বন্দে আলী মিয়ার কবিতা সংগ্রহ

 

আমাদের গ্রাম

আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর, 

থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর৷ 

পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই, 

এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই৷ 

হিংসা ও মারামারি কভু নাহি করি, 

পিতামাতা গুরুজনে সদা মোরা ডরি। 


আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান, 

আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইয়াছে প্রাণ৷ 

মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘি, 

চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি৷ 

আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশ ঝাড় যেন, 

মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন৷ 

সকালে সোনার রবি পুব দিকে ওঠে, 

পাখি ডাকে, বায়ু বয়, নানা ফুল ফোটে৷ 

  



প্রিয়া

তোমারে পাই জ্যোত্স্না রাতের  

 অলস ঘুমের মাঝে  

 আমার বাঁশী তোমার হাতে  

 গভীর সুরে বাজে।  

 নিখিল ব্যাপি চাহিয়া থাকে  

 কাজল তব আঁখি  

 নিজেরে খুঁজি হারাইয়া দিশা  

 মনেরে হানি ফাঁকি;  

 ঊষসী তব সিঁদুর পরে  

 বলাকা সারি মালিকা গড়ে  

 তোমারে যাই ধরিতে চাই---  

 অমনি পাই না যে।  

 তোমারে পাই শরৎ প্রাতে  

 শিশির-ছেঁচা ফুলে  

 নৃত্য তব উছলি উঠে  

 নদীর কূলে কূলে।  

 কখনো দেখি বাহিয়া যাও  

 মেঘের তরীখানি  

 পাতায় ফুলে দেখেছি কভু  

 লিখিতে তব বাণী  

 সাগর তালে বাজাও বীণা  

 মনেতে জানি এ-সুর চিনা  

 কখনো তাহা গুঞ্জরেছি  

 কখনো গেছি ভুলে।  

 ফাগুন দিনে মাধবী রাতে  

 যে ছবি তব জাগে  

 চমকি দেখে --- শিহরি উঠি  

 পুলক বুকে লাগে---  

 অশোক শাখে মুছেছে তব  

 চরণ রাঙা লেখা  

 আমের নব মঞ্জরীতে  

 কখনো দেছ দেখা।  

 শিমূল শাখে আবির খেলি  

 অঙ্গে ধরি পলাশ চেলী  

 বধূর বেশে কভুবা এলে  

 জীবন পূরোভাগে।  

 নয়ন তব যে-ভাষা ফোটে---  

 বুঝিতে পারি তায়---  

 সঁপিয়া দাও রিক্ত করি---  

 সকল আপনায়,  

 কাঁপিয়া প্রিয়া যে-গানখানি  

 তরুণ তব মনে  

 আমার বুকে তাহার রঙ  

 লেগেছে অকারণে।  

 তোমারে পাই সুদূর হ'তে  

 আগুন-ভরা যে-সুর পথে  

 সেথায় মোরা রচেছি গেহ  

 গোপন নিরালায়।  

 ঝড়ের সাথে এলায়ে কেশ  

 এসেছ বিরহিনী  

 তোমারে দেখে জেগেছে মনে  

 চিনি গো যেন চিনি;  

 বরষা রাতে চোখের জলে  

 হেসেছ' পলাতকা  

 চখিরে দেখে যেমন করি  

 হেসেছে ভীরু চখা।  

 পেয়েছি তোমা জীবন ভরে  

 নানান রূপে পলক তরে  

 কখনো হারি খেলার ছলে  

 কখনো যেন জিনি। 

  



ময়নামতীর চর

এ-পারের এই বুনো ঝাউ আর ও পারের বুড়ো বট  

 মাঝখানে তার আগাছায় ভরা শুকনো গাঙের তট;  

 এরি উঁচু পারে নিত্য বিহানে লাঙল দিয়েছে চাষী,  

 কুমীরেরা সেথা পোহাইছে রোদ শুয়ে শুয়ে পাশাপাশি।  

 কূলে কূলে চলে খরমূলা মাছ, দাঁড়িকানা পালে পালে  

 ছোঁ দিয়ে তার একটারে ধরি' গাঙ চিল বসে ডালে  

 ঠোঁটে চেপে ধরি' আছাড়ি আছাড়ি নিস্তেজ করি তায়  

 মুড়ো পেটি লেজ ছিঁড়ি একে একে গিলিয়া গিলিয়া খায়।  

 এরি কিছু দূরে একপাল গোরু বিচরিছে হেথা সেথা  

 শিঙে মাটি মাখা দড়ি ছিঁড়ি ষাঁড় চলে সে স্বাধীনচেতা।  

 মাথা নিচু করি কেহ বা ঝিমায় কেহ বা খেতেছে ঘাস,  

 শুয়ে শুয়ে কেহ জাবর কাটিয়া ছাড়িতেছে নিঃশ্বাস;  

 গোচর পাখিরা ইহাদের গায়ে নির্ভয়ে চলে ফেরে  

 উকুন আঠালু ঠোকরিয়া খায় লেজের পালক নেড়ে;  

 বক পাখিগুলো গোচরকীয়ার হয়েছে অংশীদার  

 শালিক কেবলই করিছে ঝগড়া কাজ কিছু নাই তার।  

 নতুন চরের পলি জমিটাতে কলাই বুনেছে যারা  

 আখের খামারে দিতেছে তারাই রাতভর পাহারা;  

 খেতে কোণায় বাঁশ পুঁতে পুঁতে শূণ্যে বেঁধেছে ঘর  

 বিচালী বিছায়ে রচেছে শয্যা বাঁশের বাখারি 'পর।  

 এমন শীতেও মাঝ মাঠে তারা থড়ের মশাল জ্বালি  

 ঠকঠকি নেড়ে করিছে শব্দ হাতে বাজাইছে তালি।  

 ওপার হইতে পদ্মা সাঁতারি বন্য বরাহ পাল  

 এ-পারে আসিয়া আখ খায় রোজ ভেঙে করে পয়মাল।  

 তাই বেচারিরা দারুণ শীতেও এসেছে নতুন চরে  

 টোঙে বসি বসি জাগিতেছে রাত পাহারা দেবার তরে;  

 কুয়াশা যেন কে বুলায়ে দিয়েছে মশারির মত করি  

 মাঠের ওপারে ডাকিতেছে ফেউ কাঁপাইয়া বিভাবরী।  

 ঘুমেল শিশুরা এই ডাক শুনি জড়ায়ে ধরিছে মায়,  

 কৃষাণ যুবতী ঝাপটি তাহারে মনে মনে ভয় পায়;  

 ফেউ নাকি চলে বাঘের পেছনে গাঁয়ের লোকেরা বলে  

 টোঙের মানুষ ভাবিতেছে ঘর, ঘর ভেজে আঁখি জলে।  

 এই চরে ওই হালটার কোণে বিঘে দুই ক্ষেত ভরি  

 বট ও পাকুড়ে দোঁহে ঘিরে ঘিরে করি আছে জড়াজড়ি।  

 গাঁয়ের লোকেরা নতুন কাপড় তেল ও সিঁদুর দিয়া  

 ঢাক ঢোল পিটি গাছ দুইটির দিয়ে গেছে নাকি বায়া।  

 নতুন চালুনি ভেঙে গেছে তার, মুছি আর কড়িগুলা  

 রাখাল ছেলেরা নিয়ে গেছে সব ভরি গামছায় ঝুলা।  

 চড়কের মেলা এই গাছতলে হয় বছরের শেষে  

 সে দিন যেন গো সারা চরখানি উত্সবে ওঠে হেসে।  

 বটের পাতায় নৌকা গড়িয়া ছেড়ে দেয় জলে কেউ,  

 এই চর হতে ওই গাঁ'র পানে নিয়ে যায় তারে ঢেউ।  

 ছোট ছেলেপুলে বাঁশি কিনে কিনে বেদম বাজায়ে চলে,  

 বুড়োদের হাতে ঠোঙায় খাবার, কাশে আর কথা বলে।  

 ছেঁড়া কলাপাতা টুকড়ো বাতাসা চারিদিকে পড়ে রয়  

 পরদিনে তার রাখাল ছেলেরা সবে মিলে ঘুঁটে লয়;  

 উত্সব শেষে খাঁ খাঁ করে হায় শূণ্য বালির চর---  

 এ পারের পানে চাহিয়া ও পার কাঁদে শুধু রাত ভর। 

  



পাখি

খাঁচার দুয়ার আলগা পাইয়া উড়ে গেছে পাখি বনে,  

 ছোট কালো পাখি উড়ে গেছে দর নীল নভ অঙ্গনে।  

 শন্য খাঁচাটি অনাদরে হোথা পড়ে আছে এক ধারে,  

 খোকা বসি পাশে অশ্রুসজল চোখ মোছে বারে বারে।  

 একদা খোকন দর দেশে গিয়ে এনেছিল এক পাখি,  

 সারাদিন তারে করিত যতন সযতনে বুকে রাখি।  

 ছোট কালো পাখি কুচকুচে দেহ-রেশম পালক তার,  

 দুটি চোখে তার বনের স্বপন জাগে দর পারাবার।  

 এত ভালোবাসা, এত যে সোহাগ, পোষ তবু মানে নাই,  

 খাঁচার প্রাচীরে পাখা ঝাপটিয়া, পথ খুঁজিয়াছে তাই।  

 খোকা চায় পাখি - পাখি চায় বন - স্বাধীন মুক্ত প্রাণ,  

 কণ্ঠে তাহার জাগে ক্ষণে ক্ষণে নীল আকাশের গান।  

 খোকা ভাবে মনে, এ পাখি তাহার - গান সে শোনায় তায়  

 জানে না তো কভু কানড়বা তাহার সুর হয়ে বাহিরায়।  

 গান শুনি তার মুগ্ধ হইয়া ভেবেছিল খোকা মনে -  

 পোষ মানিয়াছে, ভুলে গেছে বন - রবে সে তাহার সনে।  

 আদর করিয়া খাঁচার দুয়ার দিল একেবারে খুলি  

 মন কভু কারো বশ নাহি মানে, সে কথা গেল যে ভুলি।  

 সহসা পাখিটি কালো ডানা মেলি উড়ে গেল দর দেশে,  

 তারি শোকে আজ খোকার নয়ন অশ্রুতে যায় ভেসে। 

  



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন