিহ্নমাত্র শৈশবের স্মৃতি যেন নেই কোনখানে৷   

  

 পড়ার ঘরের বারান্দায় নুয়ে-পড়া বেলিফুলের গাছ থেকে  

 একটি লাউডুগী উত্তপ্ত দুপুরকে তার লক্লকে জিভ দেখালো৷  

 স্বতঃস্ফূর্ত মুখের দাড়ির মতো বাড়িটির চতুর্দিকে ঘাস, জঙ্গল,  

 গর্ত, আগাছার গাঢ় বন গড়ে উঠেছে অনায়াসে;যেন সবখানেই  

 সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করে এখানে শাসন করছে গোঁয়ার প্রকৃতি৷  

 একটি শেয়াল একটি কুকুরের পাশে শুয়েছিল প্রায়,  

 আমাকে দেখেই পালালো একজন,একজন গন্ধ শুঁকে নিয়ে  

 আমাকে চিনতে চেষ্টা করলো- যেন পুলিশ-সমেত চেকার  

 তেজগাঁয় আমাকে চিনতে চেষ্টা করেছিল৷  

 হাঁটতে- হাঁটতে একটি গাছ দেখে থমকে দাঁড়ালাম,  

 অশোক গাছ, বাষট্টির ঝড়ে ভেঙ্গে যাওয়া অশোক,  

 একসময়ে কী ভীষন ছায়া দিতো এই গাছটা;  

 অনায়াসে দু’জন মানুষ মিশে থাকতে পারতো এর ছায়ায়৷  

 আমরা ভালোবাসার নামে একদিন সারারাত  

 এ-গাছের ছায়ায় লুকিয়ে ছিলুম৷  

 সেই বাসন্তী, আহা,সেই বাসন্তী এখন বিহারে,  

 ডাকাত স্বামীর ঘরে চার- সন্তানের জননী হয়েছে৷   

  

 পুকুরের জলে শব্দ উঠলো মাছের, আবার জিভ দেখালো সাপ,  

 শান্ত-স্থির-বোকা গ্রামকে কাঁপিয়ে দিয়ে  

 একটি এরোপ্লেন তখন উড়ে গেলো পশ্চিমে-৷  

 আমি বাড়ির পেছন থেকে দরোজায় টোকা দিয়ে  

 ডাকলুম, “মা’৷  

 বহুদিন যে-দরোজা খোলেনি,  

 বহুদিন যে দরোজায় কোন কন্ঠস্বর ছিল না,  

 মরচে-পরা সেই দরোজা মুহূর্তেই ক্যাচ্ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেলো৷  

 বহুদিন চেষ্টা করেও যে গোয়েন্দা-বিভাগ আমাকে ধরতে পারেনি,  

 চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে,অফুরন্ত হাওয়ার ভিতরে সেই আমি  

 কত সহজেই একটি আলিঙ্গনের কাছে বন্দী হয়ে গেলুম;  

 সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে  

 একটি অবুঝ সন্তান হয়ে গেলুম৷   

  

 মা আমাকে ক্রন্দনসিক্ত একটি চুম্বনের মধ্যে  

 লুকিয়ে রেখে অনেক জঙ্গলের পথ অতিক্রম করে  

 পুকুরের জলে চাল ধুতে গেলেন;আমি ঘরের ভিতরে তাকালুম,  

 দেখলুম দু’ঘরের মাঝামাঝি যেখানে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি ছিল,  

 সেখানে লেনিন, বাবার জমা- খরচের পাশে কার্ল মার্কস;  

 আলমিরার একটি ভাঙ্গা- কাচের অভাব পূরণ করছে  

 ক্রুপস্কায়ার ছেঁড়া ছবি৷   

  

 মা পুকুর থেকে ফিরছেন,সন্ধ্যায় মহকুমা শহর থেকে  

 ফিরবেন বাবা,তাঁর পিঠে সংসারের ব্যাগ ঝুলবে তেমনি৷  

 সেনবাড়ি থেকে খবর পেয়ে বৌদি আসবেন,  

 পুনর্বার বিয়ে করতে অনুরোধ করবেন আমাকে৷  

 খবর পেয়ে যশমাধব থেকে আসবে ন্যাপকর্মী ইয়াসিন,  

 তিন মাইল বিষ্টির পথ হেঁটে রসুলপুর থেকে আসবে আদিত্য৷  

 রাত্রে মারাত্মক অস্ত্র হাতে নিয়ে আমতলা থেকে আসবে আব্বাস৷  

 ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর:  

 – আমাদের ভবিষ্যত্ কী?  

 – আইয়ুব খান এখন কোথায়?  

 – শেখ মুজিব কি ভুল করেছেন?  

 – আমার নামে কতদিন আর এরকম হুলিয়া ঝুলবে?   

 

 আমি কিছুই বলবো না৷  

 আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকা সারি সারি চোখের ভিতরে  

 বাংলার বিভিন্ন ভবিষ্য়্ত্কে চেয়ে চেয়ে দেখবো৷  

 উত্কন্ঠিত চোখে চোখে নামবে কালো অন্ধকার,আমি চিত্কার করে  

 কন্ঠ থেকে অক্ষম বাসনার জ্বালা মুছে নিয়ে বলবো:  

 ‘আমি এসবের কিছুই জানি না,  

 আমি এসবের কিছুই বুঝি না৷’  

  

====== 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন