কবির হোসেন এর ১০টি কবিতা
মৎস্যশিল্পী
❑
জন্মান্ধ এক মাকে কতজন কত করে বলে গেল, 'এটা সুই-সুতা নয়, বড়শি-সুতা। এটা দিয়ে মাছ ধরে, সেলাই করে না।' মা কানে শোনেন না। কাঁথার ক্যানভাসে বড়শি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঁকাআঁকি করেন। মা কোনোদিন মাছ দেখেননি, জানেন না মাছের ঢং, জানেন না কীভাবে চালতে হয় সুতার বুনন। তবুও বড়শির তুলিতে সুতার রঙে কাঁথার ক্যানভাসে মাছ আঁকতে চাইছেন। মা কেবলি শিশুর মতো মনের খেয়ালে আঁকিবুঁকি করছেন, যেন তিনি জানেন, বড়শি দিয়ে আঁকিবুঁকি যাই করা হোক, সুতা শেষ হয়ে গেলে মাছই আঁকা হয়।
.
ব্যাপারটা বুঝি নাই
❑
ভেবেছিলাম ব্যাপারটা হবে ঠান্ডা নেবেন নাকি গরম নেবেন অথবা কফি নেবেন নাকি চা নেবেনের মতো, কিন্তু ঘটলো সাদৃশ্য দেখিয়ে লবণের বদলে চিনি অথবা চিনির বদলে লবণ বেছে নিতে হবে। হিসাব করে দেখলাম— লবণে এসে স্বাদের সাদৃশ্য দেখিয়ে আমাকে তখন সমুদ্র বেছে নিতে হবে, সমুদ্র থেকে জলের সাদৃশ্য দেখিয়ে নদীতে, তারপর নদীর সাদৃশ্য দেখিয়ে নদীদের উঠোন হয়ে বাড়িতে পৌঁছাতে হবে। বাড়িতে এসে আবার বরাবরের মতো দেখতে হবে— আমাদের চায়ের সংসারে চিনির সংকট লেগেই আছে।
অবশ্য ঘরে চিনি না থাকলে মা মাঝে মাঝে শরবতের গ্লাসে চা খাওয়ান।
.
হারানো চেহারার খোঁজে
❑
ভাস্কর্যবিদ্যায় ভর্তি হয়ে টের পাই— নিজের চেহারাকেও কাদামাটির মনে হয়। আমিও কেমন লোভের ভুলে, ভাস্কর্যকলা না জেনেও নিজের চেহারায় আকার দিতে থাকি, নাক-মুখ-গাল টিপে সুদর্শন এক চেহারা খুঁজতে থাকি। কোথায় সেই চেহারা? যেখানেই যাই, প্রতিবারই এঁকে ফেলি বিভ্রান্ত এক মুখ, নির্দিষ্ট কোনো রূপে পৌঁছাতে পারি না। আগের চেহারায় ফিরে যেতে গিয়েও দেখি পথ চিনি না, নিজের চেহারাটাও আঁকার দক্ষতা নেই। হারানো চেহারার খোঁজে নানামুখি পথ দেখতে পাই যদিও, আসল মুখ খুঁজে পাই না।
ছবি দেখে দেখে নিজের চেহারায় নিজেকে আঁকি— নকল করে ফিরে আসি আসল রূপে।
.
গরম ভাতের ছোরা
❑
গরম ভাতের মণ্ড বানিয়ে এনেছি, আমাকে একটি ভাতের ছোরা বানিয়ে দাও। কুলখানি থেকে নিয়ে আসা এসব ভাত— ছোরা বানিয়ে দিলে সহজেই চিনিয়ে দিতে পারবে মৃত্যুর পথ। ছোরায় মাংসের ঝোল-রঙ মেখে দিতে পারো। যদি লোহার চেয়েও ধারালো করতে চাও, তবে দুই-চারটা হাড়মাংসও কিমা করে দিতে পারো। কুলখানির মুগডাল সুস্বাদু, স্বাদের ভিন্নতায় দিয়ে দিতে পারো। তারপর পরিমাণমতো লবণ দিয়ে রোদে শুকাও কিংবা আগুনে পোড়াও অথবা হাতুড়ি পেটা করো— আমি যেন ভাই লাঞ্চের প্লেটে ভাতের একটি গরম ছোরা পাই।
ভাতের সুস্বাদু এই ছোরা পেটে ঢুকিয়ে— ক্ষুধাটাকে মেরে ফেলতে চাই।
.
অল্প প্রতিবেশী
❑
ইঁদুরকে কেন লোকালয়ের হরিণ ভাবে বিড়াল, কেনইবা নিজেদের ভাবে বাঘের বংশধর! বাঘের দুধ খেয়ে যেন জিব বড় হয়ে গেছে, ইঁদুরের শরীরে হরিণের গোশত খোঁজে। বিড়ালের ক্ষুধা যেন ছাগলছানা, লাফাতে লাফাতে ইঁদুরের বাড়ি যায়, ছোট ছোট ইঁদুরকে চারাগাছ ভাবে, বড়কে ভাবে যেন তারই বাড়ির কাঁঠালপাতা। বিড়াল কেন তার ডানপিটে ক্ষুধাকে ডেকে নেয় না? কেন ছেড়ে দিয়েছে খোদাই ষাঁড়ের মতো! ইঁদুরদের কেউ কি মাছ খায় গোপনে? বিড়াল কেন তবে খাদ্য সংকটে পড়ে!
ইঁদুরেরা মাছ খাবে না আর, তবুও যেন বিড়ালের ক্ষুধাটা বেঁধে রাখে।
.
একটি জীবনবিবাদী কবিতা
❑
দাঁড়িয়ে থাকা একটি মোম দেখে মনে হলো এযে পানির অভাবে নেতিয়ে পড়া এক চারাগাছ! যেন মন খারাপ করে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ ডাক দিলেই মাথা তুলে জেগে উঠবে। তবে চারাগাছের সাথে মোমের তফাত এই যে— নেতানো গাছ পানি পেলে মাথা তুলে দাঁড়ায়, মোম দাঁড়ায় আগুন পেলে। একবার চারাগাছে পানি আর মোমে আগুন দিয়ে দেখেছি— নেতানো গাছ মাথা তুলে বেড়ে ওঠে, আর মাথা তুলে গলে যায় মোম।
দেখেছি— গাছের বয়স বাড়ে, মোমের কমে হায়াত।
.
"হ্যান্ডস আপ"
❑
পুলিশের বন্দুকের ধমকে সেই যে হাত তুলেছিলাম, আর নামাইনি। মাথার দুই পাশে দুই হাত উদ্ধার চিহ্নের মতো তুলে রাখি। আমার হাত দিয়েই আমাকে বেঁধে রাখা হয়েছে, বেঁধে রাখার চিহ্নও রেখেছে। আমি যেন পুলিশের কোনো বক্তব্য, উদ্ধার চিহ্নের মাঝে আটকে আছি। পুলিশের মুখ থেকে উদ্ধার করবে এমন ডাকাত কোথায়! যদিও যেকোনো বন্দুকধারীকেই পুলিশ মনে হয়, যেকোনো বন্দুকের ধমকেই হাত উঠে যায় ওপরে। এদিকে চারপাশে বন্দুক ধমকাচ্ছে খুব, হাত নামানোর সুযোগ নেই।
দারুণভাবে আটকে গেছি উদ্ধার চিহ্নের ভেতরে।
.
জোঁকের যন্ত্রণায় লবণ বেশি
❑
শরীরে কতগুলো আঘাত পেলে জোঁক হবার সিদ্ধি লাভ হয়? তখন কি সমুদ্র থেকে উড়ে আসা বাতাসও শরীরে কাটা ঘায়ে লবণের যন্ত্রণা হয়? হাজারো ঘা নিয়ে যেন জোঁক হয়ে গেছি, যে নদীতেই ধুতে গিয়েছি মনে হয়েছে লবণের দালাল। পুকুরকেও মনে হয় সমুদ্রের সাথে তার গোপন আঁতাত রয়েছে। চাপকলে তো বিশ্বাস আছে, কতটা আর আছে পৃথিবীর জলে! এ জল থেকে ও জল ঘুরে বেড়াই, এঘাট থেকে ও ঘাট, কোথাও ক্ষত ধোয়ার জল পাই না। হয়রান হওয়ার কথা থাকলেও হয়রান হতে পারি না ঘামের নোনতা ভয়ে!
বুকের যন্ত্রণায় কাঁদে জোঁক, বুকে যন্ত্রণা হয় তারই চোখের জলে।
.
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
❑
সারি সারি ফসিল দেখে মনে হলো আগের দিনের লোকজন জানলা চাষ করতো। এখানে দেখা যাচ্ছে যে জানলার ক্ষেত! এসবে উঁকি দিলে কেমন দেখা যায়, রেজুলেশন ভালো! একটায় উঁকি দিয়ে দেখি একজন প্রাচীন লোক দৌড়ে আসে, দরজায় কড়া নেড়ে সাহায্য চায়। দরজা খুঁজতে গিয়ে দেখি জানলার পাশাপাশি এখানে রোপণ করা আছে অজস্র দরজা। কেমন যেন ঘর ঘর মনে হলো। কোন দরজায় কড়া নেড়েছিল লোকটি! একটা খুলে দেখি এখনো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, মূর্তিমান। দেখি ঘরের নয়, আমি খুলেছি কফিনের দরজা!
যদিও জানলার ফসিলে উঁকি দিলে দেখি— প্রাচীন লোকটি দরজায় কড়া নেড়ে যাচ্ছে।
.
নিকটত্ব বজায় রাখুন
❑
শৈশবে কি হর্ন গিলে ফেলেছিলাম মা! লোকজন কেন আমাকে দেখলেই দূরে সরে যায়! আমি কি কাউকে অ্যাক্সিডেন্ট করেছি? এ ব্যাপারে কোনো কেলেঙ্কারি? যেন আমি ভারী কোনো যানবাহন, লোকজন পাশ কেটে যায় নিরাপদ! আমার সমস্ত আলিঙ্গন প্রত্যাখ্যাত হয়ে যাচ্ছে মা, বাড়িয়ে দেওয়া হাতকে ভাবা হচ্ছে দুর্ঘটনার ইশারা। মানুষের অভাবে আমার খুব নিঃসঙ্গ লাগে, দম বন্ধ হয়ে আসে দূরত্বে। আমি হর্ন অপসারণ করতে চাই মা, মানুষের সাথে হেঁটে যেতে যাই ফুটপাত ধরে।
মা দেখান ফুটপাতে কেউ নেই— যার যার হর্ন বাজিয়ে মানুষ রাস্তায় চলাচল করে।