শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব — সুকুমার রায়ের ছড়া

 শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব

সুকুমার রায়

পড় বিজ্ঞান হবে দিকজ্ঞান ঘুচিবে পথের ধাঁধা 

দেখিবে গুণিয়া এ দিন দুনিয়া নিয়ম নিগড়ে বাঁধা। 

কহে পন্ডিতে জড়সন্ধিতে বস্তুপিন্ড ফাঁকে 

অনু অবকাশে রন্ধ্রে- রন্ধ্রে আকাশ লুকায়ে থাকে। 

হেথা হেথা সেথা জড়ের পিন্ড আকাশ প্রলেপে ঢাকা 

নয়কো কেবল নিরেট গাঁথন, নয়কো কেবলি ফাঁকা। 

জড়ের বাঁধন বদ্ধ আকাশে, আকাশে বাঁধন জড়ে- 

পৃথিবী জুড়িয়া সাগর যেমন, প্রাণটি যেমন ধড়ে।; 

‘ইথার’ পাথারে তড়িত বিকারে জড়ের জীবন দোলে, 

বিশ্ব – মোহের সুপ্তি ভাঙিছে সৃষ্টির কলরোলে।।  


শুন শুন বার্তা নুতন, কে যেন স্বপন দিলা 

ভাষা প্রাঙ্গণে স্বরে ব্যাঞ্জনে ছন্দ করেন লীলা। 

সৃষ্টি যেথায় জাগে নিরুপায় প্রলয় পয়োধি তীরে 

তারি আশেপাশে অন্ধ হুতাশে আকাশ কাঁদিয়া ফিরে। 

তাই ক্ষণে ক্ষণে জড়ো ব্যঞ্জনে স্বরের পরশ লাগে 

তাই বারেবার মৃদু হাহাকার কলসংগীতে জাগে 

স্বরব্যঞ্জন যেন দেহমনে জড়েতে চেতন বাণী 

একে বিনা আর থাকিতে না পারে, প্রাণ লয়ে টানাটানি। 

দোঁহি ছাড়ি দোঁহে, মূক রহে মোহে, ব্যঞ্জনে নাহি বুলি 

স্বরের নিশাসে ‘আহা’ ‘উহু’ ভাষে ভাষার বারতা ভুলি। 

ছিল অচেতন জগৎ যখন মগন আদিম ধুমে, 

অরূপ তিমির স্তব্ধ বধির স্বপ্ন মদির ঘুমে: 

আকুল গন্ধে আকাশ কুসুম উদাসে সকল দিশি, 

অন্ধ জড়ের বিজন আড়ালে কে যেন রয়েছে মিশি! 

স্তিমিত-স্বপ্ন স্বরের বর্ণ জড়ের বাধন ছিড়ি 

ফিরে দিশাহারা কোথা ধ্রুবতারা কোথা র্স্বগের সিঁড়ি! 

অ আ ই ঈ উ ঊ, হা হি হি হু হু হাল্কা শীতের হাওয়া 

অলখচরণ প্রেতের চলন, নিঃশ্বাসে আসা যাওয়া। 

লেখে কি না খেলে ছায়ার আঙুলে বাতাসে বাজায় বীণা 

আবেশ বিভোর আফিঙের ঘোর বস্তুত মন্ত্রহীনা। 

ভাবে কুল নাই একা আসি যাই যুগে যুগে চিরদিন, 

কাল হতে কালে আপনার তালে অনাহত বাধাহীন।।  


অকুল অতলে অন্ধ অচলে অস্ফুট অমানিশি, 

অরূপ আধারে আখি অগোচরে অনুতে অনুতে মিশি।  


আসে যায় আসে অবশ আয়াশে আবেশ আকুল প্রাণে, 

অতি আনমানা করে আনাগোনা অচেনা অজানা টানে, 

আধো আধো ভাষা আলেয়ার আসা , আপনি আপনহারা 

আদিম আলোতে আবছায়া পথে আকাশগঙ্গা- ধারা।  


ইচ্ছা বিকল ইন্দ্রিয়দল, জড়িত ইন্দ্রজালে, 

ঈশারা আভাসে ঈঙ্গিতে ভাষে রহ-রহ ইহকালে।  


উড়ে ইতিউতি উতালা আকুতি উসখুস উকিঝুঁকি 

উড়ে উচাটন, উড়ু উড়ু মন , উদাসে উধ্বমুখি।  


এমন একেলা একা একা খেলা একুলে ওকুলে ফের 

এপার ওপার এ যে একাকার একেরি একেলা হের। 

হেরে একবার সবি একাকার একেরি এলাকা মাঝে 

ঐ ওঠে শুনি, ওঙ্কার-ধ্বনি, একুলে ওকুলে বাজে।  


ওরে মিথ্যা এ আকাশ-চারণ মিথ্যা তোদের খোঁজা, 

স্বর্গ তোদের বস্তু সাধনে বহিতে জড়ের বোঝা। 

আকাশ বিহানে বস্তু অচল, চলে না জড়ের চাকা, 

আদুল আকাশে ফোকলা বাতাস কেবলি আওয়াজ ফাঁকা।  


সৃষ্টিতত্ত্ব বিচার করনি শাস্ত্র পড়নি দাদা- 

জড়ের পিন্ড আকাশে গুলিয়া ঠাসিবে ভাষার কাদা। 

শাস্ত্রবিধান কর প্রণিধান ওরে উদাসীন অন্ধ, 

ব্যঞ্জনস্বরে যেন হরিহরে কোথাও রবে না দ্বন্দ্ব। 

মরমে মরমে সরম পরশে বাতাস লাগিয়ে হাড়ে, 

ভাষার প্রবাহে পুলক- কম্পে জড়ের জতো ছাড়ে। 

(তবে)আয় নেমে আয়, জড়ের সভায় , জীবন মরণ দোলে, 

আয় নেমে আয়, ধরণীধুলায় কীর্তন কলরোলে। 

আয় নেমে আয় রূপের মায়ায় অরূপ ইন্দ্রজালে 

উল্কা ঝলকে থনল পুলকে আয় রে অশনিতালে। 

আয় নেমে আয় কণ্ঠ্য বর্ণে কাকুতি করিছে সবে 

আয় নেমে আয় র্ককশ ডাকে প্রভাতে কাকের রবে।  


নামো নামো নমঃ সৃষ্টি প্রথম কারণ জলধি জলে 

স্তব্দ তিমিরে প্রথম কাকলী প্রথম কৌতুহলে। 

আদিম তমসে প্রথম বর্ণ কনক কিরণ মালা 

প্রথম ক্ষুধিত বিশ্ব জঠরে প্রথম প্রশ্ন জ্বালা।  


অকূল আঁধারে কুহকপাথারে কে আমি একেলা কবি 

হেরি একাকার সকল আকার সকলি আপন ছবি। 

কহে,কই কে গো, কোথায় কবে গো ,কেন বা কাহারে ডাকি? 

কহে কহ-কহ , কেন অহরহ ,কালের কবলে থাকি? 

কহে কানে কানে করুণ কুজনে কলকল কত ভাষে, 

কহে কোলাহলে কলহ কুহরে কাষ্ঠ কঠোর হাসে। 

কহে কটঁমট কথা কাটা কাটা -কেওকেটাঁ কহ কারে? 

কাহার কদর কোকিল কণ্ঠে,কুন্দু কুসুম হারে? 

কবি কল্পনে কাব্যে কলায় কাহারে করিছ সেবা 

কুবের কতন কুঞ্জকাননে, কাঙালি কুটিরে কেবা। 

কায়দা কানুনে ,কার্য কারণে কীর্তিকলাপ মুলে, 

কেতাবে কোরানে কাগজে কলমে কাঁদায়ে কেরানীকুলে। 

কথা কাড়ি -কাড়ি কত কানাকড়ি কাজে কচু কাচকলা 

কভু কাছাকোছা কোর্তা কলার কভু কৌপীন ঝোলা। 

কুৎসা -কথনে কুটিলে কৃপণে কুলীন কন্যাদায়ে 

কর্মকান্ত কুলিম কান্ত,ক্লিষ্ট কাতর কায়ে। 

কলে কৌশলে ,কপট কোদলে ,কঠিনে কোমলে মিঠে 

কেদ কুৎসিত ,কুষ্ঠ কলুষ কিলবিল কৃমি কীটে। 

কহ সে কাহার কুহক পাথারু “কে আমি একেলা কবি? 

কেন একাকার সকল আকার সকলি আপন ছবি!” 

‘ক’-এর কাঁদনে ,কাংস্য-ক্বণনে বর্ণ লভিল কায়া 

গহন শুন্যে জড়ের ধাক্কা কালের করাল ছায়া। 

সুপ্ত গগনেকরুণ বেদনে বস্তুচেতন জাগে 

অকাল ক্ষুধিত খাই খাই রবে বিশ্বে তরাস লাগে 

আকাশ অবধি ঠেকিল জলধি,খেয়াল জেগেছে খ্যাপা 

কারে খেতে চায় খুজে নাহি পায় দেখ কি বিষম হ্যাপা! 

(খালি)কর্তালে কভু কীর্তন খোলে? খোলে দাও চাটিপেটা! 

নামাও আসরে ‘ক’এর দোসরে, খেঁদেলো খেদেলো খেঁটা।” 

কহ মহামুনি কহ খুর শুনি ‘খ’য়ের খবর খাঁটি 

খামারে খোয়ারে খানায় খন্দে খুজিনু খয়ের ঘাঁটি। 

কহেন বচন খুড়ে খন্‌খন্ পাখালি আঁখির দিঠি 

খালি খ্যাঁচাখ্যাঁচি খামচাখামচি খুঁৎখূঁতি খিটিমিটি। 

এখনো খুলেনি মুখের খোলস? এখনো খোলেনি আখি? 

নিক খেয়ালে পেখম ধরিয়া, কি খেলা খেলিল পাখি! 

এখনও রাখনা ক্ষুধার খবর এখনও শেখনি ভাষা 

পঞ্চকোষের মুখের খোসাতে অন্ন দেখনি ঠাসা? 

খোল খরতালে খোলসা খেয়ালে ‘খোল খোল খোল ‘বলে, 

শখের খাঁচার খিড়কী খুলিয়া খঞ্জ খেয়াল চলে। 

সে ক্ষুধায় পাখি পেখম খুলিয়া খাঁছায় খেমটা নাচে 

আখেরী ক্ষুধায় সখের ভিখারী খাস্তা খাবার যাচে- 

প্রখর-ক্ষুধিত তোখড় -খেয়াল -খেপিয়া রুখিল ত্বরা, 

চাখিয়া দেখিল, খাসা এ অখিল খেয়ালে-রচিত ধারা। 

খুঁজে সুখে দুখে খেয়ালের ভুলে খেয়ালে নিরখি সবি, 

খেলার খেয়ালে নিখিল -খেয়াল লিখিল খেয়াল ছবি। 

খেলার লীলা খদ্যোৎ-শিখা খেয়াল খধুপ -ধুপে’ 

শিখী পাখা পরে নিখুত আখরে খচিত খেয়াল রূপে। 

খোদার উপরে খোদকারী করে ওরে ও ক্ষিপ্ত মতি 

কীলিয়ে অকালে কাঁঠাল পাকালে আখেরে কি হবে গতি? 

খেয়ে খুরো চাঁটি খোল কহে খাঁটি, ‘খাবি খাব ক্ষতি নাই,’ 

খেয়ালের বাণী করে কানাকানি – ‘গতি নাই, গতি নাই।’ 

নিখিল খেয়াল খসড়া খাতায় লিখিল খেয়াল ছবি 

ক্ষণিকের সাথে খেয়ালের মুখে খতিয়া রাখিল সবি।  


গতি কিসে হবে, চিন্তিয়া তবে বচন শুনিনু খাসা, 

পঞ্চ কোষের প্রথম খোসাতে অন্ন রয়েছে ঠাসা! 

আত্মার মুখে আদিম -অন্ন তাহে ব্যঞ্জনগুলি 

অনুরাগে লাগি,করে ভাগাভাগি মুখে-মুখে দাও তুলি। 

এত বলি ঠেলি আত্মারে তুলি তত্ত্বের লগি ধরি, 

খেয়ালের প্রাণী রহে চুপ মানি বিস্ময়ে পেট ভারি। 

কবে কেবা জানে গতির গড়ানে গোপন গোমুখী হতে 

কোন ভগীরথে গলাল জগতে গতির গঙ্গা স্রোতে। 

দেখ আগাগোড়া গণিতের গড়া নিগূঢ় গুণ সবি 

গতির আবেগে আগুয়ান বেগে অগণিত গ্রহরবি। 

গগনে গগনে গোধুলি লগনে মগন গভীর গানে, 

করে গমগম আগম নিগম গুরু গম্ভীর ধ্যানে। 

গিরি গহ্বরে অসাধ সাগরে গঞ্জে নগরে-গ্রামে, 

গাঁজার গাজনে গোষ্ঠে গহনে গোকুলে গোলকধামে।  


শুনি সাবধানে কহি কানে কানে শাস্ত্রবচন ধরি 

কৌশলে ঋষি কহে কখগঘ কাহারে স্মরণ করে 

কয়ে দেখ জল খয়ে শুন্যতল গ’য়ে গতি অহরহ 

কভূ জলে ভাসে কভূ সে আকাশে হংস যাহারে কহ। 

আঘাতে যে মারে ‘ঘ’কহি তারে হন ধাতু ‘ড’ করি 

তেঁই কখগঘ কৃষ্ণে জানহ হংস-অসুর -অরি। 

ব্যঙ্গে রঙ্গে ভ্রুকুটি -ভঙ্গে সঙ্গীত কলরবে 

রণহুংকারে ধনুঠংকারে শংকিত কর সবে। 

বিকল অঙ্গে ভগ্নজঙঘ এ কোন পঙ্গু মুনি? 

কেন ভাঙ্গা ঠ্যাংঙে ডাঙায় নামিল বাঙালা মুলুকে শুনি। 

রাঙা আঁখি জলে চাঙ্গা হয়ে বলে ডিঙাব সাগর গিরি, 

কেন ঢঙ ধরি ব্যাঙাচির মতো লাঙুল জুড়িয়া ফিরি?  


টলিল দুয়ার চিত্তগুহার চকিতে চিচিংফাক 

শুনি কলকল ছুটে কোলাহল শুনি চল চল ডাক। 

চলে চঁটপট চকিত চরণ ,চোঁচা চম্পট নৃত্যে 

চল চিত্রিত চিরচিন্তন চলে চঞ্চল চিত্তে। 

চলে চঞ্চলা চপল চমকে,চারু চৌচির বক্রে। 

চলে চন্দ্রমা চলে চরাচর চড়ি চড়কের বক্রে 

চলে চকমকি চোখের চাহনে চঞ্চরী চল ছন্দ, 

চলে চিৎকার চাবুক চালনে চপট চাপড়ে চন্ড 

চলে চুপি চুপি চতুর চৌর চৌদিকে চাহে ত্রস্ত 

চলে চুড়ামণি চর্বে চোষ্যে চটি চৈতনে চোস্ত 

চিকন চাদর চিকুর চাঁচর চোখা চালিয়াৎ চ্যাংড়া, 

চলে চ্যাংব্যাং চিতল কাতল চলে চুনোপুটি ট্যাংরা।।  


ছোটে ছঁটফটি ছায়ার ছমক ছমলীলার ছলে 

ছায়ারঙে মিশি ছোটে ছয় দিশি ছায়ার ছাঊনী তলে 

ছোটে ছায়াবাহু পিছে পিছে পিছে ছন্দে ছুটেছে রবি 

ছয় ঋতু ছোটে ছায়ার ছন্দে ছবির পিছনে ছবি 

ছায়াপথ – ছায়ে জ্যোছনা বিছায়ে…  


[অসমাপ্ত] 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন