পর্ব ১ ছিল এ ভারতে এমন দিন মানুষের মন ছিল স্বাধীন ; সহজ উদার সরল প্রাণে বিস্ময়ে চাহিত জগত পানে। আকাশে তখন তারকা চলে, নদী যায় ভেসে, সাগর টলে, বাতাস ছুটিছে আপন কাজে, পৃথিবী সাজিছে নানান সাজে ; ফুলে ফলে ছয় ঋতুর খেলা, কত রূপ কত রঙের মেলা; মুখরিত বন পাখির গানে, অটঁল পাহাড় মগন ধ্যানে; নীলকাশে গন মেঘের ঘটাঁ, তাহে ইন্দ্রধনু বিজলী ছঁটা, তাহে বারিধারা পড়িছে ঝরি- দেখিত মানুষ নয়ন ভরি। কোথায় চলেছে কিসের টানে কোথা হতে আসে, কেহ না জানে। ভাবিত মানব দিবস-যামী, ইহারি মাঝারে জাগিয়া আমি, কিছু নাহি বুঝি কিছু নাহি জানি, দেখি দেখি আর অবাক মানি। কেন চলি ফিরি কিসের লাগি কখন ঘুমাই কখন জাগি, কত কান্না হাসি দুখে ও সুখে ক্ষুধা তৃষ্ণা কত বাজিছে বুকে। জন্ম লভি জীব জীবন ধরে, কোথায় মিলায় মরণ পরে? ভবিতে ভাবিতে আকুল প্রাণে ডুবিত মানব গভীর ধ্যানে। অকূল রহস্য তিমিরতলে, জ্ঞানজ্যোতিময় প্রদীপ জ্বলে, সমাহিত চিতে যতন করি অচঞ্চল শিখা সে আলো ধরি দিব্য জ্ঞানময় নয়ন লভি, হেরিল নতুন জগত ছবি। অনাদি নিয়মে অনাদি স্রোতে ভাসিয়া চলেছে অকুল পথে প্রতি ধুলিকণা নিখিল টানে এক হতে ধায় একেরি পানে, চলেছে একেরি শাসন মানি, লোকে লোকান্তরে একেরি বাণী এক সে অমৃতে হয়েছে হারা নিখিল জীবন-মরণ ধারা। সে অমৃতজ্যোতি আকাশ ঘেরি, অন্তরে বাহিরে অমৃত হেরি। যাঁহা হতে জীব জনম লভে, যাহা হতে ধরে জীবন সবে, যাহার মাঝারে মরণ পরে ফিরি পুন সবে প্রবেশ করে, তাহার জানিবে যতন ধরি। তিনি ব্রহ্ম তারে প্রনাম করি। আনন্দেতে জীব জনম লভে আনন্দে জীবিত রয়েছে সবে; আনন্দে বিরাম লভিয়া প্রাণ আনন্দের মাঝে করে প্রয়াণ। শুন বিশ্বলোক শুনহ বাণী অমৃতের পুত্র সকল প্রাণী, দিব্যধামিবাসী শুনহ সবে- জেনেছি তাহারে, যিনি এ ভবে মহান পুরুষ নিখিল গতি, তমসার পরে পরম জ্যোতি : তেজোময় রূপে হেরিয়া তাঁরে স্তব্ধ হয় মন, বচন হারে। বামে ও দখিনে উপরে নীচে, ভিতরে বাহিরে সমুখে পিছে, কিবা জলেস্থলে আকাশ পরে আধারে আলোকে চেতনে জড়ে: আমার মাঝারে আমারে ঘেরি এক ব্রহ্মময় প্রকাশ হেরি। সে আলোকে চাহি আপন পানে আপনারে মন স্বরূপ জানে। আমি আমি করি দিবস- যামী, না জানি কেমন কোথা সে আমি অজর অমর অরূপ রূপ নহি আমি এই জড়ের স্তুপ দেহ নহে মোর চির-নিবাস দেহের বিনাশে নাহি বিনাশ। বিশ্ব আত্মা মাঝে হয়ে মগন আপন স্বরূপ হেরিলে মন না থাকে সন্দেহ না থাকে ভয় শোক তাপ মোহে নিমেষে লয়, জীবনে মরণে না রহে ছেদ, ইহা পরলোকে না রহে ভেদ। ব্রহ্মানন্দময় পরম ধাম, হেথা আসি সবে লভে বিরাম; পরম সম্পদ পরম গতি, লভ তাঁরে জীব যতনে অতি। পর্ব ২ কালচক্রে হায় এমন দেশে ঘোর দুঃখদিন আসিল শেষে। দশদিকে হতে আঁধার আসি ভারত আকাশ ফেলিল গ্রাসি। কোথা সে প্রাচীন জ্ঞানের জ্যোতি, সত্য অন্বেষণে গভীর মতি ; কোথা ব্রহ্মজ্ঞান সাধন ধন, কোথা ঋষিগণ ধ্যানে মগন; কোথা ব্রহ্মচারী তাপস যত, কোথা সে ব্রাহ্মণ সাধনা রত? একে একে সবে মিলাল কোথা, আর নাহি শুনি প্রাচীন কথা। মহামূল্য নিধি ঠেলিয়া পায় হেলায় মানুষ হারাল তায়। | আপন স্বরূপ ভুলিয়া মন ক্ষুদ্রের সাধনে হল মগন। ক্ষুদ্র চিন্তা মাঝে নিয়ত মজি, ক্ষুদ্র স্বার্থ-সুখ জীবনে ভাজি; ক্ষুদ্র তৃপ্তি লয়ে মূঢ়ের মত ক্ষুদ্রের সেবায় হইল রত। রচি নব নব বিধি-বিধান নিগড়ে বাঁধিল মানব প্রাণ; সহস্র নিয়ম নিষেধ শত ; তাহে বদ্ধ নর জড়ের মত ; লিখি দাসখত ললাটে তার রুদ্ধ করি দিল মনের দ্বার। জ্বলন্ত যাঁহার প্রকাশ ভাবে- হায়রে তাঁহারে ভুলিল সবে; কল্পনার পিছে ধাইল মন, কল্পিত দেবতা হল সৃজন, কল্পিত রূপের মূরতি গড়ি, মিথ্যা পূজাচার রচন করি, ব্যাখ্যা করি তার মহিমা শত, মিথ্যা শাস্ত্রবাণী রচিল কত। তাহে তৃপ্ত হয়ে অবোধ নরে রহে উদাসীন মোহের ভরে। না জাগে জিজ্ঞাসা অলস মনে, দেখিয়া না দেখে পরম ধনে। ব্রাহ্মণেরে লোকে দেবতা মানি নির্বিচারে শুনে তাহারি বাণী। পিতৃপুরুষের প্রসাদ বরে বসি উচ্চাসনে গরব ভরে পূজা-উপচার নিয়ত লভি ভুলিল ব্রাহ্মণ নিজ পদবী। কিসে নিত্যকালে এ ভারতভাবে আপন শাসন অঁটুট রবে- এই চিন্তা সদা করি বিচার হল স্বার্থপর হৃদয় তার। ভেদবুদ্ধিময় মানব মন নব নব ভেদ করে সৃজন। জাতিরে ভাঙিয়া শতধা করে, তাহার উপরে সমাজ গড়ে; নানা বর্ণ নানা শ্রেণীবিচার , নানা কুটবিধি হল প্রচার। ভেদ বুদ্ধি কত জীবন মাঝে অশনে বসেন সকল কাজে, ধর্ম অধিকারে বিচার ভেদ মানুষে মানুষে করে প্রভেদ। ভেদ জনে জনে, নারী ও নরে, জাতিতে জাতিতে বিচার ঘরে। মিথ্যা অহংকারে মোহের বশে জাতির একতা বাঁধন খসে: হয়ে আত্মঘাতী ভারতভবে আপন কল্যণ ভুলিল সবে। পর্ব ৩ এখনও গভীর তমসা রাতি, ভারত ভবনে নিভিছে বাতি - মানুষ না দেখি ভারতভূমে, সবাই মগন গভীর ঘুমে। কত জাতি আজ হেলার ভরে হেথায় আসিয়া বসতি করে। ভারতের বুকে নিশান গাথি বসেছে সবলে আসন পাতি। নিজ ধনমান নিজ বিভব বিদেশীর হাতে সঁপিয়া সব, ভারতের মুখে না ফুটে বাণী, মৌন রহে দেশ শরম মানি। - হেনকালে শুন ভেদি আঁধার সুগম্ভীর বানী উঠিল কার- “ভাব সেই এক ভাবহ তারে, জলে স্থলে শুন্যে হেরিছ যারে নিয়ত যাহার স্বরূপ ধ্যানে দিব্য জ্ঞান জাগে মানব প্রাণে। ছাড় তুচ্ছ পূজা জড় সাধন, মিথ্যা দেবসেবা ছাড়া এখন, বেদান্তের বাণী স্মরণ কর, ব্রহ্মজ্ঞান-শিখা হৃদয়ে ধর সত্য মিথ্যা দেখে করি বিচার খুলি দাও যত মনের দ্বার । মানুষের মত স্বাধীন প্রাণ নির্ভয়ে তাকাও জগত পানে- দিকে দিকে দেখ ঘুচিছে রাতি, দিকে দিকে জাগে কত না জাতি; দিকে দিকে লোক সাধনারত জ্ঞানের ভান্ডার খুলেছে কত। নাহি কি তোমার জ্ঞানের খনি ? বেদান্ত রতন মুকুটমণি? অসারে মজে কি ভুলেছ তুমি- ধর্মে গরীয়ান ভারতভুমি?” -শুনি মৃতদেশ পরান পায়, বিস্ময়ে মানুষ ফিরিয়া চায়। দেখে দিব্যরূপ পুরুষ বরে কান্তি তেজোময় নয়ন হরে, গবল শরীর সুঠাম অতি, ললাট প্রসর, নয়নে জ্যোতি, গম্ভীর স্বভাব,বচন ধীর, সত্যের সংগ্রামে অজেয় বীর; অতুল প্রখর প্রতিভা ধরে নানা শাস্ত্র ভাষা বিচার করে। রামমোহনের১ জীবন স্মরি, কৃতজ্ঞতা ভরে প্রনাম করি। দেশের দুর্গতি সকলখানে হেরিয়া বাজিল রাজার প্রাণে । কত অসহায় অবোধ নারী সতীত্বের নামে সকল ছাড়ি, কেহ স্ব-ইচছায়, কেহবা ভয়ে, শাসনে তাড়নে পিষিত হয়ে, পতির চিতায় পুড়িয়া মরে- শুনি কাদে প্রাণ তাদের তরে । | নারীদুঃখ নাশ করিল পণ, ঘুচিল নারীর সহমরণ । নিষ্কাম করম- যোগীর মত দেশের কল্যাণ সাধনে রত, নানা শাস্ত্রবাণী করে চয়ন, দেশ দেশান্তের ঋষিবচন; পশ্চিমের নব জ্ঞানের বাণী দেশের সমুখে ধরিল আনি। কিরূপেতে পুন এ ভারতভবে ব্রহ্মজ্ঞান কথা প্রচার হবে , নিয়ত যতন তাহারি তরে, কত শ্রম কত প্রয়াস করে ; তর্ক আলোচনা কত বিচার কত গ্রন্থ রচি’ করে প্রচার; -ক্রমে বিনাশিতে জড় ধরম ‘ব্রহ্ম সমাজে’র হল জনম । শুনে দেশবাসি নুতন কথা, মূরতিবিহীন পুজার প্রথা উপাসনা -গৃহ দেখে নতুন- যেথায় স্বদেশী বিদেশী জন শুদ্র দ্বিজ আদি মিলিয়া সবে নির্বিচারে সদা আসন লাভে। মহাপুরুষের বিপুল শ্রমে দেশে যুগান্তর আসিল ক্রমে। স্বদেশের তার আকুল প্রাণ প্রবাসেতে রাজা করে প্রয়ান; সেথায় সুদুর বিলাতে হায় অকালেতে রাজা ত্যজিল কায়। অসমাপ্ত কাজ রহিল পড়ে, ফিরে যায় লোকে নিরাশা ভরে; একে একে সব যেতেছে চলে- ভাসে রামচন্দ্র২ নয়নজলে। রাজার জীবন নিয়ত স্মরি’ উপাসনা গৃহে রহে সে পড়ি, নিয়ম ধরিয়া পূজার কালে নিষ্ঠাভাবে সেথা প্রদীপ জ্বালে। একা বসি ভাবে রাজার কাজ এমন দুর্দিনে কে লবে আজ। পর্ব ৪ ধনী যুবা এক শ্মশান ঘাটে একা বসি তার রজনী কাটে। অদূরে অন্তিম শয়নোপরি দিদিমা তাহার আছেন পড়ি, সম্মুখে পূর্ণিমা গগনতলে পিছনে শ্মশানে আগুন জ্বলে, তাহারি মাঝারে নদীর তীরে হরিনাম ধ্বনি উঠিছে ধীরে। একাকী যুবক বসিয়া কুলে সহসা কি ভাবি আপনা ভুলে। প্রসন্ন আকাশ চাঁদিম রাতি ধরিল অপূর্ব নতুন ভাতি, তুচ্ছ বোধ হল ধন – বিভব বিলাস বাসনা অসার সব, অজানা কি যেন সহসা স্মরি পলকে পরান উঠিল ভরি। আর কি সে মন বিরাম মানে? গভীর পিপাসা জাগিল প্রাণে। কোথা শান্তি পাবে ব্যাকুল তৃষা শুধায় সবারে না পায় দিশা। -সহসা একদা তাহার ঘরে ছিন্নপত্র এক উড়িয়া পড়ে ; কি যেন বচন লিখিত তায় অর্থ তার যুবা ভাবি না পায়। বিদ্যাবাগীশের নিকটে তবে যুবা সে বাণীর মরম লভে- “যাহা কিছু এই জগততলে অনিত্যের স্রোতে ভাসিয়া চলে রহ্মে আচ্ছাদিত জানিবে তায়-” শুনিয়া যুবক প্রবোধ পায়। শুনি মহাবাণী চমক লাগে, আরো জানিব রে বাসনা জাগে ব্রহ্মজ্ঞান লাভে পিপাসু মন গভীর সাধনে হল মগন: যত ডোবে আরো ডুবিতে চায় ডুবি নব নব রতন পায়া। হেনকালে হল অশনিপাত যুবকের পিতা দ্বারকানাথ, অতুল সম্পদ ধন বিভব ঋণের পাথারে ডুবায়ে সব কিছু না বুঝিতে জানিতে কেহ অকালে সহসা ত্যজিল দেহ। আত্মীয় -স্বজন কহিল সবে, “যে উপায়ে হোক বাঁচিতে হবে- কর অস্বীকার ঋণের দায় নহিলে তোমার সকলি যায়।” নাহি টলে তায় যুবার মন, পিতৃঋণ শোধ করিল পণ, হয়ে সর্বত্যাগী ফকির দীন ছাড়ি দিল সব শোধিতে ঋণ। উত্তমর্ণজনে অবাক মানি কহে শ্রদ্ধাভারে অভয় বাণী, “বিষয় বিভব থাকুক তব, মোরা তাহা হতে কিছু না লব। সাধুতা তোমার তুলনাহীন; সাধ্যমত তুমি শোধিও ঋণ।” বরষের পর বরষ যায়, যুবক এখন প্রবীণ -প্রায়। সংসারে বাসনা -বিগত মন, ঋষি কল্পরুপ ধ্যানে মগ্ন, ব্রহ্ম-ধ্যান -জ্ঞানে পুরিত প্রান , ব্রহ্মানন্দ রস করিছে পান; বচনেতে যেন অমৃত ঝরে- নমি নমি তাঁরে ভকতি ভরে। ব্রাহ্মসমাজে আসন হতে দীপ্ত অগ্নিয় বচন স্রোতে | ব্রহ্মজ্ঞান ধারা বহিয়া যায়, কত শত লোকে শুনিতে ধায়। “ব্রহ্মে কর প্রীতি নিয়ত সবে, প্রিয়কার্য় তাঁর সাধহ ভবে। হের তারে নিজ হৃদয় মাঝে, সেথা ব্রজ্যেতি নিয়ত রাজে। জ্ঞান সমুজ্জল বিমল প্রাণে , যে জানে তাহারে ধ্রুব সে জানে । জানিবার পথ নাহিক আর, নহে শাসত্র বাণী প্রমান তাঁর । বহু তর্ক বহু বিচার বলে বহু জপ তপ সাধন ফলে বহু তত্ত্বকথা আলোড়ি চিতে নাহি পায় সেই বচনাতীতে।” ব্রহ্ম সমাজের অসাড় প্রাণে , মহর্ষির৩ বানী চেতনা আনে। দলে দলে লোক সেথায় ছোটে ঊৎসাহের স্রোতে আসিয়া জোটে। মত্ত অনুরাগে কেশব৪ ধায়, প্রতিভার জ্যোতি নয়নে ভায়; আকুল আগ্রহে পরান খুলি ঝাঁপ দিল স্রোতে আপনা ভুলি। হেরি মহর্ষির পুলক বাড়ে “ব্রহ্মনন্দ” নাম দিলেন তারে । লভি নব প্রানে সমাজ কায় নব নব ভাবে বিকাশ পায় ; ধর্ম গ্রন্থ নব,নব সাধন, ব্রহ্ম উপাসনা বিধি নূতন ধর্মপ্রান কত নারী ও নরে তাহে নিমগন পুলক ভরে । পর্ব ৫ সমাজে সুদিন এল আবার, ক্রমে প্রসারিল জীবন তার। কেশব আপন প্রতিভা বলে যতনে গঠিল যুবকদলে। নগরে নগরে হল প্রচার- "ধর্ম রাজ্যে নাহি জাতিবিচার; নাহি ভেদ হেথা নারী ও নরে, ভক্তি আছে যার সে যায় ত'রে। জাতিবর্ণ- ভেদ কুরীতি যত ভাঙি দাও চিরদিনের মত। দেশ দেশান্তরে ধাঊক মন, সর্বধর্মবাণী কর চয়ন; ধর্মে ধর্মে নাহি বিরোধ রবে, মহা সমম্বয় গঠিত হবে।" পশিল সে বাণী দেশের প্রাণে, মুগ্ধ নরনারী অবাক মানে । নগরে নগরে তুফান উঠে, ঘরে ঘরে কত বাঁধন টুটে; ব্রহ্ম নামে সবে ছুটিয়া চলে, প্রাণ হতে প্রাণে আগুন জ্বলে। আসিল গোঁসাই৫ ব্যাকুল হয়ে প্রেমে ভরপূর ভকতি লয়ে। আসিল প্রতাপ৬ স্বভাব ধীর, গম্ভীর বচন জ্ঞানে গভীর। স্বল্পভাষী সাধু অঘোরনাথ৭ যোগমগ্ন মন দিবসরাত। গৌরগোবিন্দের৮ সাধক প্রাণ হিন্দুশাস্ত্রে তাঁর অতুল জ্ঞান। কান্তিচন্দ্র৯ সদা সেবায় রত সেবাধর্ম তাঁর জীবন-ব্রত। ত্রৈলোক্যনাথের১০ সরস গান নব নব ভাবে মাতায় প্রাণ। আরো কত সাধু ধরমমতি বঙ্গচন্দ্র১১ আদি প্রচার-ব্রতী একসাথে মিলি প্রেমের ভরে প্রেমপরিবার গঠন করে। কাল কিবা খাবে কেহ না জানে, আকুল উৎসাহ সবার প্রাণে । নূতন মন্দির নব সমাজ নব ভাবে কত নূতন কাজ। দিনে দিনে নব প্রেরণা পায়, উৎসাহের স্রোত বাড়িয়া যায়। সমাজ-চালনা বিধি-বিচার কেশবের হাতে সকল ভার; কেশবপ্রেরণা সবার মূলে তাঁর নামে সবে আপনা ভুলে। ধন্য ব্রহ্মানন্দ যাঁহার বাণী শিরে ধরে লোকে প্রমাণ মানি। যাঁহার সাধনা আজিও হেরি রয়েছে সমাজ জীবন ঘেরি ; যাঁহার মূরতি স্মরণ করি, যাঁহার জীবন হৃদয়ে ধরি, শত শত লোক প্রেরণা পায়- আজি ভক্তিভরে প্রণমি তাঁয়। আবার বহিল নূতন ধারা, সমাজের প্রাণে বাজিল সাড়া; ভাসি বহুজনে সে নব স্রোতে বাহির হাইল নূতন পথে। মিলি অনুরাগে যতন ভরে এই "সাধারণ" সমাজ গড়ে। ওদিকে কেশব নূতন বলে বাঁধিল আবার আপন দলে। নব ভাবে "নববিধান" গড়ি, নূতন সংহিতা রচনা করি, ভগ্নদেহ লয়ে অবশপ্রায়, খাটিতে খাটিতে ত্যজিল কায়। পর্ব ৬ ধরি নব পথ নূতন ধারা নবীন প্রেরণে আসিল যারা, আজি তাঁহাদের চরণ ধরি | ভক্তিভরে সবে স্মরণ করি। শাস্ত্রী শবনাথ সকল ফেলি বিষয় বাসনা চরণে ঠেলি বহু নির্যাতন বহিয়া শিরে, অনুরাগে ভাসি নয়ন নীরে, সর্বত্যাগী হয়ে ব্যাকুল প্রাণে ছুটে আসে ওই কিসের টানে, দেখ ওই চলে পাগলমত ভক্তশ্রেষ্ট বীর বিনয়নত, বিজয় গোঁসাই সরল প্রাণ- হেরি আজি তাঁই প্রেম বয়ান। সাধু রামতনু১২ জ্ঞানে প্রবীণ, শিশুর মতন চির নবীন। শিবচন্দ্র দেব সুধীর মন, কর্মনিষ্ঠাময় সাধু জীবন । নগেন্দ্রনাথের১৩ যুকতি বানে কূট তর্ক যত নিমেষে হানে । আনন্দমোহন১৪ মুরতি যার। উমেশচন্দ্রের১৫ জীবণ মন , নীরব সাধনে সদা মগন। দুর্গামোহনের১৬ জীবনগত সমাজের সেবা দানের ব্রত। দ্বারকানাথের১৭ স্মরন হয় ন্যায়ধর্মে বীর অকুতোভয় । পূর্ব বঙ্গে হোথা সাধক কত নবধর্ম বানী প্রচারে কত। সংসারে নিলিপ্ত ভাবুক প্রাণ স্বার্থক প্রচারে কালীনারা'ণ১৮ কত নাম কব কত যে জ্ঞানী কত ভক্ত সাধু যোগী ও ধ্যানী; কত মধুময় প্রেমিক মন আড়ম্বহীন সেবকজন ; আসিল হেথায় আকাশ ভরে সবার যতনে সমাজ গড়ে। এই যে মন্দির হেরিছ যার ইটকাঠ ময় স্থুল আকার ; ইহারি মাঝারে কত যেস্মৃতি, কত আকিঞ্চন সমাজ প্রীতি, ব্যাকুল ভাবনা দিবস রাত বিনিদ্র সাধনে জীবন পাত । বহু কর্মময় এই সমাজ সে সব কাহিনী না কব আজ, আজিকে কেবল স্মরণে আনি ব্রাহ্মসমাজের মহান বাণী । যে বাণী শুনুনু রাজার মুখে, মহর্ষি যাহারে ধরিল বুকে, কেশব যে বাণী প্রচার কারে- স্মরি আজ তাহা ভকতি ভরে। রক্তাক্ষরে লিখা যে বাণী রটে এই সমাজের জীবনপটে- “স্বাধীন মানবহৃদয়তলে বিবেকের শিখা নিয়ত জ্বলে। গুরুর আদেশ সাধুর বাণী ইহার উপরে কারে না মানি?” স্বাধীন মানে এই সমাজ মুক্ত ধর্মলাভে ইহার কাজ। হেথায় সকল বিরোধ গুচি রবে নানা মত নানান্ রুচি কাহারো রচিত বিধি বিধান রুধিবে না হেথা কাহারো প্রাণ। প্রতি জীবনের বিবেক ভাতি সবার জীবনে জ্বলিবে বাতি। নর নারী হেথা মিলিয়া সবে সম অধিকারে আসন লাভে। প্রেমেতে বিশাল জ্ঞানে গভীর চরিত্রে সংযত করমে বীর ; ঈশ্বরে ভক্তি মানবে প্রীতি, হেথা মানুষের জীবন নীতি। ফুরাল কি সব হেথায় আসি ? আসিবে না প্রেম জড়তা নাশি? জাগিবে না প্রাণ ব্যাকুল হয়ে, নব নব বাণী জীবনে লয়ে ? জ্বলিবে না নব সাধন শিখা ? নব ইতিহাস হবে না লিখা ? চিররুদ্ধ রবে পুজার দ্বার ? আসিবে না নব পুজারী আর? কোথাও আশার আলো কি নাহি? শুধাই সবার বদন চাহি। |