নদী সব মিশে যাচ্ছে এন্ড্রয়েড ফোনে
কখনো শীৎকারের শব্দ শোনেনি যে বধির, তার
তৃপ্ত সঙ্গিনীর
একান্ত উচ্চারণের
বেদনার মতো করুণ কিন্তু
উজ্জ্বল একটা আলো কেঁপে কেঁপে উঠছে
যেন বিশেষ মুহূর্তের কম্পনরতা তলপেট
কোনো রমনীর—
আজ
এই মুক ও বিষণ্ণ গভীর মেঘনায়
বৈঠার অবুঝ আঘাতে
ছিন্নভিন্ন চাঁদের মতোই একা ও অস্থির আমি
ফুটে উঠেও ফেটে পড়ছি জলে।
তবু মেঘ কত কথা বলে। মিথ্যা অনেকরকম।
আকাশে ফানুশ ওড়ে। কমলা-হলুদ কিছু তারা।
আমার মন—
প্রথম সঙ্গমরত ভয়ার্ত কিশোরীর
উদ্বেগজনকভাবে আনন্দিত কিন্তু
যন্ত্রণায় দিশেহারা একটা অস্ফুট শরীরের—অকস্মাৎ
প্রস্ফুটিত হবার ঘটনা চুরি ক'রে দেখে ফেলবার মুহূর্তের
ছেলে শিশুর
না ফোটা শিশ্নের অগ্রভাগে চর্মের স্ফিত হবার উত্তেজনায়
বিক্ষিপ্ত হতে চেয়েও
বাঁধা পেয়ে ফুলে উঠবার ব্যথার মতো করুণ
ও টনটনে।
কিন্তু কে কার কথা শোনে? ফুলেরা পচনশীল।
ধরা যাক সকলের মন আজ নদীতে ভাসমান।
এবং সাগরের পরিবর্তে
ধরা যাক নদী সব মিশে যাচ্ছে এন্ড্রয়েড ফোনে।
*
শতবার মোরা মিলিত হয়েছি, শতবার মোরা মিলিবো
পরস্পরকে ব্যাঙ ভেবে মোরা সর্পের মতো গিলিবো
[[]] প্রলাপের পঙক্তিগুলো
—দেখি?
: সত্যিই দেখবেন?
—মিছেমিছি দেখানো যায়?
: এ সবই চিত্রপট; মেকাপের পারিপাট্য।
বিসর্গহীনতা, স্বচ্ছলতা, হাসি
আনিতম্ব-স্তন এতো এতো ঢেউ...
—সব মিছে?
: নদীর জলে এতো যে চাকচিক্য,
সে-ও তো মূলত পাহাড়ের অশ্রু।
বুকের স্রোতশ্বাসে ভাসিয়ে রাখে শাপলা ও শালুক
পদ্ম ও পানকৌড়ি
—তবে কি আপনিও কোনো নদী?
: দেখবেন?
—এখনো সাহস হারাইনি
: এই আমি মেলে ধরলাম আমার পার্থিব প্রসাধন।
শ্যাওলার আস্তরণ, সমস্ত কচুরিপানা খুলুন
খুলে খুলে দেখুন অন্তর্গত কাদা, অবিন্যস্ত পলল
—এতো আলো! এতো সম্মোহন!
নৃপতির অসির মতো চাকচিক্য, এতোটা নিখুঁত!
: হ্যাঁ, নিখুঁত, অযৌগিক দুঃখ। ছুঁয়ে দেখবেন?
—ছোঁবো!
: ছোঁবেন না বুঝি?
—দেখুন আমার আঙুল, আন্তরিক আঙুলগুলো
দেখুন কী অবিশ্বাস্য উৎফুল্লে কাঁপছে!
: আপনার দৃষ্টি ও প্রশ্বাস লোলুপ হয়ে উঠছে
—দুঃখিত, কিন্তু মিথ্যে বলবো না
: চাতুরী দিয়ে যে নদীপাঠ হয় না মশাই।
হাত নয়, ঠোঁট; আঙুল নয়, জিভ... ছোঁয়াছুঁয়ি’র থার্মোমিটার
—সত্যিই?
: মিছেমিছি ছোঁয়া যায়?
—কিন্তু...
: সাঁতারুর ইচ্ছে আমি জানি
—যদি ডুবে যাই?
: ভীতু
—তবে দেখুন আমার সাহস
: অসংযমীকে সাহসী বলাই যায় যদিও
সাহসী মাত্রেই বীর নয় কিন্তু
—এতো ঢেউ, এতো ছলাৎছল, এতো বিকিরণ!
: ধীরে
সাঁতার জানলেই কি নদী পেরুনো যায়?
ধ্যানীর মতো, দমটাকে ঘুরিয়ে আনুন সপ্তর্ষিমণ্ডল
—এ দুটো প্রশান্ত, যমজ বোনের মতো; সখী
: আপনি শিশুর মতো
—নিষ্পাপ?
: চঞ্চল
—এখানে সহসা কিছু উঁচু ঢেউ
: দেখুন, হাঁসগুলো ভেসে আছে নির্বিকার।
তারা জানে কখন ডুব দিয়ে তুলে আনতে হবে শামুক
—এখানে ঘূর্ণিঝড়
: এরপর জলোচ্ছ্বাস
—খুব শৈশবে একবার প্রচন্ড জ্বর হয়েছিল আমার
: জ্বর নয়, ওটা জ...
—তারপর শুনুন
আমার মাথায় জলপট্টি, সরু পাটখড়ি বেয়ে
টিপটিপ ক'রে ফুটো কলসি থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল
কপাল বেয়ে, মাথা বেয়ে, কচুপাতার উপশিরা বেয়ে
আমার উষ্ণতা ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে উলঙ্গ উঠোনে
: খুব প্রলাপ বকেছিলেন বুঝি?
—খুউব
: এখনই পেরুতে যাবেন না; শুনুন,
দূরপাল্লার দৌড়-এ পিছিয়ে পড়ারাই জয়ী হয়
—আমার কেবল ঢেঁকিঘরের স্মৃতি মনে পড়ছে
: অপেক্ষা করতে হয় শেষ পাকের জন্য
—আপনার কণ্ঠ মিষ্টি, মিহি এবং ছন্দময়
: তারপর প্রাণপণে, জীবন বাজি রেখে, উন্মাদ ঘোড়ার মতো দ্রুত
—আপনি উন্মাদিনী
: দেখুন, সমস্ত যন্ত্রণা চিৎকার করে ছড়িয়ে পড়ছে
—পৃথিবী সূর্যের চারিপাশে বেঘোরে ঘুরছে
: সইতে পারছেন?
—কী?
: সৌরতাপ
বিবসনা দুঃখ, কাদা ও কান্নার পিচ্ছিলতা
—এতো গভীর আপনার ব্যথা!
: আপনি আমার উপশম
—সত্যি?
: আর সবকিছু মিথ্যে
হাওয়াই মিঠাই
১
স্বাধীনতার প্রতীক যে পতাকা সেও থাকে রশির কাছে বন্দী।
২
এতই সাধারণ হ'তে চাই—যেন আমার কবরে ঘাস জন্মায়, ফুল ফোটে।
৩
প্রতি দশজন মানুষের সারিতে কেবল একজনই নিষ্পাপ থাকেন, তিনি এগারোতম।
৪
পাখিদের কান্না কিংবা হাসি—দুটোকেই আমরা এক শব্দে চিনি, কিচিরমিচির।
৫
বোনেরা শিউলির মতো—ঝ'রে যাবার নিমিত্তেই যারা ফুটে ওঠে।
৬
দাতাদের মধ্যে সেই সবচেয়ে ধূর্ত যার গোপনে দান করার খ্যাতি আছে।
৭
পাখি না হ'তে পারার যন্ত্রণায় রঙিন হ'য়ে উঠেছে যে ফুল, গন্ধ মূলত তার ব্যথা।
৮
নত হ'তে হ'তে মাটিতে ঢুকে যাওয়া মাথাটা একদিন চারাগাছ হ'য়ে মাথা উঁচু ক'রে দাঁড়ায়।
৯
সেই দেয়ালটাই মানুষ, যার থেকে কোনো গালি কিংবা বিদ্রুপই প্রতিধ্বনিত হয় না।
১০
যতক্ষণে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, ততক্ষণে ঠিকানা বদলে গেছে।
১১
অন্যের নামে বদনাম অবশ্যই করবেন, কিন্তু তা কেবল নিজের মৃত্যুর পর।
১২
প্রেম সেই চারা—চোখের জলের সেচ পেলেই যা বৃক্ষ হ'য়ে ওঠে।
১৩
স্বাধীনতা তাই, যার মাধ্যমে আপনি নব্য শাসকের অধীনতা মেনে নিতে বাধ্য।
১৪
সভ্যতাই পরাধীনতা
১৫
সম্ভাবনার যোনির ভিতর সিস্টেমের শিশ্ন ঢুকিয়ে দিলে যে সন্তান জন্ম নেয় তার নাম ব্যর্থতা।
১৬
পাথরের ঠাকুরটা মাটির ঠাকুর দেখে বললো, 'দেখে তো মনে হয় নকল'।
১৭
যখন মানুষ মানুষকে কষ্ট দেয়—পাপ; যখন ঈশ্বর মানুষকে কষ্ট দেয়—মহাপাপ।
১৮
দুঃখী হলে ততটাই হও—যতটুকু দুঃখী হলে সবাইকে সুখী মনে হবে।
১৯
যে ফুলটা তুলে দিচ্ছ প্রেমিকার হাতে, মনে রেখো—বোঁটার সাথে রয়েছে তার বিচ্ছেদের সম্পর্ক।
২০
যা নেই তা যে নেই তা প্রমাণ করার উপায় নেই। ফলে যা নেই তা আছে বলে চালানো সহজ।
২১
তিনি এতটাই শান্তিপ্রিয় যে, তাঁর শান্তিতে বিঘ্ন ঘটলে খুনও করতে পারেন।
২২
কোন যন্ত্রণাটা বেশি—প্রসব যন্ত্রণা, নাকি প্রসবের যোগ্য না হওয়ার যন্ত্রণা?
২৩
নিজের জীবন সম্পর্কে এইটুকুই শুধু জানি যে—আমারই লেখা শেষ কবিতা কোনটা তা আমি জানবো না।
২৪
ফ্লাক্সের শেষ দু-কাপ চা বাঁচিয়ে বাসায় ফেরে যে চা-অলা, চাঁদ তার জন্যই ওঠে।
২৫
ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে আমরা (অধিকাংশেই) এইটুকুই জানি যে—বইটা বাসার ঠিক কোথায় রাখা আছে।
২৬
বিষ প্রয়োগ ক'রে যাকে মেরে ফেলা হয়, তাকেই বিষের উপর প্রয়োগ করতে গেলে ফলাফল একই।
২৭
এমনও নাস্তিক আছে যারা ঈশ্বরকে সহ্যই করতে পারে না—
২৮
মানুষ প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ হয়, অথচ সে নিজেই প্রকৃতির অংশ।
২৯
জ্ঞান সেই প্রসাধনী যা উঠে যাবার ভয় নেই।
৩০
মানবজীবন মূলত বাবা ও সন্তানের ভিন্ন ভিন্ন চাওয়া থেকে সৃষ্ট অন্তর্দন্দের কুফল।
৩১
অধিকাংশ সুন্দর-ই তার সৌন্দর্য সম্পর্কে অজ্ঞাত। ফুল জানে না সে এত সুন্দর।
৩২
যাহা লিখিয়াছি তাহা লিখিনাই, যাহা লিখিনাই তাহাই কিছুমাত্র লিখিতে পারিয়াছি।
[] বিষণ্ণরকমের সুন্দর []
আত্মহত্যা করবার জন্য দড়ি কিনতে গিয়েছিলাম,
পছন্দ হয়নি।
কিন্তু সূর্য উঠলো।
এবং যাঁরা মৃত, তাঁরা নিশ্চয়
সূর্যের ভাওতাবাজি সম্পর্কে অবগত হয়েছেন।
যদিও মাছেদের জীবনচক্রে আলোর প্রভাব আছে
তবু অস্বীকার করার সুবিধা হলো
নিমিষেই আপনি শিকারে পরিণত হ'য়ে যাবেন।
যেহেতু গাছেদের চোখ নেই,
তারা যদি সূর্যকে অস্বীকার ক'রেই বসে
সূর্যের কি তাতে কিছুই করার আছে?
নেই।
সুতরাং তাকাচ্ছোই যখন, ভ্রু কুঁচকে আছো কেন?
সুতোর অভাবে তুমি বাতি হ'তে পারছো না,
হে মোম, দেখো আমি সুতো হ'য়ে আছি,
আমাকে ভিতরে ঢুকাও।
কিন্তু একটা মোমবাতি—যার আত্মহত্যা করবার ক্ষমতা নেই,
একজন অগ্নিদেবতার আশীর্বাদের অপেক্ষায়
যার কেটে যায় জীবন,
তার গ'লে পড়ার মধ্যে আমি কোনো মাহাত্ম্য দেখি না।
যদিও পাখিদের কান্না কিংবা হাসি দুটোকেই আমরা এক শব্দে চিনি,
কিচিরমিচির।
তবু স্বরের কারণেই কাক ব্যতিক্রম, এবং
একবার শাহবাগে গিয়ে আমি জানতে পেরেছিলাম
স্বরের ভিন্নতা-ই বড় কবি হওয়ার প্রধান লক্ষণ।
সুতরাং আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে আমি নিউমার্কেট গিয়েছিলাম—
দড়ি কিনতে,
কিন্তু পছন্দ হয়নি।
না, দড়ি নয়
আমার পছন্দ হয়নি সেই বাচাল দড়ি বিক্রেতার কথা
যে পান চিবুতে চিবুতে আমাকে বলেছিল,
'মিয়াভাই, গরু কোরবানি দেবেন বুঝি?’।
তখন ওভারব্রিজের টবে অনেক বেগুনি রঙের ফুল।
তাছাড়া বিকেল মূলত পুরো দিনটার নাভি
ফলে মৃতদের কাছে যদি জিজ্ঞেস করেন, তারা বলবে—
সূর্য আসলে একটা শিশ্ন,
যে সামনে দিয়ে উঠে আসে এবং পেছন দিয়ে ঢুকে পড়ে।
এবং অশ্লীলতার অভিযোগে যেসব দৃশ্য কাটা পড়ে, শোনা যায়—
সেসব অশ্লীল দৃশ্য চলবার মুহূর্তে জুরিবোর্ডের কোনো কোনো সদস্য
এমন স্নানভেজা হ'য়ে ঘেমে ওঠেন যে
দেখে মনে হয় মাত্রই বুঝি সঙ্গম শেষ ক'রে হাঁপাচ্ছেন।
সুতরাং মাছের আলোচনায় সর্বদাই কাঁটার আলোচনা প্রাসঙ্গিক।
তাছাড়া রেললাইন তৈরিই হয়েছে সেইসব নিঃসঙ্গ মানুষদের জন্য
যারা মিতব্যয়ী।
কিন্তু সরকার যখন জনগণের পক্ষের, এবং
জনগণ এতটাই হাসিখুশি যে
মানুষ ম'রে গেলেও হো হো ক'রে হেসে ফেলে,
তখন আমি কেন আত্মহত্যার কথা ভাবছি?
কারণ রোখসানা;
যার দুচোখে স্বাধীনতা দিবসেও দুটো কালো ব্যাজ লাগানো থাকতো,
সে আমাকে বলেছিল—
রাজ্যের সকল প্রজাই যদি শাসকের গুণগান করে
তবে বুঝবেন সেই শাসক হয় মৃত নয়তো অত্যাচারী।
কিন্তু রোখসানা,
আমরা তো চেয়েই ছিলাম তুমি অত্যাচার করো,
যেন চিরকাল আমরা প্রেমিকেরা তোমার গুনগান গেয়ে যেতে পারি;
অথচ রোখসানাকে যখন শেষবার দেখলাম—
আমরা আপামর প্রেমিক সমাজ অবাক হ'য়ে লক্ষ্য করলাম
তার পায়ের আঙুল মাটিতেই ছিল,
দৌলদিয়ার নদীসংলগ্ন একটা কাঁঠাল গাছে
প্রায় নগ্ন হ'য়ে
ঝুলে ছিল সে।
যেহেতু মাছেরা পোশাক পরে না, এবং
শরীর আবৃত রাখবার জন্য নেই লোম কিংবা ডানা,
সুতরাং মৎস্যসমাজে অশ্লীলতা নেই।
কিন্তু নদীর পানি শুকিয়ে যাচ্ছে।
অর্থাৎ আত্মহত্যার জন্য রেললাইনই ভরসা।
আকাশে কাফনের মতো মেঘ।
সূর্যের কি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে?
সিজারিয়ান মহিলার পেটের সেলাইয়ের মতো একটা রেললাইন
চ'লে গেছে বস্তির উদর চিরে।
অনেক হৈচৈ
গুড়িগুড়ি বৃষ্টি, আর
যাত্রা শেষের ব্যাকুলতার মধ্যদিয়ে যে ট্রেনটা ছুটে আসবে—
ঝিকঝিক,
মূলত একজন আত্মহত্যাকারীর হৃৎপিণ্ডের প্রতিধ্বনি।
সুতরাং আমি এখন একমনে হেঁটে যাবো, এবং
আমাকে পেরিয়ে চ'লে যাবে যে লালরঙের মালগাড়ি
তার হুইসেলের কান্নার আড়ালে
আরও লাল
আরও রক্তিম
আরও অনন্ত হ'য়ে প'ড়ে থাকবে কিছু মাংসপিণ্ড;
ছিন্নভিন্ন।
তখন টিনের চালে অনেক বৃষ্টি।
অর্থাৎ রক্ত ধুয়ে যাবে।
বিদ্যুৎচমকের মধ্যে দিয়ে চ'লে যাবে আরও একটা ট্রেন।
তখন টিনের চালে অনেক বৃষ্টি, বিষণ্ণরকমের সুন্দর সেই বৃষ্টি।