জেলখানার চিঠি - নাজিম হিকমাত

জেলখানার চিঠি

নাজিম হিকমত

সুভাষ মুখোপাধ্যায় (অনুবাদ)


.

প্রিয়তমা আমার,

তোমার শেষ চিঠিতে

তুমি লিখেছো:

মাথা আমার ব্যথায় টনটন করছে,

দিশেহারা আমার হৃদয়।

তুমি লিখেছো:

যদি ওরা তোমাকে ফাঁসি দেয়

তোমাকে যদি হারাই,

আমি বাঁচবো না।


তুমি বেঁচে থাকবে প্রিয়তমা বধূ আমার

আমার স্মৃতি কালো ধোঁয়ার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে

তুমি বেঁচে থাকবে, আমার হৃদয়ের রক্তকেশী ভগিনী,

বিংশ শতাব্দীতে,

মানুষের শোকের আয়ু

বড়জোর এক বছর।


মৃত্যু ...

দড়ির একপ্রান্তে দোদুল্যমান শবদেহ

আমার কাম্য নয়, সেই মৃত্যু।

কিন্তু প্রিয়তমা আমার, তুমি জেনো

জল্লাদের লোমশ হাত

যদি আমার গলায়

ফাঁসির দড়ি পরায়

নাজিমের নীল চোখে ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে ভয়।

অন্তিম ঊষার অস্ফুট আলোয়

আমি দেখব, আমার বন্ধুদের, তোমাকে দেখব।

আমার সঙ্গে কবরে যাবে

শুধু আমার

এক অসমাপ্ত গানের বেদনা।


.

বধূ আমার,

তুমি আমার কোমল প্রাণ মৌমাছি

চোখ তোমার মধুর চেয়েও মিষ্টি।

কেন তোমাকে আমি লিখতে গেলাম

ওরা আমাকে ফাঁসি দিতে চায়

বিচার সবেমাত্র শুরু হয়েছে

আর মানুষের মুণ্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়

যে ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে।


ও নিয়ে ভেব না

ওসব বহু দূরের ভাবনা

হাতে যদি টাকা থাকে

আমার জন্যে কিনে পাঠিও গরম একটা পাজামা

পায়ে আমার বাত ধরেছে।

ভুলে যেও না

স্বামী যার জেলখানায়

তার মনে যেন সব সময় স্ফুর্তি থাকে

বাতাস আসে, বাতাস যায়

চেরীর একই ডাল একই ঝড়ে

দু’বার দোলে না।


গাছে গাছে পাখির কাকলি

পাখাগুলো উড়তে চায়।

জানলা বন্ধ: 

টান মেরে খুলতে হবে।


আমি তোমাকে চাই:

তোমার মত রমণীয় হোক জীবন

আমার বন্ধু, আমার প্রিয়তমার মত।...


আমি জানি, দুঃখের ডালি

আজও উজাড় হয়নি

কিন্তু একদিন হবে।


৩.

নতজানু হয়ে আমি চেয়ে আছি মাটির দিকে

উজ্জ্বল নীল শাখার মঞ্জুরিতে ফুলের দিকে আমি তাকিয়ে

তুমি যেন মৃন্ময়ী বসন্ত, আমার প্রিয়তমা

আমি তোমার দিকে তাকিয়ে।


মাটিতে পিঠ রেখে আমি দেখি আকাশকে

তুমি যেন মধুমাস, তুমি আকাশ

আমি তোমাকে দেখছি, প্রিয়তমা।


রাত্রির অন্ধকারে, গ্রাম দেশে শুকনো পাতায় আমি জ্বালিয়েছিলাম আগুন

আমি স্পর্শ করছি সেই আগুন

নক্ষত্রের নীচে জ্বালা অগ্নিকুণ্ডের মত তুমি

আমার প্রিয়তমা, আমি তোমাকে স্পর্শ করছি।

আমি আছি মানুষের মাঝখানে, ভালোবাসি আমি মানুষকে

ভালোবাসি আন্দোলন,

ভালোবাসি চিন্তা করতে,

আমার সংগ্রামকে আমি ভালোবাসি

আমার সংগ্রামের অন্তস্থলে মানুষের আসনে তুমি আসীন

প্রিয়তমা আমার, আমি তোমাকে ভালোবাসি।


৪.

রাত এখন ন'টা

ঘণ্টা বেজে গেছে গুমটিতে

সেলে দরোজা তালাবন্ধ হবে এক্ষুনি।

এবার জেলখানায় একটু বেশী দিন কাটল

আটটা বছর।


বেঁচে থাকার অনেক আশা, প্রিয়তমা

তোমাকে ভালোবাসার মতই একাগ্র বেঁচে থাকা।

কী মধুর, কী আশায় রঙিন তোমার স্মৃতি।...

কিন্তু আর আমি আশায় তুষ্ট নই,

আর আমি শুনতে চাইনা গান।

আমার নিজের গান এবার আমি গাইবো।


আমাদের ছেলেটা বিছানায় শয্যাগত

বাপ তার জেলখানায়

তোমার ভারাক্রান্ত মাথাটা ক্লান্ত হাতের উপর এলানো

আমি আর আমাদের এই পৃথিবী একই সুচাগ্রে দাঁড়িয়ে।


দুঃসময় থেকে সুসময়ে

মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে

আমাদের ছেলেটা নিরাময় হয়ে উঠবে

তার বাপ খালাস পাবে জেল থেকে

তোমার সোনালী চোখে উপচে পড়বে হাসি

আমার আর আমাদের এই পৃথিবী একই সূচাগ্রে দাঁড়িয়ে !


৫. 

যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর

তা আজও আমরা দেখি নি।

সব থেকে সুন্দর শিশু

আজও বেড়ে ওঠেনি।

মধুরতম যে কথা আমি বলতে চাই

সে কথা আজও আমি বলিনি।


৬. 

কাল রাতে তোমাকে আমি স্বপ্ন দেখলাম

মাথা উঁচু করে

ধূসর চোখ মেলে তুমি আবছা আমার দিকে তাকিয়ে

তোমার আর্দ্র ওষ্ঠাধর কম্পমান

কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।

কৃষ্ণপক্ষ রাত্রে কোথাও আনন্দ সংবাদের মতো ঘড়ির টিক্ টিক্ আওয়াজ

বাতাসে গুন্ গুন্ করছে মহাকাল

আমার ক্যানারীর লাল খাঁচায়

গানের একটি কলি

লাঙ্গল চষা ভূঁইতে

মাটির বুকফুঁড়ে উদগত অঙ্কুরের দুরন্ত কলরব

আর এক মহিমান্বিত জনতার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ন্যায্য অধিকার

তোমার আর্দ্র ওষ্ঠাধর কম্পমান

কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।


আশাভঙ্গের অভিশাপ নিয়ে জেগে উঠলাম।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বইতে মুখ রেখে

অতগুলো কণ্ঠস্বরের মধ্যে

তোমার স্বরও কি আমি শুনতে পাইনি ?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন