আগমনী - কাজী নজরুল ইসলাম
একি রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন– ঝন রনরন রন ঝনঝন!
সেকি দমকি দমকি ধমকি ধমকি দামা-দ্রিমি-দ্রিমি গমকি গমকি ওঠে চোটে চোটে,
ছোটে লোটে ফোটে বহ্নি-ফিনিকি চমকি চমকি ঢাল-তলোয়ারে খনখন!
একি রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন রণ ঝনঝন ঝন রণরণ! হৈ হৈ রব ঐ ভৈরব হাঁকে,
লাখে লাখে ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল গৈরিক-গায় সৈনিক ধায় তালে তালে ওই পালে পালে,
ধরা কাঁপে দাপে। জাঁকে মহাকাল কাঁপে থরথর!
রণে কড়কড় কাড়া-খাঁড়া-ঘাত, শির পিষে হাঁকে রথ-ঘর্ঘর-ধ্বনি ঘররর!
'গুরু গরগর' বোলে ভেরী তূরী, 'হর হর হর' করি চীৎকার ছোটে সুরাসুর-সেনা হনহন!
ওঠে ঝন্ঝা ঝাপটি দাপটি সাপটি হু-হু-হু-হু-হু-হু-শনশন! ছোটে সুরাসুর-সেনা হনহন!
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ খল খল খল নাচে রণ-রঙ্গিণী সঙ্গিনী সাথে,
ধকধক জ্বলে জ্বলজ্বল বুকে মুখে চোখে রোষ-হুতাশন! রোস্ কোথা শোন্!
ঐ ডম্বরু-ঢোলে ডিমিডিমি বোলে, ব্যোম মরুৎ স-অম্বর দোলে,
মম-বরুণ কী কল-কল্লোলে চলে উতরোলে ধ্বংসে মাতিয়া তাথিয়া তাথিয়া নাচিয়া রঙ্গে!
চরণ-ভঙ্গে সৃষ্টি সে টলে টলমল! ওকি বিজয়-ধ্বনি সিন্ধু গরজে কলকল কল কলকল!
ওঠে কোলাহল, কূট হলাহল ছোটে মন্থনে পুন রক্ত-উদধি, ফেনা-বিষ ক্ষরে গলগল!
টলে নির্বিকার সে বিধাত্রীরো গো সিংহ-আসন টলমল!
কার আকাশ-জোড়া ও আনত-নয়ানে করুণা-অশ্রু ছলছল!
বাজে মৃত সুরাসুর-পাঁজরে ঝাঁজর ঝম্ঝম, নাচে ধূর্জটি সাথে প্রমথ ববম্ বম্বম্!
লাল লালে-লাল ওড়ে ঈশানে নিশান যুদ্ধের, ওঠে ওঙ্কার রণ-ডঙ্কার,
নাদে ওম্ ওম্ মহাশঙ্খ বিষাণ রুদ্রের! ছোটে রক্ত-ফোয়ারা বহ্নির বান রে! কোটি বীর-প্রাণ ক্ষণে নির্বাণ তবু শত সূর্যের জ্বালাময় রোষ গমকে শিরায় গম্গম্!
ভয়ে রক্ত-পাগল প্রেত পিশাচেরও শিরদাঁড়া করে চন্চন্! যত ডাকিনী যোগিনী বিস্ময়াহতা,
নিশীথিনী ভয়ে থম্থম্! বাজে মৃত সুরাসুর-পাঁজরে ঝাঁঝর ঝম্ঝম্!
ঐ অসুর-পশুর মিথ্যা দৈত্য-সেনা যত হত আহত করে রে দেবতা সত্য!
স্বর্গ, মর্ত, পাতাল, মাতাল রক্ত-সুরায়; ত্রস্ত বিধাতা,
মস্ত পাগল পিনাক-পাণি স-ত্রিশূল প্রলয়-হস্ত ঘুরায়! ক্ষিপ্ত সবাই রক্ত-সুরায়! চিতার উপরে চিতা সারি সারি,
চারিপাশে তারি ডাকে কুক্কুর গৃহিনী শৃগাল! প্রলয়-দোলায় দুলিছে ত্রিকাল!
প্রলয়-দোলায় দুলিছে ত্রিকাল!! আজ রণ-রঙ্গিণী জগৎমাতার দেখ্ মহারণ,
দশদিকে তাঁর দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ!
পদতলে লুটে মহিষাসুর, মহামাতা ঐ সিংস-বাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে–
শাশ্বত নহে দানব-শক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পশুর!
'নাই দানব নাই অসুর,– চাইনে সুর, চাই মানব!'–
বরাভয়-বাণী ঐ রে কার শুনি, নহে হৈ রৈ এবার!
ওঠ্ রে ওঠ্, ছোট্ রে ছোট্! শান্ত মন, ক্ষান্ত রণ!–
খোল্ তোরণ, চল্ বরণ করব্ মা'য়; ডর্ব কায়?
ধরব পা'য় কার্ সে আর, বিশ্ব-মা'ই পার্শ্বে যার?
আজ আকাশ-ডোবানো নেহারি তাঁহারি চাওয়া, ঐ শেফালিকা-তলে কে বালিকা চলে?
কেশের গন্ধ আনিছে আশিন-হাওয়া! এসেছে রে সাথে উৎপলাক্ষী চপলা কুমারী কমলা
ঐ, সরসিজ-নিভ শুভ্র বালিকা এল বীণা-পাণি অমলা ঐ! এসেছে গনেশ, এসেছে মহেশ,
বাস্রে বাস্! জোর উছাস্!! এল সুন্দর সুর-সেনাপতি, সব মুখ এ যে চেনা-চেনা অতি!
বাস্ রে বাস্ জোর উছাস্!! হিমালয়! জাগো! ওঠো আজি, তব সীমা লয় হোক।
ভুলে যাও শোক– চোখে জল ব'ক শান্তির– আজি শান্তি-নিলয় এ আলয় হোক!
ঘরে ঘরে আজি দীপ জ্বলুক! মা'র আবাহন-গীত্ চলুক! দীপ জ্বলুক! গীত চলুক!!
আজ কাঁপুক মানব-কলকল্লোলে কিশলয় সম নিখিল ব্যোম্! স্বা-গতম্! স্বা-গতম্!!
মা-তরম্! মা-তরম্!! ঐ ঐ ঐ বিশ্ব কণ্ঠে বন্দনা- বাণী লুণ্ঠে-'বন্দে মাতরম্!!!'
Tags
কাজী নজরুল ইসলাম