দেওয়ান মমিনুল মউজদীন এর কবিতা

 


শাহজালাল এক্সপ্রেসে

কিছুই জানিনা আমি কোনোই খবর
কার মেয়ে কার বোন কার বা প্রেমিকা ?
কোথায় চলেছো তুমি ঠিকানা কোথায় 
বহুদূর চায়ের বাগান ? নগ্ন জলের হাওর ?

ট্রেনের জানালা বেয়ে ভেসে যায় বুনো মেঘ উদাস সবুজ 
বিদ্যুতের ধ্যানী থাম সন্ধানী রাখাল
লঞ্চ বাস রোদ আর বৃষ্টির প্রণয়
তারাও জানে না তুমি চলেছো কোথায় ?

মুখোমুখি বসে শুধু দেখেছি তোমাকে মেয়ে
আর, গেঁথে যাচ্ছি কৃষ্ণবর্ণ শব্দের কসুম
উত্তরের উদ্বেল বাতাস সাদা ওড়নায় মুখ ঘষে ঘষে
তোমাকে অস্থির করে তোলে
ভ্রু বাঁকিয়ে তাকে যতই ধমকাও
বাতাস তো শাসন মানে না ।

তোমার আনত চোখে দুপুরের নীল ঘুম নামে
কয়েকটি স্খলিত চুল লুটেপুটে খায় দুটি ঠোঁটের সুষমা 
সুদূর নীলিমা থেকে ছুটে আসে মেঘ 
স্টিলের জানালা গলে ছুঁয়ে যায় চুলের বিনুনি
হাতের পাতায় বোনা লাল কারুকাজ
কাঞ্চনজঙ্ঘার ভোর ঝিলিমিলি করে ওঠে কখনো কখনো 
কালো চোখে 

এইভাবে একজোড়া চোখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে
কেটে গেলো দশ জুন গোলাপি প্রহর
সিলেট স্টেশনে এই কবিতার শেষ
একজোড়া চোখ গেলো চোখের গন্তব্যে
পিছনে রইলো পড়ে হাহাকারপূর্ণ এক কবির হৃদয় ।


অভিমানী দূরের স্টেশনে

পড়ে আছো দূরের স্টেশনে
ভয়ঙ্কর অভিমান বুকে
কাছেপিঠে কৃষ্ণচূড়া নেই
কত বেশি প্রিয় ছিলো তোমার দু’চোখে !

স্টেশনের পুবে নীল ডোবা
রাশি রাশি জলফল রোদ্দুরে উন্মুখ
দুলে উঠতো ফ্রকের হাওয়ায়। 
ঠিক সাড়ে দশটা বেজে গেলে
হুইসেল বাজিয়ে গ্রিনএরো
ছুটে যেতো দক্ষিণ দিগন্তে । 

রোদে ভিজে যেতে যেতে শৈশবের স্কুলে
বড় বড় চোখ মেলে দেখতে তুমি
ফুলেদের মাতামাতি 
সে ডোবা অদৃশ্য আজ
আছে মাটি প্রস্তরের ফুল ।

কিছুই তো অবশিষ্ট নেই
বড় বড় চোখ দুটি ছাড়া
পেছনে তাকালে মনে পড়ে
মানুষের নির্মমতা স্বপ্নের সমাধি ।

এখনো কি হোস্টেলের উঠোনে শীতের রোদ
পিঠে নিয়ে আড্ডা দেয় পাঁচ জন তরুণী
এখনো কি মহিলা কলেজে আসে ঘুরে ঘুরে শুক্রবার 
অপরাহ্ণ দুলে ওঠে ভুল প্রেমিকের স্পর্শে
সিলেটের পাহাড়ি সড়কে ।

পড়ে আছো দূরেরে স্টেশনে
কখন ঘনাবে রাত চাপচাপ অন্ধকার
তার প্রতীক্ষায় ।
গোধূলির বিমর্ষ আলোয় 
অবাধ্য শিশুটি খুব ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে 
রেশমি চুলে ঝরে পড়ে
বাতাসের হিম সম্ভাষণ ।

মনে পড়ে কত রাত জেগে থাকতে ঘুমচোখে 
পিতার পায়ের প্রিয় শব্দের আশায়
মাথায় ঝুলিয়ে লাল আলো
মেলট্রেন থামতো এসে পাহাড়ি স্টেশনে
একটি কিশোরীর খুব প্রিয় স্বপ্ন সুটকেসে ঢুকিয়ে
জোসনাময় পথ তিনি পেরুতেন
বুকে নিয়ে অপার বাৎসল্য ।

উঠোনে পৌষের চাঁদ
বারান্দায় বাগানবিলাস
আশ্চর্য গহিন কণ্ঠ ডেকে উঠতো 
তাহেরা তাহেরা
তার বড় আদরের কনিষ্ঠ মেয়েটি
জেগে উঠে খুলে দিতো রাত্রির দরোজা
আজ সেই পিতা নেই
মমতামাখানো বুকে নিবিড় আশ্রয় চলে গেছে
কোন দূরলোকে 

আজ তুমি দাঁড়াবে কোথায় ?


তুমি নেই

তোমার জন্যে ছিলো আমার যাওয়া
পৌঁছে দেখি সবাই আছে
তুমিই শুধু হাওয়া
চারিদিকে বৃষ্টিবাদল
বুকের ভিতর ঢেউ
এগিয়ে এসে ভেজা হাতে 
হাত ধরেনি কেউ ।

মন তো খারাপ হতেই পারে
কোথাও তুমি নেই
তুমি তখন নিজের ভিতর 
আছো আনন্দেই ।।


মেঘের আড়ালে

তোমাকে ভোলার সাধ্য নাই
তাই বারবার ফিরে আসা
তোমার দরজায়
তুমি থাকো অন্তরালে ছায়ার ভিতরে
মেঘ হয়ে উড়ে যাও মেঘের আড়ালে
হাহাকার করে উঠে
তোমার গেটের পাশে পড়ে থাকি

চৈত্রের আকাশ ভেঙে ঝাঁক ঝাঁক বৃষ্টি নামে
মৃত্তিকায় পাথরে শিলায়
তোমার উদাস চোখ হয়তো-বা চেয়ে থাকে
সুদূর পথের প্রান্তে পড়ে থাকা একজোড়া চোখে

আমার হৃদয় ছিঁড়ে সহসাই জ্বলে ওঠে অগ্নিময় শিখা
এশিয়ার শান্ত দূর করুণ শহর
পুড়ে যায় আগুনের নীল উত্তাপে ।




দূরের মানুষ

দূরের মানুষ দুরেই থাকা ভালো
সাইবেরিয়ান হাঁসের মতো দূরে
কাছে এলে দূরত্বটাই বাড়ে
দূরে গেলে বিরহের উত্তাপে
নির্বাপিত তৃষ্ণা আবার জাগে ।

দূরের মানুষ দূরেই থাকা ভালো
কখনো যদি প্রশ্ন জাগে মনে
দূরের মানুষ কাছে কেন এলে ?

ভালোবাসা খুদ-কুঁড়ো জল চেয়ে
কাটলো অনেক বছর অনেক মাস
কালো গোলাপ আর পারি না যে
দশ বছরের তৃষ্ণা বুকের মাঝে
এবার তোমায় দিলাম বনবাস ।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন